User login
Sing In with your email
Send
Our Price:
Regular Price:
Shipping:Tk. 50
প্রিয় ,
সেদিন আপনার কার্টে কিছু বই রেখে কোথায় যেন চলে গিয়েছিলেন।
মিলিয়ে দেখুন তো বইগুলো ঠিক আছে কিনা?
Share your query and ideas with us!
Was this review helpful to you?
or
বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় দেয়া হুমায়ুন আজার এর এগারটি সাক্ষাৎকার এর সংকলন এই আততায়ীদের সাথে কথোপকথন।
Was this review helpful to you?
or
হুমায়ুন আজাদ বাংলাদেশের সাহিত্যের একটি বিচিত্র এবং বহুমাত্রিক চরিত্র। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্যের চারণভূমিতে সম্ভবত হুমায়ুন আজাদের মতো প্রভাবশালী, মননশীল, বিদগ্ধ এবং সর্বোপরি বিতর্কিত ব্যক্তিত্বের দেখা দ্বিতীয়টি মিলবে না। কবিতা, গল্প, সাহিত্য-সমালোচনা, প্রবন্ধ, ভাষাবিজ্ঞান, কিশোরসাহিত্য, উপন্যাস- সাহিত্যের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাঁর সৃষ্টিশীলতা এবং মননশীলতার প্রমাণ দিয়ে গেছেন তিনি। তবে জনমানুষে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হতেন তাঁর অকপট, নির্ভীক এবং চাঁছাছোলা মন্তব্যের কারণে। তিনি যা সত্য ভাবতেন, তা প্রকাশে কখনোই তাঁর দ্বিধা ছিলো না, হোক সেটা অত্যন্ত অস্বস্তিকর এবং অগ্রহণযোগ্য। তাঁর অকপট ভাষ্যগুলোর কিছুটা টের পাওয়া যাবে “আততায়ীদের সাথে কথোপকথন” নামক সাক্ষাতকার গ্রন্থে। কোনো লেখকের বিশ্বাস, দর্শন এবং স্বপ্ন তাঁর রচিত সাহিত্যের মাঝেই খুঁজে পাওয়া সম্ভব, কেননা সেগুলোই সাহিত্য রচনার অন্যতম প্রেরণা। কিন্তু যখন লেখকের মুখ থেকেই তাঁর দর্শনের কথা সরাসরি শোনা যায় তখন আগ্রহী হয়ে না ওঠে উপায় থাকে না। হুমায়ুন আজাদ আশির দশকের শেষ দিকে এবং নব্বই দশকের শুরুর দিকে বেশ কিছু সাক্ষাতকার দিয়েছেন পত্রপত্রিকা ও ছোট-কাগজে। তার মধ্য থেকে বাছাই করে কয়েকটি ছাপা হয়েছে “আততায়ীদের সাথে কথোপকথন” গ্রন্থে। সাক্ষাতকারগুলো আসলে তাঁর স্বভাব-চরিত্রকেই ফুটিয়ে তুলেছে। হুমায়ুন আজাদের সাক্ষাতকার পড়লে শুরুতেই সংশয়ী পাঠকের ধারণ করবেন, তিনি সম্ভবত বিতর্কিত মন্তব্য করে আলোচিত হতে চাচ্ছেন। কিন্তু তাঁর সবগুলো সাক্ষাতকার পাঠ শেষে বুঝতে পারা যায়, তিনি আসলে নিজের মাঝে অত্যন্ত গভীরভাবে যা ধারণ করে আছেন তা-ই শুধুমাত্র উচ্চারণ করে থাকেন, হোক সেটা বিতর্কিত। তিনি সমালোচনায় অতি নির্মম; যার সমালোচনা করতেন তার পিঠ বাঁচানো কঠিন হয়ে দাঁড়াতো। তবে তাই বলে শুধু সমালোচনাই করে গেছেন তা নয়, প্রাপ্য প্রশংসাও ঠিকমতো বুঝিয়ে দিতেন। আশির দশকের শেষ দিকে হুমায়ুন আজাদের কিছু প্রবচন একটি ছোট কাগজে ছাপা হয়, যেগুলোর মধ্যে কয়েকটি বারুদের মতো কাজ করে; খেপিয়ে তোলে রক্ষণশীল সমাজকে। সৈয়দ শামসুল হক তাঁর একটি একটি কলামের হুমায়ুন আজাদের কড়া সমালোচনা করেন। পরবর্তী সময়ে ‘বিশ্বদর্পণ’কে দেয়া কৈফিয়তমূলক সাক্ষাতকারে হুমায়ুন আজাদ তাঁর বিরুদ্ধে লেখা সৈয়দ সাহেবের সেইসব বক্তব্য খণ্ডন করেছেন, করেছেন শ্লেষাত্মক মন্তব্য, বলেছেন, ‘সৈয়দ হকের ব্যাখ্যা সম্পূর্ণরূপে অপব্যাখ্যা, তাঁর এ ধরনের ব্যাখ্যা এক ধরনের আত্মহত্যাও বটে। তিনি তাঁর সাহিত্যে যেভাবে এ বিষয়গুলো দেখেছেন এখানে তিনি তাঁর সম্পূর্ণ বিরোধিতা করেছেন। কিছুদিন আগে একটি মৌলবাদী পত্রিকা তাঁকে যেভাবে আক্রমণ করেছে, তিনি তাঁর কলামে আমাকে অবিকল সে-মৌলবাদী পত্রিকার কলাম লেখকের মতো আক্রমণ করেছেন, অর্থাৎ সৈয়দ হকের সঙ্গে ওই মৌলবাদী লেখকের কোনো পার্থক্য নেই এখন’। তাই বলে সৈয়দ শামসুল হকের প্রতি যে তাঁর কোনো ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব নেই তা পরিষ্কার হয় যখন তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়- স্বাধীনতা পরবর্তীকালে বাংলাদেশের সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য কাজ কারা করেছেন, তখন তিনি বলেন, ‘গদ্য ও কবিতা মিলে সৈয়দ শামসুল হক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তবে যতোটা গুরুত্বপূর্ণ তিনি ততোটা গুরুত্ব তিনি পান না’। বেশ কয়েকটি সাক্ষাতকারে সৈয়দ হকের নাম গুরুত্বের সাথে উচ্চারণ করেছেন তিনি। এসব কথোপকথনে আমরা বুঝতে পারি, সমালোচনায় হুমায়ুন আজাদ ছিলেন নিরপেক্ষ; ব্যক্তিগত রেষারেষি কিংবা দলাদলিতে আক্রান্ত ছিলেন না তিনি। যার প্রাপ্য চাবুক, তাকে কখনো ফুল উপহার দিতে চান নি হুমায়ুন আজাদ। জীবিত থাকাকালে একটি উপাধি হুমায়ুন আজাদের প্রায় চির-সঙ্গী ছিলো- তা হলো ‘বিতর্কিত’। সর্বত্রই তাঁকে এ নামে পরিচয় করিয়ে দেয়া হতো। একজন শক্তিশালী প্রথাবিরোধী লেখক হিশেবে তিনি এই উপাধিকেও চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন। বলেছেন, ‘আমার সম্পর্কে এ-বিশেষণটি বেশ প্রচলন পেয়েছে, যদিও শব্দটি আজকাল নিরর্থক। আমাদের প্রথা-বদ্ধ সমাজে প্রথা একটু ভাঙ্গলেই বিতর্কের জন্ম হয়। তবে সভ্যতা ইতিহাস হচ্ছে বিতর্কের, প্রথা মানা ও না-মানার, ইতিহাস; পৃথিবীতে চিরকালই যাঁরা অভিনব কিছু সৃষ্টি করেছেন, যাঁরা সমাজ-সভ্যতাকে বদলে দিতে চেয়েছেন এবং দিয়েছেন, যাঁরা চিন্তাবিপ্লব ঘটিয়েছেন, তাঁরা সবাই বিতর্কিত। পৃথিবীর প্রধান পুরুষেরা,আমি অবশ্য প্রধান কেউ নই, সবাই বিতর্কিত। এমন কোনো মহাপুরুষ পাওয়া যাবে না, যিনি বিতর্কিত নন। বিতর্কিতরাই সভ্যতাকে এগিয়ে দেন, অবিতর্কিতরা থাকে মেষের মতো অবিতর্কিত’। চোখে আঙ্গুল দিয়ে সত্য দেখিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে হুমায়ুন আজাদের জুড়ি ছিলো না, সম্ভবত এখনো নেই। কবি হিশেবে যতোটা গুরুত্ব হুমায়ুন আজাদের পাওয়ার কথা ততোটা তিনি পান নি। এ কারণে একটা দুঃখ তাঁর মাঝে সবসময়ই ছিলো। তবে তিনি এও জানতেন যে, সব কবির কবিতাই সমসাময়িক-কালে গৃহীত এবং প্রশংসিত হয় নি। তিনি নিজেকে সমসাময়িক অনেক কবির চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং বড়ো কবি দাবি করতেন। হুমায়ুন আজাদের সাথে অপরিচিত পাঠকের কাছে এসব মন্তব্য আত্মরম্ভী এবং অহংকারী এক ব্যক্তির প্রলাপ মনে হতে পারে; কিন্তু এটাই হুমায়ুন আজাদের ব্যক্তিত্ব। তাঁর নিরপেক্ষ বিচারে তিনি যা সত্য বলে মনে করতেন, তা-ই প্রকাশ করতেন। যদিও কিছু কিছু জায়গায় আমার মনে হয়েছে তিনি নিজের অতি-প্রশংসা করে গেছেন। সমালোচনা সাহিত্যে তিনি সবার সেরা; ভাষাবিজ্ঞানে তাঁর সমকক্ষ কেউ ছিলো না,এখনো নেই; কিশোর সাহিত্যে তিনি গুরুত্বপূর্ণদের একজন; কবিতায় স্মরণীয়। তবে ঔপন্যাসিক হিশেবে তিনি নিজেকে যতোটা উঁচু মাপের বলে ঘোষণা করে গেছেন, ততোটা সম্ভবত নন। এমনকি আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের মতো ঔপন্যাসিককেও তিনি অতোটা গুরুত্ব দেন নি, সম্ভবত তখন বুঝতে পারেন নি তাঁর গুরুত্ব। এটা হুমায়ুন আজাদের ব্যর্থতা। কবিতা,উপন্যাস,প্রবন্ধ- সবক্ষেত্রেই হুমায়ুন আজাদ বাঙ্গালির সমালোচনা করে গেছেন, বাঙ্গালির অকর্মণ্যতায় তীব্রভাবে হতাশ ছিলেন তিনি। বারবারই নানা সাক্ষাতকারে তিনি বাঙ্গালির আত্মোন্নয়নের ব্যর্থতাকে চিহ্নিত করেছেন। একে বাঙ্গালি-বিদ্বেষ হিশেবে না দেখে বরং দেখা উচিত আত্ম-সমালোচনা হিশেবে। তিনি বরাবরই বলেছেন যে, একজন বাঙালি হিশেবে তাঁর নিজ গোত্রের মানুষের সমালোচনা করার অধিকার যতোটা আছে, ততোটা আর কারও নেই। তিনি তাঁর সাহিত্যের মধ্য দিয়ে বাঙ্গালিকে সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিতে চেয়েছেন; কতোটা পেরেছেন তা ভিন্ন বিতর্কে বিষয়। এ বইয়ের সাক্ষাতকার-গুলোয় বাঙ্গালির প্রবল সমালোচনা-মুখর এক লেখকের নিজ গোত্রের আত্মিক উন্নতি সাধনের জন্য প্রবল আকুতি চোখে পড়ে, টের পাই নিজের দেশের মানুষের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা। বহুমাত্রিক লেখক হুমায়ুন আজাদের দর্শন, স্বপ্ন, বিশ্বাস, এবং সর্বোপরি তাঁর ব্যক্তিত্বকে উপলব্ধি করার জন্য তাঁর সাহিত্য পাঠের পাশাপাশি সাক্ষাতকারগুলোও দারুণ কাজে আসবে। ‘আততায়ীদের সাথে কথোপকথন’ নামের গ্রন্থটি এই অসাধারণ একমেবাদ্বিতীয়ম বাঙ্গালি লেখককে প্রকাশ করছে খোলা ডায়রির মতো। বিচিত্র এই মানুষটির সঙ্গে পরিচিত হতে চাইলে এ গ্রন্থের সাথে পরিচিত হতেই হবে।