User login
Sing In with your email
Send
Our Price:
Regular Price:
Shipping:Tk. 50
প্রিয় ,
সেদিন আপনার কার্টে কিছু বই রেখে কোথায় যেন চলে গিয়েছিলেন।
মিলিয়ে দেখুন তো বইগুলো ঠিক আছে কিনা?
Share your query and ideas with us!
Was this review helpful to you?
or
শিক্ষা বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ যে গভীরভাবে চিন্তা করেছেন তার পরিচয় নতুন করে দেবার প্রয়োজন পড়ে না। তাঁর নানা লেখায় এ-বিষয়টি বারবার জায়গা করে নিয়েছে অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই। এ ছাড়াও তাঁর লেখা শিক্ষা বইটির ২৩টি প্রবন্ধে এবং আরো বহু রচনায় শিক্ষার বহুবিধ আলোচনা স্থান পেয়েছে। বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ কর্তৃক প্রকাশিত ‘লোকশিক্ষা গ্রন্থমালা’র প্রথম বই বিশ্বপরিচয়ের পঞ্চম সংস্করণে (১৩৪৬ বঙ্গাব্দের পৌষ মাসে প্রকাশিত) ওই গ্রন্থমালা প্রকাশ প্রসঙ্গে তিনি উল্লেখ করেছেন : আমরা পর্যায়ক্রমে লোকশিক্ষা পাঠ্যগ্রন্থ প্রকাশের ভার গ্রহণ করেছি। শিক্ষণীয় বিষয় মাত্রই বাংলাদেশের সর্বসাধারণের মধ্যে ব্যাপ্ত করে দেওয়া এই অধ্যবসায়ের উদ্দেশ্য। তদনুসারে ভাষা সরল এবং যথাসম্ভব পরিভাষা বর্জিত হবে এর প্রতি লক্ষ করা হয়েছে, অথচ রচনার মধ্যে বিষয়ের দৈন্য থাকবে না, সেও আমাদের চিন্তার বিষয়। দুর্গম পথে দুরূহ পদ্ধতি অনুসরণ করে বহুব্যয়সাধ্য ও সময়সাধ্য শিক্ষার সুযোগ অধিকাংশ লোকের ভাগ্যে ঘটে না, তাই বিদ্যার আলোক পড়ে দেশের অতি সংকীর্ণ অংশেই। এমন বিরাট মূঢ়তার ভার বহন করে দেশ কখনোই মুক্তির পথে অগ্রসর হতে পারে না। যত সহজে যত দ্রুত এবং যত ব্যাপকভাবে এই ভার লাঘব করা যায় সেজন্য তৎপর হওয়া কর্তব্য। গল্প এবং কবিতা বাংলাভাষাকে অবলম্বন করে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। তাতে অশিক্ষিত ও স্বল্পশিক্ষিত মনে মননশক্তির দুর্বলতা এবং চরিত্রের শৈথিল্য ঘটবার আশঙ্কা প্রবল হয়ে উঠছে। এর প্রতিকারের জন্য সর্বাঙ্গীণ শিক্ষা অচিরাৎ অত্যাবশ্যক। রবীন্দ্রনাথ শিক্ষার প্রয়োজন সম্পর্কে যখন বলেছেন তখনই সর্বজনের শিক্ষা এবং সর্বাঙ্গীণ শিক্ষার ওপর বিশেষ জোর দিয়েছেন। কোনো একটি বা দুটি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠলেও সর্বাঙ্গীণ শিক্ষার অভাব যদি থেকে থাকে, তাহলে প্রকৃত শিক্ষার আলো মানুষের হৃদয়ে ও মনে প্রবেশ করতে পারে না। সেজন্যেই উপরিউক্ত লেখাটির মধ্যে তিনি বলেছেন : ‘বুদ্ধিকে মোহমুক্ত ও সতর্ক করবার জন্য প্রধান প্রয়োজন বিজ্ঞান- চর্চার।’ আর সর্বজনের শিক্ষার বিষয়টিও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ বলেই ‘লোকশিক্ষা গ্রন্থমালা’ প্রকাশের মূল উদ্দেশ্য ব্যক্ত হয়েছে তাঁর অপর একটি বাক্যে : ‘বলা বাহুল্য, সাধারণ জ্ঞানের সহজবোধ্য ভূমিকা করে দেওয়াই আমাদের উদ্দেশ্য।’ বিশ্বপরিচয় বইটি রবীন্দ্রনাথ উৎসর্গ করেছিলেন বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে। এতে ভূমিকাস্বরূপ ‘শ্রীযুক্ত সত্যেন্দ্রনাথ বসু প্রীতিভাজনেষু’ শিরোনামের যে-লেখাটি যুক্ত হয়েছে তাতে রবীন্দ্রনাথ এক জায়গায় লিখেছেন : … কিন্তু মানুষ আরযাই হোক সহজ মানুষ নয়। মানুষ একমাত্র জীব যে আপনার সহজ বোধকেই সন্দেহ করেছে, প্রতিবাদ করেছে, হার মানাতে পারলেই খুশি হয়েছে। মানুষ সহজ শক্তির সীমানা ছাড়াবার সাধনায় দূরকে করেছে নিকট, অদৃশ্যকে করেছে প্রত্যক্ষ, দুর্বোধকে দিয়েছে ভাষা। প্রকাশলোকের অন্তরে আছে যে অপ্রকাশলোক, মানুষ সেই গহনে প্রবেশ করে বিশ্বব্যাপারের মূল রহস্য কেবলই অবারিত করছে। যে- সাধনায় এটা সম্ভব হয়েছে তার সুযোগ ও শক্তি পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষেরই নেই। অথচ যারা এই সাধনার শক্তি ও দান থেকে একেবারেই বঞ্চিত হল তারা আধুনিক যুগের প্রত্যন্তদেশে একঘরে হয়ে রইল। রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশাতেই আধুনিক বিজ্ঞানের যুগান্তকারী আবিষ্কার ও উদ্ভাবনসমূহ সেকালের সাধারণ মানুষের চিন্তার জগৎকেও অভাবিতপূর্ব বিস্ময়ে প্রবলভাবে নাড়া দিয়েছিল। পাশ্চাত্যের শিক্ষাজগতে ও চিন্তাজগতে সে- আলোড়নের ছায়াপাত ঘটেছিল অনেকটা স্বাভাবিক-ভাবেই। ইউরোপে একাধিকবার ভ্রমণকালে রবীন্দ্রনাথ তা অনুভব করেছিলেন গভীরভাবে। অন্যদিকে ইংরেজের উপনিবেশ ভারতবর্ষে আধুনিক বিজ্ঞানের সঙ্গে নিবিড় ও ব্যাপক সংযোগ একেবারেই সম্ভব হয়ে ওঠেনি। ঔপনিবেশিক শিক্ষা-কাঠামোর মধ্যে তা হবার কথাও নয়। এই অনুভবকেই রবীন্দ্রনাথ প্রকাশ করেছেন বিশ্বপরিচয়ের সেই ভূমিকাস্বরূপ নিবেদনে : বড়ো অরণ্যে গাছতলায় শুকনো পাতা আপনি খসে পড়ে, তাতেই মাটিকে করে উর্বরা। বিজ্ঞানচর্চার দেশে জ্ঞানের টুকরো জিনিসগুলি কেবলই ঝরে ঝরে ছড়িয়ে পড়ছে। তাতে চিত্তভূমিতে বৈজ্ঞানিক উর্বরতার জীবধর্ম জেগে উঠতে থাকে। তারই অভাবে আমাদের মন আছে অবৈজ্ঞানিক হয়ে। এই দৈন্য কেবল বিদ্যার বিভাগে নয়, কাজের ক্ষেত্রে আমাদের অকৃতার্থ করে রাখছে। অবৈজ্ঞানিক মনকে বিজ্ঞানের যুক্তিনিষ্ঠতার পথে ধাবিত করানোর জন্যে প্রয়োজন শিক্ষা- কাঠামোর মধ্যে বিজ্ঞানশিক্ষার গুরুত্বকে যথাযথ মর্যাদা দেওয়া। তাতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিজ্ঞানশিক্ষার প্রতি আগ্রহ যেমন বাড়ে, তেমনি বিজ্ঞানশিক্ষার সুযোগও বেশি করে সৃষ্টি হয়। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা-কাঠামোর বাইরেও বিজ্ঞানশিক্ষার চর্চা চলতে পারে নানা উপায়ে। তার মধ্যে একটি হচ্ছে বৈজ্ঞানিক বিষয় নিয়ে লেখা রচনাদি পড়া। এজন্যে চাই মনের স্বাভাবিক কৌতূহল এবং বিভিন্ন বিষয় জানার ইচ্ছে। ক্লাসের পড়া হিসেবে যা পড়তে হয় তার প্রতি আকর্ষণের শক্তিটা প্রায়শ কমথাকে – এ কথা নতুন করে বলার প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু কৌতূহল নিবৃত্তির আনন্দহিসেবে যখন তার আবির্ভাব ঘটে, তখন আনন্দটাই মুখ্য হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর নিজের জীবনে বিজ্ঞানের প্রতি তাঁর আগ্রহের কথাটিও বর্ণনা করেছেন বিশ্বপরিচয়ের সেই পূর্বোক্ত লেখায়। আমি বিজ্ঞানের সাধক নই সে কথা বলা বাহুল্য। কিন্তু বালককাল থেকে বিজ্ঞানের রস- আস্বাদনে আমার লোভের অন্ত ছিল না। আমার বয়স বোধ করি তখন নয়- দশ বছর; মাঝে মাঝে রবিবারে হঠাৎ আসতেন সীতানাথ দত্ত মহাশয়। আজ জানি তাঁর পুঁজি বেশি ছিল না, কিন্তু বিজ্ঞানের অতি সাধারণ দুই- একটি তত্ত্ব যখন দৃষ্টান্ত দিয়ে তিনি বুঝিয়ে দিতেন আমার মন বিস্ফারিত হয়ে যেত। মনে আছে, আগুনে বসালে তলার জল গরমে হালকা হয়ে উপরে ওঠে আর উপরের ঠান্ডা ভারী জল নীচে নামতে থাকে, জল গরম হওয়ার এই কারণটা যখন তিনি কাঠের গুঁড়োর যোগে স্পষ্ট করে দিলেন, তখন অনবচ্ছিন্ন জলে একই কালে যে উপরে নীচে নিরন্তর ভেদ ঘটতে পারে তারই বিস্ময়ের স্মৃতি আজও মনে আছে। যে ঘটনাকে স্বতই সহজ বলে বিনা চিন্তায় ধরে নিয়েছিলুম সেটা সহজ নয়, এই কথাটা বোধ হয় সেই প্রথম আমার মনকে ভাবিয়ে তুলেছিল। তারপরে, বয়স যখন হয়তো বারো হবে (কেউ কেউ যেমন রঙকানা থাকে আমি তেমনি তারিখকানা এই কথাটি বলে রাখা ভালো), পিতৃদেবের সঙ্গে গিয়েছিলুম ড্যালহৌসি পাহাড়ে। সমস্ত দিন ঝাঁপানে করে গিয়ে সন্ধ্যাবেলায় পৌঁছতুম ডাকবাংলোয়। তিনি চৌকি আনিয়ে আঙিনায় বসতেন। দেখতে- দেখতে গিরিশৃঙ্গের বেড়া- দেওয়া নিবিড় নীল আকাশের স্বচ্ছ অন্ধকারে তারাগুলি যেন কাছে নেমে আসত। তিনি আমাকে নক্ষত্র চিনিয়ে দিতেন, গ্রহ চিনিয়ে দিতেন। শুধু চিনিয়ে দেওয়া নয়, সূর্য থেকে তাদের কক্ষচক্রের দূরত্বমাত্রা, প্রদক্ষিণের সময় এবং অন্যান্য বিবরণ আমাকে শুনিয়ে যেতেন। তিনি যা বলে যেতেন তাই মনে করে তখনকার কাঁচা হাতে আমি একটা বড়ো প্রবন্ধ লিখেছি। স্বাদ পেয়েছিলুম বলেই লিখেছিলুম – জীবনে এই আমার প্রথম ধারাবাহিক রচনা, আর সেটা বৈজ্ঞানিক সংবাদ নিয়ে। ‘মাঝে মাঝে রবিবারে হঠাৎ’ সীতানাথ দত্ত মহাশয়ের মতো ব্যক্তির আবির্ভাব এবং মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো পিতৃদেবের কাছে বসে আকাশের গ্রহ-নক্ষত্রের পরিচয় পাওয়ার সুযোগ পৃথিবীর সব শিশু কেন, অতি নগণ্যসংখ্যক শিশুর জীবনেও ঘটে না। রবীন্দ্রনাথের জীবনে তা ঘটেছিল। কিন্তু তিনি সেখানেই থেমে থাকেননি। পিতার কাছে যা শুনতেন ‘তখনকার কাঁচা হাতে’ তা নিয়ে ‘একটা বড়ো প্রবন্ধ’ও লিখেছিলেন। তার চেয়েও বড় কথা, বয়স আরো বাড়লে, ‘ইংরেজি ভাষা অনেকখানি আন্দাজে বোঝবার মতো বুদ্ধি’ খুলে গেলে, সহজবোধ্য জ্যোতির্বিজ্ঞানের বই সেখানে যত পেয়েছেন পড়তে ছাড়েননি। ‘মাঝে মাঝে গাণিতিক দুর্গমতায় পথ বন্ধুর হয়ে উঠেছে, তার কৃচ্ছ্রতার উপর দিয়ে মনটাকে ঠেলে নিয়ে গিয়েছি। তার থেকে একটা এই শিক্ষা লাভ করেছি যে, জীবনে প্রথম অভিজ্ঞতার পথে সবই যে আমরা বুঝি তাও নয়, আর সবই সুস্পষ্ট না বুঝলে আমাদের পথ এগোয় না এ কথাও বলা চলে না।’ রবীন্দ্রনাথ সেই তরুণ বয়সেই ‘সার্ রবার্ট বল্’, ‘নিউকোম্ব্স্’, ‘ফ্লামরিয়’ প্রভৃতি অনেক লেখকের জ্যোতির্বিজ্ঞান-বিষয়ক অনেক বই পড়ে ফেলেছিলেন। তারপর ‘সাহস করে’ পড়েছিলেন ‘প্রাণতত্ত্ব সম্বন্ধে হক্স্লির এক সেট প্রবন্ধমালা’। এই পড়াটার মাধ্যমে তিনি বিজ্ঞানের পন্ডিত হয়ে ওঠেননি, পান্ডিত্যের শক্ত গাঁথুনিও তাঁর মধ্যে ছিল না। ‘কিন্তু ক্রমাগত পড়তে পড়তে মনের মধ্যে বৈজ্ঞানিক একটা মেজাজ স্বাভাবিক হয়ে উঠেছিল। অন্ধবিশ্বাসের মূঢ়তার প্রতি অশ্রদ্ধা আমাকে বুদ্ধি উচ্ছৃঙ্খলতা থেকে আশা করি অনেক পরিমাণে রক্ষা করেছে। অথচ কবিত্বের এলাকায় কল্পনার মহলে বিশেষ যে লোকসান ঘটিয়েছে সে তো অনুভব করি নে।’ বিশ্বপরিচয় বইটি লেখার দায়িত্ব রবীন্দ্রনাথ প্রথমে দিয়েছিলেন শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ের বিজ্ঞানের অধ্যাপক প্রমথনাথ সেনগুপ্তকে। সত্যেন্দ্রনাথ বসুর বিশেষ স্নেহধন্য পদার্থবিজ্ঞানের মেধাবী ছাত্র প্রমথনাথ সেনগুপ্ত লেখা শেষ করার পর পান্ডুলিপিটি পড়তে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথকে। তিনি সেটি সংশোধন করতে শুরু করেন; আর সে-সংশোধন ছিল প্রধানত ভাষার। শেষ পর্যন্ত তার চেহারা আগাগোড়া বদলে গেল। নতুন করে বইটি লিখলেন রবীন্দ্রনাথ। লোকশিক্ষা গ্রন্থমালার প্রথম বই হিসেবে প্রকাশিত হলো সেটি (আশ্বিন ১৩৪৪)। মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে প্রকাশিত হয় এর দ্বিতীয় সংস্করণ (পৌষ ১৩৪৪)। পুনর্মুদ্রিত হয় একমাসের ব্যবধানে (মাঘ ১৩৪৪)। এবার ছয় মাসের ব্যবধানে প্রকাশিত হয় তৃতীয় সংস্করণ (শ্রাবণ ১৩৪৫)। তৃতীয় সংস্করণের ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন : যে বয়সে শরীরের অপটুতা ও মনোযোগশক্তির স্বাভাবিক শৈথিল্য-বশত সাধারণ সুপরিচিত বিষয়ের আলোচনাতেও স্খলন ঘটে সেই বয়সেই অল্প-পরিচিত বিষয়ের রচনায় হস্তক্ষেপ করেছিলেম। তার একমাত্র কারণ, সহজ ভাষায় বিজ্ঞানের ব্যাখ্যার ছাঁচ গড়ে দেবার ইচ্ছা আমার মনে ছিল। আশা ছিল বিষয়বস্ত্তর ত্রুটিগুলির সংশোধন হতে পারবে বিশেষজ্ঞের সাহায্যে। কিছুদিন অপেক্ষার পর আমার সে আশা পূর্ণ হয়েছে। কৃষ্ণনগর কলেজের অধ্যাপক শ্রীযুক্ত বিভূতিভূষণ সেন এবং বোম্বাই থেকে শ্রীযুক্ত ইন্দ্রমোহন সোম বিশেষ যত্ন করে ভুলগুলি দেখিয়ে দেওয়াতে সেগুলি সংশোধন করবার সুযোগ হল। তাঁরা অযাচিতভাবে এই উপকার করলেন, সেজন্য আমি তাঁদের কাছে অত্যন্ত কৃতজ্ঞ আছি। এইসঙ্গে পূর্ব সংস্করণের পাঠকদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করি। রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশাতেই বইটির পঞ্চম সংস্করণ প্রকাশিত হয় (পৌষ ১৩৪৬) এবং এ সংস্করণের অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত ভূমিকায় তিনি লেখেন, ‘এই গ্রন্থে যে-সকল ত্রুটি লক্ষগোচর হয়েছে সে সমস্তই অধ্যাপক শ্রীযুক্ত প্রমথনাথ সেনগুপ্ত বিশেষ মনোযোগ করে সংশোধিত করেছেন – তাঁর কাছে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করি।’ পরবর্তীকালে বিশ্বপরিচয়ের আর কোনো সংস্করণ প্রকাশিত হয়নি, কেবল পুনর্মুদ্রণ হয়েছে। এবং রবীন্দ্রনাথের রচনাসমগ্রের মধ্যে সেটি বিশেষ এক স্থানে আসীন রয়েছে সেই প্রথম প্রকাশকাল থেকেই। পাঠকপ্রিয়তায়ও এর অবস্থান যে মোটেই অনুল্লেখ্য নয় তার প্রমাণ – এই এতকাল পরও বইটি জ্ঞানপিপাসু ও বিজ্ঞানমনস্ক পাঠকদের কাছে মোটেই উপেক্ষণীয় হয়ে ওঠেনি। এর একটি বড় কারণ সম্ভবত এই যে, বইটি লেখার ভার ‘ক্রমশ সরে সরে’ রবীন্দ্রনাথের নিজের উপরেই এসে পড়ার মূলে ছিল ‘সহজ ভাষায় বিজ্ঞানের ব্যাখ্যার ছাঁচ গড়ে দেবার ইচ্ছা।’ সে- কাজটি তিনি যে করতে পেরেছিলেন তাতে সন্দেহ পোষণ করার মতো কারও দেখা আমরা এখনো পাইনি। কেমন সে ‘ব্যাখ্যার ছাঁচ’ তার প্রমাণ মিলতে পারে নিচের উদ্ধৃতিগুলো থেকেই। ১. যে নক্ষত্র থেকে এই পৃথিবীর জন্ম, যার জ্যোতি এর প্রাণকে পালন করছে, সে হচ্ছে সূর্য। এই সূর্য আমাদের চারদিকে আলোর পর্দা টাঙিয়ে দিয়েছে। পৃথিবীকে ছাড়িয়ে জগতে আর যে কিছু আছে তা দেখতে দিচ্ছে না। কিন্তু দিন শেষ হয়, সূর্য অস্তযায়, আলোর ঢাকা যায় সরে; তখন অন্ধকার ছেয়ে বেরিয়ে পড়ে অসংখ্য নক্ষত্র। বুঝতে পারি জগৎটার সীমানা পৃথিবী ছাড়িয়ে অনেক দূরে চলে গেছে। কিন্তু কতটা যে দূরে তা কেবল অনুভূতিতে ধরতে পারি নে। সেই দূরত্বের সঙ্গে আমাদের একমাত্র যোগ চোখের দেখা নিয়ে। সেখান থেকে শব্দ আসে না, কেননা শব্দের বোধ হাওয়ার থেকে। এই হাওয়া চাদরের মতোই পৃথিবীকে জড়িয়ে আছে। এই হাওয়া পৃথিবীর মধ্যেই শব্দ জাগায় এবং শব্দের ঢেউ চালাচালি করে। পৃথিবীর বাইরে ঘ্রাণ আর স্বাদের কোনো অর্থই নেই। আমাদের স্পর্শবোধের সঙ্গে আমাদের আর- একটা বোধ আছে – ঠান্ডা-গরমের বোধ। পৃথিবীর বাইরের সঙ্গে আমাদের এই বোধটার অন্তত এক জায়গায় খুবই যোগ আছে। সূর্যের থেকে রোদ্দুর আসে, রোদ্দুর থেকে পাই গরম। সেই গরমে আমাদের প্রাণ। সূর্যের চেয়ে লক্ষগুণ গরম নক্ষত্র আছে। তার তাপ আমাদের বোধে পৌঁছয় না। কিন্তু সূর্যকে তো আমাদের পর বলা যায় না। অন্য যে-সব অসংখ্য নক্ষত্র নিয়ে এই বিশ্বব্রহ্মান্ড, সূর্য তাদের মধ্যে সকলের চেয়ে আমাদের আত্মীয়। তবু মানতে হবে – সূর্য পৃথিবীর থেকে আছে দূরে। কম দূরে নয়, প্রায় ন কোটি ত্রিশ লক্ষ মাইল তার দূরত্ব। শুনে চমকে উঠলে চলবে না। যে ব্রহ্মান্ডে আমরা আছি এখানে ঐ দূরত্বটা নক্ষত্রলোকের সকলের চেয়ে নীচের ক্লাসের। কোনো নক্ষত্রই ওর চেয়ে পৃথিবীর কাছে নেই। (‘পরমাণুলোক’, বিশ্বপরিচয়) ২. পদার্থের মধ্যে অণুগুলি পরস্পর কাছাকাছি আছে একটা টানের শক্তিতে। তবু সোনার মতো নিরেট জিনিসের অণুরও মাঝে মাঝে ফাঁক আছে। সংখ্যা দিয়ে সেই অতি-সূক্ষ্ম ফাঁকের পরিমাণ জানতে চাইলে, তাতে মন পীড়িত হবে। প্রশ্ন ওঠে একটুও ফাঁক থাকে কেন, গ্যাস থাকে কেন, কেন থাকে তরল পদার্থ। এর একই জাতের প্রশ্ন হচ্ছে, পৃথিবী কেন সূর্যের গায়ে গিয়ে এঁটে যায় না, সমস্ত বিশ্বব্রহ্মান্ড একটা পিন্ডে তাল পাকিয়ে যায় না কেন। এর উত্তর, এই পৃথিবী সূর্যের টান মেনেও দৌড়ের বেগে তফাত থাকতে পারে। দৌড় যদি যথেষ্ট পরিমাণ বেশি হত তা হলে টানের বাঁধন ছিঁড়ে শূন্যে বেরিয়ে পড়ত, দৌড়ের বেগ যদি ক্লান্ত হত তা হলে সূর্য তাকে নিত আত্মসাৎ ক’রে। অণুদের মধ্যে ফাঁক থেকে যায় গতির বেগে, তাতেই বাঁধনের শক্তিকে ঠেলে রেখে দেয়। গ্যাসীয় পদার্থের গতির প্রাধান্য বেশি। অণুর দল এই অবস্থায় এত দ্রুতবেগে চলে যে তাদের পরস্পরের মিল ঘটবার অবকাশ থাকে না। মাঝে মাঝে তাদের সংঘাত হয় কিন্তু মুহূর্তেই আবার যায় সরে। তাদের পদার্থে আণবিক আকর্ষণের শক্তি সামান্য ব’লেই চলন-বেগের জন্যে তাদের মধ্যে অতি ঘনিষ্ঠতার সুযোগ হয় না। নিরেট বস্ত্ততে বাঁধনের শক্তিটা অপেক্ষাকৃত প্রবল। তাতে অণুর দল সীমাবদ্ধ স্থানের ভিতর আটকা পড়ে থাকে। তাই ব’লে তারা যে শান্ত থাকে তা নয়; তাদের মধ্যে কম্পন চলছেই, কিন্তু তাদের স্বাধীনতার ক্ষেত্র অল্পপরিসর। অণুদের মধ্যে এই চলন কাঁপন, এই হচ্ছে তাপ। অস্থিরতা যত বাড়ে গরম ততই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এদের একেবারে শান্ত করা সম্ভব হত যদি এদের তাপ তাপমানের শূন্য অঙ্কের নীচে আরো ২৭৩ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড নামিয়ে দেওয়া সম্ভব হত। (‘পরমাণুলোক’, বিশ্বপরিচয়) ৩. এখন এই মত দাঁড়িয়েছে, ইলেক্ট্রনের ডিম্বাকার চলবার পথ একটি নয়, একাধিক। কেন্দ্র থেকে এই কক্ষগুলির দূরত্ব নির্দিষ্ট। কেন্দ্রের সবচেয়ে কাছের যে পথ, কোনো ইলেক্ট্রন তা পেরিয়ে যেতে পারে না। ইলেক্ট্রন বাইরের পথ থেকে ভিতরের পথে দর্শন দেয়। কেন দেয় এবং হঠাৎ কখন দেখা দেবে তার কোনো বাঁধা নিয়ম পাওয়া যায় না। তেজ শোষণ ক’রে ইলেক্ট্রন ভিতরের পথ থেকে বাইরের পথে লাফিয়ে যায়, এই লাফের মাত্রা নির্ভর করে শোষিত তেজের পরিমাণের উপর। ইলেক্ট্রন তেজ বিকীর্ণ করে, কেবল যখন সে তার বাইরের পথ থেকে ভিতরের পথে আবির্ভূত হয়। ছাড়া-পাওয়া এই তেজকেই আমরা পাই আলো-রূপে। যতক্ষণ একই কক্ষে চলতে থাকে ততক্ষণ তার শক্তি-বিকিরণ বন্ধ। এ মতটা ধরে- নেওয়া একটা মত, কোনো কারণ দেখানো যায় না। মতটা মেনে নিলে তবেই বোঝা যায় পরমাণু কেন টিকে আছে, বিশ্ব কেন বিলুপ্ত হয়ে যায় নি। এই-সব কথার পিছনে দুরূহ তত্ত্ব আছে, সেটা বোঝবার অনেক দেরি। আপাতত কথাটা শুনে রাখা মাত্র। (‘পরমাণুলোক’, বিশ্বপরিচয়) ৪. একদা মৌলিক পদার্থের খ্যাতি ছিল যে, তাদের গুণের নিত্যতা আছে। তাদের যতই ভাঙা যাক কিছুতেই তাদের স্বভাবের বদল হয় না। বিজ্ঞানের প্রথম অধ্যায়ে দেখা গেল তাদের চরম ভাগ করলে বেরিয়ে পড়ে দুই জাতীয়-বৈদ্যুত-ওয়ালা কণাবস্ত্তর জুড়িনৃত্য। যারা ‘মোলিক পদার্থ’- নামধারী তাদের স্বভাবের বিশেষত্ব রক্ষা করেছে এই-সব বৈদ্যুতেরা বিশেষ সংখ্যায় একত্র হয়ে। এইখানেই যদি থামত তা হলেও পরমাণুদের রূপনিত্যতার খ্যাতি টিকে যেত। কিন্তু ওদের নিজের দলের থেকেই বিরুদ্ধ সাক্ষ্য পাওয়া গেল। একটা খবর পাওয়া গেল যে, হাল্কা যে-সব পরমাণু তাদের মধ্যে ইলেক্ট্রন- প্রোটনের ঘোরাঘুরি নিত্যনিয়মিতভাবে চলে আসছে বটে, কিন্তু অত্যন্ত ভারী যারা, যাদের মধ্যে ন্যুট্রন- প্রোটন-সংঘর্ষের অতিরিক্ত ঠেসাঠেসি ভিড়, যেমন ইউরেনিয়ম বা রেডিয়ম, তারা আপন তহবিল সামলাতে পারছে না – সদাসর্বক্ষণই তাদের মূল সম্বল ছিটকে পড়তে পড়তে হাল্কা হয়ে তারা একরূপ থেকে অন্য রূপ ধরছে। এতকাল রেডিয়ম-নামক এক মৌলিক ধাতু লুকিয়ে ছিল স্থূল আবরণের মধ্যে। তার আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে পরমাণুর গূঢ়তম রহস্য ধরা পড়ে গেল। বিজ্ঞানীদের সঙ্গে তার প্রথম মোকাবিলার ইতিহাস মনে রেখে দেবার যোগ্য। যখন র্যন্ট্গেন রশ্মির আবিষ্কার হল, দেখা গেল তার স্থূল বাধা ভেদ করবার ক্ষমতা। তখন অাঁরি বেকরেল ছিলেন প্যারিস ম্যুনিসিপাল স্কুলে বিজ্ঞানের অধ্যাপক। স্বতোদীপ্তিমান পদার্থ মাত্রেরই এই বাধা ভেদ করবার শক্তি আছে কি না সেই পরীক্ষায় তিনি লাগলেন। এইরকম কতকগুলি ধাতুপদার্থ নিয়ে কাজ আরম্ভ ক’রে দিলেন। তাদের কালো কাগজে মুড়ে রেখে দিলেন ফোটোগ্রাফের প্লেটের উপরে। দেখলেন তাতে মোড়ক ভেদ ক’রে কেবল য়ুরেনিয়ম ধাতুরই চিহ্ন পড়ল। সকলের চেয়ে গুরুভার যার পরমাণু তার তেজস্ক্রিয়তা সপ্রমাণ হয়ে গেল। পিচ্ব্লেন্ড্-নামক একখনিজ পদার্থ থেকে য়ুরেনিয়মকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়ে থাকে। বেকরেলের এক অসামান্য বুদ্ধিমতী ছাত্রী ছিলেন মাদাম কুরি। তাঁর স্বামী পিয়ের কুরি ফরাসী বিজ্ঞান-বিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন। তাঁরা স্বামী- স্ত্রীতে মিলে এই পিচ্ব্লেন্ড্ নিয়ে পরখ করতে লাগলেন, দেখলেন এর তেজস্ক্রিয় প্রভাব য়ুরেনিয়মের চেয়ে আরো প্রবল। পিচ্ব্লেন্ডে্র মধ্যে এমন কোনো কোনো পদার্থ আছে যারা এই শক্তির মূলে; তারই আবিষ্কারের চেষ্টায় তিনটি নূতন পদার্থ বের হল – রেডিয়ম, পলোনিয়ম এবং অ্যাক্টিনিয়ম। পরীক্ষা করতে করতে প্রায় চল্লিশটি তেজস্ক্রিয় পদার্থ পাওয়া গেছে। প্রায় এদের সবগুলিই বিজ্ঞানে নতুন-জানা। তখনকার দিনে সকলের চেয়ে চমক লাগিয়ে দিল এই ধাতুর একটি অদ্ভুত স্বভাব। সে নিজের মধ্যে থেকে জ্যোতিষ্কণা বিকীর্ণ ক’রে নিজেকে নানা মৌলিক পদার্থে রূপান্তরিত করতে করতে অবশেষে সীসে ক’রে তোলে। এ যেন একটা বৈজ্ঞানিক ভেলকি বললেই হয়। এক ধাতু থেকে অন্য ধাতুর যে উদ্ভব হতে পারে, সে এই প্রথম জানা গেল। (‘পরমাণুলোক’ বিশ্বপরিচয়) ৫. রাত্রের আকাশে মাঝে মাঝে নক্ষত্রপুঞ্জের সঙ্গে সঙ্গে দেখা যায় লেপে- দেওয়া আলো। তাদের নাম দেওয়া হয়েছে নীহারিকা। এদের মধ্যে কতকগুলি সুদূরবিস্তৃত অতি হালকা গ্যাসের মেঘ, আবার কতকগুলি নক্ষত্রের সমাবেশ। দুরবীনে এবং ক্যামেরার যোগে জানা গেছে যে, যে ভিড় নিয়ে এই শেষোক্ত নীহারিকা তাতে যত নক্ষত্র জমা হয়েছে বহু কোটি তার সংখ্যা, অদ্ভুত দ্রুত তাদের গতি। এই- যে নক্ষত্রের ভিড় নীহারিকামন্ডলে অতি দ্রুতবেগে ছুটছে, এরা পরস্পর ধাক্কা লেগে চুরমার হয়ে যায় না কেন। উত্তর দিতে গিয়ে চৈতন্য হল, এই নক্ষত্রপুঞ্জকে ভিড় বলা ভুল হয়েছে। এদের মধ্যে গলাগলি ঘেঁষাঘেঁষি একেবারেই নেই। পরস্পরের কাছ থেকে অত্যন্তই দূরে দূরে এরা চলাফেরা করছে। পরমাণুর অন্তর্গত ইলেক্ট্রনদের গতিপথের দূরত্ব সম্বন্ধে সার্ জেম্স্ জীন্স্ যে উপমা দিয়েছেন এই নক্ষত্রমন্ডলীর সম্বন্ধেও অনুরূপ উপমাই তিনি প্রয়োগ করেছেন। লন্ডনে ওয়াটারলু নামে এক মস্ত স্টেশন আছে। যতদূর মনে পড়ে সেটা হাওড়া স্টেশনের চেয়ে বড়োই। সার্ জেম্স্ জীন্স্ বলেন সেই স্টেশন থেকে আর-সব খালি ক’রে ফেলে কেবল দু’টি মাত্র ধুলোর কণা যদি ছড়িয়ে দেওয়া যায় তবে আকাশে নক্ষত্রদের পরস্পর দূরত্ব এই ধূলিকণাদের বিচ্ছেদের সঙ্গে কিছু পরিমাণে তুলনীয় হতে পারবে। তিনি বলেন নক্ষত্রের সংখ্যা ও আয়তন যতই হোক আকাশের অচিন্তনীয় শূন্যতার সঙ্গে তার তুলনাই হতে পারে না। (‘নক্ষত্রলোক’, বিশ্বপরিচয়) ৬. চোখে দেখার যুগ থেকে এল দুরবীনের যুগ। দুরবীনের জোর বাড়তে বাড়তে বেড়ে চলল দ্যুলোকে আমাদের দৃষ্টির পরিধি। পূর্বে যেখানে ফাঁক দেখেছি সেখানে দেখা দিল নক্ষত্রের ঝাঁক। তবু বাকি রইল অনেক। বাকি থাকবারই কথা। আমাদের নক্ষত্র জগতের বাইরে এমন-সব জগৎ আছে যাদের আলো দুরবীন-দৃষ্টিরও অতীত। একটা বাতির শিখা ৮৫৭৫ মাইল দূরে যেটুকু দীপ্তি দেয়, এমনতরো আভাকে দুরবীনযোগে ধরবার চেষ্টায় হার মানলে মানুষের চক্ষু। দুরবীন আপন শক্তি অনুসারে খবর এনে দেয় চোখে, চোখের যদি শক্তি না থাকে সেই অতি ক্ষীণ খবরটুকু বোধের কোঠায় চালান ক’রে দিতে, তা হলে আর উপায় থাকে না। কিন্তু ফোটোগ্রাফ- ফলকের আলো-ধরা শক্তি চোখের শক্তির চেয়ে ঢের বেশি স্থায়ী। সেই শক্তির উদ্বোধন করলে বিজ্ঞান; দূরতর আকাশে জাল ফেলবার কাজে লাগিয়ে দিলে ফোটোগ্রাফ। এমন ফোটোগ্রাফি বানালে যা অন্ধকারে -মুখ-ঢাকা আলোর উপর সমন জারি করতে পারে। দুরবীনের সঙ্গে ফোটোগ্রাফি, ফোটোগ্রাফির সঙ্গে বর্ণলিপিযন্ত্র জুড়ে দিলে। সম্প্রতি এর শক্তি আরো বিচিত্র ক’রে তোলা হয়েছে। সূর্যে নানা পদার্থ গ্যাস হয়ে জ্বলছে। তারা সকলে একসঙ্গে মিলে যখন দেখা দেয় তখন ওদের তন্নতন্ন ক’রে দেখা সম্ভব হয় না। সেইজন্যে এক আমেরিকান বিজ্ঞানী সূর্য-দেখা দুরবীন বানিয়েছেন যাতে জ্বলন্ত গ্যাসের সবরকম রঙ থেকে এক-একটি রঙের আলো ছাড়িয়ে নিয়ে তার সাহায্যে সূর্যের সেই বিশেষ গ্যাসীয় রূপ দেখা সম্ভব হয়েছে। ইচ্ছামত কেবলমাত্র জ্বলন্ত ক্যালসিয়মের রঙ কিংবা জ্বলন্ত হাইড্রোজেনের রঙে সূর্যকে দেখতে পেলে তার গ্যাসীয় অগ্নিকান্ডের অনেক খবর মেলে যা আর কোনো উপায়ে পাওয়া যায় না। (‘নক্ষত্রলোক’, বিশ্বপরিচয়) এই উদ্ধৃতিগুলি থেকে সহজেই বুঝতে পারা যায়, রবীন্দ্রনাথ কেবল যে ‘সহজ ভাষায় বিজ্ঞানের ব্যাখ্যার ছাঁচ গড়ে দেবার’ ইচ্ছায় সফল হতে পেরেছিলেন তা নয়, বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করার কাজেও কোনো শৈথিল্য দেখাননি। পরমাণুলোকের অভ্যন্তরের চিত্র কিংবা নক্ষত্রলোকের অপরিমেয় বিশালতার ব্যাপ্তি এতে সহজভাবে উপস্থাপিত হয়েছে, কিন্তু বৈজ্ঞানিক তথ্য ও ব্যাখ্যার ঘাটতি তাকে মোটেও খর্ব করেনি। কেননা, ‘আমার মত এই যে যাদের মন কাঁচা তারা যতটা স্বভাবত পারে নেবে, না পারে আপনি ছেড়ে দিয়ে যাবে, তাই বলে তাদের পাতটাকে প্রায় ভোজ্যশূন্য করে দেওয়া সদ্ব্যবহার নয়। যে বিষয়টা শেখবার সামগ্রী, নিছক ভোগ করবার নয়, তার উপর দিয়ে অবাধে চোখ বুলিয়ে যাওয়াকে পড়া বলা যায় না। মন দেওয়া এবং চেষ্টা করে বোঝাটাও শিক্ষার অঙ্গ, সেটা আনন্দেরই সহচর। নিজের যে শিক্ষার চেষ্টা বাল্যকালে নিজের হাতে গ্রহণ করেছিলুম তার থেকে আমার এই অভিজ্ঞতা।’ দুই ‘পরমাণুলোক’, ‘নক্ষত্রলোক’, ‘সৌরজগৎ’, ‘গ্রহলোক’ ও ‘ভূলোক’ – এই পাঁচটি অধ্যায় ছাড়াও বিশ্বপরিচয় বইটিতে আছে একটি সংক্ষিপ্ত উপসংহার। বিশ্বপরিচয়ের প্রথম সংস্করণে পঞ্চম অধ্যায়টির ছিল ‘পৃথিবী’; দ্বিতীয় সংস্করণে অধ্যায়টির নাম পরিবর্তন করে ‘ভূলোক’ নাম রাখলেন রবীন্দ্রনাথ। বিজ্ঞানের বই রবীন্দ্রনাথ নিয়মিত পড়তেন, এমনকি পত্রপত্রিকায় নতুন বইয়ের সমালোচনা পড়েও তিনি সেসব বই সংগ্রহ করে পড়ার জন্য উদ্গ্রীব থাকতেন। বিশ্বপরিচয় লেখার সময়ও রবীন্দ্রনাথ বইটিতে বিজ্ঞানের সর্বশেষ তথ্য দেবার আকাঙ্ক্ষায় নিয়মিত বই সংগ্রহ করেছেন, এমনকি বিলেত থেকেও বই আনিয়েছেন অথবা আনানোর জন্য তালিকা তৈরি করে দিয়েছেন। সে- তালিকার মধ্যে ছিল ঔধসবং ঔবধহং& ঙঃযবৎং-রচিত ঝপরবহঃরভরপ চৎড়মৎবংং, চধঁষ কধৎষংড়হ-রচিত ণড়ঁ ধহফঃযব টহরাবৎংব, কধৎষ ক. উধৎৎড়– রচিত ঞযব জবহধরংংধহপব ড়ভ চযুংরপং, ঈষুফব ঋরংযবৎ-রচিত ঊীঢ়ষড়ৎরহমঃযব টহরাবৎংব, ঔধসবং কবহফধষষ-রচিত অঃ ঐড়সব ধসড়হমঃযব অঃড়সং, ঔঁষরধহ ঐীঁষবু- রচিত জধৎব অহরসধষং ধহফঃযব উরংধঢ়ঢ়বধৎধহপব ড়ভ ডরষফ ষরভব, এ. ঘ. গ ঞুৎৎবষষ-রচিত ঝপরবহপব ধহফ চযুংরপধষ চযবহড়সবহধ এবং জড়নবৎঃ ঐ. ইধশবৎ-রচিত অংঃৎড়হড়সু ইত্যাদি বইয়ের নাম। বিজ্ঞানের বিষয় নিয়ে লেখার ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক তথ্য যাতে যথাযথভাবে সন্নিবেশিত হয় এবং সর্বশেষ বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ও তত্ত্ব তাতে অন্তর্ভুক্ত হয়, সে- সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ নিজে বিশেষভাবে যত্নবান ছিলেন। সেজন্য বিজ্ঞানের অধ্যাপক ও গবেষকদের সহায়তা যেমন তিনি গ্রহণ করেছেন, তেমনি প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হবার পরও পঞ্চম সংস্করণ প্রকাশ পর্যন্ত বইয়ের ত্রুটিগুলো সংশোধন করেছেন এবং সেসব ত্রুটি যাঁরা দেখিয়ে দিয়েছেন ও সংশোধনে সাহায্য করেছিলেন তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরবাড়ি থেকে প্রকাশিত ছোটোদের পত্রিকা বালকের সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তখন তাঁর বয়স মাত্র চবিবশ বছর। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী রবীন্দ্রনাথের মেজবউঠাকুরানী জ্ঞানদানন্দিনী দেবী বালক পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর সহযোগী ছিলেন এবং কার্যত সম্পাদনা ও প্রকাশনার দায়িত্ব তিনিই পালন করে যেতেন। গল্প, উপন্যাস, কবিতা ছাড়াও বালকের পাতায় ‘বৈজ্ঞানিক সংবাদ’ও লিখতেন রবীন্দ্রনাথ। তাতে অনেক অজানা তথ্য এবং মজার কথা থাকত। অজ্ঞতার অন্ধকারে নিমজ্জিত মানুষকে মূঢ়তার অভিশাপ থেকে মুক্ত করার ইচ্ছাই ছিল তাঁর বিজ্ঞানচর্চার মূল উদ্দেশ্য, কেননা আধুনিক সংস্কারমুক্ত জীবনবোধ তৈরি না হলে মনের অন্ধকার ও জীবনের অন্ধকার কখনো অপসৃত হয় না।