User login
Sing In with your email
Send
Our Price:
Regular Price:
Shipping:Tk. 50
প্রিয় ,
সেদিন আপনার কার্টে কিছু বই রেখে কোথায় যেন চলে গিয়েছিলেন।
মিলিয়ে দেখুন তো বইগুলো ঠিক আছে কিনা?
Share your query and ideas with us!
Was this review helpful to you?
or
বালুনদী গল্পের পাঠ প্রতিক্রিয়া -আশরাফুল আলম সহজ জীবনের জটিলতাগুলো অথবা জটিল জীবনের সরলতাগুলো নিয়ে মোয়জ্জেম আজিমের বালুনদী'র গল্প (ছোটগল্প 'বালুনদী' পড়ে একজন আম-পাঠকের প্রতিক্রিয়া) জীবনের চরিত্র অনেকটা ভাষার চরিত্রেরই মত; এখানে সারল্য আর জটিলতা সব মিলেমিশে একাকার - এ ব্যাপারে সরলীকরণ খুবই বিপদজনক। দীর্ঘ ইতিহাস, ব্যাকরণ, সাহিত্যভান্ডার আর শব্দভান্ডারে হিমালয়প্রায় ল্যাটিন ভাষায় যা প্রকাশ করা যায়, মাত্র কয়েকশো শব্দবিশিষ্ট এবং লিখিত রুপহীন যে কোন আদিম ভাষাতেও তা প্রকাশ করা সম্ভব। হ্যাঁ, পরিভাষা একটা সমস্যা হতে পারে বটে, তবে তা কৃত্রিম। জীবনের বেলাতেও প্রায় একই কথা খাটে। কৃত্রিম পারিভাষিক ভেদাভেদ ছাড়া জীবনের শুরু এবং শেষ, তার পথের বাঁকগুলো, আনন্দ ও সংকটগুলো, স্থান-কাল-পাত্র ভেদে খুব একটা হেরফের হয় না ইতিহাসের নানান কালে। ইদু জোলার কথাই ধরুন না - বিজনেস স্কুল থেকে কমিউনিকেশন স্কিলের পরীক্ষায় পাশ করে কেতাদুরস্ত আধুনিক আমরাও যখন প্রকাশভঙ্গীর যথার্থতা নির্ণয়ে কিম্বা প্রকাশের স্থান-কালের উপযুক্ততা খুঁজে পেতে গলদঘর্ম হই মাঝেমাঝে, সেখানে ইদু জোলার এই অসময়ে বেফাঁস কথা মনে আসা, কিম্বা মুখ ফসকে সঙ্গীদের হাস্যরস উদ্রেককারী কিছু একটা বলে ফেলাতে আমরা সমব্যথী হই, কিন্তু বিব্রত হই না। এমনটা তো অনেকেরই হরহামেশা হয়ে থাকে, তাই না? ইদু জোলার জীবন ও পরিমন্ডল আমাদের অনেকেরই অচেনা, তবে অচেনা নয় তার এই আপাতঃ সংকটটুকু। আমরা ঠিক বুঝতে পারি আতর মুন্সীর গান শুনতে নয়াপাড়া যাওয়ার পথে সহযাত্রীদের সঙ্গে তার লেনাদেনার আদি অন্ত, তার মনোভঙ্গি এবং তার কৌতুহলগুলো। তার পথচলতি এই আপাতঃ সংকট অবশ্য ম্লান হয়ে যায় তার জন্য অপেক্ষা করা আরেক আচমকা সংকটের কাছে, এবং সেই সংকটের কারণ এবং ফলাফল দুটোই ইদুর অজানা। জীবন, শেষ বিচারে, ট্র্যাজেডির নাটকই বটে - সব জীবনই তাই। ইদু জোলাও তার ব্যতিক্রম হয় নি। বালুনদী গল্পের শুরুটা বেশ একটা ধাক্কার মত - জলের দিন হারিয়ে বালুময় তার বুক, তবুও ক্ষিপ্রতা কমে নি নদীর, ভাসিয়ে নেবার দুরন্তপনা কমে নি। এ পর্যন্ত পড়েই আমরা আমাদের নিজেদের দিকে একবার তাকাই, এবং দেখি যে, সেটা বেশ অস্বাভাবিক। আমরা সবাই বালুনদীর মত চিরযৌবনা না হতে পেরে আক্ষেপে পুড়ি, এবং গল্প যখন বালুকান্দার ইদু জোলা ও তার সঙ্গীদের দিকে মোড় নেয়, তখনো আমরা এই শক্তিমান নদীকে হিংসা করতে থাকি। এর পরে ইদু জোলা ওরফে পুলিশ/খবরের কাগজের ইদু ডাকাত যখন ক্রসফায়ারে মরে, তখন আমরা কেন যেন সমব্যথী হতে পারি না - গল্প যেন তার আগেই শেষ হয়ে গেছে। ক্রসফায়ারের অংশটুকু আমাদের কাছে গতবাঁধা মনে হয়, অপ্রয়োজনীয় মনে হয়, কিম্বা এমন মনে হয় যে, ইদু জোলার পক্ষে এরকম নামহীন, গৌরবহীন মৃত্যু যেন খুবই স্বাভাবিক। সে আসলেই জোলা, ডাকাত, কামাল-রতন-দুলাল, জনযুদ্ধের সেনাপতি নাকি অন্যকিছু, তা জানবার প্রয়োজন বোধ করি না আমরা। মোয়াজ্জেম আজিমের গল্প বলার ভংগী থেকেই এটা হয়েছে - ইদুকে আমরা চিনে গেছি আগেই, তার নিরামিষ জীবনের হালখাতা আমরা অল্প কথাতেই পড়ে ফেলেছি। গল্প শুধু আমরা পড়িই না, বরং পড়তে পড়তে সেখানে কিছুটা অংশগ্রহনও করে ফেলি। কিছুটা পড়ার পরে, বাকীটা আন্দাজ করার চেষ্টা করতে থাকি সচেতন কিম্বা অবচেতন মনে, অনেকেই যেমন আজকাল বাংলা সিনেমা দেখতে বসলে 'এইটা কোন ফর্মুলায় পড়েছে' সেটা নির্ণয় করতে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। মালে থাবা পড়ার ঘটনা শোনার পরেই ইদু জোলার মনে পড়ে তার মাতা, স্ত্রী ও কন্যার কথা, আর আমরা পাঠকেরা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ি কি এক অজানা আশংকায়। গল্প আর বেশীদুরে এগোয় না, লেখকের মুন্সীয়ানাতে ইদু জোলা ওয়ালী পাগলার ওরশের স্মৃতি জাবড়ানোর কিছুক্ষণ পরেই গল্প শেষ হয়ে যায়, কিন্তু আমরা, পাঠকেরা, নিঃশঙ্কচিত্ত হতে পারি কি? কেনইবা ইদু জোলা মনে করে তার মাতা, স্ত্রী ও কন্যার কথা? সদা শ্বাপদশংকুল পরিবেশে জীবনকে যাপন কি করেছি আমরা কেউ, বিশেষতঃ যখন আমরা সেই পরিবেশে ডারউইনের তত্বের সেই 'ফিটেস্ট' নই, আমাদের জ্ঞাতসারেই? তারচেয়ে বড় জিজ্ঞাসা, আমাদের চেনাজানা জনপদই যে আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের রাজত্বে পরিণত হতে পারে আমাদের চোখের সামনে, তা প্রত্যক্ষ করবার মত মনের জোর কি আমাদের সকলের থাকে? তারচেয়ে চোখ বন্ধ করে থাকাটাই বরং নিরাপদ ও সুবিধাজনক বোধ হয়। আমার চেনা এই পথ, গলি, আঙিনা রাত নামলে ভুতুড়ে কিম্বা ভয়ের রাজ্যে পর্যবসিত হয়, তো হোক না, আমরা যতক্ষণ বেঁচে আছি, সেটাই চুড়ান্ত সত্য বলে জানি, ব্যস। ইদানিংকালের অস্থির সমাজে এমনতরো অস্তিত্বের সংকট মাথায় নিয়েই আমাদের বসবাস, আর ইদু তো আমাদেরই একজন মাত্র! ছোট গল্প কি, তা কেন আমরা পড়ি, আর কিভাবেই বা তাকে চিনি, সেই সব প্রশ্নের গোছানো উত্তর দিতে পারবেন সাহিত্যের ছাত্রেরা। রবিবাবুর বেদবাক্য তো আছেই - শেষ হয়েও শেষ না হওয়ার আভাস রেখে যাওয়া, অতৃপ্তি রেখে যাওয়া। কিন্তু কতটুকু আভাস রাখাকে যথেষ্ঠ বলে ধরে নেব, তার কোন সর্বজনগ্রাহ্য উত্তর নেই। কোন গল্প কি আসলে শেষ হয় কখনো, এমনকি 'অতঃপর তাহারা সুখে-শান্তিতে বাস করিতে লাগিল' ঘোষণা করার পরেও? কাজেই, গল্পপাঠের পরে পাঠকের মনে যে অতৃপ্তির জন্ম হয়, তার মাত্রাটা গজফিতা দিয়ে মাপামাপি করার দরকার আছে বৈকি। সেই বিচারে মোয়াজ্জেম আজিমের বালুনদী গল্পটি আমাদের চেনাজানা অনেক গল্পকে ছাড়িয়ে যায়। অনেকটা, গল্প যেন শুরুই হয় শেষ হওয়ার পর। ইদু জোলাকে আমরা চিনি খুবই অল্পসময় ধরে - মাত্রই আধাঘন্টাখানেক অথবা তারও কম। মাত্র আড়াইপাতার এই গল্পটা পড়া শুরু করতে না করতেই আমরা গল্পের শেষে এসে যাই আচমকা। আমাদের এই অস্থির সময়ের এক ছাপচিত্র হাতে পেয়ে যাই গল্পচ্ছলে। এমন অতৃপ্তি পেয়েছিলাম 'পন্ডিতমশাই' পড়ার পরে, কিম্বা 'আত্নজা ও একটি কবরী গাছ' পড়ার পরে। পন্ডিতমশাই পড়েছিলাম হাইস্কুলে থাকতে; তখন ঠিকমত বুঝে উঠতেই পারিনি গল্পটা। অনেকদিন বাদে আরেকবার যখন পড়েছিলাম, পরাধীন ব্রিটিশ ভারতে আমাদের পূর্বপুরুষদের মর্মবেদনা জ্বলন্ত বাস্তব হয়ে ধরা দিয়েছিল আমার কাছে। এত সহজ করে এই যে বলা, এবং বলার পরেও অনেক না বলা কথা রেখে দেওয়া, তাতেই ছোটগল্পের এবং তার লেখকের মুন্সীয়ানা। ছোট গল্পে 'বড়' ছবি আঁকার সেই মুন্সীয়ানার কৃতিত্ব মোয়াজ্জেম আজিমকে দিতেই হচ্ছে। তার সাবলীল বর্ণনাভঙ্গী, আঞ্চলিক ভাষার ডায়লগ ব্যবহারের দক্ষতা এবং তত্বজ্ঞান বিলানোর অনাকাঙ্খা গল্পটির সৌন্দর্য্য বাড়িয়েছে। আজকাল গল্পে যেন গল্প নয়, থাকে মনঃস্তত্ব, দর্শন আর নানান তত্বকথা - পাঠকের উপরে কিছুই ছেড়ে দিয়ে বসে থাকেন না লেখকেরা। সবই চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেন। মোয়াজেম আজিম সে পথে পা বাড়াননি। পাঠক গল্প পড়ে তার নিজের মতন করে ভাববেন, বিশ্লেষণ করবেন, অথবা কিছুই করবেন না, সব শিল্পকর্মের পাঠক/দর্শক/শ্রোতার ক্ষেত্রেই যেটা হয়ে থাকে। গল্পকারের জন্য অনেক শুভকামনা রইল। ছোট গল্পঃ বালুনদী গল্প গ্রন্থঃ বালুনদী ও গরুর হাটের গল্প মোয়াজ্জেম আজিম লেটার প্রেস, একুশের বই মেলা ২০১৪