User login
Sing In with your email
Send
Our Price:
Regular Price:
Shipping:Tk. 50
প্রিয় ,
সেদিন আপনার কার্টে কিছু বই রেখে কোথায় যেন চলে গিয়েছিলেন।
মিলিয়ে দেখুন তো বইগুলো ঠিক আছে কিনা?
Share your query and ideas with us!
Was this review helpful to you?
or
Valo
Was this review helpful to you?
or
গল্পের ভেতর কী থাকে, কী ঘটে—সোজাসাপটা জবাব খুঁজলে বলা যাবে, গল্পের শরীরে গল্পটাই মুখ্য। কাহিনি সূত্রে চরিত্রের জন্ম-বিকাশ-পরিণতি—সব মিলেমিশে পাঠকের চোখে একসময় পুরো গল্পের আকার ফরসা হয়ে ওঠে। এ রকম হিসাব মাথায় রেখে মশিউল আলমের সাম্প্রতিক গল্পগ্রন্থ পাকিস্তান পড়তে গেলে কেন জানি না মনের মধ্যে অতর্কিতে ধন্দ এসে উপস্থিত হয়। ধন্দ এই জন্য যে, গল্পের চেনাজানা আবরণের মধ্যে শেষ অবধি গল্পগুলো কতটা এবং কীভাবে গল্প হয়ে ওঠে; আর কেমন করেই বা পরিণতি পায় চরিত্রগুলো? কেননা, গোটা বইয়ে মশিউল যেভাবে একের পর এক গল্প বলে যান, তার মধ্যে টলটলে গল্প আছে বটে; কিন্তু গল্পের চরিত্রগুলো কতটা পরিণতি পায় কিংবা এখানে চরিত্রের পরিণতি সেভাবে আবশ্যিক কি না—এ রকম গুটিকয় প্রশ্ন মাথার ভেতর বন বন করে পাকিস্তান-এর পাট চুকানোর পরেও। এই গ্রন্থে জায়গা পেয়েছে নয়টি গল্প। গল্পগুলো আবার বিচিত্রমুখী—নির্দিষ্টভাবে বিষয়গত কোনো কেন্দ্র নেই বইটির। একেকটি গল্প পাঠককে একেক রকম অভিজ্ঞতার সামনে নিয়ে যায়। তবে ঐক্যের বিচার করলে মধ্যবিত্ত মানুষজনের বর্ণিল মনোভঙ্গিই গ্রন্থে নানামাত্রায় ছড়ানো ছিটানো। কথাসাহিত্যিক হিসেবে মশিউল আলম মোটেই অচেনা নন। হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, মাহমুদুল হক-পরবর্তী গল্পকারদের সারিতে তিনি এর মধ্যেই নিজেকে স্বতন্ত্রভাবে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন। লেখক সম্পর্কে কোনো পূর্ব ধারণা না রেখে শুধু এই বইটি পড়লেও পাঠক বুঝতে পারবেন, বিচিত্র আইডিয়ার পাশাপাশি গল্প নির্মাণকৌশলও তাঁর কতটা করায়ত্ত। প্রথম গল্প ‘ঘোড়া’কে দৃষ্টান্তে রেখেই আলোচনা বিস্তারিত করা যাক। ‘ঘোড়া’ গল্পের পুরো কাহিনির মধ্যে দুটি উপকাহিনী আছে—একটি বাবার, অন্যটি ছেলের। এখানে দুই প্রজন্মের মানুষের শৈশবের চোখ দিয়ে ঘোড়াকে দেখেছেন লেখক—‘একটা শাদা ঘোড়ার স্বপ্ন দেখতাম, যার পাখা ছিল। সে ঘোড়া দৌড়াত না, উড়ে-উড়ে যেত।’ এটা হলো বাবার শৈশবের চোখে দেখা। অন্যদিকে পরের প্রজন্মে পৌঁছে ছেলে যখন ঘোড়াটিকে দেখে, তখন তার চোখে নিরেট বাস্তবতার ছাপ ঢুকিয়ে দেন লেখক। ছেলে বাবাকে বলে, ‘ঘোড়া তো পাখি না, ঘোড়ার কেন পাখা থাকবে!’ আলাদাভাবে দুই প্রজন্মের দুই ব্যক্তির মধ্যে দেখার যে ফারাক, সেটি জলবৎ তরলং। স্কুলপড়ুয়া ছেলের চোখে যেখানে বাস্তব ও কল্পনার মিশেলে এক ধরনের স্বপ্ন-আবেশ থাকার কথা, সেখানে ছেলের চোখে বাস্তবতার ঘাই ছাড়া অন্য কোনো স্বপ্ন নেই। ঘোড়ার পাখা গজানোর ব্যাখ্যা হিসেবে বাবা যতই তার সামনে রূপকথার জগৎ পেশ করেন, ছেলে কিন্তু বিভ্রান্ত নয় মোটেই। “আমি বলি, ‘মানুষেরা তাদের বলেছে, এই ঘোড়ারা, তোমরা তো পাখি না। তোমাদের পাখা থাকতে পারবে না। তোমরা যদি তোমাদের পাখাগুলি ঝরিয়ে না ফ্যালো তাহলে আমরা তোমাদের পাখির মতো গুলি করে মারব, তারপর রান্না করে খেয়ে ফেলব।’ তারপর থেকে ঘোড়ারা মানুষের ভয়ে পাখাগুলি লুকিয়ে রাখে, কিন্তু ইচ্ছা করলেই তারা পাখা মেলাতে পারে। অবশ্য সেটা তারা করে শুধু রাতের বেলা, বিশেষ করে যেসব রাতে পূর্ণিমা হয়, যখন চাঁদের আলোয় ভরে যায় সারা পৃথিবী।”—বাবার স্বপ্নজড়ানো ছেলেভোলানো কাহিনির পর ‘তুমি আমাকে এখনো বাচ্চা ছেলেই মনে করো, তাই না?’ প্রশ্নের মতো করে ছেলের এই উত্তর দুই প্রজন্মের দৃষ্টিভঙ্গিতে ব্যবধানকেই নির্দেশ করে। বিষয়টি আরও খোলাসা হয়ে ওঠে গল্পের শেষে। ছেলের বর্ণনা দিতে গিয়ে বাবার বয়ান—‘রাজ্যের বইখাতায় ঠাসা ভারী স্কুলব্যাগটির দুটি ফিতার ভেতরে ক্ষিপ্র দুই হাত গলিয়ে দিয়ে সেটিকে পর্বতারোহীর মতো পিঠে নিয়ে কাঁধ দুটো বার দুয়েক ঝাঁকিয়ে আমার মুখের দিকে চেয়ে ভদ্রলোকের মতো সৌজন্যের মৃদু হাসি হেসে হাত নেড়ে বিদায় জানিয়ে সে গট গট করে হেঁটে গেল স্কুলভবনের প্রধান ফটকের দিকে।’ সামান্য ঘোড়াকে কেন্দ্র করে লতিয়ে ওঠা গল্পটি সত্যিই অসাধারণ, নতুন ঢঙে লেখা। তবে প্রশ্ন হচ্ছে, গল্পের চরিত্ররা কি ঠিকঠাক পরিণতি পেয়েছে? পাক আর না পাক গল্পে বলা কথাটি কিন্তু ঠিকই বলা হয়ে গেছে—পাঠক বুঝতেই পারবেন না গল্পটি এর মধ্যেই শেষ হয়ে যাচ্ছে! গল্পকার হিসেবে মশিউলের অভিনবত্ব এখানেই। অপ্রত্যাশিত ঝলকানি লাগিয়ে তিনি গল্পের নটেগাছটি মুড়িয়ে ফেলতে পারেন! ‘ঘোড়া’র মতো প্রভুভক্ত অন্য গল্পগুলোও সরল-সহজভাবে হুট করে শুরু হয়। তেমন কোনো বাড়তি আয়োজনের দরকার পড়ে না। লেখকের সাবলীল ভাষাভঙ্গি গল্পের মধ্যে পাঠককে টেনে নিয়ে যায়। ‘পাকিস্তান’, ‘জামিলা’, ‘ট্রয়ের হেলেন’, ‘কোকিল ডেকে যায়’—সব গল্পের একই অবস্থা। ‘পাকিস্তান’ গল্পের ইমতিয়াজ, রূপিন্দর বা ফারহানা; ‘ট্রয়ের হেলেন’-এর হাবিব বা হ্যাপি; ‘অপরাধ ও শাস্তির গল্প’-এর কাজী মাজেদুর রহমান—সব চরিত্রের মুখ দিয়ে লেখক তাঁর কথাটি বলিয়ে নিলেন। ওদিকে গল্প থেকে গল্পে পৌঁছে শুরুর প্রশ্নটি যদি আরও একবার করা যায়, চরিত্রগুলো কী রকম পরিণতি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল শেষ পর্যন্ত? থাকল। পড়া শেষে নিশ্চিত মনে হবে মশিউল তাঁর গল্পের চরিত্রগুলোকে যেনবা এমনভাবে নির্মাণ করেছেন, যেখানে গল্পের শুরু থেকেই চরিত্রটি পরিণত। গল্প বলার নিজস্ব কৌশলের কারণেই লেখকের হাতে এমনটি ঘটেছে, তিনি তাঁর করণকৌশলগুলো আড়াল করতে পেরেছেন। তাই বলা যায়পাকিস্তান বইয়ের গল্পগুলো এমনই সহজাত-সাবলীল; আরোপ কিংবা জবরদস্তির চিহ্নমাত্র নেই।
Was this review helpful to you?
or
সাংবাদিকদের সাহিত্যে থাকে রাষ্ট্র, ইতিহাসের বিশ্লেষণ। সকল সমস্যা কীভাবে শেকড় বিস্তার করে সমাজের প্রতিটি রন্ধ্রে ঢুকে যায় তা খুব অসাধারণভাবে একমাত্র সাংবাদিকরাই প্রকাশ করতে পারেন। আর এর প্রমাণ পাই মশিউল আলমের গল্পগ্রন্থ “পাকিস্তান” পড়ার পর। বইয়ের নামটাই সকলের মনের মাঝে প্রশ্ন তৈরি করবে। কারণ বইয়ের নাম ‘পাকিস্তান!’ এই গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে মোট নয়টি গল্প। প্রতিটি গল্পে উঠে এসেছে রাষ্ট্র, ইতিহাস, রাজনীতি। এছাড়া সাংবাদিকতা জীবনের কয়েকটি অভিজ্ঞতাও তুলে এনেছেন মশিউল আলম। প্রথম গল্প ‘ঘোড়া’। এই গল্পে আছে এক কাল্পনিক ঘোড়ার কথা। সেই শাদা ঘোড়াটির পাখা ছিল। ঘোড়াটিকে গল্পের চরিত্রটি বারবার স্বপ্নে দেখে। ঘোড়াটি দৌড়াতো না। শুধু উড়তো। তবে লেখক খুব আশ্চর্যভাবেই বলেন যে, এই ঘোড়া নাকি তিনি স্বচক্ষে দেখার আগেই স্বপ্নে দেখে ফেলেছেন। ঘোড়াটি নিয়ে তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন ইতিহাসের নানা প্রেক্ষাপটে। নানান ঘটনায় পাখাওয়ালা ঘোড়ায় চড়ে বেড়াবে পাঠক। আবার একই ঘোড়া তার সন্তান দেখে। সন্তানও দেখে ঘোড়া উড়ছে। তাই সে তার বাবাকে বলে, ‘ঘোড়া তো পাখি না, ঘোড়ার কেন পাখা থাকবে!’ ছেলের কথায় বাস্তবতা থাকে। ঘোড়াটি উড়ে যাচ্ছিল জাতীয় সংসদ ভবনের ওপর দিয়ে। এভাবেই ঘোড়ার গল্প এগোয়। প্লটের প্রতিটি ঘটনায় থাকে শহরের বিভিন্ন অসঙ্গতির কথা। তবে গ্রন্থের দ্বিতীয় গল্পটি পাঠককে মুগ্ধ করবে। গল্পগ্রন্থটির নাম ‘পাকিস্তান’। আর এই গল্পটিই সেই পাকিস্তানকে নিয়ে। গল্পের শুরুটাই হয়েছে পাকিস্তানের প্রতি অসম্ভব ক্ষোভ এবং ঘৃণার মধ্যে দিয়ে। গল্পটির প্রধান চরিত্রের রুমমেট হয়ে আসে এক পাকিস্তানী ছেলে ইমতিয়াজ। তার সাথেই শুরু হয় স্নায়ুযুদ্ধ। কিভাবে তাকে কথা দিয়ে ঘায়েল করা যায় সেই চেষ্টাই চলতে থাকে। যদিও ওপাশ থেকে খুব একটা সুবিধা করতে পারছিল না ইমতিয়াজ। বরাবরই সুন্দর ব্যবহার দিয়ে ইমতিয়াজ চেষ্টা করছিল ব্যপারটিকে মীমাংসা করতে। কিন্তু এতে কোন লাভ হচ্ছিল না। কিন্তু গল্পের প্রধান চরিত্র কোনভাবেই তার সাথে মিশতে চায় না। এমনকি ইমতিয়াজের রান্না করা খাবারও সে খেতে চায় না। এক পর্যায়ে ইমতিয়াজ বলে, যুদ্ধের সময় তার বাবা পূর্ব পাকিস্তানিদের পক্ষে কথা বলেছিলেন বলে বন্দি হয়েছিলেন। এর পর থেকে ইমতিয়াজের প্রতি কিছুটা সহানুভূতি জেগে উঠে তার। গল্পটি যেভাবে বিস্তার লাভ করেছে তা একাধারে তুলে এনেছে ইতিহাস, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এবং পাকিস্তানিদের মনোভাব। কখনও কখনও লেখককে মনে হয়েছে তিনি গল্পের মাধ্যমে পাকিস্তানের প্রতি তীব্র ঘৃণা জানাচ্ছেন। আবার কখনও কখনও মনে হয়েছে পাকিস্তানিদের যুদ্ধ নিয়ে ব্যাখ্যাগুলো তিনি খণ্ডন করতে চাচ্ছেন। মুসলিম লীগের জন্ম, জিন্না-ভূট্টো কীভাবে দেশটিকে যুদ্ধের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন সেটাও প্রকাশ হয়েছে গল্পে। গল্পের এক পর্যায়ে ইমতিয়াজের দেশ পাকিস্তান যায় গল্পের প্রধান চরিত্র। সেখানে ইমতিয়াজের পরিবারের সাথে তার পরিচয় হয়। উন্মোচিত হতে থাকে একের পর এক ইতিহাসের ভেতরে হারিয়ে যাওয়া কিছু গল্প। হতে পারে এটা পাকিস্তানিদের ব্যাখ্যা। পাকিস্তান ভেঙে যাওয়াকে তারা কীভাবে দেখে সেই বিষয়টিই হয়তো তুলে আনতে চেয়েছেন লেখক। ইমতিয়াজের পিতা পুরো ভারতবর্ষকে দেখেন নিজের মাতৃভূমির মতো। ভারতবর্ষ ভেঙে যাওয়ার পেছনে তার বিভিন্ন ব্যাখ্যা পাঠককে ইতিহাস সম্পর্কে নতুন কিছু তথ্য দিতে পারবে বলে আমার মনে হয়। তবে তিনি ভারত ভাঙার পেছনে মুসলিম লীগকেই সবচাইতে বেশী দায়ী করেছেন। ইমতিয়াজের পিতা ১৯৭১ সালে কোনো একটি পত্রিকায় কাজ করতেন। সেই সময় ঢাকায় ক্র্যাক-ডাউন হলে তারা ২৭ মার্চ পত্রিকার সম্পাদকীয়তে এর তীব্র সমালোচনা করেন। এর ফলাফল পেতে হলো ঠিক তার পরের দিনই। পত্রিকাটি বন্ধ করে দেয়া হলো। আর্মিরা তাদের গ্রেফতার করে নিয়ে গেলো। তিনি তার সময়ের নানান অত্যাচারের কথা বলেন। এছাড়াও পাকিস্তানিদের পূর্বপাকিস্তানে হামলাকে একটা চরম ভুল বলেও তিনি উল্লেখ করেন। ইমতিয়াজের পিতা তাহমিদুল হক আরও বললেন- …. ইন্ডিয়া যদি তোমাদের মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য না-ও করতো, তবু নিয়াজির বাহিনীর পক্ষে ওই যু্দ্ধের চূড়ান্তভাবে জেতা সম্ভব ছিল না। কারণ ওটা ছিল একটা জনযুদ্ধ। কোনো জনযুদ্ধেই বহিরাগত কোন বাহিনী শেষ পর্যন্ত জিততে পারে না।…. ইমতিয়াজের পিতার চেয়েও সবচাইতে আগ্রহের বিষয় হয় তার এক মেজর চাচা, যিনি ১৯৭১ সালে যুদ্ধের সময় পূর্ব-পাকিস্তানে দায়িত্বরত ছিলেন। তার সাথে কথা বলতে গেলেই তিনি পুরো ভুট্টোকেই পাকিস্তান ভঙ্গের জন্য দায়ী করেন। যদিও ইতিহাসে ঘাতক হিসেবে বেশি নাম আছে ইয়াহিয়ার। তার সম্পর্কে মেজর সাহেব বলেন- ‘পাগল আর মদ্যপের দোষ ধরতে নেই।’ এক পর্যায়ে মেজর সাহেব বাঙালিদেরও মানুষ হত্যায় মেতে উঠার কথা বলতে থাকেন। বলেন, সেখানে যত অবাঙালি ছিল সকলকে তোমাদের দেশের লোকেরা মেরেছে। এমনকি গণকবর নিয়েও তিনি বলেন, সেখানে অনেক মানুষ ছিল যাদের তোমাদের দেশের লোকেরাই শুধু মেরেছে। গল্পের প্লট যেনো ধীরে ধীরে ঘুরে যেতে থাকলো। বিস্তার যেভাবে বহমান ছিল এখন যেন ঠিক উল্টো দিকে মোড় নিলো। এক পর্যায়ে পাঠক গল্পটিকে আবিস্কার করবে একদম ভিন্ন প্রেক্ষাপটে। যখন জানতে পারবে মেজর সাহেবের এক পুত্র সন্তান আছে। যাকে তিনি নিয়ে এসেছিলেন বাংলাদেশ থেকে। ছেলেটির বাবা যে তিনি নন এটা এখনও ছেলে তা জানেন না। বর্তমানে সে ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য দেশের বাইরে আছে। তবে পড়াশুনা শেষ হলে তাকে বলা হবে বলেও মেজর সাহেব বলেন। এবং তাই হলো। গল্পের এক পর্যায়ে আমরা দেখতে পাই সেই ছেলেটি বাংলাদেশে আসে তার পিতা-মাতার খোঁজে। কিছুদিন থেকে সে চলে যায়। পিতা-মাতাকে পেয়েছে ঠিকই। কিন্তু দরিদ্র পিতা-মাতার সাথে হয়তো সে থাকতে পারেনি। গল্পের শুরুতে যেভাবে পাকিস্তানের প্রতি ঘৃণা দিয়ে শুরু হয়েছিল আমার কাছে মনে হয়েছে সেখান থেকে তিনি গল্পের শেষে এসে অনেকটাই বিচ্যূত হয়ে গেছেন। গল্পটি গভীরতর হতে হতে চলে গেছে বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে। গল্পকারের সার্থকতা হয়ত এখানেই। তিনি একটি গল্পকে বিভিন্ন মাত্রায় দাঁড় করিয়ে দিতে পেরেছেন। কিছুদিন আগেই সালাহউদ্দিন শুভ্রর “মানবসঙ্গবিরল” রিভিউ করতে গিয়ে বলেছিলাম, গরু নিয়ে গল্প বাংলা সাহিত্যে খুব কম। মশিউল আলমের গল্পগ্রন্থে এসেও দেখতে পাই আরেকটি গরু নিয়ে গল্প। তবে এই গরু আমার কাছে মনে হয়েছে প্রতীকী। এই গরু হয়তো ‘আমরাই’; সাধারণ জনগণ। মানুষ যে হারে নানান বিপদের সময় বেড়াজালে আটকে যায় সেখান থেকে বের করার সময় যে প্রশাসনিক সমস্যার সম্মুখীন হয় সেটাই উঠে এসেছে “জামিলা” নামক গল্পে। গল্পের জামিলা একটি মেয়ের নাম। যেই মেয়েটিকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিল মফিজ। টানাটানির সংসারে মফিজের রিক্সা চুরি যাওয়ার পর জামিলা চলে যায়। কোথায় যায় জানে না সে। পরে একটি সড়ক দূর্ঘনার মাধ্যমে একটি গাভী আসে মফিজের কাছে। সেই গাভীর নাম দেয়া হয় জামিলা। সেই জামিলাকে নিয়ে ঢাকায় থাকে মফিজ। মফিজ অসুখে পড়লে বিপাকে পড়ে জামিলা আর তার সন্তান। আর তখন জামিলা ছুটে বেড়ায় এদিক-সেদিক। কখনও সংসদ ভবন। কখনও গণভবন। কখনও বা চন্দ্রিমা উদ্যান। সংসদ ভবনে গিয়ে গুঁতো মারে এক পুলিশকে। আর তাই নিয়ে শুরু হয় গল্পের চমৎকার বর্ণনা। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীদের নানা কেচ্ছা দিয়ে এগিয়ে যায় ‘জামিলা’ গল্পটি। আইনের নানান হয়রানিগুলো স্পষ্ট করে তুলে ধরেছেন গল্পকার মশিউল আলম। জামিলাকে গ্রেফতার করা হয়। এরপর তার মালিক তাকে খুঁজে বেড়ায়। গল্পের শেষ পর্যন্ত খুঁজে বেড়ায় জামিলার মালিক। শুধু রাজনৈতিক কিংবা রাষ্ট্রের বিষয়গুলো নিয়েই ‘পাকিস্তান’ সেটা বললেও ভুল হবে। আছে ‘ট্রয়ের হেলেন’ নামে একটি গল্প। যেখানে ব্যর্থ প্রেমের এক উপাখ্যান বর্ণনা করেছেন গল্পকার। পুরাণ ভালোবাসার মানুষের সাথে বহু বছর পর দেখা ভিনদেশে। এই নিয়ে গল্প এগিয়ে যায়। অন্যদিকে আরেকটি গল্প ‘জ্বর’। যেখানে সিদাসাধা একটি গল্প এগিয়ে গিয়েছে। গল্পটির শুরুটা যতটা দুর্দান্ত মনে হয়েছিল ততটা থাকেনি শেষ পর্যন্ত। শুরুতে কবির দেখতে পায় তার মা সিলিং ফ্যানের সাথে ঝুলে আছে। মনে হয়েছিল হয়ত পাকিস্তানের মতো আরেকটি অসাধারণ গল্প পেতে যাচ্ছি। কিন্তু গল্পটা সাদামাটা হয়ে যায় ধীরে ধীরে। জ্বরে কাতর কবির ঘরের বিছানায় পড়ে থাকে। তার কোন শক্তি নেই। উঠতে পারে না। কথা বলতে পারে না। আর জ্বরের মাঝে নানা ধরনের উদ্ভট স্বপ্নের বেড়াজালে পড়ে কবির। সেই সময় তার অফিসের পিয়ন ইদ্রিস এসে হাজির হয়। ইদ্রিস হলো অফিসের বদ পিয়ন। ইদ্রিস নিয়ে আসে কিছু কাজ। যদিও এর আগে ইদ্রিস এসেছিল এবং সে জানে কবির অসুস্থ। কবির কাজ করতে অস্বীকৃতি জানালে ইদ্রিস সম্পাদকের নাম দিয়ে বলে যে এটা তাকে করতেই হবে। তখন কবির সম্পাদককে শালা বলে গালি দেয়। ইদ্রিস সম্পাদককে গিয়ে বলে, কবির তাকে হালারপুত বলে গালি দিয়েছে। তাই সুস্থ হওয়ার পর কবির অফিসে গিয়ে জানতে পারে তার চাকরি নেই। বিনিময়ে কবির তার বেতন দাবি করলে জানতে পারে তিনবছর তো তার কোন অফিশিয়াল নিয়োগ-ই হয়নি। কিসের বেতন? হতাশায় ভেঙে পড়ে কবির। আবার তার জ্বর আসে। কবির ভাবে- আজ রাতে ঘুমোলে সে আবার দেখতে পাবে তার মা ঝুলে আছে সিলিংফ্যানে। প্রতিটি গল্পেই সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা কোনো না কোনোভাবে ক্রিয়াশীল। আরেকটি গল্প ‘অপরাধ ও শাস্তির গল্প’। গল্পটি চমৎকার। ফোনের লাইন পেতে কী কী সমস্যা সকলকে পার হতে হয়, আশা করা যায় পাঠক এই গল্পটি পড়ে তা শিখে যাবেন। যথেষ্ট উপভোগ্য এই গল্পটি একজন নিরীহ সাংবাদিকের, যে কোনদিন তার এই পরিচয়টিকে অসৎকাজে ব্যবহার করেননি। তার দরকার টিএন্ডটি ফোনের লাইন। একজন অফিস কলিগের বুদ্ধিতে তিনি টিএন্ডটির একজন কর্মচারিকে ঘুষ দেন তার ফোনটা যাতে তাড়াতাড়ি লেগে যায়। কিন্তু এতো কোন লাভ হয় না। আসলে এটাই বর্তমানের প্রেক্ষাপট। কিভাবে সেই লোকটিকে হন্যে হয়ে খোঁজেন সাংবাদিক- তা দেখে আসলেই নিজেকেও একজন নিরীহ-অসহায় মনে হবে। সাংবাদিক প্রতিদিন সেই লোকটিকে খোঁজেন। তিনিও কথা হলে বলেন, লেগে যাবে। লাইন পেয়ে যাবেন এক সপ্তাহের মধ্যে। কিন্তু সেই এক সপ্তাহ আর শেষ হয় না। অবশেষে, তিনি চমৎকার এক পন্থা দেখান। টিএন্ডটির সেই লোকটির ছেলেকে তিনি ঘটনাটি বলেন। ঘুষ দেয়া হয়েছে তার বাবাকে। এমন কথা শোনার পর ছেলেটি চুপ করে থাকে। পরদিনই কাজি সাজেদুর রহমান তার অফিসে এসে হাজির হয়। চোখে মুখে অন্ধকার। ভাঙা ভাঙা স্বরে লোকটি সাংবাদিককে বলে, এতো বড় শাস্তি আমাকে না দিলেও পারতেন। পুত্রের কাছে পিতার এইভাবে ছোট হওয়াটা কাজী সাজেদুর রহমান মেনে নিতে পারছিলেন না। তাই টাকাটাও পরিশোধ করে গেছেন। সর্বশেষ ‘ডিগনিটাস’ গল্পটি একটি হিন্দি সিনেমার কথা মনে করিয়ে দেয়। বেশীদিন হয়নি ছবিটি মুক্তি পেয়েছে। ছবির নামটি ছিল ‘গুজারিশ’। সেখানে একটি লোক আত্মহত্যা করতে চায়। দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত লোকটি আইনি লড়াই চালায় তার আত্মহত্যা অধিকার প্রতিষ্ঠার করার জন্য। ঠিক সেরকই মশিউল আলমের ‘ডিগনিটাস’। আন্না নামে একজন নারী রোগের যন্ত্রণা সহ্য না করতে পারার ফলে সে আত্মহত্যার জন্য আইনি লড়াই চালাতে থাকে। এভাবেই গল্পটি এগিয়ে গিয়ে শেষে এসে আন্না আত্মহত্যার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। আমরা পুরো গল্প জুড়ে দেখতে পাই আন্না খালি বলে “আই নিড টু ডাই, প্লিজ হেল্প মি”। কিন্তু গল্পের শেষে এসে নায়কের প্রেমে পড়ে আন্না। তখন সে তাকে বলে- “আমাকে একটু আদর করে দাও, প্লিজ লাভ মি, প্লিজ হিল মি”। এমনই সব গল্প নিয়ে মশিউল আলমের “পাকিস্তান”। কখনও কোন গল্পকে সাদামাটা আবার কখনও দুর্দান্ত মনে হয়েছে। তবে প্রতিটি লাইন যেন মিলে যায় আমাদের দৈনন্দিন সমস্যাগুলোর সাথে। যা নিয়ে আমরা বেঁচে থাকি। যার সাথে বেঁচে থাকি। সর্বক্ষণ যা চোখের সামনে দেখতে পাই। সেগুলোকেই খুব ঝরঝরে প্রাণবন্তভাবে প্রকাশ করেছেন মশিউল আলম। তাই বলতে হয়, আমরা বেঁচে থাকি রাষ্ট্রে। সেখানে থাকে রাজনীতি। থাকে ইতিহাস। থাকে প্রেম-ভালোবাসা। থাকে স্বপ্ন। আর এই সবকিছুই পরিবর্তনের দিকে এগিয়ে যায়। এই সব নিয়েই পাকিস্তান।