Our User Product Reviews

#আড্ডাখানায়_রকমারি #রিভিউ_২০২৩ যে সিনেমাটি আমি এই পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি সংখ্যকবার দেখেছি তা হচ্ছে 'মাটির ময়না'। এরপরেই আছে 'রানওয়ে' 'অন্তর্যাত্রা' আর 'মুক্তির গান'। মূলত এই সিনেমাগুলোর সূত্রেই তারেক মাসুদকে চেনা। তবে তা কেবল একজন চলচ্চিত্রকার হিসেবেই। কী অসাধারণ প্রতিভাবান একজন মানুষ! প্রতিটা সিনেমা দেখে অবাক হয়েছি। কী অপূর্ব সৃষ্টিকর্ম! আজ পরিচয় হলো লেখক তারেক মাসুদের সাথে। 'চলচ্চিত্রযাত্রা' পড়ে যারপরনাই মুগ্ধ। কী চমৎকার লেখনী! 'চলচ্চিত্রযাত্রা' মূলত ৩৮টি প্রবন্ধের একটি সংকলন। তারেক মাসুদ তাঁর ২৫ বছরের চলচ্চিত্র ক্যারিয়ারে চলচ্চিত্রবিষয়ক যেসব প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখেছেন সেগুলোই এখানে স্থান পেয়েছে। আর তাতে উঠে এসেছে চলচ্চিত্র ভাবনা, দেশের চলচ্চিত্র নির্মাণের সংকট ও সম্ভাবনা। চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট তাঁর নানামুখী অভিজ্ঞতার প্রতিফলনও ঘটেছে বইটিতে। সঙ্গে রয়েছে তাঁর নিজস্ব আত্মস্মৃতি। ব্যাপকভাবে উঠে এসেছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কথা। দেখিয়েছেন মুক্তির সংগ্রামে বিজয়গাঁথা আরোহনের পথে কী অনবদ্য ভূমিকা ছিল চলচ্চিত্রের। 'মুক্তির গান' ও 'মুক্তির কথা' নির্মাণের মধ্য দিয়ে তারেক মাসুদ তুলে ধরেছেন ঐ সময়ের নির্ভরযোগ্য সব তথ্য। তা করতে গিয়ে বিভিন্ন দেশ থেকে সংগ্রহ করেছেন দূর্লভ সব ফুটেজ। যে প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি, এই ফুটেজগুলো মুক্তিযুদ্ধকে একেবারে তাদের চোখের সামনে নিয়ে এসেছে। তবে সেসব সংগ্রহের ইতিহাসও কম ত্যাগের নয়। দেশ ও দেশের বাইরের বিখ্যাত সব ব্যক্তির কথা ঘুরে ফিরে এসেছে। পাঠক জানতে পারবেন সেই সব মহান ব্যক্তিদের কর্ম ও অবদানের কথা। দেশ বরেণ্য চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানকে নিয়ে তৈরী করেছেন 'আদম সুরত'। দেখা হয়েছিল সত্যজিৎ রায়ের সাথে। কথাও হয়েছিল। সত্যজিৎ রায় কী চমৎকারভাবে জেনে নিয়েছিলেন বাংলাদেশের কথা! এছাড়াও রয়েছে লিয়ার লেভিন, সিডনি শানবার্গ, অ্যালেন গিন্সবার্গ, আলমগীর কবিরের মতো আরো অনেক মহান ব্যক্তির নাম। চলচ্চিত্র আন্দোলনের ৪০ বছরের সারসংক্ষেপ তুলে ধরা হয়েছে। সেই আন্দোলনের প্রধান হোতা মুহম্মদ খসরু। উইকেট পতনের মহামারিতে এই খসরু সত্যিকারের ক্যাপ্টেনের মতো অনমনীয়ভাবে ক্রিজে থেকে অবদান রেখেছিলেন তারেক মাসুদ থেকে চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ হতে। দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিশ্বসভায় বাংলাদেশের চলচ্চিত্র 'মাটির ময়না'। শুধু পদচারণা নয়, কান চলচ্চিত্র উৎসব থেকে জিতে গুরুত্বপূর্ণ ইন্টারন্যাশনাল ক্রিটিকস প্রাইজ। এছাড়াও মরক্কোর মারাকেশ চলচ্চিত্র উৎসব, এডিনবার্গ চলচ্চিত্র উৎসব, মন্ট্রিয়ল বিশ্ব চলচ্চিত্র উৎসবসহ আরো অনেক জায়গায় প্রদর্শিত হয় সিনেমাটি এবং বিভিন্ন পুরস্কারও পায়। অথচ নিজ দেশ বাংলাদেশে নিষিদ্ধ সেই 'মাটির ময়না'। কেমন ছিল সেই জার্নি? তারেক মাসুদের চলচ্চিত্র জগতে প্রবেশের শুরু থেকে স্বনামধন্য চলচ্চিত্রকার হয়ে উঠার গল্প লিপিবদ্ধ হয়েছে এই একটি বইয়ে। মাদ্রাসার ছাত্র থেকে চলচ্চিত্রের সাথে জড়িয়ে যাওয়া এবং টিকে থাকা কম সংগ্রামের ছিল না। তিনি সকল প্রতিকুলতা দুই হাতে এমনভাবে সরিয়েছেন যা সকলের কাছে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। নিষ্ঠার সাথে লেগে থাকলে কোনো প্রতিকুল পরিবেশই কাউকে আটকাতে পারে না। চলচ্চিত্র বিষয়ক লেখা বইয়ের বিচারে একদম প্রথম কাতারে পাওয়া যাবে চলচ্চিত্রযাত্রাকে। চলচ্চিত্রের ভেতর বাহির নিয়ে লেখা বেশ তথ্য বহুল একটা বই। বাংলাদেশে সমকালীন চলচ্চিত্রের যে সংকট তার কারণ এবং সেই সংকট থেকে উত্তরণের উপায় বিশদভাবে বর্ণিত হয়েছে এতে। আছে এদেশের চলচ্চিত্রের ভবিষ্যৎ পরিণতি এবং সেখান থেকে উঠিয়ে বিশ্ব দরবারে হাজির করার দিক নির্দেশনা। প্রতিটি লেখা একেকটি জীবন্ত ইতিহাস। আলাদাভাবে মূল্যায়ন করতে গেলে আরও একটি বইয়ের কাঠামো দাঁড়িয়ে যাবে। যেটি করা সম্ভবও। সবচেয়ে যে বিষয়টি আকৃষ্ট করেছে, তা হলো এখানে অবাঞ্ছিত শব্দচয়ন নেই, যে শব্দের ভিড়ে পাঠক তার মনোযোগ হারাতে পারে। একেবারে সহজ ও সাবলীল আলাপচারিতা। চলচ্চিত্র নিয়ে জানতে বা গবেষণা করতে আগ্রহী এমন পাঠকের জন্য অবশ্য পাঠ্য একটি বই। চলচ্চিত্রের সমস্ত কলকব্জা নিয়েই আলোচনা করা হয়েছে। তাত্ত্বিক বিষয়গুলো বর্ণনা করা হয়েছে গল্পের মতো করে। এজন্য চলচ্চিত্রপ্রেমী তো বটেই, অন্য পাঠকদের জন্যও সুখপাঠ্য হবে তারেক মাসুদের 'চলচ্চিত্রযাত্রা'। তারেক মাসুদকে বলা হয় সিনেমার ফেরিওয়ালা। চলচ্চিত্রের জন্যে তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন দেশ-বিদেশ। সেই সব অভিজ্ঞতার কথা অল্প পরিসরে তুলে ধরেছেন বইটিতে। পড়তে গিয়ে পাঠক অভিভূত হতে হবে। প্রাঞ্জল ভাষায় উঠে এসেছে সেই সব দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের কথা; রাস্তা-ঘাট থেকে শুরু করে প্রকৃতি ও পরিবেশের কথা। চমৎকার একটা ফিল পাবেন। মনে হবে কোনো প্রসিদ্ধ কোনো ভ্রমণকাহিনী পড়ছি। তারেক মাসুদ চলচ্চিত্রমনা মানুষ, ধ্যান জ্ঞানে চলচ্চিত্র থাকবে এটাই স্বাভাবিক। একটু সংশয় ছিল হয়তো অন্য পাঠকেরও থাকবে যে, লেখক হিসেবে তারেক মাসুদ কেমন করবেন? পাঠক যে আশাহত হবেন না, এটা জোর দিয়েই বলা যায়। এক ইন্টারভিউে তিনি বলেছিলেন, ' চলচ্চিত্রকার না হলে লেখক হওয়ার চেষ্টা করতাম।' বুঝাই যায় লেখালেখির প্রতি তাঁর একটা টান ছিল। চলচ্চিত্রযাত্রায় সে কথার যথার্থ প্রমাণও তিনি দিয়েছেন। ২০১১ সালের ১৩ আগস্ট এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান বরেণ্য নির্মাতা তারেক মাসুদ। স্বপ্ন ছিল এদেশের চলচ্চিত্রে, সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি নিয়ে তাঁর যে ভাবনা সেগুলো তিনি বই আকারে প্রকাশ করবেন। তা পৌঁছে দিবেন নতুনদের কাছে। এবং সেই লেখাগুলোর মধ্য দিয়েই বেঁচে থাকবেন যুগের পরে যুগ। জীবদ্দশায় সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি। মৃত্যুর পর চলচ্চিত্রযাত্রার মাধ্যমে পূরণ হয়েছে সেই স্বপ্ন। আশা করা যায় এই চলচ্চিত্রযাত্রার মাধ্যমেই আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন নির্মাতা তারেক মাসুদ।

সম্ভবত বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে প্রথমবারের মতোন আন্তর্জাতিক আঙিনাতে পৌঁছে দেয়া চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদের চলচ্চিত্র সংক্রান্ত বিবিধ প্রবন্ধের সংকলন। বইটিতে যেমন চলচ্চিত্র তৈরির পেছনের গল্প এসেছে, তেমনই এসেছে কী ভাবে অস্থির উপর রক্ত-মাংস সজ্জিত হয়ে চলচ্চিত্রের কাঠামো সেলুলয়েডে জীবন্ত হয়ে ওঠে, এছাড়াও এসেছে লেখকের বিবিধ আন্তজার্তিক চলচ্চিত্র উৎসবে যোগদানের অভিজ্ঞতা, প্রখ্যাত চলচ্চিত্র কিংবদন্তিদের গল্প। বাণিজ্যিক ধারার বাহিরের চলচ্চিত্র নিয়ে আগ্রহীদের জন্যে অবশ্যপাঠ্য।

#রকমারি_বইপোকা_রিভিউ_প্রতিযোগিতা বইঃ চলচ্চিত্রযাত্রা লেখকঃ তারেক মাসুদ প্রকাশনীঃ প্রথমা প্রকাশন প্রথম প্রকাশঃ ফেব্রুয়ারী, ২০১২ প্রচ্ছদঃ ঢালী আল মামুন বইয়ের ধরনঃ চলচ্চিত্র: বিবিধ প্রসঙ্গ মুদ্রিত মুল্যঃ ৩০০৳ রেটিংঃ ৫/৫ #রিভিউঃ চলচ্চিত্রের প্রতি আমার ছোটবেলা থেকেই দুর্বলতা কাজ করত। তাই চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট নানান ধরণের বই আমি সংগ্রহে করে পড়তে চেষ্টা করি। কিছুদিন আগে লাইব্রেরিতে গিয়েছিলাম বই কিনতে। হঠাৎ চোখে পড়ল বাংলাদেশের বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদের একটি প্রবন্ধ সংকলন “চলচ্চিত্রযাত্রা”। তৎক্ষণাৎ লোভ সামলাতে না পেরে কিনেই ফেললাম। কেননা তার প্রতিটাই চলচ্চিত্র আমি দেখছি এবং বিস্মিত হয়েছি। বইটি পড়ে ভালো লেগেছে অনেক। মনে হল যে, যদি তিনি লেখালেখি করতেন তবে লেখক হিসেবেও ভালো করতেন। চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে গিয়ে তিনি যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেন সাথে দেশের চলচ্চিত্র নিয়ে তার ভাবনা, সংকট-সম্ভাবনা প্রভৃতি বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে লিখেছেন প্রচুর। কিন্তু সেগুলো তার জীবদ্দশায় প্রকাশ পায়নি কখনো। তার মৃত্যুর পরে, বিভিন্ন সময়ে লেখা তার চলচ্চিত্র সম্পর্কিত প্রবন্ধগুলোকে একত্র করে এই বইটি প্রকাশিত হয়। বইয়ের ভূমিকা লিখেছেন তার স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদ। পাঠকদের সুবিধার জন্যে সূচিপত্রটা দিলামঃ যেভাবে ‘আদম সুরত’, ‘মুক্তির গান’-এর গল্প, লিয়ার লেভিনঃ আমাদের মুক্তির সারথি, বিশ্বসভায় মাটির ময়না, অন্তরযাত্রা বহিঃযাত্রাঃ সিনেমা যখন সহযাত্রী, চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের চল্লিশ বছরঃ গলা সাধা বনাম কান সাধা, সত্যজিৎ রায়ের স্মৃতি,তবে আমিও ‘কুয়াশা’ ছিলাম, স্মৃতিতে অম্লান আলমগীর কবির, কর্ণফুলীর কান্না; কাঠমান্ডু ও কাণ্ডজ্ঞান, রবীন্দ্রসাহিত্যের চলচ্চিত্রায়নঃ সত্যজিৎ রায় এবং নারী, বিশ্ব চলচ্চিত্রঃ ভাষা ও মাধ্যমগত বিকাশের রেখাচিত্র, সমকালীন চলচ্চিত্রের সংকট, সত্যজিৎ ও রবীন্দ্রনাথ, মুক্তিযুদ্ধের ওপর বিদেশি নির্মাতাদের চলচ্চিত্র, টেলিভিশন চ্যানেলের চলচ্চিত্র নির্মাণের উদ্যোগঃ একটি পর্যালোচনা, ডিজিটাল মাধ্যম ও বাংলাদেশের চলচ্চিত্র, মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র, চলচ্চিত্রের মুক্তিযুদ্ধ, দুই বাংলার চলচ্চিত্রের আদান-প্রদান, ভারত-বাংলাদেশ চলচ্চিত্র বিনিময়, আন্তর্জাতিক বাজারে আমাদের চলচ্চিত্র, সপ্নের চলচ্চিত্র, চলচ্চিত্রের সপ্ন, মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্রঃ ব্যতিক্রম ও বিতর্ক, চলচ্চিত্রের চোখঃ বাংলাদেশকে নতুন করে দেখার জন্য, রুপালি পর্দায় আশার রুপালি রেখা, আলোকচিত্র। বইয়ের ভাষা অনেক সহজবোধ্য ও সাবলীল। কোনখানে আসামঞ্জস্যতা চোখে পড়েনি। পাঠক প্রতিটি প্রবন্ধে নতুন স্বাদ খুঁজে পাবেন বলে আমার বিশ্বাস। শুধু চলচ্চিত্রপ্রেমী নয়, সাধারণ যেকোনো পাঠকেরই এই বইটি ভালো লাগবে। পরিশেষে বলা যায়, বর্তমান বাংলা চলচ্চিত্রে যে খরা চলছে তার মাঝে দাঁড়িয়ে এই অনবদ্য বইটি উন্নত ছবি নির্মাণে একধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবে। লিঙ্কঃ https://www.rokomari.com/book/28824/চলচ্চিত্রযাত্রা

তারেক মাসুদকে আমরা মূলত চলচ্চিত্রকার হিসেবেই চিনি। চলচ্চিত্র জগতে তাঁর প্রবেশ ১৯৮২ সালে চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানের ওপর নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র আদমসুরত-এর মাধ্যমে। এরপর মুক্তিযুদ্ধের ওপর নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র মুক্তির গান তাঁকে এনে দেয় দেশজোড়া খ্যাতি। তাঁর নির্মিত মাটির ময়না চলচ্চিত্র তাঁকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিত করে তোলে। কান চলচ্চিত্র উৎসবে ‘ক্রিটিকস অ্যাওয়ার্ড’ লাভ করে এটি। বাংলাদেশে ভিন্ন ধারার চলচ্চিত্র নির্মাণে তাঁর ভূমিকা অনস্বীকার্য। চলচ্চিত্র এমন একটি আন্তর্জাতিক মাধ্যম, যার সাহায্যে অনেক মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা সম্ভব। মানুষের চিন্তাচেতনায় প্রভাব রাখার জন্য এটি খুবই শক্তিশালী একটি মাধ্যম। তারেক মাসুদ বরাবরই ভিন্নধারার চলচ্চিত্র নির্মাণের চেষ্টা করেছেন। ১৯৫৬ সালে জন্ম নেওয়া এই স্বপ্নদ্রষ্টা মানুষটি ২০১১ সালের ১৩ আগস্ট এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন। সেদিনও তিনি যাচ্ছিলেন তাঁর নির্মীয়মাণ চলচ্চিত্র কাগজের ফুল-এর শুটিংয়ের কাজে। চলচ্চিত্র অন্তপ্রাণ এই মানুষটির এভাবে চলে যাওয়া নিঃসন্দেহে বাংলা চলচ্চিত্রের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। বিগত ২৫ বছরে তারেক মাসুদ চলচ্চিত্রের ওপর বেশ কিছু প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখেছেন। তিনি একবার বলেছিলেন, ‘চলচ্চিত্রকার না হলে লেখক হওয়ার চেষ্টা করতাম।’ অর্থাৎ লেখালেখির ওপরও তাঁর একধরনের ঝোঁক ছিল। তাঁর রচিত প্রবন্ধ-নিবন্ধগুলো নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে চলচ্চিত্রযাত্রা। এটি প্রকৃতপক্ষে চার খণ্ডে সমাপ্য তারেক মাসুদের রচনাগুলোর প্রথম অংশের গ্রন্থায়ন। চলচ্চিত্র বিষয়ে তাঁর নিজস্ব বয়ান এখানে প্রকাশিত হয়েছে। সর্বমোট ২৮টি প্রবন্ধ-নিবন্ধ রয়েছে বইটিতে। এ ছাড়া ‘আলোকচিত্র’ শিরোনামে এখানে স্থান পেয়েছে তারেক মাসুদের বেশ কিছু ছবি। প্রবন্ধগুলো মূলত বিষয় বা ভাবানুযায়ী সাজানো হয়েছে। তারেক মাসুদের গদ্য সহজ, সাবলীল ও প্রাঞ্জল। খুব গভীর ভাবনা তিনি সহজ কথায় প্রকাশ করতে পারঙ্গম। তা ছাড়া তাঁর বর্ণনাভঙ্গিও চমৎকার। গল্পের মতো করে তিনি বর্ণনা করেছেন তাত্ত্বিক বিষয়গুলোকেও। তারেক মাসুদের প্রথম কাজ একটি প্রামাণ্যচিত্র, যেটি আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানকে নিয়ে আদমসুরত। বইয়ের প্রথম লেখাটিও এ প্রামাণ্যচিত্র নিয়েই। চলচ্চিত্র নির্মাণের জগতে তাঁর প্রবেশের গল্প উঠে এসেছে এখানে। পরের কাজ মুক্তির গান। সিনেমা নির্মাণের পুরোনো কৌশল তিনি ভেঙে ফেলে সম্পূর্ণ নতুন শৈলীতে তৈরি করেছিলেন এটি। এ কাজে ব্যবহূত হয়েছিল ১৯৭১ সালে তরুণ মার্কিন নির্মাতা ও চিত্রগ্রাহক লিয়ার লেভিনের শরণার্থী শিবিরের ফুটেজ ও বিভিন্ন দেশ থেকে কেনা মুক্তিযুদ্ধের ফুটেজ। লিয়ার লেভিনকে নিয়ে পরে একটি গোটা প্রবন্ধ আছে এ বইয়ে ‘লিয়ার লেভিন: আমাদের মুক্তির সারথি’ শিরোনামে, সেখানে তারেক বলেন, ‘শুধু লিয়ার লেভিনের ফুটেজ নয়, মুক্তির গান-এর জন্য আমরা যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ড, কানাডা, ফ্রান্স, ভারতসহ বিভিন্ন দেশ থেকে প্রচুর ফুটেজ সংগ্রহ করেছি। সেগুলো দেখে মনে হয়েছে, লিয়ারের কাজের সামনে লাখো ঘণ্টার ফুটেজও কিছু না। তাঁর ফুটেজ ও সহযোগিতায় মুক্তির গান-এর অস্থিমজ্জা দাঁড়িয়েছে।’ মাটির ময়না নিয়ে একটি চমৎকার প্রবন্ধ রয়েছে এ বইয়ে। সেন্সর বোর্ডের কারণে দেশে যখন সিনেমাটি নিষিদ্ধ, ঠিক তখনই এটি আবার জিতে নিয়েছিল কান চলচ্চিত্র উৎসবের গুরুত্বপূর্ণ ইন্টারন্যাশনাল ক্রিটিকস অ্যাওয়ার্ড। ফলে একটি মিশ্র প্রতিক্রিয়া ছিল সিনেমাটি নিয়ে। মাদ্রাসামাধ্যমে পড়াশোনা করার কারণেই হয়তো তারেক মাসুদ একজন মাদ্রাসাছাত্রকে যথাযথভাবে চিত্রায়িত করতে পেরেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন লেখক শিবিরের সঙ্গে সম্পর্ক, আহমদ ছফার সান্নিধ্য, বন্ধুমহল ইত্যাদি সম্পর্কে সরস বর্ণনা আছে বইটিতে। ‘বিশ্ব চলচ্চিত্র: ভাষা ও মাধ্যমগত বিকাশের রেখাচিত্র’ শিরোনামের প্রবন্ধে খুব অল্প পরিসরে সারা পৃথিবীর চলচ্চিত্রে উল্লেখযোগ্য বাঁকবদলের ইতিহাস তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন লেখক। নির্বাক থেকে সবাক যুগের চলচ্চিত্র, নিউ রিয়েলিস্ট আন্দোলন, নিউ ওয়েভ আন্দোলন ইত্যাদি সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ বয়ান রয়েছে লেখাটিতে। এ ছাড়া ‘সমকালীন চলচ্চিত্রের সংকট’, ‘বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের সংকট’, ‘ডিজিটাল মাধ্যম ও বাংলাদেশের চলচ্চিত্র’, ‘দুই বাংলার চলচ্চিত্র আদান-প্রদান’ ইত্যাদি প্রবন্ধ এখনকার প্রেক্ষাপটেও প্রাসঙ্গিক। চলচ্চিত্র বিষয়ে নানা দিক থেকে নানা সমস্যা-সম্ভাবনা সংকট, তার থেকে উত্তরণের সম্ভাব্য উপায়, দেশি-বিদেশি চলচ্চিত্রের বৈশিষ্ট্য, সিনেমার দীর্ঘ যাত্রার ইতিহাস ইত্যাদি সম্পর্কে তারেক মাসুদের নিজস্ব বয়ান খুব সাবলীল ভাষায় উপস্থাপিত হয়েছে এ বইয়ের লেখাগুলোতে। সহজবোধ্য হওয়ার কারণে সব শ্রেণীর পাঠকের কাছেই প্রয়োজনীয় বিবেচিত হতে পারে বইটি।