User login
Sing In with your email
Send
Our Price:
Regular Price:
Shipping:Tk. 50
প্রিয় ,
সেদিন আপনার কার্টে কিছু বই রেখে কোথায় যেন চলে গিয়েছিলেন।
মিলিয়ে দেখুন তো বইগুলো ঠিক আছে কিনা?
Share your query and ideas with us!
Was this review helpful to you?
or
কোয়ানটিটি নয় কোয়ালিটিতে বিশ্বাসী ধারার লেখক গোলাম শফিক। ‘কৃপণ হাতে’ লেখেন বলে তাঁর লেখার রসাস্বাদনের সৌভাগ্য পাঠকের তেমন একটা হয় না। গদ্য-নিবিষ্ট এ লেখক সম্প্রতি ঝুঁকেছেন ভ্রমণসাহিত্যের দিকে। ২০১০ সালে বেরিয়েছিলো তাঁর ভ্রমণবই অন্যভ্রমণ ঠিক পরের বছর, এবার ২০১১-এ বেরুলো আরেকটি-চেঙ্গিস খানের মঙ্গোলিয়া ও অন্যান্য পরিব্রজন। বইটির বিশেষ বৈশিষ্ট্য-ছোট ছোট একাধিক ভ্রমণকাহিনীর সন্নিবেশ, তবে সব কাহিনীর পটভূমিই বিদেশ। ১৮টি কাহিনী সংবলিত এ বইয়ে চিত্রিত হয়েছে ৯টি দেশ-কোরিয়া, থাইল্যান্ড, ডেনমার্ক, জাপান, ভারত, মঙ্গোলিয়া, চীন, সৌদি আরব ও সিঙ্গাপুর। এক কোরিয়ারই রয়েছে ৮টি ভ্রমণকাহিনী (এ আধিক্যের কারণ লেখক পড়াশোনা সূত্রে যৌবনের বেশকিছু সময় অতিবাহিত করেছিলেন সে দেশে), থাইল্যান্ড ও ডেনমার্কের ২টি করে, অন্যান্য দেশের ১টি। এটিকে ‘সংক্ষিপ্ত বিশ্বভ্রমণ’ হিসেবে আখ্যা দিলেও খুব একটা অত্যুক্তি হবে না! অপ্রাসঙ্গিক কিংবা সস্তা আবেগ জাগানিয়া কথায়, আগড়মবাগড়ম শব্দে পাতা ভরানোর প্রচেষ্টায় মাতেননি অফ ট্র্যাকের এ লেখক। তাঁর বহির্দেশীয় ভ্রমণবইটিতে উঠে এসেছে ইতিহাস-ঐতিহ্য-লোকগাথা-মিথ-আরো কত কী। রাশভারী ইতিহাসকে রসগ্রাহী ভঙ্গিমায় পরিবেশন করেছেন বলে লেখনী তথ্যভারে এবং তত্ত্বের কচকচানিতে ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠেনি। প্রতিটি লেখায় যুক্ত হয়েছে প্রাসঙ্গিক ছবি। ছবিগুলো বিষয়ের সাথে একাত্ম করে তোলে পাঠককে; সাদাকালো ছবির ভিতর দিয়েই প্রবেশ করে রঙিন ভুবনে। সে রঙিন ভুবনে পাঠক অজান্তেই হাঁটতে শুরু করেন লেখকের পাশাপাশি। বইয়ের নামকাহিনী চেঙ্গিস খানের মঙ্গোলিয়া। পাঠক আচ্ছন্ন হয় লেখকের পরিমিত রসবোধে- ...প্রসঙ্গক্রমে বলি আমার জন্য এয়ারপোর্টে কেউ না কেউ অপেক্ষা করবে, তবু সে আমায় ‘চেঙ্গিস খান হোটেল’-এ যাওয়ার রাস্তা বাতলে দেয় এবং বলে অসুবিধা হলে যেন তাকে ফোন করি। এই কি তাহলে মঙ্গোলদের দুর্ধর্ষতার নমুনা, যাদের আক্রমণের ভয়ে একদা চীনারা মহাপ্রাচীর নির্মাণ করতে বাধ্য হয়েছিলো? তবে মঙ্গোলরা দাবি করে যে, তাদের কারণে গ্রেট ওয়াল নির্মিত হয়েছিলো বিধায় তারাও ‘গ্রেট’। দেশ হিসেবে মঙ্গোলিয়ার তেমন নামডাক না থাকলেও অনেকে এটাকে চেনে চেঙ্গিস খানের দেশ হিসেবে। ইতিহাসে চেঙ্গিস খান নৃশংসতা ও সাম্রাজ্যবাদীর প্রতীক হয়ে আছেন। নামের শেষে পদবি খান ব্যবহার করায় অনেকেই তাকে মুসলিম ভেবে ভুল করেন। প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। এ ‘অদ্ভুত দেশের’ প্রাচীন ইতিহাস থেকে শুরু করে বর্তমান পর্যন্ত স্বল্প পরিসরে বর্ণিত হয়েছে। এ বর্ণনায় কখনো পাঠকের সামনে আসে চেঙ্গিস খানের ভয়ানক মূর্তিটি আবার কখনো ম্রিয়মাণ হয়ে পড়ে তা। সাম্রাজ্যবাদের প্রতিভূ চেঙ্গিস খানের সেই শৌর্যবীর্য এখন শুধু লিখিত শব্দসমষ্টি। সৌদি আরব ভ্রমণের দীর্ঘ আখ্যান মরুরাজ্যে পান্থজন। মুসলিম সভ্যতার উন্মেষ, বিকাশ এবং ইসলাম ধর্ম প্রতিষ্ঠার স্থান হিসেবে দেশটি সব শ্রেণির মানুষের কাছে নমস্য। সৌদি আরবের মুসলমান, মুসলমানদের তীর্থযাত্রা, ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ এলাকার ওপর আলোকপাতের পাশাপাশি রয়েছে চুলচেরা বিশ্লেষণও। ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের প্রিয় এবং সম্মানীয় ধর্মীয় স্থান কাবা শরীফ, মসজিদুল হারাম, কৃষ্ণপাথর, মাকামে ইব্রাহীম, আবে জমজম, হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর স্মৃতিভবন, জেবাল-ই-সাওর, জেবাল-ই-রাহমাহ, মিনা, হেরার গুহাসহ আরো অনেক স্থান কলম-সৃষ্ট যাদুর মাধ্যমে মূর্ত হয়ে উঠেছে চোখের সামনে। সহজ কথায়, ঘরোয়া পরিবেশে গল্প করার মতো ভঙ্গি, প্রাঞ্জল বর্ণনায় ইতিহাসের চাকা উল্টোদিকে ঘুরে এসে দাঁড়ায় যেন পাঠকের সামনে! লেখকের চিত্রণে মসজিদে নববী- মদিনা মনোয়ারার এ স্থাপনাটি আসলে একটি স্মৃতি মসজিদ। দুনিয়ার কোনো মসজিদই বোধহয় ইতিহাসের এতো স্মৃতি ধারণ করছে না। মসজিদের প্রধান আকর্ষণই হচ্ছে হযরতের সমাধি যা সবচেয়ে বড় স্মৃতি ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের জন্য। মদিনাকে বলা হয় মদিনাতুন নবী, অর্থাৎ নবীর শহর। ওহুদের যুদ্ধ, খন্দকের যুদ্ধসহ আরো অনেক বিষয় ধরা পড়েছে এ কাহিনীতে। সুবৃহৎ এ ভ্রমণকাহিনী নিয়ে চাইলে আলাদা একটি পুস্তিকাও প্রকাশ করা যেতো। ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং ধর্মীয় বিষয়ে অনুসন্ধিৎসুদের কাছে এ লেখা বিশেষ মূল্য পাওয়ার দাবিদার। আধুনিক সিঙ্গাপুরের সুখ্যাতি মানুষের মুখে মুখে। প্রতি বছর সারা বিশ্ব থেকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পর্যটক সিঙ্গাপুরে বেড়াতে, চিকিৎসা নিতে কিংবা নিছক সময় কাটাতে যায়। এ আলো ঝলমল নগররাষ্ট্রের বৈচিত্র্য, অসংখ্য নৃগোষ্ঠীর সমন্বয়, প্রতিটি ক্ষেত্রে সুশৃঙ্খল ব্যবস্থা-সহজে নজর কাড়ে। অথচ এ সিঙ্গাপুরের অতীত ইতিহাস খুব একটা সুখকর নয়। সুদূরপ্রসারী চিন্তা, রাষ্ট্রনায়কোচিত প্রজ্ঞায় সুপরিকল্পিত এবং যুগোপযোগী পদক্ষেপে সিঙ্গাপুর আজ শীর্ষস্থানে। সিঙ্গাপুরের আদ্যোপান্ত ধরা দিয়েছে সিংহ নগরীর পথে প্রান্তরে শীর্ষক রচনায়। লেখকের গভীর রসবোধ এখানেও পরিস্ফুটিত- আমরা এন্ডারসন ব্রিজ পার হয়ে এ ঐ পাড়ে চলে গেলে পাই ছোটবড় অনেক বৃক্ষ বিশেষত Kasurina (ঝাউ)tree, বেনিয়ন বা কড়ই এবং মাদ্রাস থর্ন (Madras thorn). কী এক প্রকার গাছের শিকড়-বাকড় আমাদের বটবৃক্ষের মতো পানি স্পর্শ করে অদ্ভুত রূপকল্প তৈরি করেছে। শিমুল বললো, এখানকার সকল গাছই নিবন্ধিত, রেজিস্ট্রেশন ছাড়া কোনো বৃক্ষ পাবেন না। বিশেষত যে সমস্ত গাছ রোপণ করা হয় সেগুলোর খাতায় নাম আছে। একটু কটাক্ষ করে বলি, ইস্ কতো বড়ো তোমাদের দেশ, আর কতোই না এর বৃক্ষরাজি। মাত্র ৫০ লক্ষ লোক নিয়ে তোমরা বাহাদুরি করো যাতে তোমার মতো বাংলাদেশির সংখ্যা একেবারে কম নেই। সিঙ্গাপুরের মেরিনা বে, মারলায়ন, সেন্তোসা দ্বীপ, বার্ড পার্ক, চায়না টাউনসহ বর্ণিত এবং ‘নির্ণিত’ হয়েছে আরো অনেক স্থান, স্থাপনা। কোরিয়াকে নিয়ে লেখা ৮টি ভ্রমণকাহিনীর অধিকাংশ ছোট পরিসরের। এ যেন লেখক হাঁটছেন হাঁটছেন... হাঁটতে হাঁটতে চকিতে দেখে ফেলেছেন কিছু কিছু জিনিস! এ ধারার একটি রচনা শিমবাতা। বাংলাদেশে ভেষজ ওষুধ হিসেবে জিনসেং (বা জিনসাং) নামটি বহু শ্রুত এবং পরিচিত নাম। জানা গেলো, এটি কোরিয়ান গাছ। জ্ঞানবিজ্ঞানে প্রাগ্রসর কোরিয়ানরা এখনো ভেষজ চিকিৎসার উপর অধিক আস্থাশীল। পাহাড়ি জিনসেং ‘শক্তিশালী দাওয়াই’। দুর্লভ এ গাছ কালেভদ্রে কেউ খুঁজে পেলে হর্ষধ্বনি করে ওঠে-শিমবাতা! শিমবাতা শব্দটি আর্কিমিডিসের ‘ইউরেকা’ শব্দ-তুল্য। কোরিয়া দুইভাগে বিভক্ত-উত্তর ও দক্ষিণ। এ বিভাজনরেখা নিয়ে আক্ষেপ ঝরে পড়েছে লেখক এবং কোরিয়ানদের জবানীতে। দুই কোরিয়া এক হয়ে শুধু ‘কোরিয়ান’, এ পরিচয় পরিচিত হতে উদগ্রীব দেশপ্রেমিক অনেক কোরিয়াবাসী। শ্যামদেশি নারী থাইল্যান্ডের পটভূমিতে বর্ণিত। থাইল্যান্ডের রাজনীতি, সংস্কৃতি বিশেষ করে নারী স্বাধীনতা, নারীদের জীবনযাত্রার ওপর বিশেষভাবে আলোকপাত করা হয়েছে। বিদেশি পর্যটকদের উৎসাহী করতে নারীদের যথেচ্ছভাবে ব্যবহার, সহজ উপার্জনে কাপড় খোলার অনায়াস দক্ষতা, লোভের বশবর্তী হয়ে উচ্চবিত্তদের উপপত্নী (Minor Wives) থাকা, পারিবারিক জীবনযাপন ইত্যাদি বিবৃত হয়েছে। বলা চলে, লেখক শুধু শ্যামদেশি নারীদের অবস্থাই বর্ণনা করেননি, কান টেনে মাথা আনার মতো দেখিয়ে দিয়েছেন ‘শ্যামদেশ’-এর আসল রূপও। মোটামুটি বোদ্ধা পাঠক না হলে গোলাম শফিকের মতো ‘ভারিক্কি’ লেখকের লেখা থেকে পরিপূর্ণভাবে সুধা আহরণ কঠিনই। এ বইও অতীত-ইতিহাস নিপুণভাবে বজায় রেখেছে! কথা হচ্ছে, এ ভ্রমণগ্রন্থকে কীভাবে আখ্যায়িত করা যাবে-ভ্রমণের মধ্যে ইতিহাস নাকি ইতিহাসের মধ্যে ভ্রমণ! কোন পাল্লাটা বেশি ভারি-এটি কি আসলেই ভ্রমণগ্রন্থ নাকি নৈর্ব্যক্তিক ভঙ্গিতে বর্ণনা করে যাওয়া ইতিহাস! লেখক ইতিহাস অনুরাগী-এ বই অকাট্য প্রমাণ। প্রকৃতপক্ষে বইটি ভ্রমণ ও ইতিহাসের যুগলবন্দি। বর্তমান ইতিহাস ধরে যেমন চলে এসেছে প্রাচীন ইতিহাস, আবার প্রাচীনের সাথে সমান্তরালে এগিয়েছে বর্তমান। ‘খাবলা’ মাঝে বন্দি হওয়া এ সংমিশ্রণ শুধু নান্দনিকতার প্রকাশই নয়, ভিন্ন তথা নতুন এক শৈলীর শৈল্পিক উপস্থাপনও। গ্রন্থটি সব মিলিয়ে পরিচ্ছন্ন কিন্তু কিছু মুদ্রণপ্রমাদ থেকে যাওয়ায় শতভাগ পরিচ্ছন্ন বলা যাবে না। সাধারণ কিন্তু সুন্দর প্রচ্ছদ, এতে ফুটে উঠেছে চেঙ্গিস খানের নৃশংসতার চিত্র। যা প্রচ্ছদ তথা বইটিকে করেছে আরো গ্রহণযোগ্য। লেখক ভবিষ্যতেও ইতিহাসভিত্তিক ভ্রমণকাহিনীর চর্চা অব্যাহত রাখবেন আশা করি। এতে সামগ্রিকভাবে উপকৃত হবে বাংলা সাহিত্য। পাঠকরাও পাবেন আনকোরা স্বাদ। চেঙ্গিস খানের মঙ্গোলিয়া ও অন্যান্য পরিব্রজন গোলাম শফিক প্রকাশক : উৎস প্রকাশন প্রকাশকাল : ফেব্রুয়ারি ২০১১ প্রচ্ছদ : সব্যসাচী হাজরা দাম ২৫০।