User login
Sing In with your email
Send
Our Price:
Regular Price:
Shipping:Tk. 50
প্রিয় ,
সেদিন আপনার কার্টে কিছু বই রেখে কোথায় যেন চলে গিয়েছিলেন।
মিলিয়ে দেখুন তো বইগুলো ঠিক আছে কিনা?
Share your query and ideas with us!
Was this review helpful to you?
or
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কীর্তিহাটের কড়চা’ – এক মহাকাব্যিক উপন্যাসের বিশ্লেষণ - তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহিত্যসত্তা দীর্ঘকাল ধরে বাংলা সাহিত্যে এক বিশাল ভূমিকা পালন করে এসেছে। তাঁর শেষ জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি কীর্তিহাটের কড়চা নিঃসন্দেহে বাংলা উপন্যাসের এক বিস্ময়কর অর্জন। প্রায় দুইশো বছরের বিস্তৃত কাহিনির আবর্তনে, জমিদার প্রথার উত্থান ও পতনের ইতিহাসের নিরিখে, উপন্যাসটি একাধারে ঐতিহাসিক, সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের এক অনবদ্য প্রয়াস। এই উপন্যাসের অন্যতম বিশেষত্ব এর মহাকাব্যিক বিস্তৃতি। জমিদারি প্রথার সূচনা থেকে তার ক্রমশ অবসানের মধ্য দিয়ে একটি বংশের সাত পুরুষের কাহিনি এতে উঠে এসেছে। কাহিনির কেন্দ্রস্থলে রায় বংশ, যার আদি পুরুষ কুড়ারাম ভট্টাচার্য থেকে শুরু করে সপ্তম পুরুষ সুরেশ্বর রায় পর্যন্ত বিস্তৃত এক বর্ণাঢ্য জীবনগাথা। জমিদারি প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক সময় থেকে শুরু করে ১৯৫৩ সালে জমিদারি প্রথা বিলোপের মধ্য দিয়ে কাহিনির পরিসমাপ্তি ঘটে। এই বিশাল বৃত্তের মধ্যে ইতিহাসের বাস্তব চরিত্র ও কল্পিত চরিত্র এমনভাবে মিশে গেছে যে, উপন্যাসের কল্পনাজাত অংশও বাস্তব বলে প্রতীয়মান হয়। --- জমিদারি প্রথার উত্থান ও কুড়ারামের উত্থান উপন্যাসের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে কুড়ারাম ভট্টাচার্য, যিনি চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুযোগ নিয়ে এক সাধারণ পাটোয়ারী থেকে এক বিশাল জমিদারির মালিক হয়ে ওঠেন। বাংলার ইতিহাসের আলো-আঁধারি সময়কে তিনি শুধু দেখেননি, বরং সেই সময়ের এক বড় অংশের নির্মাতা ছিলেন। ইংরেজ শাসনের ছত্রছায়ায় কুড়ারাম রায় বংশের গোড়াপত্তন করেন, যা কয়েক প্রজন্ম ধরে সমৃদ্ধির শীর্ষে অবস্থান করে। তবে জমিদারি শুধু অর্থ ও ক্ষমতার উৎস ছিল না, ছিল তার অন্ধকার দিকও। --- জমিদারি শাসনের রূপ ও বীরেশ্বর রায়ের কঠোর শাসন কুড়ারামের উত্তরসূরী বীরেশ্বর রায় জমিদারির শক্তিকে আরও প্রসারিত করেন। কিন্তু তার শাসনের সময়ই প্রজাদের ওপর শোষণের মাত্রা বাড়তে থাকে। জমিদারি রাজত্ব যে কেবল ঐশ্বর্যের বাহ্যিক চাকচিক্য নয়, বরং ক্ষমতার লড়াই, ষড়যন্ত্র ও নির্যাতনের এক অন্ধকার জগত—তারাশঙ্কর সেটিকে নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। জমিদারের শাসনে প্রজারা দাসপ্রকৃতির জীবন যাপন করত, যা ধীরে ধীরে সামাজিক অসন্তোষ তৈরি করে। --- রত্নেশ্বর রায় – রায় বংশের শ্রেষ্ঠ পুরুষ উপন্যাসের অন্যতম উল্লেখযোগ্য চরিত্র রত্নেশ্বর রায়, যিনি রায় বংশের সবচেয়ে শুদ্ধ ও ন্যায়পরায়ণ জমিদার হিসেবে পরিচিত। তিনি কঠোর শাসক হলেও ছিলেন ন্যায়ের প্রতীক। অন্যায়ের বিরুদ্ধে সবসময় সোচ্চার থেকেছেন এবং প্রজাদের প্রতি দায়িত্বশীল ছিলেন। রত্নেশ্বর রায় তার পরিবারে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা ভোগ-বিলাস, নারী আসক্তি ও ক্ষমতার অপব্যবহার থেকে নিজেকে দূরে রেখেছিলেন। যদিও মনে মনে তিনি একজনকে ভালোবেসেছিলেন, তবু নিজের নৈতিকতা ও প্রতিজ্ঞার কারণে কেবল একজন নারীতেই আবদ্ধ ছিলেন। জমিদারির জৌলুসের মধ্যেও তিনি সংযমী জীবনযাপন করতেন। তার ব্যক্তিত্বের কারণে রায় বংশের সবচেয়ে শ্রদ্ধেয় ও নীতিনিষ্ঠ পুরুষ হিসেবে তাকে বিবেচনা করা হয়। --- পতনের পূর্বসূচনা ও সুরেশ্বর রায়ের উপলব্ধি সাত পুরুষ ধরে গড়ে ওঠা এক বিশাল সাম্রাজ্যের শেষ উত্তরসূরী সুরেশ্বর রায়, যিনি স্বাধীনতার পরে বিধানসভায় জমিদারি প্রথা বিলুপ্তির সাক্ষী হন। এই ঐতিহাসিক পরিবর্তনের মুহূর্তে তিনি তার সাত পুরুষের ইতিহাস এক ক্যানভাসে আঁকতে থাকেন—যেখানে একদিকে রয়েছে গৌরব, অন্যদিকে কলঙ্কের ছায়া। তারাশঙ্কর জমিদারি ব্যবস্থার পতনের এই ধ্বনিকে শুধু রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক পরিবর্তন হিসেবে দেখাননি, বরং একটি সামাজিক বিবর্তনের প্রতিচ্ছবি হিসেবে ফুটিয়ে তুলেছেন। শিক্ষার প্রসার, মধ্যবিত্ত শ্রেণির উত্থান, জমিদারদের প্রতি প্রজাদের আনুগত্য হারানো—সবকিছু মিলে জমিদারি প্রথার পরিণতির এক বাস্তব ও গভীর চিত্র ফুটে উঠেছে। --- উপন্যাসের সাহিত্যিক বিশ্লেষণ ‘কীর্তিহাটের কড়চা’ শুধুমাত্র একটি পারিবারিক উপাখ্যান নয়, এটি ইতিহাস ও কল্পনার এক অপূর্ব সংমিশ্রণ। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় তার অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে জমিদার শ্রেণির অন্দরমহলের জটিলতা, রাজনৈতিক প্রভাব, ক্ষমতার লড়াই, শোষণ এবং মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন চিত্রিত করেছেন। যদিও উপন্যাসের কিছু অংশে ঘটনাবলী পুনরাবৃত্তি হয়েছে, যা পড়তে কখনো কখনো বিরক্ত লেগেছে । উপন্যাসে থাকা ঐতিহাসিক চরিত্রগুলোর উপস্থিতি কাহিনীর বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়িয়েছে। সিরাজউদ্দৌলা থেকে লর্ড কর্নওয়ালিস, ব্রিটিশ দেওয়ানি থেকে সিপাহী বিদ্রোহের প্রভাব, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জমিদারি—এসবের উল্লেখ উপন্যাসের বস্তুনিষ্ঠতা আরও সমৃদ্ধ করেছে। --- উপসংহার তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কীর্তিহাটের কড়চা’ বাংলা সাহিত্যের এক অনন্য সৃষ্টি, যা শুধু জমিদারদের উত্থান-পতনের দলিল নয়, বরং বাংলার সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিবর্তনের এক অসামান্য উপাখ্যান। সব মিলিয়ে, কীর্তিহাটের কড়চা শুধুমাত্র তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের এক শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি নয়, এটি বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ। যারা ঐতিহাসিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে লেখা মহাকাব্যিক উপন্যাস পড়তে ভালোবাসেন, তাদের জন্য এটি এক অবিস্মরণীয় পাঠ্য। বাংলার জমিদারি ইতিহাস, ব্রিটিশ শাসনের সামাজিক প্রভাব এবং ব্যক্তিমানুষের উত্থান-পতনের এক সমৃদ্ধ চিত্রায়ণ হিসেবে এই উপন্যাস বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে চিরস্থায়ী আসন লাভ করবে।