User login
Sing In with your email
Send
Our Price:
Regular Price:
Shipping:Tk. 50
প্রিয় ,
সেদিন আপনার কার্টে কিছু বই রেখে কোথায় যেন চলে গিয়েছিলেন।
মিলিয়ে দেখুন তো বইগুলো ঠিক আছে কিনা?
Share your query and ideas with us!
Was this review helpful to you?
or
আত্মজীবনীকে কেন পাবলো নেরুদা স্বনামে না ডেকে অনুস্মৃতি বলছেন তার কৈফিয়ত তিনি নিজেই দিয়েছেন ভূমিকায়, ‘যে বিস্মৃতি জীবনেরই একটা অঙ্গ, সেই বিস্মৃতিই এর জন্য দায়ী।’ জীবনের নানা বিস্মৃত ঘটনা এবং স্মৃতিতে সদা উজ্জ্বল হয়ে থাকা ঘটনাগুলোর মধ্যে একটি স্পষ্ট পার্থক্য নির্দেশ করেন নেরুদা, যেটা প্রকৃতপক্ষে একজন কবির প্রকাশের যাতনার মতো বিশুদ্ধ আর দগদগে জ্বালাময় এক চিরন্তন অনুভূতি। সব ঘটনাই প্রণিধানযোগ্য নয়। জীবনের নানা বাঁকে ঘটে যাওয়া অজস্র ঘটনারাশির মধ্যে কিছু ঘটনা উজ্জ্বল হয়ে থাকে। রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে বালির ভেতরে যে নিয়মে কাচের টুকরা বা উজ্জ্বল ধাতব পদার্থ অনায়াসে আমাদের চোখে পড়ে, তেমনি সেসব মনে থাকা, স্মৃতির দেয়ালে গাঢ় দাগ কেটে বসে যাওয়া ঘটনাগুলোই হয়ে উঠেছে নেরুদার অনুস্মৃতির অনুষঙ্গ। আমরা দেখব সামান্য কয়েকটি লাইনে নেরুদা তাঁর অনুস্মৃতির ভূমিকা লিখছেন, যেটিকে মূলত কবিতা হিসেবেই পাঠ করেছি আমি, বিস্ময় আর মুগ্ধতায় স্তব্ধ হয়েছি প্রতিটি শব্দে- যেটা সম্ভব হয়েছে আমার ধারণা, নেরুদার আশ্চর্য বাকসংযম, শব্দের ওপর তাঁর অগাধ দখল আর সার্বক্ষণিক কবিতার ধ্যানমগ্ন থাকার ফলে। অনুস্মৃতি পড়ার সময় বারবার উপলব্ধি করেছি নেরুদাকে। পাহাড়ের গা ঘেঁষে একটানা, উদ্দাম, দীর্ঘ বৃষ্টির মনোরম ছন্দময় একঘেয়েমি আক্রান্ত করেছে আমাকে। যেন সবকিছুই আমার চোখের সামনে ঘটে চলছে, যেন ওই স্থান এবং কালে আমি হাজির ছিলাম। পাবলোর শৈশবের সমস্ত ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে চিরকালীন বালকের আত্মা হয়ে ঢুকে পড়েছি আমি। তেমুকা শহরের টানা বর্ষণে ভেসে যাওয়া কাদা যেন আমারই সামনে তার অদ্ভুদ গন্ধ ছড়াতে ছড়াতে ভেসে যাচ্ছে স্রোতে। পাবলো নেরুদার জন্ম মধ্য চিলির পারলাল শহরে ১৯০৪ সালের ১২ জুলাই। জন্মের এক মাসের মধ্যে মারা যান তাঁর মা। এরপর নেরুদার বাবা ভাগ্যান্বেষণে এসে তেমুকা শহরে স্থিত হন। শৈশবের অনেকটাই নেরুদা কাটান সেখানে। সেখানকার বর্ণিল স্মৃতিই মূলত নেরুদার শৈশবের স্মৃতি। স্কুলজীবনেই প্রেমের অভিজ্ঞতা হয় তাঁর, বন্ধুর জন্য প্রেমপত্র লিখে লিখে নিজেই হয়ে যান বন্ধুর ঈপ্সিত বালিকা ব্লাংকার প্রেমিক। আমৃত্যু প্রেমিক থেকে যাওয়া নেরুদার প্রথম প্রেম ছিল সেটা। এর্নান্দেসেদের খামারে ধান মাড়াই দেখার নিমন্ত্রণে গিয়ে বন্য প্রকৃতি আর মানুষের মধ্যে লাভ করেন প্রথম পূর্ণাঙ্গ যৌন অভিজ্ঞতা। খড়ের গাদার বিছানায় খোলা আকাশের নিচে অচেনা পরিবেশে অচেনা নারীর সঙ্গে তাঁর সেই আশ্চর্য অভিজ্ঞতা বয়ান করেন নেরুদা; ছোট কিন্তু অদ্ভুত সুন্দর সেই বর্ণনায় নারীটিকে মনে হয় চিরকালীন প্রকৃতির প্রতিরূপ। এরপর শহরে গিয়ে আবারও তিনি প্রেমে পড়েন সুন্দরী এক বিধবা মহিলার। দীর্ঘদিন প্রেমালাপের পরও নেরুদা সন্ধান পাচ্ছিলেন না তার মোহনীয় শরীরটার, মৃত স্বামীর প্রতি ভালোবাসা যাকে সরিয়ে রাখছিল শারীরিক সম্ভোগ থেকে, শেষ পর্যন্ত যেদিন চূড়ান্ত মুহূর্ত এল, মহিলা অশ্রুভরা চোখে অস্ফুট স্বরে তাঁর স্বামীর নাম জপছিলেন। নেরুদা বলছেন, ‘সেদিন ওঁকে দেখে আমার মনে হয়েছিল, অক্ষত যোনি চিরকুমারী এক সন্ন্যাসিনী আত্মসমর্পণের আগে বিদেহী ঈশ্বরকে মিনতি জানাচ্ছেন।’ অনুস্মৃতিতে নিজেকে অকপট তুলে ধরেছেন নেরুদা। শৈশবের নানা বর্ণিল আর বিচিত্র সব ঘটনা, মৃত রাজহাঁস, তাঁর পোষা বেজি, স্বপ্নের মতো ঘোড়া কিংবা সাগরপারের অপরূপ ভূমিসৌন্দর্য একের পর এক আমাদের সামনে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। ছাত্রাবস্থায় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া, পত্রিকার সাংবাদিক হিসেবে কাজ করা, কবিতার জন্য ভবঘুরে আর অনিশ্চিত জীবন কাটানো এসবই উঠে এসেছে নেরুদার অনুস্মৃতিতে। চিলির বাণিজ্যদূত হয়ে ঘুরেছেন পৃথিবীর পথে পথে। ভারতবর্ষে এসে আফিমের অদ্ভুত অভিজ্ঞতা, শ্রীলঙ্কায় তাঁর একাকী দিনগুলো, সিঙ্গাপুরের রূপোপজীবিনীদের সান্নিধ্যে কাটানো সময় ইত্যাদি খুঁটিনাটি জীবনের চিত্রগুলোকে নেরুদা তুলে ধরেছেন অনুস্মৃতিতে। এটি শুধু একক ব্যক্তির আত্মকথন নয়, এর মাধ্যমে আমরা একটি যুগের বহু বিশিষ্ট সাহিত্যিক, শিল্পী, রাজনীতিকদের সান্নিধ্য পাই। লোরকা, এলুয়ার, আরাগঁ, পিকাসো, রিবেরা, গান্ধীজি, নেহরু, মাও জে দং, ফিদেল ক্যাস্ত্রো, গেবারা, আয়েন্দেসহ আরও অনেকেই এসে হাজির হন তাঁর অনুস্মৃতিতে। নোবেলজয়ী কবি, রাজনীতিক, রাষ্ট্রদূত, সামান্য চাকুরে বা রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচন প্রার্থী এ রকম বহুবিধ নেরুদাকে আমরা পাই এখানে। আর সর্বত্রই সবকিছু ছাপিয়ে তাঁর সংবেদনশীল প্রেমিক এবং কবি রূপটিই আমাদের চোখে পড়ে। নেরুদা অনুস্মৃতি লেখা শুরু করেন জীবনের প্রায় শেষদিকে এসে। ১৯৭৩ সালে এক সামরিক অভ্যুত্থানে তাঁর প্রিয় বন্ধু সালভাদর আয়েন্দে নিহত হওয়ার পরপরই তিনি অনুস্মৃতির শেষ অধ্যায় লেখেন, যে অভ্যুত্থানের মাত্র ১২ দিন পরই মারা যান তিনি। তাঁর মৃত্যুর পর ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত হয় অনুস্মৃতি। ইংরেজিতে এটি প্রকাশিত হয় মেমোয়ার্স নমে। এর পর থেকে পৃথিবীব্যাপী নানা ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং এখন পর্যন্ত অনূদিত হয়ে চলেছে বইটি।