User login
Sing In with your email
Send
Our Price:
Regular Price:
Shipping:Tk. 50
প্রিয় ,
সেদিন আপনার কার্টে কিছু বই রেখে কোথায় যেন চলে গিয়েছিলেন।
মিলিয়ে দেখুন তো বইগুলো ঠিক আছে কিনা?
Share your query and ideas with us!
Was this review helpful to you?
or
রবীন্দ্রনাথ কে? এ প্রশ্নটির উত্তর খুঁজতে হলে রবীন্দ্রনাথকে পড়তে হবে- তাঁর সামগ্রিক সৃষ্টিসত্তার কাছে নিজেকে মেলে ধরতে হবে; এটা এই জন্য যে- রবীন্দ্রনাথ নিজেকে বিকশিত করেছেন ক্রমে ক্রমে, কুসুমের মতো; তিনি ধীর লয়ে অবগাহনের সঙ্গীত হয়ে উঠেছেন এবঙ ক্রমান্বয়ে সুরের ধারায় সৃষ্টি করেছেন নবতর তরঙ্গ। তাই, রবীন্দ্রনাথই একমাত্র বাঙালি, যাঁকে খুঁজে পড়তে হয় এবঙ পড়তে হয় আপাদমস্তক এবঙ তিনি লিখেছেন প্রচুর; তাঁর প্রাচুর্যের বারিবর্ষণে আমরা সিক্ত হতে থাকি, কিঙবা আমাদের আভ্যন্তরীণ চেতনা লীন হয়- রবীন্দ্রনাথের বিশাল-মূর্ত-বিমূর্ত ছায়াতলে। আগেই বলেছি রবীন্দ্রনাথ পড়তে হবে, এবঙ সেটা সম্পূর্ণ করতে হবে- বাঙালি ‘সম্পন্ন’ করে অনেক কিছুই, কিন্তু ‘সম্পূর্ণ’ করে না কিছু। তাই খেদ থেকে যায় মনের অরণ্যে। রবীন্দ্রনাথে অবগাহন নিশ্চিন্ত করতে পারে মানুষকে, যদিও সৃষ্টি রবীন্দ্রনাথকে নিশ্চিন্ত করেনি কখনও। রবীন্দ্রনাথের বিশাল ব্যপ্ত সৃষ্টিসম্ভারে কবিতাগুলো উদ্বেল এবঙ আকাশমুখী- এটা স্বীকারও করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, তিনি বলেছিলেন- তিনি ‘জমিনদারী’ করেন না, করেন ‘আসমানদারী’। এরপরেই আসে ছোটোগল্প, নাটক, তারপর তাঁর প্রবন্ধগুলো। সম্ভবত এরপর তাঁর উপন্যাসগুলো। আর সবার আগে তাঁর গান- যেগুলো উজ্জ্বল-উচ্চকিত-বাঙময়ী কথামালার সুরের স্নান। রবীন্দ্রনাথ পড়া তাই মোহনীয় প্রপাতের ধারার মতোই। এ যেনো প্রথম দেখা থেকে শুভদৃষ্টি পর্যন্ত এক দীর্ঘ ভালোলাগার পথ-পরিক্রমা। তাই, রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস পাঠ পর্বে ‘বউ-ঠাকুরাণীর হাট’ অপরিহার্য না হলেও প্রয়োজনীয়। এটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রথম উপন্যাস। প্রকাশকাল ১২৮৯ সালের পৌষ মাস। রবীন্দ্রনাথের সতেরো বছর বয়সের রচনা। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাদম্বরী দেবীর সাথে এ সময় রবীন্দ্রনাথ চন্দননগরে বেড়াতে গিয়েছিলেন। তখনই তিনি এ রচনায় হাত দেন। লেখাটা শেষ করেন কোলকাতার সদর স্ট্রিটের বাড়িতে। লেখা শেষ হলে কবির বড়দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পাদিত ‘ভারতী’ পত্রিকায় ১২৮৮ সালে কার্তিক সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত হয়। এটি রাজা প্রতাপাদিত্যের জীবনী অবলম্বনে রচিত একটি ঐতিহাসিক উপন্যাস। কবি উপন্যাসটি উৎসর্গ করেন দিদি সৌদামিনী দেবীর উদ্দেশ্যে। এই উপন্যাস রচনার তিরিশ বছর পরে রবীন্দ্রনাথ এর গল্পাংশ নিয়ে রচনা করেন “প্রায়শ্চিত্ত নাটক” (১৯০৯)। তারও কুড়ি বছর পর পুনরায় এই নাটকটি ভেঙে কবি লেখেন “পরিত্রাণ” নাটকটি (১৯২৯)। ‘বউ-ঠাকুরানীর হাট’ রবীন্দ্রনাথের প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস হলেও প্রথম উপন্যাস নয়। কারণ এর আগেও ভারতী পত্রিকা ‘করুণা’ নামে তাঁর একটি উপন্যাস ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করে। কিন্তু ‘করুণা’ গ্রন্থাকারে স্থান পায়নি। রবীন্দ্রনাথের এ প্রথম উপন্যাস অখন্ড গল্পগুচ্ছের পরিশিষ্ট-২ এ ‘অচলিত পুরাতন রচনার সংকলন’ হিসেবে স্থান পেয়েছে। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে ‘করুণা’ই রবীন্দ্রনাথের প্রথম উপন্যাস। ১৯৫৩-য় তৈরি হলো ‘বউঠাকুরাণীর হাট’ নিয়ে চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্রটির সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, তিনি লতা মুঙ্গেশকরকে দিয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়ালেন এই চলচ্চিত্রে। উপন্যাস সম্বন্ধে বঙ্কিমচন্দ্র বলেছিলেন- উপন্যাস লেখক অন্তর্বিষয় প্রকটনে যত্নবান হইবেন এই অন্তর্বিষয়ের ব্যাখ্যাও দিয়েছেন বঙ্কিম, বলেছেন মনন ও মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের কথা। বাঙলা উপন্যাসের প্রথম পর্ব মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ নয়- নীতি, আদর্শ, তত্ত্ব-প্রচার ও সঙস্কার পর্বের যুগ। এ ধারার বাইরের স্রোতের প্রসবণ যদিও তখনই, আরও বিশেষভাবে বললে বঙ্কিমচন্দ্র থেকেই খানিক শুরু হতে থাকে- তারপরও তার স্বগেদ্ভাসিত স্নিগ্ধতা ধরা পড়ে রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসপর্বে। ‘বউ-ঠাকুরাণীর হাট’ ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে লেখা। বাঙলার বারো ভূঁইয়ার অন্যতম রাজা প্রতাপাদিত্য-তার ছেলে উদয়াদিত্য-পিতৃব্য বসন্তরায়ের নানাদিকের নানামুখী বাঁকের আলোতে উপন্যাসটি এগিয়ে গেছে এবঙ গতি পেয়েছে, হয়েছে শক্তিশালী, প্রাণ পেয়েছে সুরমা ও বিভা চরিত্রটির জন্যে। উপন্যাসের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটটি আলোচনার দাবি রাখে। প্রাচীন যশোর রাজ্যের রাজধানী সুন্দরবনের ভিতর ছিলো বলে সুন্দরবনের অধীশ্বরকে সুন্দরবনের রাজা বলা হতো। এই সুন্দরবনের রাজা মহাজারা প্রতাপাদিত্য মহারাজা বিক্রমাদিত্যের পুত্র। বৈষ্ণব ধর্ম মতে পিতা-মাতা তাঁর নাম রেখেছিলেন গোপী নাথ। ১৫৬০ খৃষ্টাব্দে বা তার অব্যবহিত পরে অতি অল্প বয়সে শ্রীহরি বিক্রমাদিত্যর ঔরসে বসু কন্যার গর্ভে একটি সন্তানের জন্ম হয়। তার নাম রাখা হয় প্রতাপ গোপীনাথ। এই প্রতাপই বিশ্ববিশ্রুত বঙ্গেশ্বর মহারাজা প্রতাপাদিত্য। যুবরাজ অবস্থায় তিনি প্রতাপাদিত্য নামে পরিচিত হয়েছিলেন। রাম রাম বসু প্রতাপ সম্পর্কে লিখেছেন- জ্যোতিষিরা বলিলেন সব বিষয়েই উত্তম হইবে কিন্তু পিতৃদ্রোহী। হরিষেবিষাদ মনে রাজা অন্নপাশনে পুত্রের নাম রাখিলেন প্রতাপাদিত্য। অল্প বয়সে মা মারা যাওয়ায় কাকীমা বসন্ত রায়ের প্রথমা স্ত্রীর স্নেহে লালিত পালিত হতে থাকেন। পিতা তাঁর উপর বিরক্ত থাকলেও স্নেহমমতার মূর্তিমান অবতার রাজা বসন্ত রায়ের স্নেহগুণে তাঁর বিশেষ কোনো ক্ষতি হয়নি। প্রতাপের রাজত্বকালে এই মাতাই ‘যশোহরের মহারাণী’ বলে পরিচিত ছিলেন। রাজা প্রতাপাদিত্যের বিজয়গাঁথা নিয়ে আরও আগেই রচিত হয়েছে সাহিত্য। কবি ভরতচন্দ্র রায় গুণাকর তার ‘অন্নদামঙ্গল কাব্যে’ লিখেছেন- যশোর নগর ধাম প্রতাপাদিত্য নাম মহারাজ বঙ্গজ কায়স্থ নাহি মানে পাতশায় কেহ নাহি আঁটে তায় ভয়ে যত নৃপতি দ্বারস্থ।। বরপুত্র ভবানীর প্রিয়তম পৃথিবীর বায়ান্ন হাজার যার ঢালী ষোড়শ হলকা হাতী অযুত তুরঙ্গ যুদ্ধকালে সেনাপতি কালী।। কিন্তু ‘বউ-ঠাকুরাণীর হাট’ উপন্যাসটিতে রবীন্দ্রনাথ সে রাস্তায় হাঁটেননি; তিনি চেয়েছেন একটি মনবিকিরণের কাহিনী তুলে আনতে, যার অন্ত্যজ রসায়নে নিবিড় ভাসবে মনস্তত্বের কলাকৈবল্য। সেক্ষেত্রে কী রবীন্দ্রনাথ সফল? বা তিনি কি নিশ্চিত ছিলেন- একটি সফল মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস তিনি রচনা করতে পারবেন। ছিলেন না; বোধ করি সে কারণেই উপন্যাসের ভূমিকায় তিনি লিখেছেন- আর্টের খেলাঘরে ছেলেমানুষীরও একটা মূল্য আছে।.. ..এ যেনো অশিক্ষিত আঙুলের আঁকা ছবি, সুনিশ্চিত মনের পাকা হাতের চিহ্ন পড়েনি তাতে। উপন্যাসের শুরুতেই আমাদের সামনে উন্মোচিত হয় রাজা উদয়াদিত্যের দ্বন্ধ-সঙঘাতের পর্দা- সে যুবরাজ, উত্তরাধিকারী, কিন্তু সন্তান নয়। এ তার এক প্রগাঢ় বেদনা, যা পুরো উপন্যাসজুড়ে আমরা পেয়েছি এবঙ দেখেছি, হৃদয়ের চোখ খুলে- এ বেদনা অনতিক্রম্য। উদয়াদিত্য বলছেন- যুবরাজের ইচ্ছা পুরাইতে প্রাণ দিতে পারেন, কিন্তু প্রাণ দিলেও এই ইচ্ছা পুরাইতে পারিবেন না এই দুঃখ।.. ..রাজার ঘরে সকলি বুঝি কেবল উত্তরাধিকারী হইয়া জন্মায়, সন্তান হইয়া জন্মায় না। .. ..আমার প্রতি কার্য, প্রতি অঙ্গভঙ্গি তিনি পরীক্ষার চোখে দেখিয়া আসিতেছেন, স্নেহের চক্ষে নয়। কিন্তু পুরো উপন্যাসের শেষে এসে উদয়াদিত্যের জন্যে আমাদের ভালোবাসা জাগে না, জাগে করুণা- একজন যুবরাজ, হৃদয় নীলিমার সূক্ষ্ম বিচারে সে হয়তো তারও উর্ধ্বে- কিন্তু সেই ‘মানুষ’ উদয়াদিত্যও কখনো আসেনা আমাদের সামনে। প্রতাপাদিত্য যেমন সন্তান হিসেবে নয়, যুবরাজ হিসেবে দেখতে চেয়েছেন সন্তানকে; সন্তান উদয়াদিত্যও পিতার সামনে নয়, শাসকের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে প্রতিবার। তাই উদয়াদিত্য যেখানে হতে পারতেন এ উপন্যাসের নায়ক, হতে পারতেন সত্যিকারের যুবরাজ- কেবল প্রতাপাদিত্যের রাজ্যের নয়, পুরো পাঠকের হৃদয়ের- সেখান থেকে তিনি ছিটকে পড়েন- হয়ে ওঠেন একটি সাধারণ ‘সুখ-দুঃখের বৃত্তাবদ্ধ’ চরিত্র। এ প্রসঙ্গেই মনে আসে উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র সম্বন্ধে। সন্দেহ নেই- যদি শেকসপীয়রীয় রীতিতে সাহিত্যের চরিত্র-আখ্যান বিচার করি, তবে প্রতাপাদিত্যই ধরে রেখেছেন পুরো উপন্যাসের লাগাম, তিনি প্রখর হয়েছেন- ঘটনা শিথিল হয়েছে, হয়েছে তটস্থ। অতএব মানবিকতার বিচারে না দাঁড়ালেও যদি কেবল প্রখরতার প্রাচুর্যে হিসেব কষি- তবুও দেখতে পাবো- পুরো উপন্যাসে রাজা প্রতাপাদিত্যের চেয়ে প্রখরতর আর কেউ নেই। কেন্দ্রীয় চরিত্রের দাবি তাই তিনি করতেই পারেন। তবে এর অর্থ এই নয় যে- তিনি-ই নায়ক। ‘বউ-ঠাকুরাণীর হাট’ উপন্যাসের নায়িকা প্রশ্নে বিতর্ক থাকতে পারে, কিন্তু বোধ করি যে কোনো বিচারে এর নায়ক চরিত্র নিয়ে কোনো প্রশ্ন থাকবে না। প্রতাপাদিত্য আর যাই হোক নায়ক নন, উদয়াদিত্যকে নায়কের আসনে বসালে সেটা হবে সৌন্দর্যের সাথে চাতুরি, আর রামচন্দ্র, চন্দ্রদ্বীপের রাজা ও বিভার জীবনসঙ্গী, একজন স্থূল রাজনৈতিক কলা-কৌশলবিদ হতে পারেন- কিন্তু নায়ক কখনোই না। গভীরতা-প্রজ্ঞা-মানবিকতা-সাহস-চিন্তার প্রগাঢ়তা এ সমস্ত কিছুর বিচারে এক বসন্ত রায়ই আছেন- যিনি উদাত্ত কণ্ঠে বলতে পেরেছিলেন- তলোয়ারে শত্রুকে জয় করা যায়, কিন্তু সঙ্গীতে শত্রকে মিত্র করা যায়। বসন্ত রায় সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অনত্রও লিখেছেন। বসন্ত রায় কবি এবঙ কেবল কবি-ই নন, তিনি তাঁর নন্দনতত্ত্বের রসে জারিত করেছেন রবীন্দ্রনাথকেও। রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রবন্ধ সঙকলনের সমালোচনা অঙশে লিখছেন- কেহ কেহ অনুমান করেন, বসন্তরায় আর বিদ্যাপতি একই ব্যক্তি। এই মতের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক প্রমাণ কিছু আছে কি না জানি না, কিন্তু উভয়ের লেখা পড়িয়া দেখিলে উভয়কে স্বতন্ত্র কবি বলিয়া আর সংশয় থাকে না। প্রথমত, উভয়ের ভাষায় অনেক তফাত। বিদ্যাপতির লেখায় ব্রজভাষায় বাংলা মেশানো, আর রায় বসন্তের লেখায় বাংলায় ব্রজভাষা মেশানো। ভাবে বোধ হয়, যেন ব্রজভাষা আমাদের প্রাচীন কবিদের কবিতার আফিসের বস্ত্র ছিল। শ্যামের বিষয় বর্ণনা করিতে হইলেই অমনি সে আটপৌরে ধুতি চাদর ছাড়িয়া বৃন্দাবনী চাপকানে বত্রিশটা বোতাম আঁটিত ও বৃন্দাবনী শাম্লা মাথায় চড়াইয়া একটা বোঝা বহিয়া বেড়াইত। রায় বসন্ত প্রায় ইহা বরদাস্ত করিতে পারিতেন না। তিনি খানিকক্ষণ বৃন্দাবনী পোষাক পরিয়াই অমনি “দূর করো” বলিয়া ফেলিতেন! বসন্ত রায়ের কবিতার ভাষাও যেমন কবিতার ভাবও তেমন। সাদাসিধা, উপমার ঘনঘটা নাই, সরল প্রাণের সরল কথা- সে কথা বিদেশী ভাষায় প্রকাশ করিতে যাওয়াই মিথ্যা। কারণ, সরল প্রাণ বিদেশী ভাষায় কথা কহিতে পারেই না; তাহার ছোটো ছোটো সুকুমার কথাগুলি, তাহার সূক্ষ্ম স্পর্শকাতর ভাবগুলি বিদেশী ভাষার গোলেমালে একেবারে চুপ করিয়া যায়, বিদেশী ভাষার জটিলতার মধ্যে আপনাদের হারাইয়া ফেলে। বসন্ত রায়ের সার্বিক সত্তার মধ্যে কবি ও তার প্রকট ছায়া দৃশ্যমান। তাই আমরা উপন্যাসের প্রতিটি অধ্যায়ে দেখি বসন্ত রায়কে দিয়েই রবীন্দ্রনাথ মানবতার উচ্চকিত সৌধ নির্মাণের চেষ্টা করেছেন, এবঙ তিনি সেটা পেরেছেনও। বসন্ত রায় বলছেন- যে আমার অপকার করে সে আমার কাছে ঋণী, পরকালে সে ঋণ তাহার শোধ করিতে হইবে। যে আমার উপকার আমি তার কাছে ঋণী, কিন্তু কোনোকালে তাহার সে ঋণ আমি শোধ করিতে পারিবো না। ‘বউ-ঠাকুরাণীর হাট’ পাঠ করলে বোঝা যায় এখানে বঙ্কিমের প্রভাব সুস্পষ্ট। এর কারণ সম্ভবত এই যে- রবীন্দ্রনাথ তখনও উপন্যাসের ক্ষেত্রে আপন পথের সন্ধান পাননি। তাই সামাজিক উপন্যাস (অগ্রন্থিত) ‘করুণা’র পরে বঙ্কিমের পথ ধরে রবীন্দ্রনাথও হেঁটেছিলেন ঐতিহাসিক রোম্যান্টিক গতিময়তার পথে। ঐতিহাসিক উপন্যাস হিসেবে এর চারিত্রিক গড়নে যেমন ঐতিহাসিক ছাপ থাকার কথা ছিলো- সেরকম পাই না ‘বউ-ঠাকুরাণীর হাট’ এ। রবীন্দ্রনাথের কল্পনার রথ এখানে ঐতিহাসিক গবেষণার চৌকাঠ পেরিয়ে গেছে। উপন্যাসটির নারী চরিত্রগুলোর দিকে তাকালে দেখতে পাই- বিভা ও সুরমা একেবারেই গার্হস্থ্য। সাঙসারিক সুখ ও দুঃখের দোলায় দুজনেই দুলছেন। দুজনেই বঙ্কিমী আদলে স্বামীর জন্যে উৎসর্গিত প্রাণ। স্বামীর মঙ্গলকামনা ও তার ইচ্ছেকেই শিরোধার্য করেছে। তবুও বিভার চরিত্রে রবীন্দ্রনাথের স্পষ্ট প্রভাব ফুটে ওঠে। স্বামীকে তেমন কাছে না পেয়েও বিভা স্বামীকে ভালোবেসেছে। এই বোধ রোম্যান্টিক কবি হিসেবে রবীন্দ্রনাথ পরেও দীপ্র করেছেন- বারবার, প্রতিবার। বিভা রাজকন্যা এবঙ অন্য এক রাজার পত্মী। পিতার অহঙ্কারের দরুন সে স্বামীসঙ্গসুখ-বঞ্চিতা। সে ইচ্ছে করলেই স্বামীর ঘরে একলা যেতে পারে না। তার আত্মসম্মানবোধ প্রবল। স্বামীর অদর্শনে বিভার জীবনে আনন্দ নেই, কিন্তু সেই স্বামীর কাছ থেকে যখন ডাক এলো তখন বাঁধা হয়ে দাঁড়ালো ভ্রাতৃপ্রেম। এ দুয়ের দ্বন্ধে বিভার ভ্রাতৃপ্রেম জয়ী হয়। সে রামমোহনকে স্পষ্ট স্বরে জানিয়েছে- এখন আমি যাইতে পারিবো না। এ উপন্যাসে ঐতিহাসিক পটভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ উপস্থাপন করেছেন নারীর অধিকার-সচেতনতা। যদিও বিভা তার অধিকার থেকে বঞ্চিত, সুরমাকে অকালে প্রাণ দিতে হয়েছে, তবুও তাদের দুজনের কেউ-ই নিজেদের আত্মসম্মান বিসর্জন দেয়নি। যদিও রবীন্দ্রনাথের ভাষায় এ উপন্যাসের চরিত্রগুলো ‘পুতুলের ধর্ম’ ছাড়িয়ে উঠতে পারেনি। উপন্যাসের শেষে একেবারে সরলভাবে উপন্যাসের নামের সার্থকতা দেখানো হয়েছে। রবীন্দ্রনাথই দেখিয়েছেন। কী জানি- কবির বড়দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘ভারতী’ সম্পাদনা না করলে আদৌ তা পত্রিকায় ছাপা হতো কি না। শেষ লাইনটিতে লিখেছেন- চন্দ্রদ্বীপের যে হাটের সম্মুখে বিভার নৌকা লাগিয়াছিলো- অদ্যপি তাহার নাম হইয়াছে- বউ-ঠাকুরাণীর হাট। এ প্রসঙ্গে একটা প্রশ্ন জাগতেই পারে- আদৌ কি এমন কোনো হাটের ঠিকানা আমরা জানি? ইতিহাস পাঠে জানা যায়- প্রাচীন চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যের রাজধানী মাধবপাশার কাছাকাছি বর্তমান বরিশাল সদরের কাশীপুর ইউনিয়নের সারসী গ্রামের পাশেই গড়ে ওঠে একটি বাজার, যার নাম বউ ঠাকুরানীর হাট। উপন্যাসের দাঢ্যতা বিচারে এটি হয়তো টিকবে না, কিঙবা টিকলেও কেবল এই জন্য যে- এর ভেতরে একটা ঐতিহাসিক প্রাণ আছে। রবীন্দ্রনাথের অন্য উপন্যাসগুলো যদি পড়া হয়- বিশেষত ‘চতুরঙ্গ’, ‘গোরা’ ও ‘দুই বোন’- তবে নিশ্চিত হওয়া যাবে যে কতোটা ক্ষীণস্রোতা হয়ে ‘বউ-ঠাকুরাণীর হাট’ এগিয়ে গেছে এবঙ শেষ পর্যন্ত হাটে এসে পৌঁছেছে। তবে রবীন্দ্র সাহিত্যের সুবিশাল আয়েজনের রস-আস্বাদনে এই উপন্যাসটি অবশ্য পাঠ্য। তথ্যসূত্র ১। সমালোচনা গ্রন্থ, মাহবুবুল আলম, খান ব্রাদার্স, ঢাকা ২। কথাকোবিদ রবীন্দ্রনাথ, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, বাক-সাহিত্য লিমিটেড, কোলকাতা ৩। উপন্যাসে বাস্তবতা: রবীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্র গুপ্ত, চিরায়ত প্রকাশনী, কোলকাতা ৪। রবীন্দ্রনাথ ও আধুনিক মনন, ভবতোষ চট্টোপাধ্যায়, প্যাপিরাস, কোলকাতা