User login
Sing In with your email
Send
Our Price:
Regular Price:
Shipping:Tk. 50
প্রিয় ,
সেদিন আপনার কার্টে কিছু বই রেখে কোথায় যেন চলে গিয়েছিলেন।
মিলিয়ে দেখুন তো বইগুলো ঠিক আছে কিনা?
Share your query and ideas with us!
Was this review helpful to you?
or
অন্যপ্রকাশ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ রচনা সমগ্র - ৬ এ স্যারের লেখা দুটি বই স্থান পেয়েছে। একটি হল স্যারের আত্মজীবনীমূলক বই 'আমার উপস্থাপক জীবন' এবং আরেকটি হল স্যারের লেখা প্রবন্ধের সংকলন 'বন্ধ দরোজায় ধাক্কা'। বই দুটি সম্পর্কে নিচে সংক্ষেপে আলোচনা করা হল। ১. আমার উপস্থাপক জীবন : অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের অসংখ্য পরিচয়ের মধ্যে তিনি সর্বস্তরের মানুষের কাছে সবচেয়ে বেশি পরিচিত এবং জনপ্রিয় তাঁর টিভিতে উপস্থাপক হিসেবে পরিচিতির কারণে। তিনি দীর্ঘদিন বাংলাদেশের টেলিভিশনের সাথে কাজ করেছেন। অনেকগুলো অনুষ্ঠানের উপস্থাপনা করেছেন। কাজ করতে গিয়ে অনেক ভালো-মন্দ পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছেন। ‘আমার উপস্থাপক জীবন’ বইটি স্যারের সেই টিভিতে উপস্থাপনার দিনগুলোরই গল্প। এই বইটিতে অবশ্য একই সাথে বিটিভির শুরুর দিকের দিনগুলোর ইতিহাস সম্পর্কেও ধারণা পাওয়া যাবে। বইটি লেখক শুরু করেছেন তাঁর ছেলেবেলার গল্প দিয়ে। মূলত ছোটবেলা থেকেই যে তাঁর মঞ্চের প্রতি অপরিসীম আগ্রহ সেই প্রসঙ্গে আলোকপাত করার জন্যেই তিনি তাঁর স্কুলজীবনের কথা এনেছেন। ছোটবেলায় একবার মঞ্চে উঠার সুযোগ হারিয়ে ফেলার কারণে তিনি যে অত্যন্ত কষ্ট পেয়েছিলেন সেই ঘটনা বর্ণনা করেছেন। তারপর তিনি ছাত্র অবস্থায় রেডিওতে একবার অডিশন দিতে গিয়েছিলেন। তখনও তিনি ব্যর্থ হন। আর বুকভরা কষ্ট নিয়ে রেডিওর অফিস থেকে ফিরে আসেন। সেই গল্পও এই বইয়ের শুরুর দিকেই আছে। রেডিওর কাছে থেকে স্যার যেই খ্যাতি চেয়েছিলেন পরবর্তীতে টেলিভিশন এসে তা তাঁকে বহুগুণে দিয়েছে। ঢাকা শহরে যখন প্রথম টেলিভিশন আসে তখন তা সবার কাছে এক আশ্চর্য বস্তু। স্যার এক প্রদর্শনীতে গিয়ে প্রথমবার টেলিভিশন দেখেছিলেন। তাও বন্ধ অবস্থায়। আর স্যারের কী ভাগ্য, এই ঘটনার অল্প কিছুদিন পরেই তিনি নিজেই টিভিতে একটি অনুষ্ঠান করার সুযোগ পেয়ে যান। স্যারের উপস্থাপনায় সেই অনুষ্ঠানটি সে সময়ে বেশ জনপ্রিয়ও হয়। তারপর থেকে স্যার টেলিভিশনের মোটামুটি নিয়মিত মানুষ হয়ে যান। তখন স্যার একটা ধাঁধাঁর অনুষ্ঠান করতেন। সেই সময়ে স্যার এতটাই জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন যে মানুষ সারা সপ্তাহ স্যারের অনুষ্ঠানটি দেখার জন্যে অপেক্ষা করে থাকতো। এই সবই হল যুদ্ধের আগেকার কথা। তারপর যুদ্ধ শুরু হল। সেই যুদ্ধের সময় এমন একটা ঘটনা ঘটে যে কারণে স্যার নিজেই তাঁর উপস্থাপক সত্ত্বার কাছে আজীবন কৃতজ্ঞ। সে সময় একবার পাকিস্তানী আর্মিরা ভুলে স্যারকে ধরেন। তারপর তাঁকে আরও অনেক মানুষের সাথে একটা ঘরে বন্দী করে রাখা হয়। স্যার অনেকের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছিলো না। শেষে রাত্রেবেলা ঊর্ধ্বতন আর্মি অফিসার আসে। এখন তার হাতেই অন্য অনেকের সাথে স্যারের জীবনও বন্দী। সে যাকে যাকে ছাড়ার আদেশ দিবে তারা মুক্ত আর যাকে যাকে মেরে ফেলার নির্দেশ দিবে তাদের খুন করা হবে। স্যার তখন বেঁচে থাকার আশা পুরোপুরি ছেড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর ভাগ্য লেখা ছিল অন্যভাবে। সেই আর্মি কর্মকর্তা স্যারকে দেখেই চিনে ফেললো। কারণ সে স্যারের অনুষ্ঠান আগেই টিভিতে দেখেছে। এবং সে বলতে গেলে রীতিমত স্যারের অনুষ্ঠানের ভক্ত। তারপর যা হবার তাই হল। স্যারকে সসম্মানে গাড়িতে করে যেখানে যাচ্ছিলেন সেখানে রেখে আসা হল। এই পুরো ঘটনাটা আরও অনেক বিস্তৃত বিবরণ এবং হাস্যরস সহকারে স্যার এই বইয়ে বিধৃত করেছেন। স্বাধীনতার পরে নতুন দেশ, নতুন জাতি। স্যারও নতুন উদ্যমে টেলিভিশনের কাজে নেমে পড়লেন। এবার আর ধাঁধাঁর অনুষ্ঠান নয়। এবার স্যার বিভিন্ন ধরনের ছোট ছোট পর্বের পাঁচ-মিশালি বানিয়ে ‘সপ্তবর্ণা’ নামে একটা অনুষ্ঠান শুরু করেন। এই ‘সপ্তবর্ণা’ই হল আমরা বর্তমানে টিভিতে যে সব ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান দেখি তাদের আদি পিতা এবং বাংলাদেশ টেলিভিশনের ইতিহাসে সবচেয়ে জনপ্রিয় অনুষ্ঠান। স্যার এই বইয়ে লিখেছেন, ‘সপ্তবর্ণা’ করার সময়ে তিনি এই অনুষ্ঠানটির সাথে এতটাই একাত্ম হয়ে গিয়েছিলেন যে সে সময় তাঁর মনে হত এই অনুষ্ঠান করতে করতে মঞ্চের উপরও যদি তাঁর মৃত্যু হয় তাহলে সেটাই হবে তাঁর মহত্তম মৃত্যু। আমরা এখন ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানে যে সব ছোট ছোট নাটিকা দেখি সেটা সর্বপ্রথম ‘সপ্তবর্ণা’র মাধ্যমেই শুরু হয়েছিলো। আর সেটার ভাবনা ছিল পুরোপুরি স্যারের মৌলিক। কারণ তখন প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতার কারণে বাহিরের দেশে কী হচ্ছে তা দেশে বসে জানা সম্ভব ছিল না। পরে যখন স্যার টেলিভিশনের অনুষ্ঠানের ব্যাপারে প্রশিক্ষণ নিতে অস্ট্রেলিয়া যান তখন দেখেন ওরাও এ ধরনের অনুষ্ঠান বানানোর চেষ্টা করছে। তবে সে সময় ওদের একজন টিভি উপস্থাপকের যে পারিশ্রমিক ছিল তার তুলনায় স্যারের পারিশ্রমিক ছিল একেবারেই হাস্যকর। এছাড়া আমাদের দেশে বর্তমানে যে ব্যান্ড সংগীত এত জনপ্রিয় তার পেছনেও মূল অবদান স্যারের। সপ্তবর্ণা অনুষ্ঠানেই আমাদের দেশে প্রথমবারের মত ব্যান্ড সংগীত জনগণের সামনে আসে। এই সাহসটি স্যার দেখিয়েছিলেন এবং বলাই বাহুল্য তুমুলভাবে প্রশংসিত হয়েছিলেন। এভাবে অনেক প্রথমের জন্ম দিয়ে সপ্তবর্ণা একসময় শেষ হল। স্যার তখন নতুন চ্যালেঞ্জ হাতে নিলেন। টিভিতে প্রথমবারের মত ‘মানচিত্র’ নামে একটা শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান শুরু করলেন। এই অনুষ্ঠানও যথারীতি ব্যাপক জনপ্রিয় পেলো। কিন্ত ‘সপ্তবর্ণা’র যে তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয়তা তা আর পাওয়া সম্ভব হল না। কারণ ‘সপ্তবর্ণা’য় বাসার কাজের লোক থেকে শুরু করে রুচিশীল দর্শক পর্যন্ত সবার জন্যেই বিনোদনের খোরাক ছিল। কিন্তু ‘মানচিত্র’তে তা সম্ভব ছিল না। এদিকে স্যারের শরীরও তখন অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়ে। টেলিভিশন অনুষ্ঠানের জন্যে সপ্তাহে সপ্তাহে যে অস্বাভাবিক ঝক্কি তা আর স্যার নিতে পারছিলেন না। তবে সবচেয়ে বড় কথা স্যারের হৃদয় তখন আরও মহৎ স্বপ্নে বিভোর হয়ে গেছে। স্যার তখন গোটা জাতির জীবন আলোকিত করতে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের কাজে বেশ ভালমতই জড়িয়ে পড়েছেন। তাই টেলিভিশনের রঙিন জগত তাঁকে আর সেভাবে টানছিলো না। এসব কারণেই তিনি উপস্থাপক জীবন থেকে অবসর নেন। ‘আমার উপস্থাপক জীবন’ বইটি স্যারের দীর্ঘ উপস্থাপক জীবনের অনন্যসাধারণ আখ্যান। এ এমনই এক হৃদয়স্পর্শী বই যা পড়ার সময় পাঠক স্যারের স্বপ্নে উজ্জীবিত, স্যারের দুঃখে ব্যথিত হবেন। বিটিভির শুরুর ইতিহাস আর স্যারের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে আগ্রহী যে কোন পাঠকের জন্যেই এই বইটি অবশ্যপাঠ্য। ২. বন্ধ দরোজায় ধাক্কা : অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের ‘বন্ধ দরোজায় ধাক্কা’ বইটি একটি প্রবন্ধের সংকলন। এই বইয়ে দু’টি অংশে বিভিন্ন বিষয়ের উপরে স্যারের লেখা গভীরতাস্পর্শী একগুচ্ছ প্রবন্ধ সংকলিত হয়েছে। ‘বন্ধ দরোজায় ধাক্কা’ বইটির প্রথম অংশে যে সকল প্রবন্ধ সংকলিত হয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে লেখা একটি প্রবন্ধ। স্যার একবার এক সম্মেলনে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে গিয়েছিলেন। সেখানে এক বক্তা হঠাৎ রবীন্দ্রনাথের মৌলিকত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলে। এবং সেই বক্তা দাবি করে রবীন্দ্রনাথ যে সব সাহিত্য রচনা করে গেছেন সেগুলো বহু পূর্বেই পাশ্চাত্য দেশে রচিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের কোন স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য নেই। তখন স্যার বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে ভাবেন এবং সেই বক্তার সে সকল প্রশ্নের উত্তর এই প্রবন্ধে দেন। স্যার এখানে যুক্তি দিয়ে দেখিয়েছেন যে, মাঝারি মানের লেখকদের আবেগ-অনুভূতি ও সে সবের বহিঃপ্রকাশ খুবই কেন্দ্রীভূত। তাই সেগুলো খুব সহজেই পাঠকের চোখে ধরা পড়ে। তাঁদের লেখনীর স্টাইলকে আলাদা করা যায়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের মত নাক্ষত্রিক লেখকদের বেলায় ব্যাপারটা পুরোপুরি আলাদা। তাঁর জ্যোতি এতই বিশাল পরিসরকে আলোকিত করে যে হঠাৎ করে তার অস্তিত্ব অনুধাবন করা যায় না। তাঁকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী বলা যায় না। আর অনেকে তখন সেই বক্তার মত ভুল করে তাঁকে অমৌলিক দাবি করে। যেমন, আমরা বাতাসের মধ্যে ডুবে থেকে বাতাসের অস্তিত্ব উপলব্ধি করতে পারি না এই ব্যাপারটিও অনেকটা সে রকমই। লেখকের ক্ষুরধার যুক্তি, স্বাদু গদ্যের ভাষা আর সাবলীল বর্ণনাভঙ্গি এই প্রবন্ধটিকে অসাধারণ করে তুলেছে। আমার পড়া রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লেখা এটা অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ। এই অংশের অন্যান্য প্রবন্ধগুলোও একই রকমের আকর্ষণীয়। ‘বন্ধ দরোজায় ধাক্কা’ বইয়ের দ্বিতীয় অংশে লেখক কয়েকজন অনুজ লেখকের লেখার উপর আলোচনা করেছেন। এর মধ্যে আছে লুৎফর রহমান রিটনের ছড়া নিয়ে আলোচনা, আনিসুল হকের কবিতা নিয়ে আলোচনা। আর শেষ দুটি প্রবন্ধে লেখক আব্দুল মান্নান সৈয়দের ‘জ্যোৎস্না-রৌদ্রের চিকিৎসা’ এবং রফিক আজাদের ‘অসম্ভবের পায়ে’ নামক দুটি কবিতার বই নিয়ে আলোচনা করেছেন। আব্দুল মান্নান সৈয়দ এবং রফিক আজাদ দুজনেই ষাটের দশকের প্রতিভাবান কবি, স্যারের অনুজপ্রতিম। ষাটের দশকে আমাদের জাতীয় জীবনে যে নৈরাজ্য প্রবেশ করেছিল এই দুই কবিই তাঁদের কবিতার সেই বিশৃঙ্খল সময়কে ধারণ করেছেন। সে সব আলোচনাই এই দুই প্রবন্ধে উঠে এসেছে। এর পাশাপাশি এই দুই কবির কবিতা লেখার নিজস্ব স্টাইল নিয়েও স্যার অনেক চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছেন। আমি জীবনে যতগুলো কবিতার বইয়ের উপর আলোচনামূলক প্রবন্ধ পড়েছি তার মধ্যে নিঃসন্দেহে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের লেখা এই দুটি প্রবন্ধ বেশ উপরের দিকেই থাকবে। এই দ্বিতীয় অংশের প্রত্যেকটি প্রবন্ধই আসলে অসাধারণ সুগঠিত এবং চিন্তা-উদ্রেককারী।। যারা প্রবন্ধ পড়তে ভালবাসেন আর আমার মত যারা আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের লেখা ভালবাসেন তাদের জন্যে ‘বন্ধ দরোজায় ধাক্কা’ অবশ্যই সংগ্রহে রাখার মত একটা বই। পরিশেষে বলা যায়, স্যারের রচনা সমগ্র - ৬ বইটি স্যারের রচনা সমগ্রের অন্যান্য বইয়ের মতই সংগ্রহে রাখার মত।