User login
Sing In with your email
Send
Our Price:
Regular Price:
Shipping:Tk. 50
প্রিয় ,
সেদিন আপনার কার্টে কিছু বই রেখে কোথায় যেন চলে গিয়েছিলেন।
মিলিয়ে দেখুন তো বইগুলো ঠিক আছে কিনা?
Share your query and ideas with us!
Was this review helpful to you?
or
#আড্ডাখানায়_রকমারি #রিভিউ_২০২৩ বইঃ জাহান্নম হইতে বিদায় লেখকঃ শওকত ওসমান প্রকাশনীঃ সময় প্রকাশন পৃষ্ঠাঃ ৭৯ মূল্যঃ ১২০ টাকা। কিছু বই থাকে যা পড়ার পর মনে আলাদা একটা আত্মতৃপ্তি আসে। তখন চোখ বন্ধ করেই আমরা সেই বইগুলোর গায়ে ভালো বইয়ের ট্যাগ লাগিয়ে দেই। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে লেখা শওকত ওসমানের "জাহান্নম হইতে বিদায়" ঠিক তেমনই একটা বই। “জাহান্নম হইতে বিদায়” উপন্যাসটি মূলত পোড় খাওয়া এক স্কুল শিক্ষকের বিমর্ষ চোখে দেখা এদেশের মুক্তিযুদ্ধের কিছু খন্ডচিত্র। গল্পের সেই প্রবীণ শিক্ষক যার নাম গাজী রহমান, তিনি নরসিংদীর একটি বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। বাড়িটি অবশ্য তাঁরই এক পুরাতন ছাত্র ইউসুফের। যুদ্ধের বয়স তখন কেবল দেড় মাস। গাজী রহমান যে যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন বিষয়টা এমন নয়। কিন্তু তাঁর স্কুল বিভিন্ন কাজ করে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ফলস্বরূপ গাজী রহমানের নাম ওঠে গেছে হানাদার বাহিনীর কালো তালিকায়। এরপর থেকে সকলের মুখেই ঐ এক কথা, “তোমার প্রাণ সংশয়াপন্ন। অতএব, নিরাপদ কোথাও চলে যাও।” শুরু হয় পৌঢ় শিক্ষকের জীবন রক্ষার আদিম তাগিদে অনিশ্চিত গন্তব্যে পথচলা। সেই ভয়াল যাত্রাপথে আগুনে পোড়া গ্রামের দেখা পায় গাজী রহমান। এমন অদ্ভুতভাবে কোনকিছু যে পুড়তে পারে তা তার জানাই ছিল না। পোড়া কড়িকাঠ ঝুলে আছে, নিচেই ভিটেতে লেপ্টে আছে কালো ছাইয়ের দাগ। ছোট ছোট খেজুরের গাছগুলো ঝলসানো দেহেই বাতাসে আন্দোলিত। সবকিছু যেন বর্বরতার সাক্ষীরূপে চারপাশের সবুজকে ব্যঙ্গ করছে। দেখা হয় এক বৃদ্ধের সাথে। সে শুনায় কেমন করে তাকে দিয়ে দোকান লুট করিয়েছে পাক হানাদারেরা। নদী পথে দেখা হয় এক পৌঢ়া মহিলা ও তার কিশোর সন্তান ফালুর সাথে, যাদের জীবন বেঁচেছিল অন্য আরেকটি জীবনের বিনিময়ে। সেই অবলম্বনকে হারিয়ে তারা ফিরে যাচ্ছিল গ্রামে। শুধু ঐ দুজনই নয়, অজস্র মানুষ প্রাণভয়ে একবস্ত্রে দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে। তাদের গন্তব্য ছিল অনিশ্চিত, তবু তারা যাচ্ছে। কিন্তু যে জাহান্নম থেকে তারা বিদায় নিতে চাচ্ছে সেই মুক্তি কি এত সহজে মিলবে? এখানে যে চতুর্দিকে যমের আয়োজন। নদী-নালায়, ঝোপে-ঝাড়ে, গঞ্জে-বন্দরে, পথে-প্রান্তরে এমনকি মানুষের নিভৃত কক্ষেও। যমদূত তার জাল ছড়িয়েছে সর্বত্রই। সেই জালের ভেতরে আহতের গোঙানি, ধর্ষিতার আর্তনাদ, অসহায় মানুষের ফরিয়াদ সব একাকার হয়ে পাক খাচ্ছে শব্দের একটি বিশাল কুণ্ডের মধ্যে। সেখানে কেবল একটি শব্দেই আছে সমাধান। তা হলো মৃত্যু। গাজী রহমানসহ তারা কি পেরেছিলেন সেই শব্দকে ডিঙিয়ে যেতে? জাহান্নম থেকে বেরিয়ে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে? শওকত ওসমান বাংলা সাহিত্যের একজন প্রথম সারির লেখক। সমাজ ও সমসাময়িক বাস্তবতাই ছিল তাঁর লেখার মূল হাতিয়ার। সমাজের বাস্তব করুণ চিত্র এবং সমকালীন রাজনৈতিক অস্থিরতার বিভিন্ন ঘটনাকেই তিনি তাঁর লেখনীর মাধ্যমে স্থান দিয়েছেন। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে তিনি চারটি উপন্যাস লিখেছেন। সবকটিতেই তিনি ধরা দিয়েছেন একজন স্বার্থক কথাশিল্পী হিসেবে। "জাহান্নম হইতে বিদায়" উপন্যাসটির কলেরব ছোট। কারণ কোনো ধারাবাহিকতা নেই। কাহিনীর এতটা উত্থান পতনও নেই। ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ পরবর্তী দেড় মাস জুড়ে বাংলাদেশের উপর দিয়ে যে তাণ্ডব বয়ে গিয়েছিল তাই সংক্ষেপে উঠে এসেছে। তবে কলেরব ছোট হলেও কাহিনীর গাঁথুনি বেশ মজবুত। সত্যিকার অর্থেই সেই সময় দেশ জাহান্নম হয়ে উঠেছিল। অল্প পরিসরে ঐ সামাজিক দুর্যোগের সম্যক পরিচয়দান কঠিন ছিল। কিন্তু লেখক তা পেরেছেন । ব্যক্তি গাজী রহমানের আড়ালে ফুটিয়ে তুলেছেন যুদ্ধপীড়িত একটা দেশের দেড় মাসের কিছু চালচিত্র। সেখানকার আতঙ্কজনক পরিস্থিতি, স্বজন হারানোর বেদনা, চেকপোস্ট পার হওয়ার ভয়াল অভিজ্ঞতা ও শীতলক্ষ্যা নদীর তীরবর্তী মানুষের জনজীবন। মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকেই লেখক কলকাতায় চলে গিয়েছিলেন। লেখকের সেই ভয়াল যাত্রাপথের বাস্তব অভিজ্ঞতা আর কল্পনার মিশেলেই পরবর্তীতে রচিত হয়েছিল এই উপন্যাস। বাঙালি মধ্যবিত্তের মানসিক দ্বন্দ্ব, আক্রান্ত ও শত্রুকবলিত স্বদেশের মাটি থেকে প্রানভয়ে পালিয়ে যাওয়া মানুষের বিবরণ, হানাদার বাহিনীর হত্যা ও নির্যাতনের নির্মমতার চিত্র-এই বিষয়গুলো গাজী রহমানের চরিত্রের মাধ্যমে সাবলীলভাবেই উঠে এসেছে। এই চরিত্রটির মধ্যে একটা দ্বন্দ্বও কাজ করেছে সবসময়। কী করবেন? সবুজ মাতৃভূমি ছেড়ে পালিয়ে যাবেন, নাকি সংকটকালেও মাটি আঁকড়ে ধরে রাখবেন? লেখকের শব্দচয়ন আর ভাষা প্রয়োগ প্রশংসা দাবি রাখে। নিবিড় যত্নের ছাপ রয়েছে প্রতিটা বাক্যে। এমন সব উচ্চশ্রেণির শব্দ ব্যবহার করেছেন ফলে ঘটনার বর্ণনাভঙ্গিতে আলাদা একটা ভাবের উদয় হয়েছে। পড়তে গিয়ে পাঠক হয়তো ডুব দিবে সেই ভাব দরিয়ায়। সেখানে স্পষ্টতই দেখতে পাবে লেখক কী চমৎকার সুকৌশলে কাহিনীর চিত্রায়ন করে গেছেন। অনেকগুলো কথা তিনি বলে গেছেন কেবল মাত্র একটি বাক্যের অবতারণায়। শিল্পসাহিত্য বিচারে নামকরণ একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। লেখক এখানেও সফল। পাক হানাদারের অত্যাচারে সৃষ্ট এই জাহান্নম থেকে বেরিয়ে যেতে গাজী রহমানের যে প্রচেষ্টা তার জন্যই এরূপ নামকরণ। এই ভূখন্ডের সেই সময়ের ভয়াল পরিস্থিতি বুঝা যায় গাজী রহমানের একটা উক্তির মাধ্যমেই- “জোরে চালাও মাঝি। দেখছ না চারদিকে দোজখ? অগ্নিকান্ড দাউ দাউ জ্বলছে? আরো জোরে চালাও, আমি এই নরক থেকে বাইরে যেতে চাই।” সাহিত্যের মানদণ্ডে বিচার বিশ্লেষণ করলে হয়তো আরো অনেক কিছুই উঠে আসবে। কিন্তু মুক্তিকামী বাঙালি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামের দিনগুলোর যে চিত্রায়ণ লেখক করেছেন তাতেই "জাহান্নম থেকে বিদায়" হয়েছে উপন্যাস হিসেবে স্বার্থক। অনন্য, অসাধারণ।।
Was this review helpful to you?
or
Fantastic
Was this review helpful to you?
or
মুক্তিযুদ ভালো একটি উপন্যাস
Was this review helpful to you?
or
মুক্তিযুদ্ধ সময় কাল নিয়ে দারুন একটি উপন্যাস।
Was this review helpful to you?
or
দাম অনুযায়ী সব কিছুই ভলো ছিল৷
Was this review helpful to you?
or
শওকত ওসমানের ‘জাহান্নম হইতে বিদায়’ একটি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস। যুদ্ধ শুরুর মাস কয়েক পর একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক গাজী রহমানের নাম ওঠে কালো তালিকায়। কারণ তাঁর স্কুলটি স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় বিভিন্ন ভূমিকা রাখতে শুরু করে। জীবন বাঁচাতে অন্য এক এলাকায় আশ্রয় নেন তিনি। প্রথমে আশ্রয় নেন প্রত্যন্ত একটি গ্রামে, তাঁর পুরনো এক ছাত্রের বাড়িতে। তারপর জানতে পারেন, এই এলাকায়ও পাকি মিলিটারি পৌঁছে যাবে। তাই সেখান থেকে তিনি অন্যত্র পালানোর সিদ্ধান্ত নেন। এক জায়গা থেকে অন্য জায়গা, যুদ্ধ, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্নতা, অস্থিরতা, পাকিস্তানি সেনাদের হাতে ধরা পড়ার ভয় এবং এ কঠিন যাত্রাপথে দেখা নানা ঘটনাই এ উপন্যাসে বর্ণিত হয়েছে ।
Was this review helpful to you?
or
বইঃ জাহান্নাম হইতে বিদায় লেখকঃ শওকত ওসমান প্রথম প্রকাশ: নভেম্বর ১৯৭১ প্রচ্ছদঃ নওসাবা ডালিয়া প্রকাশনীঃ সময় প্রকাশন পৃষ্ঠাঃ ৭৯ মুদ্রিত মূল্যঃ ১২০ সাল ১৯৭১। সময়টা যুদ্ধের। চারিদিকে পরিস্থিতি খারাপ হতে থাকে হত্যাযজ্ঞের মেলাতে। মে মাসের প্রথম সপ্তাহে শেখ আজিজুর রহমানের পরিবার তার নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত হয়ে উঠে। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় তাকে ভারতবর্ষে পাঠিয়ে দেবার । এ ব্যাপারে তার মেজপুত্র আসফাক ওসমান সব ব্যবস্থা করে। সে তখন সায়েন্স ল্যাবরেটরিতে রিসার্চ অফিসার হিসেবে চাকুরিরত। তার পিয়ন ইদ্রিস মিয়া ও অন্যতম অধঃস্তন অফিসার জীবনকে সঙ্গে নেওয়া হয় গন্তব্য স্থলের জন্য। ওদের বাড়ি কুমিল্লা কোনাবন বর্ডারের কাছে। ওরা আজিজুর রহমানকে আগরতলা পৌঁছে দেবে। তার ছোট ছেলে জাঁনেসারও ছিল ওদের সঙ্গে। সেই সময় গুলোতে আজিজুর রহমান সবসময় মানসিক দ্বন্দ্বে থাকত। যে কেউ তার মুখ দেখলেই সেটা স্পষ্ট দেখতে পেত। যাত্রাপথের প্রত্যেকটি চিত্রপট উঠে আসে পরবর্তীতে তার লেখা একটি উপন্যাসে। উপরে উল্লেখিত আজিজুর রহমান বাংলা সাহিত্যে শওকত ওসমান নামে স্মরনীয় হয়ে আছে। আর তার যাত্রাপথের রথযাত্রাটি সাহিত্যে 'জাহান্নাম হইতে বিদায় ' শিরোনামে চিত্রিত এক জীবন্ত উপাখ্যান। জাহান্নাম হইতে বিদায় প্রত্যক্ষ ঘটনার উপর ভিত্তি করে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম উপন্যাস; এ কথা অনস্বীকার্য। এই উপন্যাসের পটভূমিতে দেখা যায় ১৯৭১ সালের যুদ্ধের বিভীষিকা চলছে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কর্তৃক চারপাশে বলাৎকারের পাশবিকতা। এরই প্রেক্ষিতে একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক গাজী রহমান জীবন বাঁচানোর তাগিদে ছুটতে থাকে শহর ছেড়ে অজানা গন্তব্যে। কারণ, যুদ্ধে তার স্কুল স্বাধীনতার জন্য অনেক সাহায্য সহযোগিতা করেছে। ফলশ্রুতিতে, গাজী রহমান এখন পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর কালো তালিকাভুক্ত। জীবন বাঁচাতে আশ্রয় নেয় এক প্রত্যন্ত গ্রামে। তাকে আশ্রয় দিতে এগিয়ে আসে ইউসুফ নামে তার এক পুরোনো ছাত্র। ইউসুফের স্ত্রী সখিনা সেবা যত্নে গাজী রহমানকে নির্ভার করার প্রচেষ্টা চালায়। কিন্তু, কপালের লিখন খন্ডায় কে? একসময় ইউসুফের গ্রাম পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী দ্বারা আক্রান্ত হয়। অগত্যা গাজী রহমান আবারও বেরিয়ে পরে অজানা গন্তব্যে। একদিকে ভীরু, কাপুরুষের মত পলায়নের তাড়না অন্য দিকে লড়ার মত্ত নেশা। কিন্তু কোথায় যাবে তিনি? জাহান্নামের কিনারা কতদুর বিস্তৃত? আদৌ কি পেরেছিল জীবন বাঁচাতে গাজী রহমান? এভাবেই রচিত হয় জাহান্নাম হইতে বিদায়ের পটভূমি। জাহান্নাম হইতে বিদায় এই উপন্যাসটি পড়তে গিয়ে পাঠকের মনে আরো কিছু উপন্যাসের কথা স্মরনে আসবে। তার মধ্যে অন্যতম আনোয়ার পাশার 'রাইফেল রোটি আওরাত'। নামটি উর্দুর গন্ধে ভরা। শব্দগুলো বিদেশী শব্দের আবরণে যদিও আমাদের কাছে পরিচিত; কিন্তু উপন্যাসে লেখক এই তিনটি শব্দেই বুঝিয়েছেন পাকিস্তানি হীন মানসিকতাকে। উপন্যাসে পাকিস্তানিদের মনোভাব ব্যক্ত হয়েছে এভাবে, " হাত দেওয়া যায় রোটি ও রাইফেলে। আর আওরাতের গায়ে। দুনিয়ার সেরা চিজ আওরাত আওর রাইফেল৷ রোটি খেয়ে গায়ের তাকত বাড়াও, রাইফেল ধরে প্রতিপক্ষকে ক্ষতম কর, তারপর আওরাত নিয়ে ফূর্তি কর। ব্যা, এহি জিন্দেগী হ্যায়। এই ত জীবন।' এই উপন্যাসের অধ্যাপক সুদীপ্ত শাহীনের কথা কি মনে আছে আপনাদের? ঘটনাচক্রে এই উপন্যাস গুলো মানে জাহান্নাম হইতে বিদায়, রাইফেল রোটি আওরাত লেখকদের প্রত্যেকেই শিক্ষক; উপন্যাসে কল্পিত চরিত্রদ্বয়ের মত। ছা-পোষা জীবনের বেড়াজালে লড়াইয়ের তীব্র বাসনা। কিন্তু প্রত্যক্ষ সংগ্রামে অংশগ্রহণ করতে পারেনা যাপিত জীবনের দ্বন্দ্বে! জাহান্নাম হইতে বিদায়ে গাজী রহমানের অক্ষমতার সুরও এমন করে বেজে উঠে নাগরিক যাপনের নিগূঢ় চাপে। বিবেকের দংশনে তার কন্ঠে ধ্বনিত হয়, "তোমরাও কথা বলতে ভয় পাও? তোমরা অশিক্ষিত, দরিদ্র। আর আমিও বহু ডিগ্রী অর্জনের পর তোমাদের খুঁটাতেই বাঁধা রয়েছি। আমাকে খুন করো। অপদার্থ, ভীরু.......। গলা টিপে আমাকে খুন করো। বালাই ঘুচে গেছে। মূর্খ আর পণ্ডিত সমান ওজন।” শিক্ষক গাজী রহমান, অধ্যাপক সুদীপ্ত শাহীনের কথা বললামই যখন; অধ্যাপক রায়হানের কথা বাদ দেব কেন? হ্যা, শওকত আলীর 'যাত্রা' উপন্যাসের অধ্যাপক রায়হানের কথায় বলছি। একাত্তরের পটভূমিতে রচিত এই উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় ১৯৭৬ সালে। উপন্যাসে দেখা যায় ঢাকা শহর ছেড়ে মানুষ জীবন বাঁচাতে পালিয়ে যাচ্ছে। বুড়িগঙ্গা ছেঁয়ে গেছে মৃত লাশে। একে একে নিজস্ব শহর ছেড়ে সরে পড়ছে উপদ্রুত মানুষ। অন্তহীন এই যাত্রাপথে তারা কোথায় যাবে? অনিশ্চিত গন্তব্যের পথে ধাবমান সেই জনস্রোতে উপন্যাসের প্রধান চরিত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রায়হান ও তার পরিবার। আক্রান্ত ঢাকা শহরে অধ্যাপক তাঁর স্ত্রী বিনু ও দুই সন্তান নিয়ে দুইদিন আত্মগোপনে থেকে অবশেষে জনস্রোতে ভেসে নদী পেরিয়ে অসংখ্য মানুষের সঙ্গে মিশে আশ্রয় নেয় অচেনা এক গ্রামের স্কুলঘরে। বিবেকের তাড়নায় বিক্ষত অধ্যাপকের চেতনার দ্বার। লেখক এই উপন্যাসে লিখেন, “দূরে সারা বাংলাদেশ জুড়ে তখন হত্যা আর অত্যাচার। হয়তো অন্য কোন গ্রামের আকাশে তখন ঘর জ্বালানো আগুনের শিখা আকাশমুখী লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে কিংবা কে জানে, হয়তো আরেক শহরের আকাশে ধবল জোছনা, নীল তারা আর দক্ষিণের বাতাস আগ্নেয়াস্ত্রের গুলিতে ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যাচ্ছে। ” উপরের প্রত্যেকটি চরিত্রের মধ্যে এক আর্তনাদ ভর করে প্রতিনিয়ত। সুভাষ দত্তের 'অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’ আরেকটি জলজ্যান্ত উদাহরণ এই আর্তনাদের। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অব্যবহিত পরে যে কটি চলচ্চিত্র মুক্তিযুদ্ধকে সার্থকভাবে ধারণ করেছে তার মধ্যে ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’ একদম প্রথম সারিতে রয়েছে। এই উপন্যাসের আনোয়ার হোসেনের চরিত্রটি আজকে আলোচ্য চরিত্রগুলোর আর্তনাদের আরেক রূপ। সিনেমার সেলুলয়েডে দেখা যায় ছবিতেও একজন চলচ্চিত্র অভিনেতা আনোয়ার হোসেন। পাকিস্থানি হানাদারদের তাণ্ডবে ধূলিসাৎ হতে থাকে বাংলার চারিদিক। জনে জনে মানুষ পালাতে থাকে সীমান্তের দিকে। ধর্ষিতা হয় গ্রাম্য তরুণী রোমেনা। কৃষক বদরুদ্দিনসহ অনেকে তরুণ মুক্তিযোদ্ধা হয়। কিন্তু মৃত্যু ভয়ে আনোয়ার হোসেন পালিয়ে বাঁচতে যায়। সাহসে কুলোতে পারেনা যুদ্ধে অংশ নিতে। শরণার্থীর বেশে ছুটে যায় ভারতীয় সীমান্তের দিকে। আশ্রয় শিবিরে অসংখ্য মানুষ। সীমান্তের দিকে এগিয়ে যাওয়ার পথে পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় আশ্রয়দলের সবাই। আনোয়ার হোসেন আত্মগোপন নেন ঝোঁপের আড়ালে। সেখানে দেখা হয় আবার রোমেনার সঙ্গে। বন্দিশিবির থেকে পালিয়ে এসে আত্মহত্যা করতে চায় রোমেনা। তার আগে দুজনেই ধরা পড়েন, বন্দি হন। বন্দী অবস্থায় আনোয়ার হোসেন দেখেন হানাদার বাহিনীর পৈশাচিক বর্বরতা। তার বিক্ষুব্ধ হৃদয় এক সময়ে কাপুরুষোচিত সত্তার দহনে জীর্ণ হয়ে পড়ে। এভাবেই, মুক্তিযুদ্ধের প্রতিটি পার্শ্বে জাহান্নাম হইতে বিদায়ের গাজী রহমানের স্বরূপ ভেসে উঠে। এ উপন্যাসে বৈশ্বিক রাজনৈতিক দিকের একটি স্পষ্ট ব্যাখা পাওয়া যায়। যেটি উপন্যাসটিকে অন্যান্য উপন্যাসগুলো থেকে আলাদা করে তুলে। শওকত ওসমান এ উপন্যাসে প্রায় কটাক্ষ করেছেন যুদ্ধকালীন চীনের ভূমিকাকে। একটু ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকালে, Cold War বা স্নায়ুযুদ্ধ শব্দটি প্রথম ব্যবহার করে মার্কিন সাংবাদিক ওয়াল্টার লিপম্যান তাঁর 'The Cold War' গ্রন্থে। ১৯৪৫ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পুঁজিবাদী যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যে সংঘাত হয় তা ইতিহাসে স্নায়ুযুদ্ধ নামে পরিচিত। পৃথিবী তখন দু'টি ভাগে বিভক্ত ছিল মার্কিন মুলক আর সোভিয়েত বিশালতায়। বাইপোলার নীতিতে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারত। অন্যদিকে, বিপক্ষ শক্তিতে ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন। যুদ্ধের শেষ দিকে যখন পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয় আসন্ন হয়ে আসে; জয় বানচাল করতে ৪ ডিসেম্বর জাতিসংঘে মার্কিন প্রতিনিধি সিনিয়র বুশ 'যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব' দেয় । যেখানে ভেটো দেয় রাশিয়া ও পোল্যান্ড। ৫ ডিসেম্বর সোভিয়েত প্রস্তাব দেয় পূর্ব পাকিস্তানে এমন এক রাজনৈতিক নিষ্পত্তি প্রয়োজন যার ফলে বর্তমান সংঘাত ও পাক বাহিনীর সহিংসতা অবিলম্বে বন্ধ হবে; প্রস্তাবটিকে সমর্থন করে পোল্যান্ড। প্রস্তাবটিতে ভেটো দেয় চীন! উল্লেখ্য যে, ১৯৪৯ সালের পর জাতিসংঘে ফিরে চীনের এটিই ছিল প্রথম ভেটো। শওকত ওসমান তার তুলির ছোঁয়াতে রাজনৈতিক এই বিষয়টি নিগুঢ়ভাবে ফুটিয়ে তোলে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ঋজুপথে শেষ অব্দি স্বাধীনতা নস্যাৎ করার ষড়যন্ত্র হয়েছে। বিজয়ের তিনদিন আগেও ১৩ ডিসেম্বর নিরাপত্তা পরিষদের মূলতবী বৈঠকে যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবের বিপক্ষে সোভিয়েত ইউনিয়ন ৩য়বারের মত ভেটো দিয়ে ষড়যন্ত্র বিনষ্ট করে দেয়। এ স্বাধীনতা তাই বহু পার্থিব, বাঙ্গালির অস্তিত্বের উজ্জ্বল স্বাক্ষর। শওকত ওসমানের এই উপন্যাসটি 'দেশ’ পত্রিকার সম্পাদক শ্রী সাগরময় ঘোষের অনুরোধে তিনি রচনা করেন এবং দেশ পত্রিকায় এটি প্রথম প্রকাশিত হয়। উপন্যাসটি সাতটি পরিচ্ছেদে বিভক্ত। এই উপন্যাস সম্পর্কে লেখক তাঁর নান্দীপাঠে লিখেছেন - ’বাংলাদেশের ট্র্যাজেডির প্রকৃত কাহিনীকারের অপেক্ষায় আছি। অল্প পরিসরে ওই সামাজিক ঘূর্ণিঝড়ের সম্যক পরিচয়দান কঠিন। বক্ষ্যমাণ উপন্যাস একটিমাত্র মানসলোকের বিবরণ। সেখানে পরিবেশ মতো যেটুকু ছায়া পড়েছে, তার কোন পটভূমির হদিস হয়নি।’ যদিও সমালোচকরা উপন্যাসটির গতিময়তা এবং কাহিনীর বিস্তরণ নিয়ে কলম ধরে; তথাপি প্রত্যক্ষ কাহিনীর বয়ানে এই উপন্যাসটি যুদ্ধ উত্তরকালীন সময়ের অন্যতম সেরা লেখা। ক্ষমতার পালাবদলে আমরা অনেক ভ্রমে ইতিহাসকে কালিমা লেপন করেছি। নিজেদের পূর্বপুরুষের ইতিহাসকে করেছি হেয়। একটি ছোট ঘটনা বয়ান করছি নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে। কিছুদিন আগে ক্লাসে বসে আছি বাকি সবাই মিলে। বিজ্ঞানের ক্লাস। একটু পরে স্যার ক্লাসে এলেন। আমাদের নিয়মিত বিষয়ভিত্তিক পড়াশোনা শুরু হয়ে যায়। একটু পরেই বিভিন্ন বিষয়ের অবতারণার মাঝে মুক্তিযুদ্ধের কথা উঠে এলো। স্যার বললেন, মুক্তিযুদ্ধের ওই যেসব গল্প বলা হয় আরকি, যদি সত্য বলেও ধরি! এভাবে স্যার অতীতের সাথে বর্তমানের একটি তুলনা দেওয়ার চেষ্টা করছিল। আমি মুহূর্তে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম 'গল্প' কথাটি শুনে। একজন শিক্ষকের মুখে যখন নিজের অস্তিত্ব নিয়ে এখনো এমন সন্দিহান শব্দ বেরিয়ে আসে, তখন সে ক্লাস থেকে আমি বেরিয়ে যাই 'জাহান্নাম হইতে বিদায়' প্রতুত্তরে! মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক এ উপন্যাসটি শেষ হয় জীবনানন্দের কবিতার একটি পক্তি দিয়ে; "আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে এই বাংলায়"। জন্মান্তরবাদের স্বাধীন ভূমিতে শব্দচাষী লেখক শওকত ওসমান স্বাধীনতাকে বয়ান করেছেন নিজস্ব সত্তার অন্তরালে গাজী রহমানের সংগ্রামী যাপনে। একসময় যাপনের এ বয়ানে লেখকের সত্তা বলে উঠে, 'এ নরকমুক্তির লগ্ন কবে আসবে?' আমাদের যাপিত জীবনে ক্রমশ হাহাকার বাড়ছে। এ উপন্যাসটি 'জাহান্নাম হইতে বিদায়' সেখানে জীবনের আরেক রূপ হিসেবে মানবিক সত্তাকে আলোকিত করে রাখবে। #হ্যাপিরিডিং
Was this review helpful to you?
or
তখন আমার বড় আপা মনোবিজ্ঞানে পড়তেন। প্রায় দিনই আমাদের কাজিনসহ মোটামুটি কুড়ি-পঁচিশ জনকে নিয়ে তিনি বিভিন্ন রকম খেলা খেলতেন। কেন খেলতেন সেসব বিষয়গুলো এখন আর তত মনে নেই কিন্তু খেলাগুলোর কথা মনে আছে। একটার কথা বলি। আমাদের পঁচিশ জনকে তিনি একটি বৃত্তের মত করে দাঁড় করালেন। তারপর একজনের কানে কানে একটা গল্প বললেন। গল্প শেষ হলে যাকে গল্পটি বললেন, তার পাশের জনের কানে কানে বলতে বললেন। সে আবার তার পাশের জনের কানে, তারপরের জন তার পাশের জনের কানে করে বলতে বলতে পঁচিশ নম্বর জনকে বললেন, প্রকাশ্যে সবাইকে শুনিয়ে বলতে। পঁচিশতম জন যেটা বললো, তার সাথে বড় আপার গল্পের খুব কমই মিল থাকতো। পরিবর্তন হতে হতে তিল কখনো তাল হয়ে যেত আবার তাল হয়ে যেত তিল। মনোবিজ্ঞানের ভাষায় এই খেলাটিকে কি বলে সেটা বলার উদ্দেশ্য আমার নয়। আমি এই খেলাটি থেকে শিখেছিলাম, যে কোন বিষয় জানতে হলে যতটা সম্ভব ভেতরে যেতে হবে, ঘটনার কাছাকাছি যেতে হবে। বাংলাদেশী বাঙালীদের সবচেয়ে বড় অর্জন হলো তার মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পাওয়া স্বাধীনতা। একইভাবে সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয়ও হলো, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সঠিক এবং গ্রহণযোগ্যভাবে সামনে না থাকা। যতদিন গেছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকৃত করা হয়েছে। কারা করেছে, কেন করেছে সেটা না হয় থাক। আমার মনে হয়, নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকে বিশেষভাবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বেশি বিকৃত করা হয়েছে। এখনও তার ধারাবাহিকতা চলছে। যুদ্ধকালীন বা যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরপরই যারা এ বিষয়ে বই লিখেছেন তাদেরগুলো অনেকাংশে বেশি গ্রহণযোগ্য বলে আমার মনে হয়। শওকত ওসমানের লেখার হাত যে কাউকে মুগ্ধ করবেই। তার লেখা উপন্যাস, “জাহান্নম হইতে বিদায়” আমার কাছে বিশ্বাসযোগ্য একটি দলিল বলে মনে হয়েছে। বইটি প্রকাশিত হয় নভেম্বর-১৯৭১ -এ। তখনও যদ্ধ শেষ হয়নি। পাকিস্তানী বাহিনীর যে বর্বরতা বইটিতে ফুটে উঠেছে তা আমাদেরকে একদিকে যেমন অশ্রুসিক্ত করে তেমনিভাবে দেশের প্রতি কর্তব্যবোধে উদ্বুদ্ধও করে। বত্রিশ বছরের শিক্ষকতা জীবন শেষ করে গাজী রহমান বয়সের ভারে ন্যুব্জ। বয়স তাকে অস্ত্র ধরে যদ্ধ করবার মত শক্তি দেয় না। কিন্তু তবুও সে দাগী আসামী। তার স্কুলেই সংগঠিত হতো স্বাধীনতার নানা কর্মকৌশল। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর শ্যেন দৃষ্টিকে এড়িয়ে সে আত্নগোপন করে তারই এক সাবেক ছাত্র ইউসুফের বাসায়। ইউসুফের স্ত্রী সখিনাকে তিনি কন্যাসম ভাবলেও তার কাছেই তাকে মিথ্যা বলতে হয়, যা তার স্বভাবসিদ্ধ নয়। সখিনার মা-বাবা হারানো একমাত্র ভাই, ঢাকায় পড়ে। সখিনা আর ইউসুফই অনেক কষ্টে এতদিন তার পড়ার খরচ চালিয়ে আসছিলো। আজ একমাস হলো তার খোঁজ নেই। তারা অবিরত কান্নায় বাড়িটাকে মরার বাড়িতে পরিণত করে রেখেছে। গাজী রহমান সখিনার ভাই খালেদের মৃত্যুর কথা জানতেন। তার বিছানায় ছোপ ছোপ রক্তের দাগ দেখে এসেছে খুব বিশ্বস্ত একজন সংবাদদাতা। তবু সখিনাকে মিথ্যা প্রবোধ দেয় গাজী রহমান। বলে তার কাছে স্পষ্ট খবর আছে, খালেদ বেঁচে আছে এবং সে মুক্তিফৌজে যোগ দিয়েছে। মিথ্যা সান্ত্বনা পায় সখিনা। ছাত্রের বাড়িও তার জন্যে নিরাপদ নয়। শীতলক্ষ্যা পাড়ি দিয়ে গাজী রহমান পৌঁছে যায় বন্ধু রেজা আলির বাড়ি। সেখানেই সে পেয়ে যায় আরেক বন্ধু কিরণ রায়কে। সেও বয়ো:বৃদ্ধ। তাকেও খুঁজছে মিলিটারি। সেখানেই কর্মপন্থা ঠিক হয়। গাজী রহমানকে বর্ডারের দিকে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়। সেসব এলাকায় গিয়ে মুক্তিফৌজের মধ্যে বক্তৃতা করে তাদের মনোবল চাঙ্গা রাখার দায়িত্ব দেওয়া হয় তাকে। অপরিচিত পথ প্রদর্শক সৈয়দ আলীর সাথে সে পৌঁছে যায় বর্ডারে । সেখানে গিয়ে সে সৈয়দ আলীকে বুকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করে তার পরিচয়। সৈয়দ আলী বলে- ”গোলামের কোন পরিচয় থাকে না, স্যার। গোলাম গোলামই। স্বাধীন বাংলাদেশেই হবে আমার পরিচয়।” বহু ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে গাজী রহমান বর্ডারে পৌঁছে। রাস্তায় রাস্তায় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বর্বরতা প্রত্যক্ষ করে। ছোট ছোট বাচ্চাদের লাশের চোখ উপড়ে খেতে দেখে কাক শকুনকে। পোড়া ঘর দেখে, ধর্ষিতার লাশ দেখে। বার বার নিজের কাছে নিজেই প্রশ্ন করে, বেঁচে থেকে কি লাভ! তবু মৃত্যু তাকে তাড়া করে বেড়ায়। পাকিস্তানী বাহিনীও তাকে তাড়া করে মৃত্যুর মতই। গাজী রহমান অপমৃত্যুকে ভয় পায় না। তার মন বলে- ” অপমৃত্যুর ভয় না-থাকা হয় দুঃসাহস, নচেৎ মূর্খতা। সংসারের বিনা কাজে হঠাৎ জন্তুর মত আয়ু খোয়ানো কারো অভিপ্রেত নয়। একবারই যখন বাঁচা, তার সমাপ্তি অর্থবহ হওয়া উচিত।” একবার হাঁটের কাছে কিছু তরুণ আর কিছু প্রৌঢ়কে আটক করে পাকিস্তানী বাহিনী। তারা তাদেরকে দিয়ে খালি বাজারের দোকান পাট লুট করাতে চায়। পাঁচজন তরুণ লুট করতে অস্বীকার করে। তাদেরকে গুলি করে হত্যা করে হানাদার বাহিনী। অন্যদের দিয়ে লুট করানোর সময় তারা ভিডিও করে। প্রৌঢ়রা বুঝতে পারেনা, কেন তাদের লুট করার দৃশ্য ভিডিও করা হলো। গাজী রহমান নৌকার সহযাত্রী তরুণের মতই বোঝে এসব দৃশ্য বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়া হবে, পূর্বপাকিস্তানীদের লুটেরা সাজাতে। ভিডিও দৃশ্য ধারণ কিংবা মিথ্যা প্রচার এখনও সারা বিশ্বের সমস্ত ক্ষমতাবানরা ব্যবহার করছে। নিপীড়িত মানুষের উপর পরিচালিত নিপীড়নকে বৈধ করতে এখনও মিথ্যা প্রচারণা চালানো হচ্ছে। আজো দেশে দেশে যুদ্ধকে বৈধ করতে মিডিয়ার অপব্যবহার করা হচ্ছে। যার ফলে শওকত ওসমানের “জাহান্নম হইতে বিদায়” আজও সমান আবেদনময়ী হয়ে বিরাজ করছে আমাদের সাহিত্য ভান্ডারে। নিজের মাতৃভূমিকে তাদেরই কাছে কিভাবে জাহান্নাম বানিয়ে তুলেছিল পাকিস্তানী বাহিনী, সেটা জানার জন্যে এই বই পড়া আবশ্যক। যারা নিজেদের শেকড় চিনতে চান, তাদের জন্যেও বইটি জরুরী।
Was this review helpful to you?
or
শওকত ওসমান বাংলাদেশের একজন চিন্তক, লেখক ও কথাসাহিত্যিক। মুক্তিযুদ্ধ ও ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে তিনি ছিলেন এক উচ্চকিত কণ্ঠের অধিকারী। "জাহান্নম হইতে বিদায়" উপন্যাস হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত রচনা করা প্রথম উপন্যাস । মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় এদেশে যে একটা গুমোট পরিস্থিতি বিরাজ করছিল তা লেখক এই উপন্যাসে বর্ণনা করেছেন । এক প্রবীণ শিক্ষক মনে হাজার দুঃখ -বেদনা- অশ্রু নিয়ে ভেসে চলছে এখান থেকে সেখানে ; না সে পাকিস্তানীদের সামনে মাথা উচু করে দাড়াতে পারছে , না সে সব কিছু স্বাভাবিক ভাবে মেনে নিতে পারছে কারণ বিবেক আর বয়স । কতো জনই তো চেয়েছিল এদেশ পাকিস্তানের হোক, পরে যখন নিজের চোখে দেখেছে পাকিস্তানী সৈন্যদের আসল রূপ তখন তারা নিজেরাই অনুশোচনায় আল্লাহ'র কাছে কতো হাজার বার চেয়েছে আর যারা নিজের ভুল বুঝেনি তারা তো রাজাকার - আলবদর হয়েছে । তাদের ছিল অত্যাধুনিক যুদ্ধাস্ত্র আর জানোয়ারের মতো হিংস্র মন , অপরদিকে আমাদের ছিল মনোবল আর দেশ মায়ের প্রতি গভীর ভালোবাসা তবুও আমরা স্বাধীন হয়েছি । "জাহান্নম হইতে বিদায়" উপন্যাসের নাম যা উপন্যাসটাও তা , বাকী সব কিছু তো বইটা পড়লে আপনারা বুঝতেই পারবেন । বই সংগ্রহ করে পড়ুন, যুদ্ধ চলাকালীন সময়ের অস্থিরতা অতি সামান্য অর্থাৎ চুল পরিমাণ হলেও অনুভব করতে পারবেন । শুভ হোক আপনার পাঠ্য কার্যক্রম।
Was this review helpful to you?
or
#রকমারি_বইপোকা_রিভিউ_প্রতিযোগিতা "জাহান্নাম হইতে বিদায়" উপন্যাসের পটভূমি ১৯৭১ সাল,যা শওকত ওসমানের প্রথম মুক্তিযুদ্ধভিক্তিক উপন্যাস। বলা হয়, প্রত্যক্ষ ঘটনার উপর ভিত্তি করে এটিই মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক প্রথম উপন্যাস। শওকত ওসমানের যুদ্ধকালীন ব্যক্তিগত যে ভাবনা তাই উঠে এসেছে তাঁর উপন্যাসের প্রধান চরিত্রের হাত ধরে। শওকত ওসমানের বড় ছেলে বুলবন ওসমান সে সময়ের প্রসঙ্গে লিখেছেন -''মে মাসের প্রথম সপ্তাহে আমরা বাবার বাংলাদেশে থাকাটা নিরাপদ নয় মনে করে ভারতবর্ষে পাঠিয়ে দেবার সিদ্ধান্ত নিই। এ ব্যাপারে আমার মেজভাই আসফাক ওসমান সব ব্যবস্থা করে। সে তখন সায়েন্স ল্যাবরেটরিতে রিসার্চ অফিসার হিসেবে চাকরিরত। তার পিয়ন ইদ্রিস মিয়া ও অন্যতম অধঃস্তন অফিসার জীবনকে সঙ্গে নেয়। ওদের বাড়ি কুমিল্লা কোনাবন বর্ডারের কাছে। ওরা বাবাকে আগরতলা পৌঁছে দেবে। আমার ছোটভাই জাঁনেসারও ছিল ওদের সঙ্গে। এই সময় বাবার যে মানসিক দ্বন্দ্ব তা আমরা তার মুখ দেখে বুঝতে পারতাম।যেটি উপন্যাসে বারবার এসেছে।" আলোচিত এই উপন্যাসের পর্যালোচনা: বাংলাদেশ পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী কর্তৃক আক্রান্ত হলে মাসদেড়েক পর একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক গাজী রহমান জীবন রক্ষার আদিম তাগিদে শহর ছেড়ে অনিশ্চিত গন্তব্যে রওনা হন। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তাঁর স্কুল বিভিন্ন কাজে ভূমিকা রেখেছে। তাই হানাদার বাহিনীর কালো তালিকায় তাঁর নাম ওঠে। প্রথমে তিনি আশ্রয় নেন এক প্রত্যন্ত গ্রামে তাঁর এক পুরনো ছাত্রের বাড়িতে। ছাত্রটির নাম ইউসুফ। ইউসুফ সওদাগরী অফিসের কেরানী। ইউসুফের স্ত্রী সখিনা গাজী রহমানকে সেবা যত্ন করে। কিন্তু এক সময় গাজী রহমান জানতে পারেন ইউসুফের গ্রামও দখলদার মিলিটারি বাহিনী দ্বারা আক্রান্ত হবে। তাই তিনি সেখান থেকে অন্যত্র পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এরপরই পালিয়ে বেড়ানোর সময় নানান ঘটনাবলী যা তিনি প্রত্যক্ষ করেন, তাই এ উপন্যাসে বর্ণিত হয়। কিন্তু গাজী রহমান কি আদৌ পালিয়ে বাঁচতে পেরেছিলেন? যে জাহান্নাম হতে বিদায়ের কথা বলা হচ্ছে তা কেমন বিদায় ছিল? এ কী পৃথিবী থেকে বিদায়? নাকি সামরিক জান্তা কর্তৃক জাহান্নামে পরিণত হওয়া বাংলাদেশ থেকে সাময়িক বিদায়? উপন্যাস শেষ হয় কবিতার পংক্তি দিয়ে, 'আবার আসিব ফিরে ধানসিড়িটির তীরে'- প্রধান চরিত্রের এ উক্তির কারণ কী ছিল? তা কী জীবনানন্দের মতই জন্মান্তরবাদ ছিল? না অন্য কিছু? এই সব কিছুর উত্তর লুকিয়ে রয়েছে হৃদয়গ্রাহী এ উপন্যাসে। পাঠপ্রতিক্রিয়া: আনোয়ার পাশার "রাইফেল রোটি আওরাত "(১৯৭১), শওকত ওসমানের "জাহান্নাম হইতে বিদায়" (১৯৭১) ও শওকত আলীর "যাত্রা"(১৯৭৬) - এই তিনটি উপন্যাসের মধ্যে আশ্চর্যজনকভাবে একটা মিল খুঁজে পাওয়া যায়। তিনটি উপন্যাসের (রাইফেল রোটি আওরাতের সুদীপ্ত শাহীন, যাত্রা উপন্যাসের অধ্যাপক রায়হান এবং জাহান্নাম হইতে বিদায় উপন্যাসের গাজী রহমান) কেন্দ্রীয় চরিত্র পেশায় শিক্ষক এবং লেখকত্রয়ীও পেশায় শিক্ষক। ফলে উপন্যাসের চরিত্রের মধ্যে তাঁদের আত্মচরিত্রের প্রক্ষেপ ঘটেছে। মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ শক্তির প্রতি তাঁদের অসীম মমত্ব রয়েছে এবং তাঁরা মনেপ্রাণে চান দেশ স্বাধীন হোক কিন্তু কেউ প্রত্যক্ষ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন না। এ চরিত্রগুলো আমাদের সমাজের মধ্যবিত্তসমাজের প্রতিনিধিত্ব করে। একাত্তরের যুদ্ধে মধ্যবিত্ত সমাজের ভূমিকা অপরিসীম। চিন্তায়, মননে তারা মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক হলেও, নিজের আত্মরক্ষা, পরিবারকে নিরাপত্তা দানই তাঁদের কাছে প্রধান হয়ে ওঠে। তাই একাত্তরের সময়কালে চেতনায় তাঁরা ছিলেন উজ্জীবিত, কিন্তু মানসে যন্ত্রণাদগ্ধ। পলায়নপর মানসিকতায় সেই সমাজ ক্রমাগত বিপদ ও বৈরী বাস্তবতা থেকে দূরে থাকতে চেষ্টা করে। কিন্তু তার বিবেক জাগ্রত, সেও মনেপ্রাণে মুক্তি কামনা করে, তার মধ্যেও প্রবল দেশপ্রেম রয়েছে। তবু তার মধ্যে যে মানসিক দোলাচল তাই যেন গাজী রহমানের মধ্যে প্রতিফলিত হয়। তথাপি এ উপন্যাস সমালোচনার উর্ধ্বে উঠতে পারে নি পুরোপুরি। সমালোচকদের মতে "জাহান্নাম হইতে বিদায়" উপন্যাসের কাহিনির কোনো উত্থান-পতন নেই, দ্বন্দ্ব এবং চরিত্রের বিকাশও চোখে পড়ে না। "শহিদ স্মরণে" কবিতায় মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান বলেছেন, 'মুক্তিযুদ্ধ- এ এক বিরাট মহাকাব্য'। বাস্তবিক ভাবেই এটা সত্যি। এই মহাকাব্যকে একটি উপন্যাসে পুরোপুরিই তুলে ধরা সম্ভব নয়। মুক্তিযুদ্ধ একটি অভিযান। সে অভিযানে একেকজন অভিযাত্রী একেকভাবে তার অভিযাত্রার বর্ণনা করবে, সেটাই স্বাভাবিক।তাই, '৭১ এর যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে যে অস্থিরতা চলছিল, তার মধ্যে এ ধরনের উপন্যাস পাঠকসমাজকে দেওয়া, প্রসংশার দাবী রাখে। পুরো উপন্যাস জুড়েই রয়েছে কিছু এপিগ্রাম। যেমন: "গোলামের কোনো পরিচয় থাকে না। গোলাম গোলামই। বাংলাদেশের স্বাধীনতাই আমার পরিচয় হোক।" "গোটা বাংলাদেশ স্তব্ধ। শব্দের মালিক তারাই, যাদের হাতে মেশিনগান প্রভৃতি আগ্নেয়াস্ত্র আছে, পিতলের নক্ষত্র উর্দির উপর বসিয়ে যারা নিজেদের ভাবে পৃথিবী এবংআকাশ বিজেতা।" "এখানে হয় তুমি কসাই অথবা মাংস।" মুক্তিযুদ্ধ উত্তর প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক উপন্যাসের রেটিং করা দু:সাধ্য বটে তবুও আমার হিসাবে এর রেটিং ৪/৫