User login
Sing In with your email
Send
Our Price:
Regular Price:
Shipping:Tk. 50
প্রিয় ,
সেদিন আপনার কার্টে কিছু বই রেখে কোথায় যেন চলে গিয়েছিলেন।
মিলিয়ে দেখুন তো বইগুলো ঠিক আছে কিনা?
Share your query and ideas with us!
Was this review helpful to you?
or
সাহিত্য পাঠকের মনোজগতে আলোড়ন সৃষ্টি করে তখনই, যখন তা জীবনবোধের গভীর সত্যকে প্রকাশ করতে সক্ষম হয়। সমসাময়িক বাংলা সাহিত্যে এ ধরনের রচনা খুব বেশি দেখা যায় না, কিন্তু সাবের চৌধুরীর ‘জীবনে রোদ্দুরে’ বইটি সে ঘাটতি পূরণ করেছে। এ গ্রন্থটি শুধুমাত্র একগুচ্ছ শব্দের সমষ্টি নয়, বরং জীবন, অনুভূতি, নিঃসঙ্গতা এবং আত্ম-উন্মোচনের এক শৈল্পিক দলিল। বইয়ের সারসংক্ষেপ ‘জীবনে রোদ্দুরে’ মূলত আত্মোপলব্ধি এবং জীবনযাপনের অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানকে কেন্দ্র করে রচিত একটি গ্রন্থ। এটি গল্প, প্রবন্ধ ও আত্মজীবনীমূলক অনুভূতির এক মিশ্র রূপ। লেখক এখানে তার জীবনদর্শন, মানবিক অনুভূতি, সমাজ-সংস্কৃতির পর্যবেক্ষণ এবং অন্তর্দৃষ্টিকে নিখুঁতভাবে তুলে ধরেছেন। বইয়ের প্রতিটি অধ্যায় একেকটি আলাদা দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে হাজির হয়, যা পাঠকের চিন্তার খোরাক যোগায় এবং জীবন সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে। সাবের চৌধুরী খুব সূক্ষ্ম ও মার্জিত ভাষায় জীবনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেছেন। কখনো তিনি বিষণ্ণতার কথা বলেন, কখনো আশার কথা, আবার কখনো বেঁচে থাকার গভীর দর্শন ব্যাখ্যা করেন। তার লেখনীতে অতীত ও বর্তমানের এক সংবেদনশীল মিলন ঘটে, যেখানে পাঠকও নিজেকে যুক্ত করতে পারেন। ভাষা ও শৈলী সাবের চৌধুরীর ভাষাশৈলী অত্যন্ত নান্দনিক ও প্রাঞ্জল। তার লেখার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো ভাষার সাবলীলতা, যা সহজেই পাঠকের হৃদয়ে গেঁথে যায়। তার গদ্যের মধ্যে কোথাও অতিরঞ্জন নেই, কোথাও কৃত্রিমতা নেই; বরং প্রতিটি বাক্যের মধ্যে একধরনের স্বাভাবিক গতিশীলতা রয়েছে, যা পাঠককে বাধ্য করে বইটি শেষ করতে। তিনি কখনো ছোট ছোট বাক্যে ভাবপ্রকাশ করেছেন, আবার কখনো দীর্ঘ ও গভীর চিন্তাপূর্ণ বাক্যের সাহায্যে জটিল সত্যকে সহজভাবে তুলে ধরেছেন। তার শব্দচয়ন অত্যন্ত সুনির্বাচিত এবং প্রাঞ্জল, যা তার লেখাকে আরও মধুর ও চিন্তাশীল করে তুলেছে। বিষয়বস্তু ও থিম ‘জীবনে রোদ্দুরে’ বইটির মূল থিম হলো জীবনদর্শন ও অনুভবের বহুমাত্রিক বিশ্লেষণ। লেখক এখানে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, দর্শন এবং আবেগের সংমিশ্রণে এক অনন্য কথন তৈরি করেছেন। ১. জীবন ও সময়ের ধারা লেখক তার বইয়ের বিভিন্ন অধ্যায়ে সময়ের প্রবাহমানতা নিয়ে আলোচনা করেছেন। জীবন আমাদের হাতে বয়ে যায়, কিন্তু আমরা সেটি বুঝতে পারি তখনই, যখন হারিয়ে ফেলি। সময়ের প্রতি এই সংবেদনশীল উপলব্ধি লেখকের দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচায়ক। ২. আত্ম-অনুসন্ধান ও আত্মজিজ্ঞাসা লেখক বইটিতে আত্মজিজ্ঞাসার এক অসাধারণ দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছেন। তিনি নিজের অস্তিত্বের বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, আমাদের বেঁচে থাকার অর্থ কী, আমরা কেন জীবনকে যাপন করি, এবং কিভাবে আমরা জীবনকে আরও গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারি – এসব বিষয় নিয়ে গভীরভাবে আলোচনা করেছেন। ৩. সম্পর্ক ও নিঃসঙ্গতা বইটিতে সম্পর্কের গভীরতা এবং নিঃসঙ্গতার বাস্তবতা নিয়ে লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত সংবেদনশীল। তিনি দেখিয়েছেন, মানুষ একদিকে সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ হতে চায়, কিন্তু অপরদিকে সে একাকীত্বের স্বাদও উপভোগ করে। এই দ্বৈততা মানুষকে কিভাবে পরিচালিত করে, সেটি লেখক নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। ৪. আনন্দ ও বিষাদ জীবন শুধুমাত্র আনন্দ বা শুধুমাত্র দুঃখের সংমিশ্রণ নয়, বরং এটি এক অপরটির পরিপূরক। লেখক দেখিয়েছেন, দুঃখ না থাকলে আনন্দ অর্থহীন, আর আনন্দ ছাড়া দুঃখ দুর্বহ। এই দৃষ্টিভঙ্গি তাকে আরও বাস্তববাদী ও সংবেদনশীল লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। ৫. স্মৃতি ও বিস্মৃতি লেখকের লেখনীতে স্মৃতি একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে উপস্থিত। তিনি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে উঠে আসা বিভিন্ন স্মৃতিকে সাহিত্যের মাধ্যমে চিত্রিত করেছেন এবং তা আমাদের নিজেদের জীবনবোধের সঙ্গে মিলিয়ে দেখার সুযোগ করে দিয়েছেন। প্রভাব ও গুরুত্ব এই বইটি শুধুমাত্র একটি সাধারণ সাহিত্যগ্রন্থ নয়, এটি একটি জীবনগবেষণা। পাঠকের ব্যক্তিগত অনুভূতি ও জীবনবোধের সঙ্গে এই বইয়ের ভাবনাগুলো এতটাই মিশে যায় যে, একবার পড়তে শুরু করলে তা শেষ না করে উঠা কঠিন হয়ে পড়ে। বইটি পড়ার পর পাঠক নিজের জীবনকে নতুনভাবে দেখতে শিখবে, সম্পর্কের অর্থ বুঝতে পারবে, সময়ের গুরুত্ব উপলব্ধি করবে এবং নিজেকে আরও গভীরভাবে জানার চেষ্টা করবে। সমালোচনা ও কিছু সীমাবদ্ধতা যদিও ‘জীবনে রোদ্দুরে’ একটি অনবদ্য গ্রন্থ, তবুও কিছু কিছু জায়গায় পাঠক অতিরিক্ত চিন্তাশীল ভাবনার ভারে ক্লান্ত হতে পারেন। কিছু অধ্যায় তুলনামূলকভাবে জটিল এবং গভীর, যা সাধারণ পাঠকের জন্য বোধগম্য হতে সময় লাগতে পারে। এছাড়া, লেখকের লেখার ধারা কখনো কখনো অতিমাত্রায় দার্শনিক হয়ে ওঠে, যা সাধারণ পাঠকের কাছে কিছুটা দূরত্ব সৃষ্টি করতে পারে। তবে, এটি নির্ভর করে পাঠকের অভ্যাস ও রুচির ওপর। শেষ কথা সাবের চৌধুরীর ‘জীবনে রোদ্দুরে’ শুধু একটি বই নয়, বরং এক গভীর জীবনবোধের প্রতিফলন। এটি এমন একটি গ্রন্থ যা পাঠকের চিন্তার জগতে আলোড়ন তুলবে এবং তাকে জীবনকে নতুনভাবে দেখার সুযোগ করে দেবে। তার ভাষা, ভাবনাপ্রবাহ, সম্পর্কের গভীরতা ও দার্শনিক বিশ্লেষণ বইটিকে অনন্য মাত্রা দিয়েছে। যারা সাহিত্য ও জীবনবোধ নিয়ে গভীর চিন্তায় আগ্রহী, তাদের জন্য এটি অবশ্যপাঠ্য। এই বইটি একবার পড়লে পাঠকের মনে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলবে, যা তাকে জীবন সম্পর্কে নতুনভাবে ভাবতে শেখাবে। লেখক তার চিন্তার গভীরতা এবং অনুভূতির সূক্ষ্মতাকে এমনভাবে প্রকাশ করেছেন, যা তাকে একজন শক্তিশালী ও সম্ভাবনাময় সাহিত্যিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। সর্বোপরি, ‘জীবনে রোদ্দুরে’ আমাদের সময়ের এক উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্ম, যা বহুদিন ধরে পাঠকের হৃদয়ে স্থান করে নেবে।
Was this review helpful to you?
or
"জীবনে রোদ্দুরে" আমার সংগ্রহে থাকা বইগুলোর মধ্য থেকে আমার পছন্দের একটি বই।?? অনেক আগে থেকেই (তালীমি মুরুব্বি) ওস্তাদের তাগিদে বই পুস্তক পড়া শুরু করি। গল্প, ইতিহাস, কবিতা ইত্যাদি অনেক লেখাই টুকটাক পড়েতাম, মজা ও পেতাম। তবে লেখকদের লেখাতেও যে ভিন্ন রকম এক মজা আছে, সৌন্দর্য ও শৈল্পিকতা আছে তা কখনো অনুধাবণ করতে পারিনি। কিন্তু গতবারের ইসলামিক বইমেলা থেকে যখন বইটি কিনে পড়া শুরু করলাম, তখন খুব ভালো লাগছিলো যে, কত সুন্দর লেখা, শব্দের কি সুন্দর ব্যবহার, বারবারই মুগ্ধ হচ্ছিলাম। এর আগেও প্রবীণ লেখকদের কিছু বই পড়েছি, সেগুলোও অনেকটা এমনি ছিলো তবে তখন হয়তো তাদের সেই লেখার সৌন্দর্য অনুভব করার মতো অভিজ্ঞতা আমার হয়ে উঠেনি। এখন আমি এটাও বলছিনা যে, আমি বড় কোন সাহিত্যিক বা লেখক হয়ে গেছি, যার কারণে অন্যান্য লেখকদের লেখার মান নির্ণয় করতে পারি। আমি শুধু এটা বলতে চাচ্ছি যে, লেখকদের লেখার মধ্যেও যে একপ্রকার সৌন্দর্য ও শৈল্পিকতা আছে সেটা আমি এখন কিছুটা হলেও বুঝতে শুরু করেছি। আলহামদুলিল্লাহ.. আর এর হাতেখড়ি হয়েছে " জীবনে রোদ্দুরে " এই বইটির মাধ্যমে।? বইটি লিখেছেন তরুণ আলেম ও গদ্যশিল্পী -সাবের চৌধুরী বারাকাল্লাহু ফি হায়াতিহ?
Was this review helpful to you?
or
▪️না চাইতেই পেয়ে গেলাম যা: মুহাম্মাদ যাইনুল আবিদীনের “কবি না কবিতা হবো” বইটি পড়েছিলাম বেশ কয়েকমাস আগে। যদিও আমি পাঠিকা হিসেবে নতুন কিন্তু ছোট্ট এই বইটিজুড়ে আমার মুগ্ধতার শেষ নেই। বইটি পড়ার সময় মনে হচ্ছিলো হয়তো মুহতারাম এর দরসে বসে আছি। আর ভাবছিলাম যারা তাঁর সোহবত পাবে নিঃসন্দেহে তাঁরা অনেক ভালো লিখবে। কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি মুহতারামের কোনো শিষ্যের বইয়ের সন্ধান পেয়ে যাবো তা ঘুণাক্ষরেও ভাবিনি। আমি তো মুহতারাম যাইনুল আবিদীনের বইয়ের সন্ধানেই ছিলাম আজতক। ▪️ভাঙছে যে ভুল: ছোটবেলায় ভাবতাম মাদ্রাসার হুজুরগণ বা মাদ্রাসা পড়ুয়ারা ওয়াজ নসিহত করে আর কুরআন তেলাওয়াত পর্যন্তই তাঁদের গন্ডি। মাদ্রাসার কাউকে দিয়ে সাহিত্যচর্চাও হয়, তাঁরা সাহিত্যাঙ্গনে আরো কয়েক কদম এগিয়ে। এইটা হয়তো জানা হতো না, যদি না বইয়ের জগতে আসতাম। ধীরে ধীরে ভুলগুলো ভাঙছে। জানছি নতুন অনেক কিছু, চিনছি অনেক জনকে। তেমনিই আজকের আলোচ্য বইটিও। “জীবনে রোদ্দুরে” বইটির মাধ্যমে পরিচয় হলো গদ্যশিল্পী সাবের চৌধুরীর সাথে। যখন বইয়ের শুরুতে আমার প্রিয় লেখক শ্রদ্ধেয় যাইনুল আবিদীন বলে রেখেছেন- “সাবের একই সঙ্গে চঞ্চল এবং খেয়ালি। ফলে তার সৃষ্টিশীলতার জীবনের বাস্তবতা এবং কবির কল্পনা গলাগলি ধরে ঢেউ ভাঙে।” তখন বইয়ের ভেতরের ডুব দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা আরও তীব্র হয়ে উঠে। বইটি পড়তে পড়তে আমিও যেনো হারিয়ে যাচ্ছিলাম লেখকের সাথে তাঁর ফেলে আসা দিনগুলোতে। মানসপটে ভেসে উঠেছিল একেকটি দৃশ্যপট। আবার আমি তাথৈ তাথৈ ধ্বনিতে হারাচ্ছিলাম আমার শৈশবের দিনগুলোতে। ▪️বই অভ্যন্তরে: বইটি চারটি অধ্যায়ে সজ্জিত। প্রথম অধ্যায়- নির্ঝর। আচ্ছা, অধ্যায়ের নাম নির্ঝর কেনো! ঝরণা। পাহাড়ের আঁকাবাঁকা বন্ধুর পথ মাড়িয়ে এসে একসময় তার পথচলা শেষ হয়। সৃষ্টি হয় এক নতুন ছন্দের। নতুন উল্লাসের। শৈশবের দিনগুলো পার করে এসে লেখকও জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশের সমাপ্তির পর নতুন জীবনে প্রবেশ করেন তাই হয়তো এই অধ্যায়ের নাম নির্ঝর। অধ্যায়টিতে সতেরোটি পাঠ রয়েছে। যেখানে লেখকের শৈশবের স্মৃতিকথা গুলোই পাঠক জানবে। লেখক চেয়েছেন জীবনকে সাদামাটাভাবে গ্রহণ করতে। অথচ, “মেঘেদের মাঠে” বিমানের আওয়াজ শুনে তা দেখার জন্য ঘর থেকে হুড়মুড়িয়ে বেরিয়ে পড়ার মতো বিষয়টিকেও তিনি কতই না অসাধারণভাবে উপস্থাপন করেছেন। কিংবা “একদিন ঢাকার পথে”- গদ্যাংশটিতে তিনি কত সহজ সাবলীল ভাবে উপস্থাপন করেছেন তার ঢাকায় যাওয়ার গল্প। আমাদের কাছে যা বিরক্তিকর এক স্মৃতি সেটিই লেখকের কলমে ফুটে উঠেছে ভিন্ন আঙ্গিকে, মজার ছলে। কথা বলা যায়, তাঁর “শাসন” বা “বাবা” শিরোনামের গদ্য নিয়েও। গদ্যের ঢঙে উঠে এসেছে তাঁর হিফজ যাত্রা আর লজিং বাড়ির স্মৃতিগুলো। তরঙ্গ: মোট চৌদ্দটি পাঠের সমন্বয়ে বইয়ের দ্বিতীয় অংশ। শুধুই স্মৃতিকথা নয়, এখানে রয়েছে কিছু ভারী কথাও। এই অংশটা পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিলো টপিকগুলো সকল সাহিত্যপ্রেমীদের জন্য। যারা শব্দ দিয়ে খেলতে পছন্দ করে। গদ্যের আড়ালে তারা পেয়ে যাবে সাহিত্যের নানা রসদ, পাবে অনেক মূল্যবান কৌশল। জাদুর হরফ, শব্দ: চেতনা ও সতর্কতা, শব্দের মায়া, গদ্যের শরীর, কবিতা: আমাদের অক্ষমতার ভাষা, তারানা: হৃদয়ের উঠোনে ঝরা প্রেমের বকুল- পাঠগুলোকে ঘিরে ঘোরলাগা এক শব্দ তরঙ্গ সৃষ্টি হয় বলেই বোধহয় অধ্যায়ের নাম তরঙ্গ। শুধুই কি গদ্য! লেখক দেখবে পদ্মফুলের ন্যায় প্রস্ফুটিত কিছু পদ্য। আর অধ্যায়ের পাঠগুলো পড়েই মনে হচ্ছিলো এই হলো যাইনুল আবিদীনের শিষ্য। যারা বাঙলা সাহিত্য নিয়ে ভাবে আর ভাবায়। অববাহিকা: নদীর উভপার্শ্বের তীরভূমি, যেখান থেকে জল এসে নদীতে মেশে৷ অববাহিকায় রয়েছে পনেরোটি পাঠ। গদ্যের পরতে পরতে লেখক লুকিয়ে রেখেছেন মণিমুক্তো। মনোযোগী পাঠক মাত্রই সেগুলো কুড়িয়ে নিবে। অমনোযোগী পাঠকের জন্যও লসের কিছু নেই৷ সাহিত্যে স্বাদ পুরোটাই সে পাবে। চমৎকারভাবে লেখক উপস্থাপন করেছেন তাঁর জীবনবোধ। “ব্ল্যাকহোল”নামের অংশটুকু আমার বেশ ভালো লেগেছে। এছাড়াও ছিলো- প্রেম ও প্রেমোন্মাদনা, সমকালে ফতোয়াচর্চা: কিছু ভাবনা, দুঃখবোধ দুঃখবিলাস, ব্যক্তিস্বাধীনতা: ব্যবধান। জরুরি আর কঠিন কোন বিষয়কেও কিভাবে সহজে উপস্থাপন করা যায় তা বুঝতে পারা যায় অববাহিকায়। কোলাহল: পাখিসবের কিচিরমিচির যেনো। আসলেও তাই, শিশুদের মিলনমেলা যেনো এই অধ্যায়। শিশুদের প্রতি লেখকের ভালোবাসা, শিশুদের নিয়ে তাঁর দরদ, ভাবনাগুলোই স্থান পেয়েছে এই অংশে। নির্ঝরের লেখক শিশুই এখানকার শিশুর অভিভাবক। নয়টি পাঠের মাধ্যমে অধ্যায়টি সজ্জিত। রয়েছে- শিশুগণ, মমতার ভার, মমতাময়ী, একটি চুমুর জন্য'র মতো শিরোনামে লেখকের অসাধারণ গদ্যসম্ভার। শিশুদের কোলাহল তিনি চয়ন করেছেন শব্দে শব্দে। ▪️মতামত: বইটিকে লেখকের স্মৃতিকথা বলা না গেলেও গদ্য সংকলন বলা যায়। বলা যায় জীবনের সহজ পাঠ। যাপিত জীবনের সাধারণ ঘটনাগুলোই তিনি উপস্থাপন করেছেন অসাধারণ গদ্যময় ঢঙে। শব্দের রূপ, রস, ঘ্রাণ পুরোটাই মজুদ রয়েছে বইয়ের ভাঁজে৷ সাহিত্যপ্রেমীরা পেয়ে যেতে পারে সাহিত্যচর্চার রসদ। এই বইয়ের আলোচনা সমালোচনা করার মতো যোগ্যতা আমার হয়নি। এই লেখা রিভিউ হয়েছে কি না তাও সন্দেহ। তবে বইটি অসাধারণ হয়েছে এক বাক্যে বলতে পারি। যে কেউ মন্ত্রমুগ্ধের মতো পাঠ করবে৷ বইয়ের নাম, প্রচ্ছদ, উপস্থাপন ভঙ্গি, একেকটা শিরোনাম, গদ্যের ক্রমবিন্যাস এবং বইয়ে ব্যবহৃত শব্দভাণ্ডার বেশ সমৃদ্ধ। সাবলীল, ঝরঝরে উপস্থাপনায় সমাজের নানা দিকের আলোচনা উঠে এসেছে। বইটি সহজেই পাঠকের মন ছুঁতে পারবে বলে আমার মনে হচ্ছে। বইটি পাঠক সমাদৃত হোক। বইয়ের রোদ্দুরটুকু ছড়িয়ে পড়ুক সবার কাছে, সবার মননে, আলোকিত হই আমরা, আলোকিত হোক আমাদের সমাজ। লেখকের কলম আরও শাণিত হোক। আমরা আরও ভালো বই পাই, আমাদের সাহিত্যাঙ্গন সমৃদ্ধ হোক, এই কামনা।
Was this review helpful to you?
or
'সাবের চৌধুরী এবং আমি একই বৃত্তের মানুষ। তার মুকুলিত শিল্পসত্তা প্রস্ফুটিত হয়েছে আমার সামনে। আমি তার প্রায় প্রতিটি পাপড়ি বিকশিত হতে দেখেছি। আমার মনে হয়েছে—সাবের যখন পৃথিবীতে এসেছেন শিল্প-সাহিত্যটা সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন। তার এই শক্তি স্বভাবজাত—ফলে তিনি তার বৃত্তে আলাদা উচ্চতায় দৃশ্যমান।'— বক্ষমান বইটির লেখক সাবের চৌধুরী সম্পর্কে কথাগুলো বলেছেন নন্দিত কথাশিল্পী মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন হাফিজাহুল্লাহ। সূর্য থেকে যে তড়িৎচৌম্বকীয় তরঙ্গ পৃথিবীতে এসে পড়ে আমরা সেই আলোকরশ্মিকেই 'রোদ' বা 'রৌদ্র' নামে চিনি। রৌদ্র-এর কথ্যরূপ হলো 'রোদ্দুর'। গায়ে রোদ মাখা স্বাস্থ্যের জন্য বেশ উপকারী। বিশেষকরে সকালের মিষ্টি-রোদ। চিকিৎসাবিজ্ঞান-এর মতে— ভালো ঘুম হওয়া, ওজন পরিমিত রাখা, বিষণ্নতা দূরীকরণ, ক্যান্সার ও হৃদরোগ নিয়ন্ত্রণসহ সকালের রোদ পোহানোর রয়েছে নানাবিধ উপকারিতা। 'জীবনে রোদ্দুরে' বইটি পড়ার পর আমার কাছে মনে হয়েছে—নবীন-লেখক ও বোদ্ধা-পাঠক উভয় শ্রেণীর জন্যই বইটি নানাদিক থেকে উপকারী হবে। দুর্বোধ্য শব্দ ও বাক্য পরিহার করে লেখক তার যাপিত জীবনের গল্পগুলো যেমন গড়গড় করে বলে গেছেন, এতে পাঠক পড়তে বেশ আরাম পাবেন। ভাড়ামি-মুক্ত নির্মেদ গদ্য পড়তে কার না ভালো লাগে বলুন? ঝরঝরে গদ্যে লেখা বইটি একবার পড়া শুরু করলে শেষ না করে উঠতে মন চাইবে না। প্রতিটি গল্পই পাঠকের ভাবনার দুয়ারে নতুন করে নাড়া দিয়ে যাবে। শিরোনামের সঙ্গে মিল রেখে গল্প বলার ধরণে লেখক যে মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন তা পাঠককে মুগ্ধ করবে। পরিচিত প্রেক্ষাপট আর রচনার সাবলীলতা পড়ায় গতিও যোগাবে বেশ। অবশ্য আপনি আমার মতো পাঠক হলে পড়া বেশি এগুবে না! একেকটা প্যারা শেষ করে কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে যাবেন লেখার পটভূমিতে। মনে হবে—আপনি বুঝি লেখকের পাশেই অবস্থান করছেন। দৃশ্যপটটা যেন আপনার সামনেই মঞ্চস্থ হচ্ছে! চরিত্রগুলোর হাসি-কান্না, আবেগ-উৎকণ্ঠা সবই আপনি দেখতে পাচ্ছেন! কখনো মনে হবে—আরে! এ তো দেখছি আমার জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনাটাই! গল্পগুলোর কোনোটি আপনাকে হাসাবে, কোনোটি কাঁদাবে। কোনোটি ভাবনার সাগরে ডুবিয়ে দেবে, কোনোটি আপনার চোখে নিয়ে আসবে আনন্দাশ্রু। কোনোটি বিবেকের দরজায় মৃদু টোকা দেবে, কোনোটি আপনাকে করে দেবে একবারে নস্টালজিক! আমার বিশ্বাস—কোনো নবীন লেখক এ বই পড়লে ভাবনার আরও গভীরে যাওয়া শিখবেন। তার বিশ্লেষণ-ক্ষমতা সূক্ষ্ম থেকে সুক্ষ্মতর হবে সন্দেহাতীতভাবে। সরল বর্ণনায় অলঙ্কারশাস্ত্রের চমৎকার ব্যবহার তার গদ্যকে ঋদ্ধ হতে সহায়তা করবে। লেখক তার বইটিকে 'নির্ঝর, তরঙ্গ, অববাহিকা ও কোলাহল' এই ৪টি পরিচ্ছেদে সন্নিবেশিত করেছেন। এগুলোর অধীনে গল্প বলতে গিয়ে তিনি যেসব শিরোনাম ব্যবহার করেছেন সেগুলো এমন চমৎকার ও শ্রুতিমধুর যে, পাঠকমাত্রই বইটি গোগ্ৰাসে গিলতে চাইবে। পরিচ্ছেদগুলোর নামকরণে লেখক দারুণ বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন। শব্দগুলোর বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়— 'নির্ঝর' অর্থ ঝরনা বা পর্বত হতে বেগে ধাবিত জলপ্রবাহ। 'তরঙ্গ' মানে জলের ঢেউ। 'অববাহিকা' অর্থ নদীর দুই তীরের ঢালু ভূমি, যেখান থেকে জল নদীতে এসে পড়ে। আর 'কোলাহল' মানে অনেক লোকের উচ্চরব বা হৈ হুল্লোড়। লেখক তার অভিজ্ঞতায় টইটম্বুর জীবনকে সাদৃশ্য দিয়েছেন সুস্থির পর্বত বা পাহাড়ের সঙ্গে। এরপর অভিজ্ঞতার ঝুলি থেকে বেছে বেছে সেরা ঘটনাগুলো বর্ণনা করেছেন পাহাড়ের বুক চিরে গড়িয়ে পড়া স্বচ্ছ জলের শীতল ঝরনার মতো। বইয়ের পাতায় লিপিবদ্ধ এসব ঘটনা পাঠক-হৃদয়ে তোলে ভালোলাগার ঢেউ। এ পাঠ-অভিজ্ঞতা অববাহিকারূপে তার পূর্বের চেয়ে পরের-জীবনকে সমৃদ্ধ করে সুনিপুণভাবে। ফলে হাজার মানুষের কোলাহলেও সে হারিয়ে যায় না, বরং স্বতন্ত্র উচ্চতায় দৃশ্যমান থাকে মজবুতভাবে! • 'নির্ঝর' পরিচ্ছেদ-এর অধীনে লেখক ১৭টি শিরোনামে প্রায় ৮৭ পৃষ্ঠা ব্যাপী তার বর্ণিল স্মৃতিকথা, বিচিত্র জীবনবোধ, স্মৃতিকাতরতা, ভাতৃত্বের মূল্যবোধ, আত্মার টান ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা করেছেন। এগুলো পাঠককে অবশ্যই মোহিত করবে। যদিও লেখক বয়সে তরুণ হওয়ার দোহাই দিয়ে এগুলোকে ঠিক স্মৃতিকথা বলতে নারাজ। • 'তরঙ্গ' পরিচ্ছেদ-এর অধীনে এসেছে ছোট-বড় ১৪টি লেখা। শব্দ বাক্য ও ভাষা তার মন ও মননকে কীভাবে আন্দোলিত করে— প্রায় ৪৭ পৃষ্ঠা ব্যাপী তিনি এর বর্ণনা দিয়েছেন নিজস্ব ঢঙে। এসব বর্ণনা পাঠকের হৃদয়ে দাগ কাটবে নিঃসন্দেহে। যদিও লেখক অভিযোগ করেছেন, 'আমি কবি নই বলে শব্দ আমাকে প্রতারিত করেছে বহুবার'। • 'অববাহিকা' পরিচ্ছেদ-এর অধীনে রয়েছে ১৫টি বয়ান। চমৎকার সব শিরোনামের বয়ানগুলোতে পাঠক জানতে পারবেন তার সহজ জীবনদর্শনের নানান টুকরো চিন্তা ও অভিজ্ঞতা, সমাজ ধর্ম ও দেশ-সংক্রান্ত চৈতন্য ইত্যাদি। প্রায় ৪৯ পৃষ্ঠা ব্যাপী এসব বয়ান তিনি করেছেন একদম সরল বাক্যে। এ সম্পর্কে লেখক বলেছেন, 'আমি দার্শনিক জটিল আলোচনার উপযোগিতা ও যথার্থতাকে অস্বীকার করি না, কিন্তু সবসময় চেয়েছি সাদামাটা জীবনের ভেতর থেকে আমি যেন সেই সরল বাক্যটিকে সহজেই খুঁজে পাই। এজন্য জীবনের দিকে চোখ ফেলে বসে থাকি, তাকিয়ে থাকি বুভুক্ষুর মতো।' • সর্বশেষ পরিচ্ছেদ 'কোলাহল' এর অধীনে এসেছে ছোট ছোট ৯টি লেখা। প্রায় সবগুলো লেখাই শিশুদের নিয়ে। কোমলমতি শিশুদের প্রতি লেখকের যে প্রীতি ও ভালোবাসা তা তিনি প্রকাশ করেছেন মমতার হরফে, খুব সচেতনভাবে। লেখক মনে করেন, শিশুদের জীবনটি সুদীর্ঘ কবিতার মতো । বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রূপে একে আবিষ্কার করা যায়। মুক্তোদানার মতো শিশুদের ছোট ছোট কথা, শিশিরমাখা চাহনি, কোমল আবেগ, হৃদয়ের আকুলতা, ঠোঁটভাঙা অভিমানের ফিরিস্তি তিনি তুলে ধরেছেন শেষের ২২ পৃষ্ঠায়। তার মতে, 'শিশুদের এই সমস্ত কিছু আমাদের জীবনে স্বর্ণরেনুর মতো ছড়িয়ে থাকে, ফুলের পাপড়ির মতো সুগন্ধ ছড়ায়। •• মানবীয় দুর্বলতার কারণেই হয়তো বইটির কিছু বিষয় কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে। যেমন, বইটির প্রকাশকাল লেখা হয়েছে মে ২০২১! বইয়ে সুনসান এবং সুনশান—দুই রকমের বানানের দেখা মিলেছে। কয়েকটি জায়গায় বর্ণ মিসিং এবং একই শব্দের পুনরুল্লেখ হয়েছে। আর চন্দ্রবিন্দু বেশ কিছু জায়গায় বর্ণের উপর না বসে স্বরচিহ্নে বিশেষকরে আকার-এর উপর বসেছে। আশা করি যথাযথ কর্তৃপক্ষ বিষয়গুলোর প্রতি সুদৃষ্টি দেবেন। •• সাবের চৌধুরীর লেখার সঙ্গে আমার পরিচয় প্রায় ৭/৮ বছর আগে। লিটলম্যাগ 'পরাগ' এ বৃষ্টি-সংক্রান্ত একটি লেখা পড়েই তার লেখনীর প্রতি দুর্বল হয়ে যাই। পরবর্তীতে পরাগ মারফতই তার বেশ কিছু লেখা পড়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। এসময় আমি লক্ষ করেছি—প্রতিনিয়ত নিজেকে ভেঙে তিনি গড়ছেন! এরই মধ্যে নিজস্ব একটি রচনারীতিও তিনি দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছেন। সবশেষ 'জীবনে রোদ্দুরে' বইটি পড়ার পর এটি আরও ভালোভাবে উপলব্ধ হলো। সাবের চৌধুরী এগিয়ে যাক এবং অগণন কালজয়ী লেখা আমাদের উপহার দিক—এই কামনা করি। জয়তু সাবের চৌধুরী! •• ব্যক্তিগত রেটিং: ৮/১০ সাহিত্যমান, বিষয়বস্তু, উপস্থাপনা, নামকরণ, প্রয়োজনবোধ ইত্যাদি বিবেচনায় বইটিকে অনায়াসেই দশের মধ্যে আট দেওয়া যায়। আর ভাবনার পরিশীলতা, চিন্তার গভীরতা, সুস্থ রুচিবোধ ও অলঙ্কারশাস্ত্রের যথার্থ প্রয়োগের কারণে বইটিকে অবশ্যপাঠ-এর তালিকায়ও রাখা যায় নির্দ্বিধায়। ___________ বই: জীবনে রোদ্দুরে লেখক: সাবের চৌধুরী ক্যাটাগরি: মৌলিক ধরন: মুক্তগদ্য প্রকাশক: পুনরায় প্রকাশন প্রচ্ছদ: কাজী যুবাইর মাহমুদ প্রকাশকাল: মে ২০২২ পৃষ্ঠাসংখ্যা: ২২৪ বাঁধাই: পেপারব্যাক মুদ্রিত মূল্য: ৩৩৪৳
Was this review helpful to you?
or
এই বই সম্পর্কে কিভাবে উচ্ছাস প্রকাশ করব -এর ভাষা জানি না, তবু এটুকু নির্দ্বিধায় বলতে পারি, এই বছরে বাংলায় পড়া সেরা বই “জীবনে রদ্দুরে”। এতো শক্তিশালী গদ্য বারবার আমাকে হতাশাগ্রস্থ করেছে, এতো সুন্দর গদ্য মনে হবে, নিজে যে কথা বলতে পারি না, প্রকাশ করতে পারি না, লেখক সাবের চৌধুরী তাই অবলীলায় বলে যাচ্ছেন। অবশ্য গুরুগম্ভীর কিছু বিষয় লেখক আলোচনা করেছেন, তার সরল ভাষাশৈলী ও চলিত জীবনের যুক্তিসমেত উপস্থাপনায় বুঝেছি; কিন্তু ওটা পড়বার সময় মনে হয়নি আমার অব্যক্ত আলাপ চৌধুরী সাহেব করছেন; বরং সেটা একান্ত তার —আচ্ছা, শেষকথা যে কেউ বইটা আয়েশ করে পড়তে পারবেন। মাদরাসার ছাত্ররা ভাববেন, প্রতিটা লেখা হয়তো আমাকে লক্ষ করে অবতারণা, বাইরের মানুষ মাদরাসার ছাত্রদের চিন্তাচেতনা ও তাদের যাপিত জীবনের স্পর্শ পাবেন। এছাড়া সামাজিক ও ধর্মীয় নানাদিক তো আছেই।
Was this review helpful to you?
or
এক ঘোরমেশানো ভালোলাগা নিয়ে সাবের চৌধুরীর 'জীবনে রোদ্দুরে' বইটি পড়ে শেষ করলাম। দীর্ঘদিন ধরে ইতিহাস, দর্শন, সমাজনীতি আর রাজনীতি বিষয়ক বই পড়তে পড়তে ক্লান্ত পথচারীর মতো কেমন হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। ঠিক সেই মুহূর্তে 'জীবনে রোদ্দুরে' একটু জিরিয়ে নেয়ার অবকাশ এনে দিলো; কেমন যেন একটা শীতল পরশ বুলিয়ে দিলো সারা দেহমনজুড়ে। অনেকেই ভাববেন—আমি হয়ত প্রশংসার ডালি নিয়ে বসেছি। কিন্তু বাস্তবতা হলো, বইটি নিয়ে যতই আলোচনা করি না কেন—তা যথেষ্ট হবে না। হয়ত বহুদিন বাদে এরকম ঝরঝরে গদ্য পড়ছি বলেই ভালোলাগার পরিমাণ একটু বেশিই। 'জীবনে রোদ্দুরে' বইটিকে ঠিক কোন্ ক্যাটাগরিতে ফেলা যায় তা নিয়ে আমি অনেক ভেবেছি। তবে ভাবনারা ঠিকমতো তল খুঁজে পায়নি কিছুতেই। কখনও মনে হয়েছে—এটা তো সাবের চৌধুরীর আত্মজীবনী। কারণ, পুরো বইজুড়ে তাঁর নিজের গল্পগুলো মুক্তোর দানার মতো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। আবার মনে হয়েছে—এটা তো প্রবন্ধের বই। এমন অনেক বিষয় এই বইয়ে স্থান পেয়েছে, যা নিয়ে অনায়াসেই গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ রচনা করা সম্ভব। তবে এখানে কোনো কপট গাম্ভীর্য দেখতে পাইনি। বরং এক ধরনের সহজ-সরল সর্বজনবোধ্য ভাষায় অনেক জটিল বিষয় নিয়ে আলাপ হয়েছে। মোটকথা, এই বইয়ের মূল আকর্ষণ হলো এর সাবলীল গদ্য। তা না হলে একজন পাঠক হিসেবে অতি অল্প সময়ে এতটা পথ পাড়ি দিতে পারতাম না। • সাবের চৌধুরীর উস্তাদ এবং আমার অন্যতম প্রিয় একজন লেখক মুহাম্মদ যাইনুল আবেদীন বইটি নিয়ে ছোট্ট অথচ গুরুত্বপূর্ণ একটি মতামত দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, 'সাবের একই সঙ্গে চঞ্চল এবং খেয়ালি। ফলে তার সৃষ্টিশীলতায় জীবনের বাস্তবতা এবং কবির কল্পনা গলাগলি ধরে ঢেউ ভাঙ্গে।' এই মূল্যায়ন আমাদের কাছে এজন্য গুরুত্বপূর্ণ যে—একজন পাঠক বইটি পড়তে গিয়ে পাতায় পাতায় এর বাস্তব নমুনা দেখতে পাবেন। এমন অনেক সিরিয়াস বিষয়ও তিনি কাব্যের ঢঙে উপস্থাপন করেছেন। ফলে পাঠ করতে গিয়ে পীড়াদায়ক কিছু মনে হয় না। মনে হয়—যেন নরম মখমলের ওপর দিয়ে পথ চলছি! বাক্যের গঠন ও চিন্তাশৈলী দেখেও মনে হয়েছে—যেন কবিতার বইই পড়ছি! সাবের চৌধুরী প্রথম দিকে কিছুটা দুঃশ্চিন্তায় আক্রান্ত ছিলেন কি? আমার কাছে শুরুর দিকের কিছু অংশ সামান্য এলোমেলো মনে হয়েছে; যেন গান শুরু করার আগে ঠিক তালটা খুঁজে পাচ্ছেন না। অথবা ফুটবল মাঠে বলের দখল নিয়ে একটা বিশৃঙ্খল ভাব বিরাজ করছে। তবে খুব দ্রুতই তিনি বলের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেয়েছেন। প্রথম অধ্যায়ের দ্বিতীয় পরিচ্ছদে গেলেই পাঠক মূল ব্যাপারটি ধরে ফেলতে পারবেন। তখন আর কোনোকিছু এলোমেলো লাগবে না। সাবলীল গদ্য টানটান উত্তেজনায় ধরে রাখবে শেষ অবধি। • নির্ঝর, অববাহিকা, তরঙ্গ, কোলাহল—শিরোনামগুলো থেকে এক অসাধারণ দ্যুতিছড়ানো কাব্যময়তা প্রকাশ পেয়েছে। পাঠকের কাছে এই শব্দগুলো তারুণ্যের ঝংকারের মতো মনে হবে। আবার এই শিরোনামের অধীনে যে বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে তাও সঠিকভাবে একে প্রতিনিধিত্ব করতে সক্ষম হয়েছে। নির্ঝর অর্থ হলো ঝর্ণা; যা পাহাড় থেকে নেমে এসে বয়ে চলেছে জমিনের বুক চিরে। যার চলার পথের অববাহিকা পানিতে সিক্ত হয়ে সবুজে ভরে উঠেছে। 'নির্ঝর'-এ মূলত সাবের তার শৈশবের স্মৃতিময় দিনগুলোর গল্প আমাদের শুনিয়েছেন। তার বৈচিত্র্যে ভরপুর শৈশবের গল্প শুনতে শুনতে আমিও যেন কল্পলোকে ভেসে হাজির হলাম আমার শৈশবে। আমিও প্রকৃতি খুব পছন্দ করি ছোটবেলা থেকেই। এখনও সুযোগ পেলে নেমে পড়ি সবুজ মাঠে, সময় পেলে বসে থাকি নদীর তীরে গিয়ে। সাবের তার শৈশবের পানসিতে চড়িয়ে আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে গেছেন তাঁর মমতাময়ী মায়ের কাছে, তাঁর মক্তবের দিনগুলোতে। তিনি আমাদের হাজির করেছেন তাঁর বালকবেলার মাদ্রাসায়, তাঁর হাসিমুখো বন্ধুদের সামনে। তিনি যে বাড়িটিতে লজিং থাকতেন, সেটা কি আমাদের চোখের সামনে এখন ভাসছে না? তরঙ্গ হলো ছন্দ, স্পন্দন, ঢেউ। এটা কিসের স্পন্দন—জীবনের? আমার তো সেটাই মনে হলো। একজন মানুুষ যখন শৈশবের দিনগুলো পেরিয়ে কিছুটা পরিণত হয়, তখন তার জীবনে সূচনা হয় এক অসাধারণ অধ্যায়ের। এ এমন এক সময়—যাকে শব্দের বৃত্তে বন্দী করে ব্যাখ্যা করা মুশকিল। এখানে লেখকের সঙ্গে আমাদের কথা হয় শব্দ নিয়ে, আমাদের সাহিত্য নিয়ে। ইসলামি সাহিত্যের বিষয়টি বিশেষভাবে উঠে এসেছে। লেখকের সঙ্গে আমি একটি বিষয়ে পুরোপুরি একমত হয়েছি এখানে এসে। তিনি মাদ্রাসাশিক্ষিতদের জন্য বাংলা সাহিত্যের মৌলিক বইগুলো পড়ার ওপর জোর দিয়েছেন। এতে ভাষাজ্ঞান পোক্ত হয়। একদম সঠিক কথা। মুসলিম পরিচয় নিয়ে সাহিত্যসাধনা করতে হলে এর তো কোনো বিকল্প দেখি না। 'অববাহিকা'য় এসে লেখকের চিন্তার জটিলতা উপলব্ধি করা যায়। একজন কবিও যেন তার স্বদেশ, সমাজ, ধর্ম নিয়ে চিন্তা করেন; তার সুসংহত প্রকাশ ঘটেছে এখানে। চিন্তা করার মতো কিছু টপিক আলোচিত হয়েছে এখানে। 'কোলাহল'—তা যদি হয় শিশুদের তাহলে এটা যেন জগতের সবচেয়ে মনোরম বিষয় হয়ে দেখা দেয়। যে সাবের চৌধুরীকে আমরা 'নির্ঝর'-এ শিশু হিসেবে পেয়েছিলাম, তিনিই 'কোলাহল'-এ এসে পিতা হয়েছেন; তাঁর ভেতরে জেগে উঠেছে এক অসাধারণ পিতৃস্নেহ। আমরা তাঁর ভেতরে থাকা একটি কোমল হৃদয়েরও সন্ধান পাই এখানে এসে। পুরো ব্যাপারটিকে আমরা এভাবে ভাবতে পারি—একটা চারাগাছ জন্মের পর ধীরে ধীরে বড় হলো। তার জীবনে এসে জমা হলো বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা। একদিন তার থেকে পাওয়া গেল নতুন, সজীব ফল। সে অনুভব করতে পারলো ফলের অস্তিত্ব। চারটি অধ্যায়ের মূল বিষয় এটিই মনে হলো। এর মানে সাবের চৌধুরীর গল্প এখনও শেষ হয়নি। আমরা আরও নতুন গল্পের জন্য অপেক্ষায় থাকবো। • 'আসলে অতি মুগ্ধতা মানুষকে কিছুটা নিয়ন্ত্রণহীন করে ফেলে।' সাবের চৌধুরীর এই কথা হয়ত আমাকেও পেয়ে বসেছে। হতে পারে সেজন্যই আলাপ করতে করতে এতদূর চলে এসেছি। এই মুগ্ধতার কিছু কারণও অবশ্য আছে। আমাদের সাহিত্য-সমাজে একটি কথা খুব জোর করে প্রতিষ্ঠা করে দেওয়া হয়েছে যে—মাদ্রাসার হুজুররা আবার সাহিত্যচর্চা করবে! এই নেতিবাচক ধারণার পেছনে হয়ত যৌক্তিক কিছু কারণও আছে। তবে অনেকদিন হলো এই অচলায়তন ভাঙতে আরম্ভ করেছে। মুহাম্মদ যাইনুল আবেদীনের লেখা পাঠ করে যে মুগ্ধতার সূচনা হয়েছিল, তাঁরই সাগরেদ সাবের চৌধুরী তাতে নতুন হাওয়া নিয়ে এসে হাজির হয়েছেন। আশা করি—তিনি এই মুগ্ধতার রেশ অনেকদিন ছড়িয়ে যাবেন। আমার সাম্প্রতিককালে পড়া বইগুলোর মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর প্রচ্ছদ হিসেবে কাজীদার এই কাজটিকে সেরা হিসেবে মেনে নেবো। হাতে নিয়েই মন ভরে যাওয়ার মতো একটি কাজ উপহার দিয়েছে পুনরায় প্রকাশন। তবে প্রতি পরিচ্ছদের শিরানামের ফন্টটি বড্ড চোখে লেগেছে। আরেকটু হ্যাংলাপাতলা হলে বোধহয় বেশি ভালো লাগতো। আর বইয়ের প্রকাশকাল লেখা হয়েছে ২০২১। হয়ত ভুলবশতই হয়ে থাকবে। বইটিকে বিশেষভাবে ভালোলাগার একটি কারণ হলো, অনেক সুন্দর ও দামী কিছু কথা রয়েছে। সেগুলো আমি ফাঁস করতে চাচ্ছি না। পাঠক নিজেই আবিষ্কার করতে পারবেন। তাছাড়া 'জীবনে রোদ্দুরে' আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে আমার শৈশবে। আমার মন বলছে, নামের মতোই সাবের চৌধুরীর বইটি পাঠকের হৃদয়ে রোদ্দুরের উত্তাপ ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হবে।
Was this review helpful to you?
or
লেখক সাবের চৌধুরীর জন্য অনেক শুভ কামনা। এই সিরিজের আরো বই চাই লেখকের কাছ থেকে।
Was this review helpful to you?
or
বাংলা সাহিত্যকে নতুনমাত্রা দিতে তৈরী হচ্ছে নতুন কালি ও কলম। তরুন আলেমেদ্বীন সাবের চৌধুরির লেখা "জীবন রোদ্দুরে"বইটি তা প্রমান করে।আলেমরাই হোক আগামীর সাহিত্যের কান্ডারি।
Was this review helpful to you?
or
পুরো বইটি লেখক সাজিয়েছেন মোট চারটি পর্বে— প্রথম পর্ব—তরঙ্গ : এতে আছে তার বিচিত্র বর্ণিল স্মৃতিকথা, স্মৃতিকাতরতা ও স্মৃতির সংশ্লেষ। দ্বিতীয় পর্ব—নির্ঝর : শব্দ বাক্য ও ভাষা তার চৈতন্যে যে আলোড়ন তোলে, এখানে মনোরম এক গদ্যে তিনি বলেছেন সেসব কথা৷ শব্দ ও কথা কীভাবে আমাদের জীবনকে ধারণ করে, পূর্ণ করে, ভাঙে ও বিশ্লিষ্ট করে এই অনুভব পাঠককে মোহিত করবে, এ কথা নিশ্চিত করেই বলা যায়। তৃতীয় পর্ব—অববাহিকা : এখানে আছে সহজ জীবন দর্শনের নানা টুকরো, চিন্তা ও অভিজ্ঞতা, দেশ ধর্ম ও সমাজ চেতনা। শেষ পর্ব—কোলাহল : কোমলমতি স্বর্গীয় শিশুদের নিয়ে লেখকের হৃদয় রাজ্যটি বড় মনোরম। তিনি মনে করেন একটি শিশু সত্যিকার অর্থে একটি জীবন্ত কবিতার মতো। আপন অভিজ্ঞতার আলোকে সেই অনুভব ও অবলোকনকে তিনি ব্যাখ্যা করেছে এখানে, পরম মমতায়, স্নেহে ও আকুলতায়।