User login
Sing In with your email
Send
Our Price:
Regular Price:
Shipping:Tk. 50
প্রিয় ,
সেদিন আপনার কার্টে কিছু বই রেখে কোথায় যেন চলে গিয়েছিলেন।
মিলিয়ে দেখুন তো বইগুলো ঠিক আছে কিনা?
Share your query and ideas with us!
Was this review helpful to you?
or
প্রযত্নে- হন্তা গল্পটা আর ১০টা গল্প থেকে আলাদা। সেই জন্য ভালভাবেই আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। বিশেষ করে বইয়ের ফ্ল্যাপে বই সম্পর্কে লেখাটা পড়ে আরও বেশি বইটা পড়ার আগ্রহবোধ করি। সচরাচর লেখক-সাহিত্যিকরা প্রাণপণ চেষ্টা করেন তাঁদের বইয়ের ফ্ল্যাপটা চটকদার কথাবার্তায় আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপন করতে যেন পাঠক মহাশয়-পাঠিকা মহাশয়া সেটা পড়ে ভিতরে ভিতরে পুরো বইটা পড়ার একটা তীব্র তাগিদ অনুভব করে। কিন্তু মজার ব্যাপার হল যে, এই বইটাতে এমন কোন চেষ্টাই করা হয়নি বরং যেন পাঠক-পাঠিকাদের নিরুৎসাহিত করা হয়েছে বইটি না পড়তে এবং এটা করতে গিয়ে আমার মনে হয়েছে উল্টো সাপে বর হয়েছে। নিরুৎসাহিত করাতে আমার উৎসাহ যেন আরও দ্বিগুণ বেড়ে গেছে গল্পটা পড়ার জন্য। প্রযত্নে- হন্তা গল্পটায় মোট ১০টা ছোট গল্প আছে। প্রতিটা গল্প ভিন্ন মাত্রার, ভিন্ন চরিত্রের, ভিন্ন পটভুমির ওপরে। তাই পড়ার সময় কখনই ধৈর্য্যচ্যুত হইনি। গল্পগুলো এমন যে ‘শেষ হইয়াও হইল না শেষ’ এইরকম একটা রেশ মনে রেখে দিয়ে যায়। একধরনের অপূর্ণ তৃপ্তি মনকে খোঁচায়। আরও মজার একটা বিষয় হচ্ছে প্রতিটা গল্পের শেষে ছোট করে একটা গল্পটিকা আছে। যেটাকে লেখক ‘গল্পের গল্প’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এটা থেকে জানতে পেরেছি লেখক ঠিক কোন সময় কোন পরিস্থিতিতে গল্পটা লিখেছিলেন। ফলে হয়েছে কি, আমি আরও বেশি গল্পের ভিতর ঢুকে যেতে পেরেছি, পেরেছি চরিত্রগুলোকে আমার আশেপাশে আবিষ্কার করতে। এই বইয়ের শেষে লেখকের পরিচিতি অংশটুকুও অন্যরকম। এখানেও একইভাবে এমন কিছু কথা লেখা আছে যা পড়ে আমার মত সাধারণ পাঠক-পাঠিকারা কম আশ্চর্য হবে না। যদিও আমি কোন বোদ্ধা পাঠিকা নই, তারপরও রকমারিতে ইউজার রিভিউ থাকায় নিজের ক্ষুদ্র অনুভুতিগুলো শেয়ার করতে ইচ্ছে হল। গল্পের লেখক মাহফুজ সিদ্দিকী হিমালয়কে আরও গল্প উপহার দিতে অসংখ্য অনুরোধ জানাচ্ছি। ধন্যবাদ। ফারজানা মোবিন একজন সাধারণ পাঠিকা
Was this review helpful to you?
or
প্রায় এক দশক ধরে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে ব্লগ। ব্লগ হয়ে উঠেছে নির্ভরযোগ্য এবং বিকল্প সাহিত্যমাধ্যম। অনেক তরুণ লেখক ব্লগকেই লেখালেখির প্রধান কিংবা একমাত্র মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছেন। আবার কেউ কেউ কাগজের পাশাপাশি ব্লগেও সমানতালে লিখছেন। ব্লগে লেখার সুবিধা হলো, এতে সরাসরি পাঠকপ্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়। অবশ্য শুধু ইন্টারনেটভিত্তিক এ-মাধ্যম সব শ্রেণির পাঠকের কাছে পৌঁছায় না। সমাজের অগ্রসর, মধ্যবিত্ত ও এর উপরের শ্রেণির মানুষরাই ব্লগ ব্যবহারকারী। একেবারেই নতুন এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলের পাঠকের কাছাকাছি পৌঁছার কোনো সুযোগ ব্লগ লেখকের নেই। কিছু সীমাবদ্ধতার কথা মেনে নিয়েও বলা এ বিকাশমান সাহিত্যধারার উপযোগিতা প্রচুর। লেখক লিখছেন, তারপর সরাসরি ব্লগে পোস্ট করছেন সেই লেখা পলকে পৌঁছে যাচ্ছে পাঠকের হাতে, আন্তর্জালিক দুনিয়ায়। মাঝখানে সম্পাদক ‘দেয়াল’টি না থাকায় সব লেখার সাহিত্যমান যথাযথ রতি হচ্ছে কিনা সেটা অন্য প্রসঙ্গ। চুলচেরা বিশ্লেষণে না গিয়ে, বিশাল সংখ্যক নবীন লেখক নিজেদের প্রতিভা বিকাশের সুযোগ পাচ্ছেন এটা ভেবেও আমরা আনন্দিত হতে পারি। প্রকাশের সীমাবদ্ধতা ব্লগে নেই, এটাও ইতিবাচক একটা দিক। কাগজের নির্দিষ্ট চরিত্র থাকে, চরিত্র অনুযায়ীই সব কিংবা ছোটকাগজ পরিচালিত হয়। সেদিক থেকে ব্লগ অনন্য এবং নির্ঝঞ্ঝাট। সামহয়্যারইনব্লগডটনেট’র একজন ‘নিরাপদ’ ব্লগার মাহফুজ সিদ্দিকী হিমালয়। দীর্ঘদিন যাবৎ ব্লগিং করছেন তিনি। নানা ধরনের লেখাই লেখেন। বাছাই করা, ব্লগে প্রকাশিত ১০টি গল্প নিয়ে সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে তার প্রথম গল্পগ্রন্থ প্রযন্তে- হন্তা। পাঠক একেবারে আনাড়ি না হলে এ-বই হাতে নিলে, পড়া শেষ না করে উঠতে পারবেন না। এমনই সম্মোহনী শক্তি রয়েছে বইটির। এ বইয়ের প্রায় প্রতিটি গল্পই ব্যতিক্রম, যা সাধারণ পাঠকের পাঠরুচির সাথে না-ও মিলতে পারে। আর এই না মেলাটাতে পাঠকের উৎসাহ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে, দ্রুত টেনে টেয় গল্পের গভীরে। এক্সপেরিমেন্টাল গল্প লিখতে পছন্দ করেন এ তরুণ লেখক, এটা তার গল্প পাঠ শুরু করলে বুঝে উঠতে সময় লাগে না। প্রযতে- হন্তা বইয়ের প্রথম গল্প ৪১। গল্পের নায়ক আরমান একদিন বেরিয়ে পড়ে অনির্দিষ্ট যাত্রায়। বাস থেকে নেমেই জড়িয়ে যায় নতুন এক গোলকধাঁধায়। এই চক্রের নাম ৪১। সংখ্যার সূত্র ধরে অনেকদূর এগোয় আরমান, ঘটনাচক্রে পড়ে না এগিয়ে তার উপায় থাকে না। বাস থেকে নেমে নিরুদ্দিষ্ট যাত্রার যাত্রী আরমান রিকশায় ওঠে। রিকশাঅলার সাথে কথোপকথনের মাধ্যমে নিজের অজান্তেই তার জীবনে ঢুকে যায় ৪১ নামক অধ্যায়টি। ব্যতিক্রমধর্মী একটি আশ্রমের গল্প এটি; যে আশ্রমের সবকিছুই ৪১ময়। কিছু খেয়ালী মানুষ নির্দিষ্ট ল্য এবং উদ্দেশ্যে পরিচালনা করছে আশ্রমটি। এর নেটওয়ার্ক বিশ্বজুড়ে। সাধারণ মানুষই এদের নিরীার দাবার গুটি। পৃথিবীর সব মানুষই কোনো না কোনোভাবে গিনিপিগ। এই দর্শন উঠে এসেছে গল্পের অন্যতম চরিত্র মনসুর মাজিদের সংলাপে- ...গিনিপিগের কথা বললে তো? শোনো প্রতিটি মানুষই সজ্ঞানে হোক, অবচেতনে হোক একে অন্যকে গিনিপিগ ভাবে। এই যে তুমি; তুমিও আমাকে তোমার গিনিপিগ ভাবছো নিজের মত করে।... সব মানুষের ভেতরই যে ঘাপটি মেরে আছে দ্বৈতসত্তা, এ দুটির সত্তার একটির নাম আলো রাখলে অন্যটিকে অবধারিতভাবে আঁধার ডাকতে হবে। অন্ধকার সত্তাটি বেশির ভাগ সময় ঘুমিয়ে থাকে অথবা সচেতনভাবে তাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়। তবু ফাঁক-ফোঁকর আর সুযোগ পেলেই সে বেরিয়ে আসতে চায়। লেখক এ-বিষয়টি মনোগ্রাহীভাবে উপস্থাপন করেছেন- মনের ভেতর আছে নগর, সেখানকার নাগরিকেরা কাঠামোবদ্ধ মানুষটিকে নিয়ন্ত্রণ করে; আবার মানুষটিও নিজস্ব রুচি মোতাবেক সেই নাগরিকদের একটা অংশকে কয়েদখানায় রাখে। বছরের সবকটা দিন চিন্তানগরের কুলীন নাগরিকেরা ভোগ করে, আজ নাহয় কয়েদিদের দিকেও একটু নজর দেয়া যাক! কয়েদি মানে মনের অন্ধকার দিকের বাসিন্দারা। যাদের বিবেকবান মানুষরা বন্দি করে রাখে। এমন অসংখ্য দর্শনঋদ্ধ বিশ্লেষণ লেখক ছড়িয়ে দিয়েছেন পাতায় পাতায়- শব্দে, লাইনে। যা পড়ার পর পাঠকের আলোড়িত না হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কেবলই মনে হয়- এমন তো পড়িনি আগে, এমন করে তো আর কেউ বলেনি! ডিজেইলিং, উপমা এবং ভাষার যে কারুকাজ লেখক রপ্ত করেছেন, সেটার সাথে তাল মেলাতে না পারলে পাঠকের চোখ-মন পাঠগতি হারাতে বাধ্য। তাও অজানা অন্ধকারে! লেখকের শক্তিমত্তার সাথে পাঠকেরও কিছু যোগ্যতা অর্জন জরুরি। নইলে ব্যাটে-বলে মেলাতে না পারার সমূহ সম্ভাবনা থেকেই যায়। ভালো লেখকের পাঠকও ভালো হওয়া জরুরি। জীবনযুদ্ধে পরাজিত একজন তরুণ কবির গল্প @ মনীষী সিনড্রোম। লেখালেখিতে সফলতা অর্জন স্বপ্ন দেখে অনেক সৃজনপ্রয়াসী তরুণ। বাংলাদেশের তরুণরা এক্ষেত্রে বিশ্বের অপরাপর তরুণদের চেয়ে এগিয়ে। কিন্তু শেষপর্যন্ত ক’জনই বা খুঁজে পায় স্বপ্নলোকের চাবি? ধনাঢ্য পরিবারের সন্তানরা এদিকটাতেই কমই ঝোঁকে। ঝুঁকলে এ কঠিন সাধনায় নিজেকে নিয়োজিত রাখার ধৈর্য কিংবা মতা তাদের অধিকাংশেরই থাকে না। যাদের জীবন ভরে থাকে পুষ্পপত্রে, তারা কেন স্বেচ্ছায় কাঁটার আঘাত সইতে যাবে! সঙ্গত কারণেই মধ্যবিত্ত এবং নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েরাই সাধারণত শিল্পাসাহিত্যচর্চায় তুলনামূলক অধিক উৎসাহী। কেউ কেউ লেখালেখি জীবনের একমাত্র ল্য হিসেবে নেয়। তারা পরিবার থেকে, সমাজ-সংসার থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে অন্য ভুবনের বাসিন্দা হওয়ার স্বপ্নে মশগুল হয়। অতিমাত্রায় যারা ঝুঁকে পড়ে এদিকটায়, বাস্তব অবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে- তাদের হোঁচট খেতেও বেশি সময় লাগে না। লক্ষ্মী এবং সরস্বতীর নাগাল একসাথে পাওয়া কষ্টসাধ্য। এই শ্রেণির শিল্পমনস্করা যখন ‘ভুল’ বুঝতে পারে, কিছু করার থাকে না আর। জীবন হয়ে ওঠে বিষাক্ত, স্বপ্নের কাছাকাছিও পৌঁছাতে না পারায় বেঁচে থাকাটাই কঠিন হয়ে ওঠে এদের কাছে। কঠিন বাস্তবতার ফেরে পড়া এই মানুষদের না হয় শিল্পসাধনা, না হয় জীবনসাধনা। রূঢ় সত্যের হৃদয় এফোঁড়-ওফোঁড় করা গল্প @ মনীষী সিনড্রোম। এ গল্পের নায়ক শরীফ মালিবাগের একটি হোটেলে কারো ফেলে যাওয়া একটি ডায়রি পায়। কৌতূহলবশত শরীফ আলগোছে ডায়রিটা নিয়ে আসে। ডায়রি পড়ে জানতে পারে কবি যশোপ্রার্থী হতভাগ্য এক তরুণের জীবনের কাহিনী। সেই কবি ডায়রি ফেলে দেয়ার পর আরো হাতবদল হয়, সেই ইতিহাসও অবিদিত থাকে না শরীফের। সে নিজেকেও এই ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে ফেলে। পূর্ববর্তীদের মতো সেও ডায়রিতে কিছু লিখে যেখানটায় কুড়িয়ে পেয়েছে সেখানে ফেলে আসার সিদ্ধান্ত নেয়। গল্পটিতে স্বপ্নবাজ মানুষের স্বপ্নভঙ্গের পাশাপাশি বিধৃত হয়েছে কঠিন বাস্তবতাও। লেখক কঠিন বাস্তবতা উপলব্ধি করতে পেরেই যেন বলেন- মানুষ এখন দিনভর ফোনে কথা বলে, আর বাকি সময় দেখে হিন্দি সিরিয়াল; বই পড়ে কয়জন। কিন্তু দেখো, প্রতিটি এলাকায় ২-১ ঘর পরপরই একজন কবির জন্ম হচ্ছে। বুঝলা সোহেল, আমি ভাই যেভাবেই হোক রেজিস্ট্রি অফিসের দলিল লেখকের কাজ পেয়ে কষ্টেশিষ্টে বেঁচে-বর্তে আছি, কিন্তু যত কবি বাড়ছে, এই অভাগা দেশে এতগুলো দলিল লেখকের পদ খালি আছে তো? লেখকের এ-কথার প্রেক্ষিত যেন একটা চপেটাঘাতের শব্দ হয়। কিন্তু কোথায় গিয়ে পড়ে এই চপেটাঘাত তাৎণিকভাবে অনুমান করা যায় না! এদেশ যে সৃজনশীল মানুষের জন্য উপযোগী নয়, তা ব্যঙ্গাকারেই যেন উচ্চারিত হয়। যে ব্যঙ্গে মিশে আছে কষ্ট, হৃদয়মথিত বেদনা। ৭দশ১’একাত্তর ১২ বর্গফুটের একটি রুমে বসবাসকারী তিন তরুণের গল্প। বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন তরুণ বন্ধু, তিন রুচির। তাদের ধ্যানজ্ঞান, পেশার ত্রেও ভিন্ন। তৈমুর আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে করা এই কাজে অর্থ আছে, কিন্তু সামাজিক স্বীকৃতি বা সম্মান নেই। তাই সে বাড়িয়ে ফার্মাসিটিকাল কোম্পানির চাকুরে হিসেবে পরিবারে নিজের ’পরিচয়’ প্রতিষ্ঠা করেছে। প্রিয়ম স্বপ্ন দেখে ভালো একটি সিনেমার বানানোর। এ ল্েয সিনেমার পরিচালকের সহকারী হিসেবে কাজও শুরু করে দিয়েছে। কিন্তু সেখানেও সে স্বস্তি পায় না। নানা কিছু, অসঙ্গতিগুলো পীড়া দেয় তাকে। অন্য অনেক ক্ষেত্রের মতো এখানেও বামনদেরই জয়জয়কার, অযোগ্যদের রামরাজত্ব। সে স্ক্রিপ্ট লেখে, কিন্তু ‘সত্যজিত রায় মার্কা’ স্ক্রিপ্টগুলো পাবলিক খাবে কি খাবে না, সেটা পরের কথা; প্রথমত পরিচালকরাই ‘খায়’ না। তবু সব অপমান সহ্য করে লেগে আছে পরিচালক হওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে। বাশার স্বপ্ন দেখে নামকরা লেখক হওয়ার। দিনদুপুরেই তার চোখে ভেসে ওঠে দূরের দৃশ্য- সুন্দরী পাঠকরা অটোগ্রাফের জন্য এগিয়ে আসছে! কিন্তু তার লেখনীর দুর্বলতা, সঠিক ‘লিংক’ ধরতে না পারা স্বপ্নপূরণের অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। তবু দমে না সে। স্বপ্ন দেখে সম্মুখে এগিয়ে যাওয়ার, পাঠক তার বই লাইন দিয়ে কিনছে- এই মধুর স্বপ্ন মনের ভেতর লালন করে। ভিন্ন ভিন্নমুখী জীবনযন্ত্রণায় অতিষ্ঠ, তিন রকম রুচি ও মানসিকতার তিন তরুণকে নিয়ে রচিত ৭দশ১’একাত্তর গল্পে মহান মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী মুক্তিযোদ্ধাদের জীবনসংগ্রামই মুখ্য হয়ে ওঠে। অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধার অবস্থা বর্তমানে শোচনীয়। কেউ ভিা করে, কেউ রিকশা চালায়- অনাহারে অর্ধাহারে দিন যায় তাদের। প্রান্তিক মানুষে পরিণত হওয়া মুক্তিযোদ্ধারাও বস্তিতে থাকে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে, মুক্তিযোদ্ধাদের নাম ভাঙিয়ে, সুযোগ মতো অনেকেই অনেক রকম ব্যবসা করছে। তিন তরুণও বুদ্ধি করে একটি ‘লাভজনক ব্যবসা’ করার উদ্যোগ নেয়। যে ব্যবসার মূলধন হিসেবে থাকবেন মুক্তিযোদ্ধারা। মুক্তিযুদ্ধকে কতজন কতভাবে পুঁজি করে কতকিছু করছে, তারাই বা পিছিয়ে থাকবে কেন। কিন্তু অনেকদূর এগিয়েও শেষ পর্যন্ত তারা আর ‘ব্যবসা’টা করতে পারে না। স্বার্থসিদ্ধির বদলে জেগে ওঠে মানবতাবোধ, সহমর্মিতা। এ গল্পের বিভিন্ন সংলাপ ও বর্ণনা প্রচণ্ডভাবে ঝাঁকুনি দেয়। এই ঝাঁকুনিতে মুক্তিযুদ্ধের নানান বিষয় চলে আসে পাদপ্রদীপের আলোয়- ভেতরে থাকা প্রিয়ম বাইরে দাঁড়ানো মহিউদ্দিনের ছেলের গজগজানিও শুনতে পেল। ‘বুইড়া মরেও না, ঘরও ছাড়ে না। কয়দিন পরপর মানুষ আসে, কিন্তু টাকাপয়সা দ্যায় না। মিষ্টি কথায় কি পেট ভরবো?’ মু্িক্তযোদ্ধারা যে মানবেতর জীবনযাপন করছেন, সঙ্গত কারণেই দেশ তথা সরকারের কাছে তাদের কিছু চাওয়া তৈরি হয়েছে। কিন্তু এই চাওয়া যখন পূরণ হয় না, তার ওপর ‘উটকো’ লোকের ‘অকারণ’ কৌতূহল নিয়ে আনাগোনা বাড়লে এরা বিরক্ত হতেই পারে। একজন অথর্ব মুক্তিযোদ্ধা মহিউদ্দিনকে তার ছেলে কটা করে যে কথা বলে, তাতে যেন অদৃশ্য একটা ঘাই অনুভব করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিশ্বাসীর মন। রাজাকারদের উত্থান এবং অর্থবিত্তপ্রতিপত্তি যেন মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নিষ্ঠুর এক রসিকতা। শেষ পর্যন্ত বাণিজ্যিক চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে তিন তরুণ সহায়সম্বলহীন মুক্তিযোদ্ধা মহিউদ্দিনের পাশে দাঁড়ায়। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়ে। ভিন্নস্বাদের, সংলাপবিহীন একটি গল্প লিখি চলো। চমকপ্রদ থিমের এ গল্প এগিয়ে গেছে প্রেমিকের উদ্দেশে উচ্চারিত (অনেকটা আত্মকথনের ভঙ্গিতে) এক তরুণের কথামালায়। এ গল্পে বর্ণিত হয়েছে লেখালেখির প্রাথমিক ধাপগুলো। কীভাবে একটি লেখা লিখতে হয়, আইডিয়া বা থিম কীভাবে আনতে হয়, কীভাবে নিরেট শব্দে করতে হয় প্রাণসঞ্চারÑ এমন টেকনিক দারুণ মুন্সিয়ানা উপস্থাপন করেছেন লেখক। যা লিখতে ইচ্ছুক নবীনদের কাজে লাগবে। লেখালেখি, সাহিত্যচর্চা নিয়ে আরেকটা গল্প পাঠক সমীপেষু। এক তরুণ গল্পকার তার বইয়ের ভিন্নধর্মী প্রকাশনা উৎসব করার জন্য আমন্ত্রণ জানান কয়েকজন বুদ্ধিজীবী, লেখক, অধ্যাপক, লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদক ও সাংবাদিককে। জনপ্রিয় সাহিত্য বনাম মূলধারা সাহিত্য বিতর্ককে উপজীব্য করে এগিয়ে যায় আলোচনা। মূল বিষয়টিই যে বাদ পড়ে যাচ্ছে, সেদিকে খেয়াল নেই কারো। দু’পরে সমর্থকই জোরালো এবং অকাট্য ভাষায় বক্তব্য রাখলেন। গল্পটিতে চমৎকারভাবে বিধৃত হয়েছে আমাদের লেখকদের নিচু মানসিকতা, গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল ধরনের আত্মম্ভরিতা, অহেতুক অহংবোধ, অন্যকে ছোট করে নিজেকে বড় হিসেবে জাহির করার প্রবণতাকে। বিশেষ করে লিটল ম্যাগাজিনের লেখক সম্পাদকরা দৈনিক এবং বড় কাগজের লেখকদের সস্তা-বাজারি সাহিত্যিক তকমা দিয়ে তাদের লেখক হিসেবে মান্যই করতে চান না। এদের সত্যিকারের সাহিত্যের জন্য তিকর হিসেবে বিবেচনা করেন। যদিও ‘বাজারি’ লেখকদের এসব নিয়ে বাড়তি কোনো এলার্জি নেই। এদের কেউ কেউ বাধ্য হয়ে মন্তব্য করেনÑ এটা হচ্ছে ব্যর্থদের প্রলাপ! এটা ঠিক, বিকল্পধারা বা মূলধারার দাবিদার লেখকদের পাঠকরা সেভাবে চেনে না, সঙ্গত কারণে বইও বিক্রি হয় কম। দুঃখজনক হলেও সত্য, ‘ছোট লেখক-বড় লেখক’ বাছাইয়ের মানদণ্ড হিসেবে বই বিক্রির পরিসংখ্যানকেই গণ্য করা হয়। ‘বাজারি’ লেখকদের লেখার বিষয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সহজ-সরল এবং বিজ্ঞাপনমুখী। অন্যদিকে মূলধারার দাবিদার লেখকদের বইয়ের বিষয় এবং বক্তব্য সাধারণ পাঠকের বোধগম্যতার বাইরে থেকে যায়। তাদের বইও যথাযথভাবে বাজারজাত করা হয় না। সব মিলিয়ে একটা দ্বন্দ্ব, নীরব সংঘাত দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। অধ্যাবধি এর সুরাহা হয়নি, ভবিষ্যতেও যে হবে তার কোনো সম্ভাবনা আপাতত দেখা যাচ্ছে না। গল্পলেখক দুই শ্রেণির সাহিত্যধারার প্রতিনিধিদের বক্তব্য চূড়ান্ত, অব্যর্থভাবে প্রয়োগ করেছেন। এই তর্কবিতর্কে লিপ্ত দুই শ্রেণির, দুই রকম মতে বিশ্বাসী লোক এক পর্যায়ে একে অপরের ওপর চড়াও হন। বিতর্ক কুতর্কে রূপ নিলে যা হয় আরকি। গল্পের শেষাংশ লেখক চমৎকার, সময়োচিত ইঙ্গিত দিয়ে শেষ করেছেনÑ কিন্তু রাস্তার জ্যাম, যানবাহনের শব্দ সবকিছু আগের মতই আছে। তাই কোন একদিন জারিফ নামের ৬-৭ বছরের ছোট্ট একটি শিশু যখন বাবার সঙ্গে বই কিনতে বেরিয়ে টি-শার্ট কিনে ফিরলে সেটিও আলাদা কোন ভাবনার খোরাক জোগায় না, যদিও প্রকৃতি তার নিজস্ব ডায়েরিতে লিখে রেখেছে যে জারিফ নামের শিশুটি বাবার সঙ্গে বই কিনতে যাবার পথে ছবির হাট নামক স্থানে প্রচণ্ড ভিড় দেখতে পেয়েছিল। ভিড়ের কাছে গিয়ে জানা যায় দু’দুল লেখক নিজেদের মধ্যে হাতাহাতি বাঁধিয়েছে। জারিফ তার বাবাকে ক্রমাগত প্রশ্ন করে গেছেÑ আচ্ছা বাবা, লেখকরা মারামারি করে কেন? বাবা সদুত্তর না পেয়ে বইয়ের বদলে ওকে টি-শার্ট কিনে দেয়াটাই সহজ সমাধান মনে করেছিল। সবাই এখন শুধু সহজ সহজ সমাধানের দিকে ছুটছে, লেখকেরাও সৃষ্টিশীলতার পরিবর্তে জনপ্রিয়-মূলধারা তর্কে সময় দিচ্ছে খুব, হয়তবা তর্কের জায়দা অদল-বদল হচ্ছে, পাত্র-পাত্রী পাল্টাচ্ছে; কিন্তু তর্ক চলছে, চলছেই...। মধ্যিখানে জারিফরা বইয়ের বদলে টি-শার্ট কিনতে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই! পাঠক, এ কী বলবেন বলুন। কেউ একজন অপোয় আছে এই ঠিকানায় ংধযরঃঃড়থহরবথশঁঃড়ৎশড়থপযধরহধ@নড়রঢ়ড়ৎঁহ.পড়স চমৎকার ইঙ্গিতধর্মী এ গল্পের জন্য লেখককে বিশেষ ধন্যবাদ না জানালেই নয়। স্যালুট দিতে হয় তার নিরপে অবস্থান এবং স্বচ্ছ চিন্তাকে। এ গল্পের শেষের দিকে সূè একটি আলোকপাত পুরোনো আশঙ্কাকে আবার নতুন করে মনে করিয়ে দেয়। একসময় বইপাড়া হিসেবে আজিজ সুপার মার্কেটের খ্যাতি থাকলেও বর্তমানে এটি হয়ে উঠছে কাপড়পাড়া। টি-শার্টের আগ্রাসনে দিন-দিন কমে যাচ্ছে বইয়ের দোকান। প্রকাশকরাও বিকল্প ঠিকানার খোঁজে বেরিয়ে পড়েছেন। কেউ কেউ ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছেন। প্রকাশনা সংস্থা এবং বইয়ের দোকান কমছে আজিজ সুপার মার্কেট থেকে, অন্যদিকে প্রতিনিয়ত বাড়ছে ফ্যাশন হাউসের সংখ্যা। শেষ পর্যন্ত টিকে থাকবে কী- বই নাকি পোশাক? উত্তরটা যদি বইয়ের প্রতিকূলে যায়, সেটা অবশ্যই কষ্টের বিষয় হবে কিন্তু এই বাস্তবতা অস্বীকার সুযোগই বা কই! বইয়ের অন্য গল্পগুলোও বিষয়বৈচিত্র্য এবং স্বাদে মনকাড়া। কোনো লেখকের প্রথম বই, এতোটা গোছানো ও সমৃদ্ধ- বিস্ময়কর বিষয়ই বটে। প্রতিটি গল্পেরই ‘গল্পের গল্প’ রয়েছে। সংেেপ লেখক বলেছেন সৃজনপ্রক্রিয়া এবং কীভাবে, কোত্থেকে গল্পের বীজ বাসা বেঁধেছিলো। লেখকের সব গল্পই বড় বড়। অবশ্য যেভাবে লেখক বিষয়ের গভীরে ঢুকে আদ্যপান্তের তত্ত্বতালাশ করেন তাতে পরিসর ছোট রাখারও সুযোগ নেই তেমন একটা। কোনো কোনো জায়গায় শব্দ প্রয়োগ খাপছাড়া মনে হয়েছে। পাশাপাশি এ-ও মনে হয়েছে ভাষার ব্যাপারে, শব্দের ব্যাপারে লেখক মাত্রাতিরিক্ত যত্নশীল। বইটি সুন্দর- কাগজ-ছাপা-বাঁধাই ঝকঝকে। প্রচ্ছদও মনকাড়া। কিন্তু ছোট কিছু ত্র“টি-বিচ্যুতি রয়ে গেছে। বোঝাই যায়, লেখক বইয়ের টেক্স সরাসরি ইন্টারনেট থেকে নিয়েছেন। মূল ওয়ার্ড ফাইল ব্যবহার না করে ইউনিকোডের লেখাগুলোকে কনভার্ট করেছেন কেবল। যার কারণে অনেক মাত্রা, চিহ্ন, শব্দে কিঞ্চিৎ গোলমাল দেখা দিয়েছে। অনেক যুক্তার ভেঙে কিম্ভুত শব্দে রূপ নিয়েছে। বানান ভুলের পরিমাণকেও কম বলার সুযোগ নেই। এদিকটায় আরো সতর্ক থাকা উচিত ছিলো। বাংলা কথাসাহিত্যে একজন তেজস্বী গল্পকারের আবির্ভাব হয়েছে, অনেকের অগোচরে। এটা যত তাড়াতাড়ি ‘কাগুজে’ পাঠকের গোচরীভূত হবে, তত তাড়াতাড়িই পাঠক নিজের পাঠক পরিচয়কে বিশেষ একটা মাত্রায় পৌঁছে দিতে দিতে সম হবে। অভিনন্দন গল্পকার মাহফুজ সিদ্দিকী হিমালয়। গল্পভুবনে আপনার রাশি-রাশি সোনা ছড়ানো অব্যাহত থাকুক। প্রযত্নে- হন্তা মাহফুজ সিদ্দিকী হিমালয় প্রকাশক : অন্যরকম প্রকাশনী প্রকাশকাল : অক্টোবর, ২০১১ প্রচ্ছদ : আইরিন সুলতানা দাম : ১৯০ টাকা
Was this review helpful to you?
or
জি এইচ হার্ডি, প্রখ্যাত ব্রিটিশ গণিতবিদ। প্রফেসরের কথায় কথায় অক্টোবরে হার্ডির সাথে পরিচয় হল গেল অক্টোবরে । বেশ কিছুদিন ধরে গণিতের সাথে আমার সম্পর্কটা কিছুটা লুকোচুরি মিশ্রিত বলে জনাবের নাম শুনে দু'চার পা অগ্রসর হওয়ার বদলে না চেনার ভান করে পিছনেই ফিরে রইলাম। নভেম্বরে জানলাম তার আরেকটি তথ্য । ১৯৪০ এ প্রকাশিত হয়েছিল তার বিরল এবং বিখ্যাত বই, যার নাম আমাকে অন্ত:ত বিস্মিত করে তুলল-- A Mathematician's Apology। বইটার পেছনে লেগে গেলাম প্রায় সাথে সাথেই। Apology তথা ক্ষমা কেন চাইবেন একজন গণিতবিদ? খানিকটা এগুনোর সাথে সাথে পরিস্কার হতে শুরু করল সবকিছু , ক্ষমা অর্থে Apology ব্যবহার করেননি তিনি , সারাজীবনে তার গাণিতিক কর্মকান্ডের পেছনে Justification/যৌক্তিকতাগুলো তিনি লিপিবদ্ধ করেছেন। জি এইচ হার্ডি সে কারণেই এখন আমার চোখে অন্যরকম কেউ। গণিতবিদের যেখানে কারও কাছে জবাবদিহিতা অপরিহার্য নয় ,সাহিত্যিকের বেলায় সেখানে যৌক্তিকতার বিশ্লেষণ আর আত্মসমর্থন অনেকাংশেই কাম্য । গল্প,কবিতা পড়ে পাঠক নিজের মত করে গল্পের গল্পসৌধ গড়ে , ছবি আঁকে , তবুও গল্পের পেছনে লেখকের গল্প জানবার তৃষ্ঞা কি তাতে কখনও লাঘব হয়? সেই না হওয়া ঘটনাটিই এবার ঘটল ।মাহফুজ সিদ্দিকী হিমালয়ের "প্রযত্নে-হন্তা" গল্পগ্রন্থটি পাবার সাথে সাথে পৃষ্ঠা উল্টে প্রতিটা যখন লেখকের Apology সম্বলিত "গল্পের গল্প" অনুচ্ছেদটি চোখে পড়ল , আগ্রহের পারদ তখনই আকাশ ছুঁয়েছে। Apology of a reviewer: একজন পাঠক হিসেবে আমার কিছু বৈশিষ্ট্য আছে , কারও দৃষ্টিতে সেটা সীমাবদ্ধতা মনে হলে আগাম দুঃখপ্রকাশ করে নিচ্ছি। প্রথমত , আমি সাহিত্যের ঠিক সমঝদার পাঠক নই , কিন্তু আমি অক্লান্তভাবে নতুনত্বের সন্ধানী। দ্বিতীয়ত, বেশিরভাগ গল্প যেখানে মূলত দাঁড়িয়ে থাকে ফিকশনকে আশ্রয় করে, সেখানে আমি কেবল সত্যাশ্রয়ী ঘটনাই বেশি করে খুঁজেই ক্ষান্ত হইনা, খানিক স্বার্থপরের মত আমি সব গল্পের মাঝে নিজের জীবনের প্রতিবিম্ব খুঁজি।সবকিছুর উর্ধ্বে উঠে ন্যায়বিচারক হয়ে উঠার চেষ্টাটা অনেক সময় শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়ে যায় আমার ব্যক্তিগত ভাললাগার দিকে অবচেতন পক্ষপাতের কারণেই । তৃতীয়ত, ভেতর থেকে নির্মোহ থাকার প্রবল একটা অনুভূতি আমাকে তাড়া করে ফেরে, নিরপেক্ষতা হন্তারক কোন উপাদান । লেখক এখানে আমার অনুজপ্রতীম , চেনা জানা , আর আমি পড়ছি তারই ছোটগল্পের একটি সংগ্রহ। তাই রিভিউ লেখার চিন্তাটা ছিল একান্তই দুরাশা। স্রষ্টা কিন্তু অন্যকিছু ভেবে রেখেছিলেন। বইটা হাতে নিয়ে উল্টো করে শেষ গল্পটা দিয়ে শুরু করলাম যখন, দ্বিতীয় আর তৃতীয় আশংকার মৃত্যুতে সময় লাগল না। এক "পাঠক সমীপেষু" গল্পের বিল্ড-আপটা বেশ তাৎপর্যবহ । সমসাময়িক প্রকাশিত উপাদানগুলোকে সংকলিত করে চলমান এক বিতর্কের নতুন করে সূত্রপাত ঘটে দু'দল লেখকের মাঝে। গল্পাশ্রয়ী, উপভোগ্য এ বিতর্কে ক্লান্তি আসে না এক মুহুর্তও , বরং দু'পক্ষের বহুলাংশে অকাট্য যুক্তির তোড়ে নিজের পুরনো বিশ্বাসের পেন্ডুলামরুপী কাঁটাটা টলে উঠে কেন যেন সাম্যাবস্থার চারপাশে স্থিতি পেতে চায়। পাঠক মানস বড় বিচিত্র ,বোধ করি ঠিক আমার মতই, এত উপভোগ্য বিতর্কেও খানিক পর আমি জয়-পরাজয়ের সন্ধানী হয়ে উঠি। বিতর্কের ফলাফল তবে কোথায় গিয়ে ঠেকবে , বাস্তব জীবনে বহতা এই তর্ক গল্পের ফ্রেমেও কি অস্পষ্টই থেকে যাবে কিনা সেসব নিয়ে কৌতুহল দানা বাঁধতে শুরু করে। গল্প ঠিক তখনই ভীষণ গতিতে আচমকা মোড় নেয় । টানটান উত্তেজনার আবহ ছড়ানোর পর চমক আসে , বাস্তবতার নিরীখে দশক বা যুগের বিতর্ক অসমাপ্ত রয়ে যাওয়ার ফাঁকে চাপা পড়ে যাওয়া তৃতীয় কোন সম্ভাবনার মৃত্যুর আকুতি বাজে খুব বেশি করে। ভীষণভাবে নাড়িয়ে যাওয়া মেসেজটি গল্পের শেষ হওয়ার পরও দীর্ঘ সময় ভাবায় । আমার মাঝের পাঠক সত্ত্বা তখন মুগ্ধ, সদ্য জাগ্রত ভাবুক সত্ত্বা আক্রান্ত গভীর ভাবালুতায়। দুই A Very Long Engagement নামে একটা সিনেমা দেখেছিলাম বছর চারেক আগে। সিনেমাটিতে ভাল লাগার শত উপকরণ শুরুর দিকের একটা দৃশ্য এখনও চোখে আটকে আছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ফ্রন্টে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত পাঁচজন ফরাসী সেনা থিকথিকে কাঁদায় আটকে যাওয়া বুট ভীষণ সংগ্রাম করে টেনে টেনে সামনে এগিয়ে চলে। কোন অদৃশ্য অলঙ্ঘনীয় টানের অনুবর্তী করে, সে দৃশ্যটি আমাকে পুরো সিনেমাটি আদ্যোপন্ত দেখার প্রবল আকর্ষণে বেঁধে রাখে। এতগুলি দিন পর ঠিক একই রকম অনুভূতি ফিরে আসে ভিন্ন আবেশে, গল্প হয়ে। সেই নামে আটকে থাকা গল্পটির নাম "র্দাপ"। নাম উচ্চারণের সংগ্রামে করতে ব্যর্থতা ক্রমশ: সংক্রমিত হয় কৌ্তুহলে । শুধু গল্পের নামকরণের রহস্য থেকে যে কৌতুহলের সূচনা তার সমাপ্তি অপেক্ষা করে অসাধারণ মনস্তাত্ত্বিক স্বীকোরক্তি দিয়ে। মানসগ্রন্থের জটিলতম অধ্যায় "মন" নিয়ে র্দাপ এ চলে সংঘাত। গল্প যত এগোয় লাবণীকে ভীষণ চেনা লাগে , দু'চারবার ভাবতে হয় এ গল্পের মূল চরিত্র কি আমি নিজে ? তারপর একটা সময় লাবণী প্রতিস্থাপিত হয়ে যায় আমার নিজেকে দিয়ে ।গল্প এগোয় আমার নিজের মত করে , অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করি লাবণীর দ্বৈত সত্ত্বার সাথে তার নিজের মাঝে জেগে ওঠা দ্বিতীয় সত্ত্বা মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় । মানুষের এই দ্বিতীয় সত্ত্বা ভীষণ গোঁয়ার , প্রতিনিয়ত নানান রুপে প্রশ্ন তোলে তার সাফল্যকে নিয়ে।জগৎ যেখানে প্রশংসায় অকুন্ঠ , চারপাশের আর দশটা মানুষ যখন আমাকে নিয়ে খেদহীন নিশ্চিন্ত , আমার দ্বিতীয় সত্ত্বা বিবেকের আশ্রয়ে নিজের বিচ্যুতিগুলোকে ক্যানভাসে এঁকে নিজেকে অপরাধী করে তোলে। প্রশ্নের জওয়াব মেলে গল্পের একদম শেষ লাইনে এসে সম্পাদকের মৃদুহাস্য মিশ্রিত প্রশ্নে , "লাবণীরও একই সমস্যা?" লাবণী সেই মুহুর্ত থেকে আলাদা কেউ নয় , মানুষের মানসপটের প্রতিচ্ছবি। তড়িৎগতির স্লাইড শোর মত ঠিক তখনই পেছনে ফেলে আসা গল্পের অসাধারণত্বগুলো রং পেতে শুরু করে। লাবণীর আয়নায় "র্দাপ" কে আমরা পড়ি পর্দা , আয়নার মাঝে , দেয়ালের খাঁজে , পর্দার ভাঁজে স্পষ্ট করে দেখি আমাদের সমান্তরাল অস্তিত্বকে। সব মিলিয়ে র্দাপ দারুণ সফল তার প্রাঞ্জলতায়, বিকাশে , উপমা আর ভাষার ব্যবহারে। "র্দাপ" পড়ার পর থেকে আমার অবচেতন মন বিশ্বাস করতে শুরু করে ,আমি একাই সম্ভবত আমার মত করে ভাবছি না ।ঠিক করে ফেলি সুযোগ পেলেই ,নিজেকে এরপর থেকে ক্ষুদ্র "আমি"র বদলে বৃহত্তর পাঠক পরিচয়েই পরিচিত করব। তিন ঈশিতা একটি আমগাছ খুঁজেছিল গল্পটির স্বাতন্ত্র্য, মূলত এর বর্ণনা ভঙ্গীতে । "ঈশিতা আরেকবার সারারাত কেঁদেছিল ঐ ঘটনার ১৪ বছর পর -- খুব সাধারণ এই বাক্যটি গল্প শেষ হওয়ার আগে গল্পের সাথে পাঠকের সম্ভাবনাটির মৃত্যু ঘটায় । গল্পের ভাষ্যে সাধারণ অতীতের ব্যবহারে গল্পে যখন একটা ছন্দ আসে , গল্পটাকে তখণ কখনও কবিতার মত লাগে , কখনও বা ছবির মত লাগে। কিন্তু কবিতা বা ছবি গল্পের চেয়ে অনেক বেশি স্পর্শকাতর বলেই হয়ত একটা বিরাট সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত গল্পটি ছবির মত বা কবিতার মত গল্প হয়ে উঠে না। অনর্গল সুরেলা ভাষারীতির সামান্য বিচ্যুতি গল্পের কিছু জায়গায় সুর কেটে দেয়, অসাধারণ একটা ছবি ফ্রেমে আবদ্ধ হওয়ার সুযোগটি খানিকটা ফ্যাকাশে হয় । গল্পকারের ইচ্ছেটা অবশ্য তাতে মরে যায় না , পাঠকের ভাবনার উঠোনে শেষ বিকেলে বদলে যাওয়া সময়ের আলো ঠিকরে পড়ে। চার খ্যাতনামা ইরানী পরিচালক জাফর পানাহির দারুণ একটি সৃষ্টিকর্ম "মিরর" সিনেমাটি হয়ত পাঠকদের অনেকেরই দেখা। সে সিনেমার পুরোটা সেলুলয়েড জুড়ে বিস্ময়করভাবে চলে কেবল একটি সিনেমা বানানোর সংকল্পের ছবি। প্রশ্ন ওঠে সিনেমাকে কি সবসময় প্রথাগত সিনেমাই হতে হবে? আর দশটা সিনেমার মত তাতে প্রেম ভালবাসা, বিরহ , হাসি থাকতেই হবে ? একটু ঘুরিয়ে যদি বলি, আমরা কি প্রশ্ন করতে পারি না যে, গল্পকে কি শুধু গল্পই হতে হবে ? গল্প বাঁধার গল্প কি গল্প হতে পারে না? বোধ করি , পানাহি স্বয়ং "লিখি চলো" গল্পটির সুন্দরতম বিশ্লেষণটি করতে পারতেন । লিখি চলো প্রচলিত অর্থে গল্প নয়, এটি একটি গল্পের পরিকল্পনা , যার মাঝে গল্পকে ছাড়িয়ে যাবার সম্ভাবনা তৈরি হয়। ভীষণ মমত্ব ভরা বর্ণনায় যেখানে একটি গল্পের ভ্রুণের জন্ম দেয়া হয়। প্রচলিত রীতি-নীতি ভেঙে সূত্রের অমোঘ নিয়মে বন্দীত্ব বরণ করে গল্পকার গল্পের জন্মের প্রয়াস নেন। পারিপ্বার্শিক নানান উপাদান থেকে থেকে জন্ম নেয় বিচ্ছিন্ন উপাদান , গল্পের জীবন চক্রের নানান ধাপে আলোড়িত হয় , কখনও হয় সংকুচিত বা প্রসারিত। বিবর্তন চক্রে একটা সময় একটি গল্পের জন্ম হয় । অতঃপর লেখক গল্পের গল্পে ব্যাখ্যা করেন তার যৌক্তিকতা , কেন শুধু গল্পের খাতিরে এই গল্প নয় । এ গল্পটিতে বর্ণিত কাঠামো হটে পারে ভবিষ্যতের অনেক গল্পের সম্ভাবনা , অনেক গল্পের জনক এবং জননী । বইয়ের অন্য আর সবক'টি গল্পের চেয়ে এই গল্পটি অনন্য হওয়ার একটি কারণ হতে পারে গল্পটির পড়ার পর গল্প-শৈলীকে ছাপিয়ে গল্পের মাঝের উদ্যোগটি ঘিরে পাঠকদের মনে জেগে ওঠা প্রশ্ন ।ছাঁচে ফেলে এমন গল্প রচনায় গল্পের প্রাণ কি হারিয়ে যায় না? লেখকের হৃদয় নিঃসৃত অনুভূতির অবাধ প্রবাহের অভাবে এমনতর গল্প কি জরাগ্রস্থ স্রোতহীন হয়ে উঠতে পারে না? পাঁচ নামকরণ অনেকসময় প্রত্যাশার পারদ চড়িয়ে দেয়। পাঠক হয়ত সবচেয়ে বেশি সেটি অনুভব করবে 41 গল্পটিতে গিয়ে ।চিরায়ত ধারার ইতিহাস আশ্রয়ী গল্প একদিকে ৭১,২১ আর ৫২ কে দেয় অবারিত সুযোগ , অন্যদিকে মানবমনের অবচেতন একটি ধারা বড়জোড় খোঁজে , গল্পের নামে ১২ এর গুণিতক । কিন্তু , 41 কি করে তার নাম হয় ? সে প্রশ্নটির উত্তর খুঁজতে যাওয়াই গল্পের গভীর প্রবেশের মূল উদ্দীপনা যোগায় । গল্পের বিকাশের সাথে সাথে একটা সময় সায়েন্স ফিকশনের আবহের একটি সম্ভাবনা তৈরি হতে থাকে , তবে শেষ পর্যন্ত সেটা আর প্রধান উপজীব্য রয় না। গোধুলী লগ্নে মোবাইল সেটে এসএমএস এর প্লাবন আরমানকে যখন মুগ্ধ করে , তখন সবকিছু ছাপিয়ে নিগূঢ় মনস্তাত্ত্বিক বোধেরই প্রকাশ হয় । গল্প শেষে গল্পটির নামকরণে 41 প্রসঙ্গটি আরেকবার সামনে আসে , কিন্তু গল্পের ভেতরকার ব্যাখ্যা সত্ত্বেও নামকরণটি ঠিক গল্পের উপযোগী স্বার্থক হয়ে উঠতে পারে না। ছয় মনীষী সিন্ড্রোম গল্পটি নিঃসন্দেহে বইটির সৌকর্য বাড়িয়েছে । ডায়েরিকে পটভূমি করে অসংখ্য গল্প রচিত হয়েছে আজ অবধি , কিন্তু গল্পকার হয়ত দাবী করতেই পারেন তার গল্পে পাঠকের চিরাচরিত ধারণার বিপরীতে এমন কিছু উপাদান আছে যা হয়ত পাঠক আগে কোথাও দেখেনি। দু'টি মানুষের বিকাশ এবং বিবর্তনের স্বাক্ষী হয়ে রয় একটি ডায়েরি, সে পরিবর্তন ধরা পড়ে ডায়েরি পাঠক তৃতীয় একটি মানুষের চাহনিতে। একটা সময় ডায়েরি তৃতীয় মানুষটিকেও তার সত্ত্বার সাথে মিশিয়ে ফেলে , ডায়েরির সেই আবেদন অগ্রাহ্য করার ক্ষমতাটুকু তখন আর থাকে না। মানুষের মানসপটের ক্যানভাস চিরে নানান বর্ণের ব্যবচ্ছেদ করার লেখকের অসাধারণ ক্ষমতার পরিচয় মেলে এই গল্পে । সাত "একটি লাল পিঁপড়া একটি কালো পিপড়াকে অতিক্রম করে গেল--- গুরুত্ব বিচারে এটি কোন ঘটনাই নয় ।" গল্পের প্রথম বাক্যটি যদি শৈল্পিক বিচারের প্রধান মাপকাঠি হত , তবে পাঠকের দৃষ্টিতে নিঃসন্দেহে এগিয়ে থাকতো "গ,ল,হ; তবু গলগ্রহ" গল্পটি। একমাত্রিক একটি ধারাকে ঘিরে গল্পের প্রথমাংশের বিকাশ , তারপর আরেকটি আলাদা ডাইমেনশনের উদ্ভবের সাথে কিছু সময়ের জন্য প্রথম ধারাটি হারিয়ে যায়। একটা সময় দু'টো ধারা মিলিত হয়ে অভিন্ন লক্ষ্যে ছোটে , গল্পের শেষে দু'টো ধারা আবার দু'টো প্রবাহে আলাদা হয়ে যাবার সম্ভাবনা উঁকি দিলেও শেষ পর্যন্ত তা হয়ে উঠে না । সম্পর্কের বিস্তৃত জালে ,বিচিত্র মানব ভাবনায়, মানুষের সংকল্পের ভঙ্গুর অবস্থানটিকেই গল্পের সবচেয়ে মোক্ষম পরিপূরক মনে হয় । যদিও গল্পের শেষটা কেমন হতে পারত সেটা নিয়ে পাঠকদের নিজস্ব মতামতের অবকাশ খানিকটা রয়ে যায়, তারপরও গল্পের বর্ণিত দু'টো ধারার সমন্বয়গুলো বেশ মসৃণভাবে এগোয় বলে গল্পটি সুপাঠ্য । আট সাহিত্যে গল্পে, কবিতায় একাত্তর(৭১) এসেছে নানাভাবে , কিন্তু ৭দশ১’একাত্তর তারপরও আলাদাভাবে উল্লেখ করার দাবী রাখে। ৭দশ১’একাত্তর সুস্পষ্টতই একাত্তর নিয়ে প্রচলিত ধারার খোলস ভেঙে আসার দারুণ প্রয়াস। সে কাজটি করতে গিয়ে গল্পকারের মুনশিয়ানা চোখে পড়বার মত ।৭১ নিয়ে গল্পগুলো ঠিক যেখানে বাধা পড়ে থাকে ঠিক সেখানটাতেই গল্পে প্রথম আঘাত হানা হয় । ঘটনাগুলোর আবর্তনচক্র বর্তমান সময়কালে বলে , পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের উথান-পতন গল্পকার ঘটিয়েছেন সাম্প্রতিক বাস্তবতার সাথে সামঞ্জস্য রেখেই । গল্পটিতে একটি খুঁত অবশ্য আমাকে খুব বেশি ভুগিয়েছে -- সেটি হল ১২ বর্গফুট। ১২ বর্গফুটের একটি ঘরে কি আদৌ ৩ জনের থাকা সম্ভব ? নয় ছোটগল্পের স্বার্থকতা কি কেবল তার মিলনাত্মক বা বিরহাত্মক পরিসমাপ্তিতে ? ছোটগল্প কখনও বা সফল বা কখনও ব্যর্থ হয়, অসমাপ্ত রয়ে যাওয়াটাকেই কি সবসময় ব্যর্থতার সংজ্ঞা হিসেবে দাঁড় করানো যায়? এবার পরিপূরক কিছু প্রশ্ন করা যাক। ব্যর্থ হয়ে যাবার দেয়ার মানস থেকেই যদি জন্ম দেয়া হয় কোন গল্পের , তবে কেমন হত সেটা? চরিত্রগুলো সুচারুভাবে পুঙ্কানুপুঙ্খরুপে গড়ে তোলার পর লেখকের ভীষণ হেয়ালিতে যদি সেই কাঠামোটি গুঁড়িয়ে দেয়া হত তবেই বা কেমন হত ? আপাত কল্পনায় হয়ত আমরা পাঠকের কপালে বিরক্তিরেখা দেখি , মুখে দু'চারটি ক্ষোভ নিঃসৃত বাণী শুনি। কিন্তু অবাক ব্যাপার হল , অসমাপ্ত রেখে দেবার পরও "২৫ অক্টোবর" গল্পটি নিয়ে কোন ক্ষোভ জাগে না , বরং গল্প শেষ না করার পুরোটুকু স্বাধীনতা লেখককে দিতে ইচ্ছে হয় । আরেকটু যদি আশাবাদী কন্ঠে বলি , পাঠককে নিজের মনের মত করে গল্প গড়ে নেয়ার সুযোগ এর চেয়ে বেশি আর কোথায় পাওয়া যেতে পারে? তবে পাঠকের সে কাজটি সহজ করে দেয়ার স্বার্থেই হয়ত গল্পকার গল্পটি আরেকটি এগিয়ে নিতে পারতেন। তারপরও বলতে হয় , শুধুমাত্র চিন্তাধারার নতুনত্বের কারণে এ বইয়ের "২৫ অক্টোবর" গল্পটির ধারণাটি অনেকদিন মনে থাকবে। দশ কোন কিছুর ডিটেইলিং করা বেশ পরিশ্রমসাধ্য কাজ ।বইয়ের নামে যে গল্প "প্রযত্নে-হন্তা", সেখানে গল্পকার এই কঠিন কাজটিই করার জন্য ব্রতী।চারটি কেন্দ্রীয় চরিত্র , চারটি আলাদা জীবন , চারটি আলাদা প্রেক্ষাপট , চারটি আলাদা দৃষ্টিভঙ্গি, যেন চারটি সুদৃশ্য বক্ররেখা , যাদের উথান-পতন আছে , ছেদবিন্দু আছে, অথচ সমান্তরাল ধারায় তাদের বিকাশ লেখকের হাত ধরে। দীর্ঘ বিকাশ শেষে চারটি জীবনরুপী বক্ররেখা বারংবার পরস্পর পরস্পরকে ছেদ করে একটা বিন্দুতে এসে মিলে যায় , অদৃশ্য একটি নিয়তি বা শক্তির বাঁধনে নিজেদের জড়িয়ে ফেলে । গল্পে এক চরিত্র থেকে অন্য চরিত্রে বদলে যাবার মাঝে সংযোগবিন্দুগুলোর উপস্থাপন কৌশলটিও বেশ অভিনব । গল্পটি যে ধাঁচে গড়ে ওঠে ,নিঃসন্দেহে এটি বইয়ের সবচেয়ে কঠিন গল্পগুলোর একটি , সে কারণেই মনে হতে থাকে সংযোগবিন্দুগুলোকে মসৃণ রাখা ভীষণ দুরুহ। লেখক হয়ত তার হৃদয় নিংড়ে গল্পটির দেহে প্রাণ সঞ্চার করেন , কিন্তু পাঠকের চোখে নিখুঁত গল্পই আরও বেশি প্রয়োজন । তাই শিল্পগুণে উৎরে গেলেও গল্পটা কেন যেন সুপাঠ্য হয়ে ওঠে না । -- লেখার স্বার্থকতা তখন,যখন লেখকের নিজস্ব ভাল লাগাগুলো পাঠকের চাহিদার কাছে হারিয়ে যায় না । লেখার স্বার্থকতা তখন , যখন গতানুগতিক ধারার বাইরে লেখক নতুন কিছু পাঠকের জন্য সৃষ্টি করতে জানেন।আর তিনিই সফল লেখক যিনি উপরোক্ত স্বাতন্ত্র্য অক্ষুণ্ন রেখে পাঠকের ভাল লাগা / খারাপ লাগার মত আপেক্ষিক ব্যাপারটিকেও অতিক্রম করে পাঠক মন জয় করতে জানেন । গতানুগতিক এবং আপাত স্তিমিত সাহিত্যধারার সাম্প্রতিক প্রেক্ষাপটে এবং উপরোল্লিখিত বৈশিষ্ট্যগুলোর বিচারে "প্রযত্নে-হন্তা" পাঠককে নিঃসন্দেহে নতুন কিছু দিয়েছে। পাঠকের ভাল লাগা/খারাপ লাগার স্বাধীনতাটা না হয় পাঠকের কাছেই সংরক্ষিত থাকুক , কিন্তু একজন সৃজনশীল গল্পকার হিসেবে মাহফুজ সিদ্দিকী হিমালয়ের জন্য শুভকামনা রইল।
Was this review helpful to you?
or
প্রযত্নে হন্তা তরুণ গল্পকার মাহফুজ সিদ্দিকী হিমালয়ের প্রথম গল্পগ্রন্থ। হিসেবে বলতে গেলে তাঁর লেখক জীবনের প্রথম বই, এই প্রযত্নে হন্তা। যে কোনো তরুণ লেখকের কাছে জীবনের প্রথম বই- প্রতিভার সবটুকু ঢেলেও যদি প্রকাশিত হয়, তবুও আমপাঠকের গোচরে আসতে সেটির কিছুটা দেরীই হয়! একটু সময়ক্ষেপনের পর, অনেকদিন পার হয়ে যাবার পর হয়তো পাঠক সেটি পড়ে। পড়ে এবং কোনো পাঠ প্রতিক্রিয়া জানাতেও হয়তো ইচ্ছে করে না পাঠকের, জানালেও সেটি মূলধারার কোনো পত্রিকায়ও হয়তো আসে না। এই যে অবহেলা, এইযে অনাদর এটি লেখকের মনে বেদনার মত বাজবার কথা, লেখকের সমস্ত ভালোবাসা আর দরদ যেখানে জড়িত সেখানে এই অনাদর নীল কষ্টের মত বুকে ঝুলে থাকবার কথা। অভিমানের চোরাবালিতে আটকে গিয়ে হয়তো পরবর্তী লেখাটি লেখবার ইচ্ছেতেও ভাটা পড়ে লেখকের। পাঠক হিসেবে আমিও একজন আম পাঠক। প্রযত্নে হন্তা অন্যরকম প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে ২০১১ এর নভেম্বরে, আর আমি সদ্যই এটি পড়ার সুযোগ পেয়েছি। লেখার শুরুতে তাই তরুণ লেখকের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে, তবে, আলোচনায় প্রবেশ করছি। প্রযত্নে হন্তায় সম্পাদনার ত্রুটি লক্ষনীয়। প্রুফ রিডারের অযত্ন, ছাপাখানার ভুত বইটির প্রেজেন্টেশনকে বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। লেখক তরুণ হলেও তাঁর লেখার হাত চমকে দেবার মত বলে রক্ষে, না হয়, এই গ্রন্থ নিয়ে হতাশা ছাড়া অন্যকিছুই আমি প্রকাশ করতাম না। একটা সূচি জুড়ে দেয়া হয়েছে; কিন্তু তাতে কোনো পৃষ্ঠা নির্দেশক কিছু নেই, স্রেফ গল্পগুলোর তালিকা দেয়া। কোনো পাঠক নিদৃষ্ট একটি গল্প পাঠ করতে চাইলে পুরো বই হাতড়ে তবে সে গল্পের দেখা পাবে। এই ত্রুটিটি পীড়া দিয়েছে সবচেয়ে বেশি। বানানের, ছাপার ভুলের কথা আর বিস্তারিত না বললাম। আমি জানি, এগুলোর দায় লেখকের নয়, তাই প্রযত্নে হন্তার গল্প নিয়েই কথা বলা যাক। দশটি গল্প রয়েছে বইতে। প্রত্যেকটি গল্প নিয়ে লেখক নিরীক্ষা করেছেন। কোনোটি কোনোটির মতো নয়। প্রত্যেকটি গল্প কোন পরিস্থিতিতে রচিত হয়েছে সেটিও ফুটনোটের মতো করে জুড়ে দেয়া হয়েছে। এই অভিনব কাজটি গ্রন্থটির প্রতি, গল্পগুলোর প্রতি লেখকের তুমুল মনোযোগ নির্দেশ করে। দশটি গল্পের মধ্যে দার্প গল্পটি সবচেয়ে শক্তিশালী। মূলত গল্পটি পড়ার পর বইতে সন্নিবেশিত অন্য গল্পগুলোর আলোচনা একপাশে রেখে শুধু এটি নিয়েই বিশদ আলোচনা করার ইচ্ছে তীব্র হয়েছে। কাফ্কার মেটামোরফোসিস এ গল্পের নায়ক একদিন সকালে আবিস্কার করে, সে আরশোলা হয়ে গিয়েছে। দার্প- গল্পের শুরুতে বলা হচ্ছে, ‘কেমন হবে যদি হঠাৎ করেই মাথার উপর আরও তিনটি চোখের সৃষ্টি হয়, কিংবা জিহবার পরিবর্তে বাগযন্ত্র হিসেবে নাসিকা ব্যবহৃত হয়; সর্বোপরি মানুষগুলোও সবসময় ভূমির ১ফুট উপরের উচ্চতায় হেঁটে বেড়ায়?’ এখানে অবশ্য সম্ভাবনার কথা বলা হয়েছে, আর মেটামোরফোসিসের গ্রেগর সামসা প্রকৃতই আরশোলা হয়ে যায়। মাহফুজ সিদ্দিকীর লেখা দার্প গল্পটি কী সায়েন্স ফিকশন? অ্যাবসার্ড গল্প? গল্পটির গুরুত্বপূর্ণ শক্তি এর বক্তব্য। এর অন্তর্নিহিত ভাবটি। আর দূর্বল দিক এর গণিত এবং বিজ্ঞান সম্বন্ধীয় কথাবার্তাগুলো। গল্প পাঠকের সর্বজনীন অস্তিত্ব ম্বীকার করলে লেখকের দায়িত্ব ভাষা এবং শব্দকে পাঠকের কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া। টেকনিক্যাল ওয়ার্ডগুলো পাঠক না বুঝতে পারলে সে-দায় লেখককে কিছুটা নিতেই হবে! গল্পের প্রধান চরিত্র লাবণি। তার ব্যক্তিত্ব গড়ে উঠেছে একভাবে, তার কল্পনার জগৎ বেড়ে উঠেছে অন্যভাবে। সে দন্ত চিকিৎসক হবার জন্য লেখাপড়া করেও চাকুরী করে বেসরকারী চ্যানেলে খবর পাঠকের, কারণ মানুষের দাঁত দেখলে তার নোংরা লাগে। প্রতিষ্ঠা নাকী সুনাম? নাম নাকী শুধুই কাজ? কোনটি ব্যক্তির প্রায়োরিটি হবে? লাবণির বাস্তবতা হচ্ছে সে নামকেই প্রাধান্য দিচ্ছে, সে এবং তার পরিবার। আরো একটা চাওয়া লাবণির বাবা-মায়ের ছিল; মেয়েকে সংসারী দেখা। বাঙালি পরিবারে এইযে চাওয়া গুলোর প্রথামাফিক অনুসরণ, সেটি লেখক কৌশলে স্যাটায়ারের মতো করে তুলে দিয়েছেন। হঠাৎ করে লাবণি পর্দায় বিবেক নামক কোনোকিছুর অস্তিত্ব টের পায়। তার দুটো সত্বা ক্রমাগত নানা অসঙ্গতি নিয়ে কথা বলতে থাকে। একপর্যায়ে লাবণি টের পায় সে আসলে একজন ব্যর্থ মানুষ। এই ব্যর্থতা সে মেনে নিতে পারে না। সে সফলদের অমঙ্গল কামনা করে, এমনকি মৃত্যুও! অবচেতন মনে মানুষের চিন্তার গতিধারা কীভাবে প্রবাহমান হয় সেটি দার্প গল্পের মাধ্যমে লেখক চমৎকার ভাবে তুলে ধরেছেন। দার্প গল্প দিয়ে মানুষের জীবনের ত্রুটি-বিচ্যুতিকে লেখক কখনো তীর্যকভাবে, কখনো কৌশলে, কখনো হতাশার হাত দিয়ে, কখনো নির্মোহভাবে উঠিয়ে এনেছেন। মনীষী সিনড্রোম, গ্রন্থের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ গল্প। গল্পের প্রধান চরিত্রকে ধরা যাক গ। গ একটি ডায়েরি রীতিমত চুরি করে (তার চুরির বদভ্যাস আছে) বাড়িতে নিয়ে আসে। ডায়েরিটি ক,খ দুটি চরিত্র বিবেচনায়, ক এবং খ এর। গ ডায়েরিটি পড়ছে। ডায়েরি চতুর্থ ঘ কে গছিয়ে দেবার আগে (সে দৃশ্যপটে নেই, সে সম্ভাব্য) গ-ও কিছু কথা লিখে দ্যায়। ডায়েরিতে কী লেখা? এর উপজীব্য মূলত, জীবন এবং বাস্তবতা। সফলতা লাভের চেষ্টা এবং নোংরামো নিয়ে খেলার প্রচেষ্টা। মূলত সবই সিনড্রোম। বাকী গল্পগুলো নিরীক্ষার এক- একটি উদাহরণ। গল্প উপভোগের জন্য প্রযত্নে হন্তা পাঠককে পড়তে হবে, এবং গভীর আনন্দ অবগাহন নিজ দায়িত্বে করতে হবে।