User login
Sing In with your email
Send
Our Price:
Regular Price:
Shipping:Tk. 50
প্রিয় ,
সেদিন আপনার কার্টে কিছু বই রেখে কোথায় যেন চলে গিয়েছিলেন।
মিলিয়ে দেখুন তো বইগুলো ঠিক আছে কিনা?
Share your query and ideas with us!
Was this review helpful to you?
or
পুস্তক পর্যালোচনা শিপ্রা গোস্বামীর স্মৃতিপ্রবন্ধ : হৃদয়বৃত্তির অনুশীলন ড. অরুণকুমার গোস্বামী [আমার স্মৃতিতে আমার সত্তায়, লেখক : শিপ্রা গোস্বামী, ঢাকা : শোভা প্রকাশ, ফেব্র“য়ারি, ২০১৩, প্রচ্ছদ: সুখেন দাস। পৃষ্ঠাসংখ্যা ১০৮। দাম : ১৭৫ টাকা। ] স্মৃতি এবং সত্তার অভিব্যক্তি নিয়েই একজন মানুষের ‘আত্মজীবনী’র কাঠামো রচিত হয়। দুইজন জগদ্বিখ্যাত ব্যক্তিত্বের আত্মজীবনীর কথা এপ্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে। ‘সত্য’-এর সাথে তাঁর পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাহিনী লিখে মহাত্মা গান্ধী এবং বাঙালিদের মুক্তির জন্য সংগ্রামী জীবনের কর্মকাণ্ডের স্মৃতি লিখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তাদের স্ব-স্ব আত্মজীবনীই লিখেছেন। ১৯২৫ সালের ২৬ নভেম্বর আহমেদাবাদের সাবরমতি আশ্রমে বসে মহাত্মা গান্ধী তাঁর ‘দ্য স্টোরি অব মাই এক্সপেরিমেন্ট উইথ ট্রুথ’ এর ভূমিকা লিখেছিলেন। সেই ভূমিকার এক জায়গায় তিনি বলেন --I live and move and have my being in pursuit of Moksha. যুZসই বাংলায় এর অর্থ এভাবে করা যায়, আমি বেঁচে থাকি ও বিকশিত হই ও আমার সত্তা জুড়ে আছে মোক্ষ অর্জনের প্রয়াস। বেঁচে থাকা, বিকশিত হওয়া এবং সত্তার লক্ষ্য হিসেবে মোক্ষ লাভের প্রয়াসের কথা বলতে যেয়ে তাঁর জীবনের কথাই গন্ধীজি বলেছেন। আসলে এমনই হয়। ‘আমার স্মৃতিতে, আমার সত্তায়’ শিরোনামে শিপ্রা গোস্বামীও প্রকৃত পক্ষে তাঁর আত্মজীবনীই পাঠকদের উপহার দিয়েছেন। যদিও বিনয় করে তিনি বলেছেন, ‘প্রকৃত বিচারে আমি লেখক নই।’ কিন্তু তাঁর স্মৃতি রোমন্থন ও সত্তাবিষয়ক কথকতার মধ্য দিয়ে পাঠকদের কাছে তিনি একজন ‘স্বভাব-লেখকের’ পরিচয় দিয়েছেন। শিপ্রা গোস্বামী পেশায় আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী। আইনসহায়তা সংগঠনের কর্মী হিসেবে প্রতিদিন অজস্র অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে তাঁকে অগ্রসর হতে হয়। প্রচুর ভাল-মন্দ মানুষের সঙ্গে মুখোমুখি হতে হয়। তাই তাঁর স্মৃতিতে জমা হতে থাকে বিচিত্র সব মানুষ। তাঁদের সঙ্গ ও সখ্য নিয়ে লেখা স্মৃতি ও সত্তার এই অভিব্যক্তিমূলক বইটি ব্যাপকভাবে প্রচার ও প্রসার লাভ করতে না পারলেও যে বাংলাভাষী পাঠক এ বইটি পড়া শুরু করবেন তিনি তা শেষ না করে ছাড়তে পারবেন না। ১০৮ পৃষ্ঠার এই বইতে ২১টি লেখা স্থান পেয়েছে। এই ২১টি লেখায় ২১ জনেরও বেশি মানুষ এবং ২১টিরও বেশি স্থানের কথা জানা যায়। এর মধ্যে লেখকের ব্যক্তিসত্তার আনুষঙ্গিক বিষয় হিসেবে তাঁর জন্মগ্রহণ, বাল্যস্মৃতি, সন্তান ধারণ, লালন-পালন, বিদেশভ্রমণ, মানবসেবা, খ্যাতনামা ব্যক্তিদের সাক্ষাৎ প্রভৃতির স্মৃতি রোমন্থিত হয়েছে। হৃদয়ের আবেগ কত গভীর হলে একজন ব্যক্তি প্রাণহীন কোন প্রস্তরমূর্তির স্পর্শকে জীবন্ত মনে করতে পারেন তার পরিচয় এ বইটির অন্তত দু’ জায়গায় লেখক দিয়েছেন। ২০১১ সালে মাইকেল মধুসূদন দত্তের জন্মস্থানে কবির ভাস্কর্যটি স্পর্শ করে লেখকের মনে হয়েছিল তিনি রক্তমাংসের মানুষকে স্পর্শ করছেন। লেখক বলছেন, ‘মধুসূদন দত্তের ভাস্কর্যের খুব কাছে গিয়ে ছুঁতেই আমার মনে হয়েছিল যেন কোন রক্তমাংসের মানুষকে স্পর্শ করলাম, যার উষ্ণ শরীরে এখনও প্রাণের স্পন্দন আছে। মুহূর্তেই আমার এক ধরনের অজানা অনুভূতি হল। ছবি তোলা শেষে অজন্তাকে আমার অনুভূতির কথা বলতেই সে জানাল তারও নাকি একই রকম লেগেছে। আজও সেই ক্ষণটির কথা মনে পড়লে শিহরিত হই।’ (পৃ. ১৪) লেখকের এই ধরনের অনুভূতির আর একটি পরিচয় পাওয়া যায় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শান্তিনিকেতনে সফরে যেয়ে। শান্তিনিকেতনের ‘শ্যামলী বাড়িতে ঢুকে আমার ভিতর অন্য এক ধরনের অনুভূতি হল। ভীষণ আর্দ্র হয়ে উঠল হৃদয়। ঘোরাবদ্ধ হয়ে গেলাম। অনেক গান অনেক কথা মনে উঁকি দিচ্ছিল। দেয়ালে হাত রেখে তার ছোঁয়া পাচ্ছিলাম।’ (পৃ. ২৩) খ্যাতিমান ব্যক্তিবর্গের সাথে লেখকের স্মৃতির মধ্যেও লেখকের হৃদয়ের আবেগের প্রকাশ দেখা যায়। এসবের মধ্যে হৃদয়গ্রাহী দু’একটি স্মৃতির কথা উল্লেখ করা যায়। প্রয়াত কমিউনিস্ট নেতা কমরেড সন্তোষ ব্যানার্জী লেখকের ফরিদপুরস্থ বাড়িতে আসতেন। লেখক বলছেন ‘আমাদের বাসায় এলে ভাত মেখে থালার মাঝখানে দিয়ে একপাশে মাছ বেছে দিতাম।’ (পৃ. ৩৯) অকৃতদার এই নেতার প্রতি লেখকের আন্তরিকতার আর একটি উদাহরণ পাওয়া যায় এভাবে, ‘একবার তাঁর সাদা গেঞ্জিতে নীল বেশি হয়ে গিয়েছিল বলে কী যে রাগ করেছিলেন। বাপ রে বাপ ! ওরকম সাধু সন্ত মানুষ যে রাগ করতে পারেন তা আমার কল্পনাতেও ছিল না। কিন্তু আমি তাতে একটু মন খারাপ করিনি। ওই রাগের মধ্যেও আমার প্রতি তাঁর ভালোবাসার প্রকাশটাই দেখেছিলাম।’ (পৃ.৩৮) লেখক প্রসঙ্গক্রমে সন্তোষ ব্যানার্জীর প্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহামানের শ্রদ্ধা প্রদর্শনের কথাও উল্লেখ করেছেন। (পৃ.৪০-৪১) “আমার স্মৃতিতে, আমার সত্তায়” বইটির ন্যারেটিভ থেকে উপমহাদেশ বা প্রাচ্য দেশসমূহে বিদ্যমান পরম্পরাগত জ্ঞানচর্চার একটি স্থায়ী বৈশিষ্ট্যের লক্ষণও অনুধাবন করা যায়। তা হলো, যুক্তি-বুদ্ধি, দেশপ্রেম ও মানবপ্রেম দিয়ে লেখক শিপ্রা গোস্বামীর হৃদয়বৃত্তির অনুশীলন। অপরদিকে এতসব গুরুত্বপূর্ণ ও গুরুত্বহীন ব্যক্তিবর্গের সাথে অনিঃশেষিত হৃদয়ের আবেগ অনুভূতি দিয়ে মেলা-মেশা করলেও লেখকের একাকীত্ব অনুভূতির লক্ষণও অনেকটা স্পষ্টভাবেই লক্ষ্য করা যায়। লেখক বলছেন, ‘...পুরো বাড়িতে আমি একা। বারান্দায় গিয়ে অনেকক্ষণ আকাশ দেখেছি।... কী যেন এক প্রত্যাশা নিয়ে বারবার দরজার দিকে খেয়াল করছি, কেউ যদি এসে কড়া নাড়ে!’...(পৃ.৮০) একাকীত্ব ঘুচাতেই হোক অথবা পাখিপ্রম থেকে হোক বা সৌন্দর্যপ্রীতিই হোক বাড়ির এক কোণে পুত্রের লাগানো তুঁতগাছের ডালে বাসা বাঁধা ছোট্ট পাখির সাথে সখ্য লেখকের একটি প্রিয় সখ হয়ে উঠেছিল। (পৃ. ৮৪-৮৭) এমনিতর বিক্ষিপ্ত হৃদয়ের আবেগ দিয়ে লেখক তাঁর প্রথম প্রকাশিত বইটি ভরে দিয়েছেন। তবে লেখক তাঁর ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে পাঠকদের অন্তত একটি প্রত্যাশা অপূর্ণ রেখেছেন তা হলো, তাঁর নিজের ভাষায়, ‘বেশ কয়েক বছর আগের কথা আমরা তখন ফরিদপুর মিশন হাউজের তিন তলা একটা বাড়িতে থাকি। আমরা মানে, সুনীলদা, আমি ও আমার দুই শিশুপুত্র শুভ্র এবং সৌম্য। সুনীলদা আমার জীবনসঙ্গী, তাকে দাদা বলার একটা ইতিহাস আছে। সেটা আজ নয় অন্য দিন...।’ (পৃ. ৯২) লেখকের স্মৃতি ও সত্তার শুধু এই একটি অপূর্ণ বিষয় নয় তাঁর আরও অনেক কথা জানার জন্য অপেক্ষা নিশ্চই করা যায়। কারণ, তাঁর লেখা এক নিশ্বাসে পড়া যায় এবং পড়তে কখনোই একঘেঁয়েমি বোধ হয় না। এখানেই লেখকের সাফল্য। প্রথম গ্রন্থেই লেখক যে সাহিত্যপ্রতিভার স্বাক্ষর রাখলেন, নিরন্তন চর্চায় তার প্রকাশ বাংলাসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করবে। আশা করি লেখক তাঁর পাঠকের প্রত্যাশা পূরণে আন্তরিক হবেন, আরো বিচিত্র বিষয় নিয়ে গ্রন্থ রচনা করে সাহিত্যের সুস্থ ধারায় নিজের আসনকে ধরে রাখবেন। একই দেশের, একই ভাষার এবং একই এলাকার বাসিন্দা হওয়া সত্ত্বেও ব্যক্তিগতভাবে লেখককের সঙ্গে পরিচয় না হওয়াকে আমার দুর্ভাগ্য মানি। এই সীমাবদ্ধতা সত্ত্বে আমরা শিপ্রা গোস্বামী নামের একজন পরিপূর্ণ লেখকসত্তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। [ড. অরুণ কুমার গোস্বামী, অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ ও পরিচালক, সাউথ এশিয়ান স্টাডি সার্কেল, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।]