User login
Sing In with your email
Send
Our Price:
Regular Price:
Shipping:Tk. 50
প্রিয় ,
সেদিন আপনার কার্টে কিছু বই রেখে কোথায় যেন চলে গিয়েছিলেন।
মিলিয়ে দেখুন তো বইগুলো ঠিক আছে কিনা?
Share your query and ideas with us!
Was this review helpful to you?
or
Good book
Was this review helpful to you?
or
শান্ত বিকেল। ফুরফুরে হাওয়া বইছে। পাখিরা উড়ে গিয়ে এক বৃক্ষশাখা থেকে আরেক বৃক্ষশাখায় বসছে। কিন্তু তাদের কূজন নেই। পাখিদের মধ্যে কেমন একটা সম্ভ্রম। পাখিদের সম্ভ্রম আবার বোঝা যায় নাকি? হয়ত যায়। অনেকে হয়ত পারে। কিন্তু আপাত দৃষ্টিতে সাধারণেরা তা বোঝে না। বুঝতে পারেন হয়ত মহৎ মানুষেরা। কোন মহৎ মানুষদের কথা বলছে? এই যে শান্ত বিকেলে এক মানবের কথা শুনতে ‘জেতবন বিহারে’ সমবেত হয়েছে মগধের কত মানুষ। ছদ্মবেশি মহারাজ বিম্বিসার, তিষ্য, চণক, বিশাখা, মহারাজ প্রসেঞ্জিত, জিতসোমা, আম্রপালি এবং আরও নাম না জানা কত মানুষ। মুণ্ডিত মস্তক, রক্ত-কাষায় পরিহিত শ্রমণ গৌতম ‘দেশনা’ করছেন। তার একপাশে আনন্দ। সামনের মানুষগুলো চিত্রার্পিতের ন্যায় বুদ্ধের বানী শুনছেন। কি? দেখতে পারছেন না আপনারা? পাবেন কি করে,এ যে শত বৎসর পূর্বের কথা। আজ তাঁরা নেই। তবু আছেন। এখনও তাঁরা বেঁচে আছেন। সামান্য এক গোষ্ঠী-নেতার পুত্র থেকে মগধাধীপ হয়েছেন বিম্বিসার। তাঁর আসল নাম সেনিয়। মুখশ্রী সুন্দর বলে সুযোগ পেলেই দর্পণে নিজের মুখ দেখতেন বলে তাঁর আচার্য তাঁকে বিম্বিসার নাম দিয়েছিলেন। মুখে মুখে সেই নামটিই রয়ে গেল। অঙ্গরাজ্য জয় করে মগধে সুশাসন চালিয়ে যাচ্ছেন বিম্বিসার। বৃষস্কন্ধ-সিংহকটি এই পুরুষটি যেমন বীর,তেমনি কূটনীতিজ্ঞ। চক্রবর্তী রাজা হওয়ার মত সব গুণ রয়েছে তাঁর। আর মগধ হতে পারে সেই চক্রবর্তী ক্ষেত্র। কাত্যায়ন দৈবরাত তাঁর শিষ্য সেনিয়কে আশীর্বাদ করে গিয়েছিলেন। সেই আশির্বানী সত্য করতে এগিয়ে চলেছেন কাত্যায়ন চণক। আচার্য দৈবরাতের পুত্র। সাকেতের সেরা ধনী শ্রেষ্ঠী ধনঞ্জয়। পিতা মেন্ডক হলেন ভদ্দিয়ের সেরা ধনী। মহারাজ প্রসেঞ্জিত তাই ধনঞ্জয়কে নিয়ে এসেছেন তাঁর রাজ্যের শ্রীবৃদ্ধির জন্য। এবং তা হচ্ছেও। ধনঞ্জয়ের পত্নী দেবী সুমনা, বিদ্যা বুদ্ধি আর শারীরিক বলের দিক দিয়ে যে কোন পুরুষের সমতুল্য তিনি। মহারাজ বিম্বিসারের সতীর্থও বটে। তাঁর বুদ্ধির জন্য মাঝে মাঝেই ডাক পড়ে রাজভবনে। ধনঞ্জয়-সুমনার একমাত্র পুত্রী বিশাখা; পঞ্চকল্যাণী। রাজা উগ্রসেনের পুত্র তিষ্যর প্রণয় প্রত্যাখ্যান করে, কুমার কুনিয়র সাথে বিবাহ এড়াতে বিশাখা তাঁর বাবা-মার সাথে পরামর্শ করে স্রাবস্তির মিগার শ্রেষ্ঠীর পুত্রকে বিবাহ করতে সম্মত হয়। কন্যাকে পুত্রের মত করে বড় করেছেন সুমনা-ধনঞ্জয়। রূপ,গুণ,বিদ্যা-বুদ্ধিতে তাঁর সমকক্ষ বা উপযুক্ত পাত্র মেলা ভার। মিগার-পুত্র পুন্যবর্ধন ভোগী,কামুক নীচ। মনের মিলনের জন্য আকাঙ্ক্ষী বিশাখার জীবনে প্রেম-সুখ আসে না। সে বুদ্ধের শরণ নেয়। আর বিশাখার কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়ে রাজগৃহ ছেড়ে পথে বেড়িয়ে যায় তিষ্য। কাত্যায়ন চণকের উপরে ছিল দূতিয়ালির দায়িত্ব। কিন্তু তাঁর মনে মনে আরও কিছু ছিল। তক্ষশীলা-স্নাতক এই গান্ধার যুবকের মনে তাঁর পিতার স্বপ্ন পূরণের সাধ। সাথে সাথে তিনি লিখছেন রাজশাস্ত্র। দৈবরাত স্বপ্ন দেখেছিলেন এক চক্রবর্তী রাজার। যার ছত্রতলে এক হবে ভারতভূমি। সেই আশা নিয়ে বিম্বিসারের কাছে এসেছেন চণক। অদ্ভুত মানুষ এই বিম্বিসার। সামান্য গোত্রপতির পুত্র থেকে মগধের মহারাজ হয়েছেন। জয় করেছেন অঙ্গ। বৈবাহিক সম্পর্ক করেছেন প্রসেঞ্জিতের সঙ্গে। লিচ্ছবিদের কন্যাকে ঘরে এনেছেন। এই বীর কূটনীতিজ্ঞ মানুষটি নাকি এক নগরশোভিনীর প্রণয় আহ্বানে সাড়া দিয়ে শত্রুরাজ্যে ঢুকেছিলেন একা। গবাক্ষ থেকে গৌতমকে দেখে প্রধান সেনাপতির পদ দিয়ে দিতে চেয়েছিলেন এক নিমেষে। বিম্বিসার যতটা না একজন শৃঙ্খলিত রাজা,তার চেয়ে বেশি তিনি একজন মানুষ। শাক্যসিংহ গৌতম হতে পারতেন রাজা। গৃহসুখ,রাজ্যলোভ ছেড়ে তিনি হয়ে গেলেন সন্ন্যাসী। নিজেকে তিনি এখন বলেন বুদ্ধ। এক উজ্জ্বল প্রভা ঘিরে রাখে তাঁকে সব সময়। কাছে যেতেই সাধারণ মানুষেরা সেই প্রভায় স্নান করে। তথাগতর মুখ নিঃসৃত বানী শুনে বহু মানুষ মুহূর্তে বিস্মৃত হয়েছে নিজেকে, নিজের দুঃখকে। গৌতম মানুষের সামনে নিয়ে এসেছেন এক নতুন ধর্ম, এক নতুন জীবন। আমরা এমন এক সময়ের কথা বলছি যেখানে ইন্টারনেট তো দূরের কথা, রেডিও পর্যন্ত ছিল না। ছিল না ডাক ব্যবস্থা। মানুষ ছিল কূপমণ্ডূক। নিজের আশেপাশে কি ঘটছে তার বাইরে তারা কিছুই জানতেন না। রাজনীতিতে ছিল না সাধারণের কোন অংশগ্রহণ। ‘রাজা একজন আছেন, তিনি থাকেন রাজগৃহে। আর তিনি দেবতা’-এই ভাব ছিল মানুষের মনে। ধর্ম আর ধর্ম-প্রচারক যেখানে সব কিছুর উর্ধে। এমন এক সময়ে এক গান্ধার যুবক স্বপ্ন দেখেছিলেন এক রাজসঙ্ঘের। এক রাজার অধীনে একটি সঙ্ঘ গঠিত হবে। প্রত্যেকের থাকবে নিজ সেনাবাহিনী। বহিঃশত্রুর আক্রমণ মানে সবার উপরে আক্রমণ। সবাই মিলে প্রতিহত করা হবে তা। ইতিহাস আশ্রিত বেশিরভাগ বইই দেখা যায় সংকীর্ণ গণ্ডিতে আবদ্ধ। হয় একটি প্রেম কাহিনী,কিংবা একটি চরিত্রকে উপজীব্য করে একটা গল্প ফাঁদেন লেখক। সাথে হয়ত থাকে ধর্ম,দর্শন ইত্যাদি। বানী বসু এই বইটিতে নিয়ে এসেছেন কিছু ঐতিহাসিক মানুষকে। তাদের মন উপস্থাপন করেছেন। দেখিয়েছেন তাদের মানুষী চেহারা। দেখিয়েছেন পূর্ববর্তী এক সময়ের সমাজ-বাস্তবতা। পুরুষের কামুকতা,নারীর অসহায়তা। গণিকার ঋদ্ধি, রাজকুমারের দুর্বলতা। কিন্তু ‘মৈত্রেয় জাতক’-এর মূল হল রাজনীতি। এখানে এমকজনকে খোঁজা হয়েছে, যিনি মৈত্রীর মাধ্যমে গড়ে তুলবেন এক বিশাল জনপদ। আর্য্য অনার্য্য বিভেদ থাকবে না। দাস থাকবে না। নারী-পুরুষ হবে সমান মর্যাদার অধিকারী। চণক আর জিতসোমার চিন্তার মাঝ দিয়ে উঠে এসেছে অনেক রাজনৈতিক সত্য। অনেক ভবিষ্যৎ বানী। অজান্তে চণক হয়ত ‘ভারতবর্ষ’ কল্পনা করে গেছেন। গৌতম বুদ্ধ এই উপন্যাসের একটি মূলচরিত্র। বারবার আমরা তাঁর কাছে ফিরে যাই। এই মানুষটি যেন সবকিছু থেকে বিযুক্ত হয়েও সব কিছুর সাথে যুক্ত। তিনি শ্রমণ, কিন্তু কৃচ্ছতা সাধন করতে বলেন না। বুদ্ধ কাউকে শরীর নিপাত করে ধর্ম পালন করতে বলেন না। আর মানুষ তাঁর কাছে এসে, কথা শুনে অভিভূত হয়ে পড়ে। গ্রহণ করে প্রবজ্জা। আর তাতেই তাঁর অনুসারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। তিনি যাগযজ্ঞ করতে নিষেধ করেন। ক্ষেপে ওঠে ব্রাহ্মণরা। কিন্তু তাঁরা তথাগতর সঙ্গে তর্ক করতে গিয়ে নিজেরাই সঙ্ঘে আশ্রয় নেয়। বুদ্ধকে পরাস্ত করতে গিয়ে নিজেরাই পরাস্ত হয়। কি কারন এসবের? কেন গৌতমের সামনে সবাই এমন হয়ে যায়? তিনি নিশ্চয়ই জাদুবিদ্যা জানেন। উপন্যাসে একদিকে গৌতমের দেবত্ব, অন্যদিকে তাঁর মানুষী রূপ দেখানো হয়েছে। এই মানুষটির বুদ্ধি, মনন, মেধা, ধৈর্য, স্থৈর্য, কূটনীতি ছিল সময়ের চেয়ে এগিয়ে। প্রবল ধীশক্তি সম্পন্ন মানুষটির সামনে কেউ দাঁড়াতে পারতো না। যে জ্যোতি তাঁর চারদিকে ছড়ানো ছিল, তা কোন অলৌকিক কিছু নয়, বরং তাঁর ব্যক্তিত্বের দৃঢ়তা। গৌতম ছিলেন দার্শনিক। আবার তিনি রাজনীতি বুঝতেন অনেকের চেয়ে ভালো। মানুষের মন পড়তে পারতেন। গৌতমের দৃঢ়তার সামনে একবার রুখে দাঁড়িয়েছিল চণক। তারপর একদিন চণক বুঝতে পারে,যে চক্রবর্তী রাজার খোঁজ করছিলেন, সে আসলে গৌতম। মহারাজ বিম্বিসার একসময় বন্দী হন পুত্র অজাতশত্রুর হাতে। চণক তখন নির্বাসিত। বন্ধু বিম্বিসারের কাছ থেকে নির্বাসন দণ্ড পেয়ে হারিয়ে যান চণক। ফেলে যান তার অর্ধসমাপ্ত রাজশাস্ত্র। জীবনে সফল কিন্তু নিজের কাছে তখন পরাজিত বিশাখা। জিতসোমা তখনও তার রাজশাস্ত্র লিখে চলেছে। তিষ্য তখন সাড়া জম্বুদ্বীপ ঘুরে মগধের পরিকল্পনা জানিয়ে এসেছে। কিন্তু পারলেন না বিম্বিসার। কেননা তিনি শুধু রাজা নন। অমাত্যদের বিশ্বাসঘাতকতা আর পুত্রের লোভের হাতে রাজ্য সমর্পণ করলেন। পুত্র পিতাকে হত্যা করল অনাহারে। জম্বুদ্বীপ এক ছত্রতলে এলো না। দেহ রাখলেন তথাগত। আনন্দকে বলে গেলেন, তাঁর মৃত্যুর পাঁচ হাজার বছর পর আসবেন একজন। তিনিই হবেন মৈত্রেয়। চণক মিশে গেছেন বন্যদের সঙ্গে। ভূমি কর্ষণ করে ফসল ফলাচ্ছেন। তাঁকে সন্তান দিয়েছে এক বন্য নারী। চণকের স্মৃতি হারিয়ে গিয়েছে। তবু হঠাৎ মনে হয়, কিছু করা বাকি। মনে করতে পারেন না। তিনি জানেন না, তাঁর স্বপ্ন পূরণ হওয়া বাকি। তাঁর মৈত্রেয়-জন্ম বাকি।