User login
Sing In with your email
Send
Our Price:
Regular Price:
Shipping:Tk. 50
প্রিয় ,
সেদিন আপনার কার্টে কিছু বই রেখে কোথায় যেন চলে গিয়েছিলেন।
মিলিয়ে দেখুন তো বইগুলো ঠিক আছে কিনা?
Share your query and ideas with us!
Was this review helpful to you?
or
সত্যজিৎ রায় 'ফেলুদা' আর 'প্রফেসর শংকু' চরিত্রের মাধ্যমে বেশি জনপ্রিয় হলেও, লেখকজীবনে তিনি লিখেছেন আরও অনেকগুলো ছোটগল্প যেগুলো সাহিত্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে মোটামুটি অমূল্য। সত্যজিৎ রায়ের লেখা ফেলুদা, প্রফেসর শংকু চরিত্র এবং অনুবাদক গল্পগুলো বাদ দিলে বাদবাকি মোট মৌলিক গল্পের সংখ্যা ৯১টি। সেই ৯১টি গল্পের মধ্যে অন্যতম দশটি গল্প নিয়ে সাজানো হয়েছে 'সেরা সত্যজিৎ' গল্পটি। নিচে এই বইয়ে জায়গা পাওয়া দশটি গল্প নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করা হল। # ১ বিপিন চৌধুরীর স্মৃতিভ্রমঃ- বিপিন চৌধুরী আত্মকেন্দ্রিক মানুষ। অফিসে যান, নিরলস পরিশ্রম করেন, বাড়ি ফিরে বই পড়েন - এতেই তার জীবনযাত্রা সীমাবদ্ধ। কারো সাতে পাঁচে থাকেন না এমনকি কারুর বিপদেও এগিয়ে যান না। এই বিপিন চৌধুরী একবার দারুণ মানসিক অশান্তির মধ্যে পড়ে গেলেন। নিউ মার্কেটে দেখা হওয়া এক লোক তাঁকে মনে করিয়ে দিল ১৯৫৮ সালে তাঁদের রাঁচি ভ্রমণের বিষয়টি। অথচ আজব ব্যাপার, বিপিন চৌধুরীর মনেই নেই সেই রাঁচি ভ্রমণের কথা। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস তিনি কখনো রাঁচি যান নি। কিন্তু সেই রাঁচি ভ্রমণের কথা জানতে পারে, এমন সবার থেকে বিপিন চৌধুরী শুনলেন তিনি নাকি আসলেই রাঁচি গিয়েছিলেন। তাহলে কি তিনি আসলেই স্মৃতিভ্রষ্ট হয়েছেন? নাকি তাঁকে ধন্দে ফেলে দিয়ে এই মানসিক অত্যাচারের পেছনে আছে কোন প্র্যাকটিকাল জোক বা কারো তীব্র প্রতিশোধস্পৃহা? গল্পের একদম শেষে এসে উত্তর বেরুবে এই প্রশ্নের। এই গল্পের বিশেষত্ব হল, লেখক বিপিন চৌধুরীর রহস্য অমীমাংসিত রেখেই গল্প শেষ করে দেন নাই। অথচ এক পর্যায়ে অমীমাংসিত সমাপ্তি ঘটবে, এমনই আশংকা করছিলাম আমি। কিন্তু তার বদলে যেভাবে গল্পটাকে লেখক শেষ করেছেন, তা সত্যিই অসাধারণ। # ২ পটলবাবু ফিল্মস্টারঃ- পটলবাবু নিতান্তই ভাগ্যান্বেষি সাধারণ বাঙালি। এক কালে থিয়েটারে বেশ ভালোই অভিনয় করতেন, তবে সে অনেক আগের কথা। এখন ঠিকভাবে সংসার চালানোর চিন্তা আর নতুন নতুন ধান্দাতেই তার কর্মপরিধি বিস্তৃত। হঠাৎই একদিন খবর পেলেন, তাঁকে নাকি কোন এক ফিল্মে একটা পার্ট দেয়া হবে। শুনেই রক্ত চনমন করে উঠল তাঁর। পার্ট খুব বড় কিনা সেটা কোন ব্যাপার না। ছোট থেকেই যে আস্তে আস্তে জীবনে বড় হতে হয়। তারপরও শ্যুটিং স্পটে গিয়ে নিজের পার্ট আর ডায়লগের পরিমাণ জেনে একটু ধাক্কাই খেয়েছিলেন। তবু অভিনয় প্রতিভা তাঁর রক্তে মিশে আছে। তাই সামান্য একটি দৃশ্যকেই নিজের অভিনয় ক্ষমতার জোরে নিখুঁত করে তুললেন তিনি। কিন্তু তার প্রতিদানে কি কিছু জুটবে তাঁর কপালে? দারুণ জীবনবোধ সম্পন্ন একটা গল্প। গল্পে জীবনের একটা দিকই হয়ত দেখাতে পেরেছেন লেখক কিন্তু তার ভেতর দিয়ে পাঠকের সামনে জীবনের চিরাচরিত কিছু বাস্তবতাকে বেশ সচেতনতার সাথে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন লেখক। # ৩ খগমঃ- মহাভারতের গল্পে খগম নামে এক তপস্বী ছিল যাঁর সাপে তাঁর বন্ধু সহস্রপাদ মুনি ঢোড়া সাপ হয়ে যায়। এমনটাই কি হতে চলেছে ধুর্জটিবাবুর সাথে? ইমলিবাবার পোষা কেউটে সাপকে মেরে ফেলেছেন ধুর্জটিবাবু। তাই তাঁকে অভিশাপ দিয়েছেন ইমলিবাবা। তাহলে কি শেষ পর্যন্ত সহস্রপাদ মুনির মতন পরিণতি হবে ধুর্জটিবাবুর? গল্পের আদিভৌতিকতা আমাকে খুব একটা টানে নি। তবে একটা প্রাচীন মিথকে লেখক যেভাবে আধুনিক কালের প্রেক্ষাপটে অ্যাডাপ্ট করেছেন তা বেশ আকর্ষনীয়। পাশাপাশি এটাও মনে হয়েছে যে অ্যাডাপশনটা আরও ভাল হতে পারত। # ৪ রতনবাবু আর সেই লোকটাঃ রতনবাবুন নির্বান্ধব একাকী লোক। তাঁর বন্ধু নেই কারণ কারো সাথে তাঁর বিচিত্র মনের মিল হয় না। তাই তিনি একাই প্রতিবছর বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণে পড়েন। সেবার গেলেন সিনি। সিনিতে গিয়ে দেখা মিলল হুবহু তাঁরই মত দেখতে মনিলালবাবুর সঙ্গে। চেহারা, নাম, স্বভাব, পেশা, বেতন, শখ, প্রবৃত্তি, জন্ম তারিখ সবই দুজনের এক। এ বড়ই অদ্ভুত ব্যাপার। প্রথমবারের মত রতনবাবু নিজের মনের সাথে মিল আছে এমন একজনের দেখে পেলেন। তবু খুশির বদলে লোকটার সাথে তাঁর এত মিল দেখে অস্বস্তিতে পড়ে গেলেন তিনি। তারপর কোন হঠকারি সিদ্ধান্ত নিয়ে বসলেন তিনি? জানতে হলে পড়তে হবে গল্পটি। মনস্তত্ব আর আদিভৌতিকতার মিশেলে বেশ ভালোই একটা গল্প সাজিয়েছেন লেখক। কিন্তু এই গল্পের রহস্য যুক্তি দিয়ে উন্মোচন করা যাবে না। একটা সময় পর্যন্ত পুরো ব্যাপারটিকেই রতনবাবুর কল্পনা বলে মনে হচ্ছিল। কিন্তু বাস্তবে তা তো হলই না বরং বিষয়টা পরবর্তিতে আরও জটিল হয়ে উঠেছে। লেখক জটিলতার জট না ছাড়িয়েই গল্প শেষ করেছেন। তাই জাগতিক অনেক রহস্যময়তার মত এই গল্পের রহস্যকেও মেনেই নিতে হবে। আর কিছু করার নেই। # ৫ ভক্তঃ- অরূপবাবু গেছেন পুরীতে বেড়াতে। সেখানে তাঁর সাথে দেখা হল এক শিশু আর তাঁর মায়ের। তারা ভেবেছে তিনি বোধ হয় আকাদেমি অ্যাওয়ার্ড প্রাপ্ত শিশু সাহিত্যিক অমলেশ মৌলিক। কিন্তু তা যে আসলে ঠিক না সেটা বলার সুযোগই পেলেন না অরূপবাবু। পুরীর একদল বাচ্চার কাছে অরূপবাবু বিবেচিত হতে লাগলেন তাদের প্রিয় লেখক হিসেবে। অরূপবাবুকেও বাধ্য হয়ে অভিনয় করে যেতে হল। কদিন পর সত্যি সত্যিই অমলেশ মৌলিক এল পুরীতে। তিনি আবার খ্যাতির বিড়ম্বনা নিয়ে চিন্তিত। এখন দেখার বিষয়, কিভাবে অরুপবাবু বিষয়টাকে ম্যানেজ করেন যাতে তিনি নিজে ধাপ্পাবাজ বলে পরিগণিত না হন! বেশ মজার গল্প। বিষয়বস্তু অভিনব। তবে মৌলিক মশাই ও তাঁর ভক্তরা যদি জানতে পারত অরূপবাবু এতদিন মৌলিক মশাইয়ের বেশ ধরে ছিলেন, তাহলে বেশ ভালোই একটা টেনশন সৃষ্টি হতে পারত। কিন্তু লেখক সেসব নাটকীয়তায় যান নি। তার আগেই গল্প শেষ করে দিয়েছেন। এতে আমি ব্যক্তিগতভাবে অবশ্য খুশি। কারণ ছোটগল্পে একবার বড় রকমের টেনশন সিন নিয়ে আসলে গল্পের পরিধিও অনেক বেড়ে যেত। # ৬ অসমঞ্জবাবুর কুকুরঃ এই গল্পের অসমঞ্জবাবুও নির্বান্ধব একজন মানুষ। আপিসের বাইরে কারো সাথে তাঁর খুব একটা মেলামেশা নেই। তবে কুকুরের প্রতি আলাদা একটা ভালোবাসা ছিল। তাই কিনে ফেললেন একটা নেড়ি কুকুর। নাম দিলেন ব্রাউনি। কিন্তু ব্রাউনি কোন স্বাভাবিক কুকুর না। সে মজার কথা শুনলে বা ঘটনা দেখলে হেসে ফেলে। অথচ শুধু কুকুর কেন, কোন জন্তুর পক্ষেই হাসা সম্ভব না। তাই অসমঞ্জবাবুর কুকুর যে হাসে সেই কথা কেউই বিশ্বাস করল না। তবু ঘটনাচক্রে এই খবর বেরিয়ে গেল খবরের কাগজে। প্রচুর মানুষের আগ্রহের বিষয়ে পরিণত হল ব্রাউনির হাসি। এক বিদেশী ভদ্রলোক ব্রাউনিকে কেনারও ইচ্ছা প্রকাশ করল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ব্রাউনির ভাগ্যে কি আছে? সেটা ঠিক করবেন অসমঞ্জবাবুই। ব্রাউনি নামের আশ্চর্য কুকুরটির শেষ পর্যন্ত কি হল তা জানতে গল্পটা পড়তেই হবে। এই গল্পটাও একদম ভিন্নধর্মী। এমন বিচিত্র বিষয়েও যে গল্প লেখা যায়, তা সত্যিই অবাক করার মত। # ৭ ক্লাসফ্রেন্ডঃ- এক সকালে ফোন করে মোহিতকে এক লোক জয় বলে পরিচয় দিল, সে নাকি তার ক্লাস ফ্রেন্ড! সত্যিই মোহিতের জয় বলে স্কুল জীবনে খুবই ঘনিষ্ঠ একজন বন্ধু ছিল কিন্তু সময়ের ব্যবধানে আর দেখা না হওয়ার বদৌলতে মোহিতের মনেই নেই জয়ের কথা। সেই জয় কোন এক কারণে আসবে সন্ধে সাতটায়। সারাদিন মোহিত স্কুল জীবনের অনেক স্মৃতিচারণা করল। সন্ধেয় এল জয়। সত্যিই সে জয় কিনা নিশ্চিত হতে পারল না মোহিত। আজকের দিনে চর-ধাপ্পাবাজের কি অভাব আছে? তাই জয় যখন তার কাছে কিছু অর্থ সাহায্য করল, সোজা না করে দিল মোহিত। আধুনিক সমাজে চলতে গেলে প্রয়োজনে একটু কঠিন হতেই হয়। আর যাতে জয় তাকে জ্বালাতে না আসে, এজন্য কিছু কৌশল অবলম্বন করল সে। কিন্তু জয় পরেরবার নিজে না এসে পাঠাল তার ছেলেকে। জয়ের ছেলেকে দেখে বালক বয়েসি জয়ের কথা মনে পড়ল মোহিতের, মনে পড়ল তাদের বন্ধুত্বের কথা। তখন হৃদয় দ্রবীভূত হল তার। এবার সে সাহায্য করল জয়ের ছেলেকে। এই গল্পটা শুধু এই বইয়েরই সেরা গল্প না বা শুধু সত্যজিৎ রায়েরও সেরা গল্প না। বাংলা সাহিত্যে এ যাবতকাল অব্দি রচিত শ্রেষ্ঠ ছোটগল্পগুলোর তালিকায় 'ক্লাসফ্রেন্ড' থাকবেই। আর বেশি কিছু বলব না। বর্তমান সময়ের রুঢ় বাস্তবতাকে কি অবলীলাক্রমে এই গল্পে তুলে ধরা হয়েছে তা নিজে গল্পটি না পড়লে বোঝা অসম্ভব। গল্পের কিছু কিছু জায়গার সাথে সত্যজিৎ রায়ের 'আগন্তুক' নামক ছবিটির ভাবগত মিল আছে। # ৮ বৃহচ্চঞ্চুঃ- তুলসিবাবু জঙ্গলে ঘুরতে গিয়ে পেয়ে যান একটা পাখির বাচ্চা। পাখিটাকে পোষ মানানোর জন্য নিয়ে এলেন তিনি। মাংস খাইয়ে বড় করে তুলতে লাগলেন। খুব অল্প বয়সেই বিশালাকার ধারণ করল পাখিটি। তারপর মাংসাশী এই পাখি গোটা এলাকায় তান্ডব চালাতে লাগল। জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে উঠল। কে পারবে এই পাখির হাত থেকে সবাইকে বাঁচাতে? কিভাবে তা সেটা সম্ভব হবে? অনেকটা বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী ধাঁচের কাহিনী। সাই-ফাই জনরা পছন্দ করেন যারা, তাদের এই গল্পটি বেশ ভালো লাগবে। # ৯ লখনৌর ডুয়েলঃ- তারিণীখুড়ো গল্প বলছেন ন্যাপলাদের। গল্প শুরুর আগেই তিনি ডুয়েলিং ও তার ইতিহাস সম্পর্কে লম্বা একখানা লেকচার দিয়েছেন। ন্যাপলারা বেশ আন্দাজ করতে পেরেছিল, আজকের গল্পের বিষয়বস্তু ডুয়েলিং। আসলেও তাই। তারিণীখুড়ো বললেন ১৯৫০ সালের দিকে এক ঘটনার কাহিনী। তারিণীখুড়ো তখন লখনৌতে। এক অকশন শপ থেকে কিনে এনেছেন একখানা বাক্স। সেই বাক্সের ভেতর আছে একই রকম দেখতে একজোড়া পিস্তল। ডুয়েল লড়বার পিস্তল। সেদিন রাতেই তারিণীখুড়োর কাছে এল এক সাহেব ভদ্রলোক। তারিণীখুড়োকে সে শোনাল এক আশ্চর্য কাহিনী। তারিণীখুড়োর সদ্য পাওয়া পিস্তল দুইটি দিয়ে নাকি এই লখনৌতেই প্রায় দেড়শ বছর আগে এক ডুয়েল হয়েছিল। আর সেই ডুয়েলের পেছনে ছিল গভীর রোমান্টিক এক কাহিনী। সেই কাহিনী শোনাল সাহেব তারিণীখুড়োকে। তারিণীখুড়ো জানতে উদগ্রীব হলেন, ডুয়েলের ফলাফল কি হয়েছিল। সাহেব তা বলল না। ১৬ই অক্টোবর ছিল সেই ডুয়েলের ডেট। সেদিন নাকি স্বচক্ষেই দেখা যাবে সেই ডুয়েলের। সত্যিই, ১৬ই অক্টোবর সরাসরি তারিণীখুড়ো যেন অবলোকন করলেন দেড়শ বছরের পুরনো এক লড়াইয়ের চিত্রনাট্য। তবে সেটাই সব না। সেই চিত্রনাট্যের শেষ দৃশ্যে এসে সাহেবের পরিচয় পেয়ে চমকে গেলেন তারিণীখুড়ো। ডুয়েলে জিতেছিল কে? আর কেই বা ছিল সেই সাহেব? জবাব মিলবে 'লখনৌর ডুয়েল' গল্পে। তারিণীখুড়োর অন্যান্য গল্পের মতই এই গল্পের কাহিনীও একেবারে অবাস্তব। তবু শেষের টুইস্টটা সত্যিই চমকজাগানিয়া! # ১০ তারিণীখুড়ো ও বেতালঃ- তারিণী খুড়ো আরও একবার তাঁর গল্পের ঝুলি মেলে ধরেছেন ন্যাপলাদের কাছে। এটা তাঁর একেবারে যুবক বয়সের গল্প যখন তিনি এক চিত্রকরের ছবিতে মডেল হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু পরে গুন্ডার আক্রমনে তিনি কুপোকাত হয়ে পড়লে তাঁর জায়গা নেয় অন্য এক লোক। পরে বেতালের দৃশ্যের ছবি আঁকার সময় সেই নতুন মডেলকে আক্রমন করল এক কংকাল। কিন্তু কেন? কিন্তু তাঁর কারণ কি? জানতে হলে পড়তে হবে গল্পটি। তারিণীখুড়োর জবানিতে আরও একটা আজগুবি গল্প। তবে এমনভাবে গল্পটা বলেছেন তারিণীখুড়ো যে সেটা সত্য না মিথ্যা তা বোঝার কোন উপায় নেই! সবমিলিয়ে বলতে হবে, এই বইয়ের দশটি গল্পই দারুণ সুন্দর। দশটাই দশটা আলাদা ধরণের তা অবশ্য বলার উপায় নেই। কিছু কিছু গল্পের বিষয়বস্তু আর চরিত্রদের মধ্যে সামান্য হলেও মিল আছে। তারপরও বলতে হবে, সত্যজিৎ রায় যে ছোটগল্প রচয়িতা হিসেবে কতটা অসামান্য ছিলেন তার সাক্ষ্য বহন করবে এই দশটি গল্প। তবে এই বইয়ের নাম 'সেরা সত্যজিৎ' মানে যে প্রকৃতই সত্যজিৎ রায়ের শ্রেষ্ঠ ১০টি গল্পের সংকলন এটি, তা বোধ হয় ঠিক না। সত্যজিৎ রায়ের লেখা আরও কিছু গল্প আছে যেগুলো এই বইয়ের গল্পগুলোর সাথে পাল্লা দেবার যোগ্যতা রাখে এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে সেগুলোর কয়েকটি এই বইয়ের কতগুলো গল্পের চেয়েও ঢের বেশি শক্তিশালী।
Was this review helpful to you?
or
বাংলা ভাষায় একটি কথা প্রচলিত রয়েছে যে, রবীন্দ্রনাথের ছেলে কখনো রবীন্দ্রনাথ হয় না। তবে কথাটি সম্ভবত সত্যজিৎ রায়ের বেলায় খাটে না। সত্যজিৎ রায়ের বেলায় বলা যায়, রবীন্দ্রনাথের ছেলে যে সব সময় রবীন্দ্রনাথ হয়, তা নয়। অনেক সময় রবীন্দ্রনাথকেই ছাড়িয়ে যায়। একথা সকলেই স্বীকার করবেন যে, সত্যজিৎ রায় খ্যাতি এবং জনপ্রিয়তায় তাঁর পিতা সুকুমার রায় এবং ঠাকুরদা উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীকেও হার মানিয়েছেন। এমন বই পাগল মানুষ খুব কমই পাওয়া যাবে, যাদের শৈশব ও কৈশোরের অনেকটা সময় ‘ফেলুদা’ এবং ‘প্রফেসর শঙ্কু’ পড়ে কাটেনি। তবে, সত্যজিৎ রায়ের সাহিত্যিক সৃজনশীলতা শুধু এই দুই অমর চরিত্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। তাঁর কলমের জোরের পরিচয় পাওয়ার আরও একটি উপায় হল তাঁর ছোটগল্প সমূহ। এমনই কয়েকটি ছোট গল্পের সংকলন হল ‘সেরা সত্যজিৎ’ নামক বইটি। এতে স্থান পেয়েছে সত্যজিৎ রায়ের মোট ১০টি অসাধারণ ছোটগল্প। এগুলো হলঃ- ১। বিপিন চৌধুরীর স্মৃতিভ্রম ২। পটল বাবু ফিল্মস্টার ৩। খগম ৪। রতনবাবু আর সেই লোকটি ৫। ভক্ত ৬। অসমঞ্জবাবুর কুকুর ৭। ক্লাস ফ্রেন্ড ৮। বৃহচ্চচঞ্চু ৯। লখনৌর ডুয়েল ১০। তারিণীখুড়ো ও বেতাল বইটি পড়লেই পাঠক সত্যজিৎ রায়ের অসাধারণ কল্পনাশক্তি ও আধিভৌতিক ব্যাপার এ কৌতূহল সম্পর্কে জানতে পারবেন। আধিভৌতিক ব্যাপারে কৌতূহল এর ফলাফলই সম্ভবত সংকলনে বাস্তব ঘটনার উপর অবলম্বন করে লেখা গল্পের সংখ্যা মাত্র ৪টি। এখন আসা যাক ছোটগল্প গুলো কেমন, সেই ব্যাপারে। ১। বিপিন চৌধুরীর স্মৃতিভ্রমঃ এই গল্পের প্রধান চরিত্র হলেন বিপিন চৌধুরী নামে এক ভদ্রলোক। এক অফিসের কর্মকর্তা। নিরীহ, নির্বিরোধী মানুষ, তবে বেশ কতকটা স্বার্থপর। অন্যের দুঃখে-কষ্টে মন তেমন ব্যাথিত হয় না। এমনিতে পরিষ্কার মাথার মানুষ। সেই বিপিন চৌধুরীই একদিন অফিস ফেরত হয়ে নিউমার্কেটে বই কিনছিলেন। সেই সময় আচমকা এক অপরিচিত আগন্তুকের দেখা মেলে। আগন্তুক, তাঁকে ১৯৫৮ সালের এক রাঁচি ভ্রমণের কথা বলে। সেই ভ্রমণেই নাকি আগন্তুকের সাথে দেখা মেলে বিপিন চৌধুরীর। কিন্তু আশ্চর্যের বিশয় হলো, বিপিন চৌধুরীর সেই ভ্রমণের কোন স্মৃতিই মনে নেই। এমনকি তিনি কোনোদিন রাঁচি গিয়েছেন কিনা তাও স্মরণ করতে পারছেন না। এই গল্পের মাধ্যমেই পাঠকের পরিচয় ঘটবে সত্যজিৎ রায়ের অপূর্ব গদ্যশৈলীর সাথে। তবে, এই গল্পের শেষেই পাঠক একটি চমক খাবেন, তা নিশ্চিন্তেই বলা যায়। ২। পটলবাবু ফিল্মস্টারঃ- গল্পের নাম থেকেই গল্প সম্পর্কে কিছুটা আঁচ করা যায়। গল্পটি পটলবাবু নামক এক মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক নিয়ে। এক কালে পাড়ার থিয়েটারে অভিনয় করতেন। বয়স হওয়ার কারণে পরে তা ছেড়ে দেন। তবে জীবনের পড়ন্ত বেলায় এসে হঠাৎ করেই সুযোগ আসে একটি ফিল্মে অভিনয় করার। আমাদের সমাজের এই সাধারণ ঘটনা বা নিজস্ব বোধকে সুনিপুণ শিল্পীর মত সত্যজিৎ রায় কলমের আঁচড়ে এঁকে দেন বইয়ের ক্যানভাসে। গল্পটি শেষ করার পরপরই পাঠক জীবনটাকে নতুন দৃষ্টিভঙ্গীতে দেখবেন, সেই আশাই করা যাচ্ছে। ৩। খগমঃ- ‘খগম’ গল্পটিকে বলা যায়, প্রাচীন হিন্দু মিথ বা রূপকথার আধুনিক সংস্করণ। ধূর্জটিবাবু নামক এক ভদ্রলোককে নিয়ে আবর্তিত হয় এর ঘটনা প্রবাহ। পড়ার সময় প্রতি মুহূর্তেই গা শিউরে উঠবে। গল্প সম্পর্কে বেশি কিছু বলে পাঠকের কৌতূহল নষ্ট করতে চাচ্ছি না। গল্প পড়লে পাঠক বুঝবেন, কেন যে অসাধারণ গল্প বলার ক্ষমতার কারণে সত্যজিৎ রায়ের এ আধিভৌতিক গল্পটিকে অনেক সময় সত্য বলে ভ্রম হয়। ৪। রতনবাবু আর সেই লোকটিঃ- গল্পটিকে বলা যায়, সায়েন্স ফিকশন এবং ভৌতিকতার সংমিশ্রণ। গল্পের মূল চরিত্র হল রতনবাবু নামে এক ভদ্রলোক। অদ্ভুত অদ্ভুত জায়গায় বেড়াতে ভালবাসেন। সিনিতে বেড়াতে যাওয়ার সময় তার সাথে পরিচয় ঘটে মণিলালবাবু নামে এক ভদ্রলোকের। অবিশ্বাস্য ভাবে রতনবাবুর চেহারা, স্বভাব এবং ব্যক্তিজীবনের সাথে হুবহু মিল রয়েছে মণিলালবাবুর। ঠিক যেন একজন আরেকজনের কার্বন কপি। পাঠক নিশ্চিতভাবেই রহস্যের গন্ধ পেয়ে যাবেন এ গল্পে। গল্পটি পড়ে আমার নিজের মনে হয়েছে, জগতের কিছু রহস্য হয়তবা পর্দার আড়ালেই থেকে যাবে। ৫। ভক্তঃ- গল্পটিকে আমার কাছে বেশ মজার বলে মনে হলেও, এই গল্পটি ‘সেরা সত্যজিৎ’ বইয়ের সবচেয়ে দুর্বল গল্প বলেও আমার মনে হয়। অরূপরতন নাম লোকটির। পুরীতে বেড়াতে গিয়েছেন। হঠাৎ, তাঁর পরিচয় হয় একদল লোকের সাথে। তারা তাঁকে শিশু সাহিত্যিক অমলেশ মৌলিক ভেবে ভুল করে। তারপর নানা ঘটনার জন্ম দিয়ে এগোতে থাকে গল্পের কাহিনী। গল্পটি পড়ার পর আমার মনে হয়েছে সত্যজিৎ রায়ে হয়তবা মানুষের একটি স্বভাব মানে ‘নিজেকে প্রকাশ করার মধ্যে যে অহংবোধ’ সে সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিল না। ৬। অসমঞ্জবাবুর কুকুরঃ- এটি একটি সায়েন্স ফিকশনধর্মী ছোটগল্প। অসমঞ্জ নামে এক লোক রাস্তা থেকে এক ভুটানি নেড়ি কুকুর ক্রয় করেন। তবে তাঁর এর এ কুকুর সাধারণ কুকুর নয়। কারণ তাঁর কুকুর মানুষের মত হাসতে পারে! এবং তা কিছুদিনের মধ্যেই দৃষ্টিগোচর হয় অসমঞ্জবাবুর। সারা শহরে ছড়িয়ে যায় কথাটা। শেষ পর্যন্ত অসমঞ্জবাবুর কুকুরের ভাগ্যে কি ঘটে তা জানার জন্যে পাঠকের এই গল্পটি পড়তে হবে। গল্প শেষ করার পরে বাস্তবিকই সত্যজিৎ রায়ের কল্পনাশক্তির প্রশংসা না করে পারা যায় না। ৭। ক্লাস ফ্রেন্ডঃ- আমাদের সমাজের তথা নিজেদের মানসিকতার দুর্বলতার প্রতিচ্ছবি এই গল্পটি। স্কুল জীবনের দুই বন্ধুর পরিণত বয়সের কাহিনী এটি। কেউ যদি আমাকে জিজ্ঞাসা করে, ‘সেরা সত্যজিৎ’ গ্রন্থের সেরা গল্প কোনটি? তবে আমি নিঃসন্দেহে এটির নাম বলব। নিজের বিবেককে নাড়া দেয়ার মত গল্প। ৮। বৃহচ্চঞ্চুঃ- ঠিক যেন জুরাসিক যুগের উপাখ্যান এটি। ত্রিশ বছর আগে বিলুপ্ত হওয়া এক দৈত্যাকৃতির পাখি নিয়ে লেখা সায়েন্স ফিকশন ধর্মী গল্প। তুলসীপ্রসাদ নামে এক লোক জঙ্গলে ঘুরতে গিতে হঠাৎ পেয়ে যান পাখিটির বাচ্চা। পোষ মানানোর জন্য নিজের বাড়িতে নিয়ে আসেন পাখিটিকে। বড় হওয়ার সাথে সাথেই যেন শুরু হয় পাখিটার তাণ্ডব। পুরো লোকালয় পাখির ভয়ে তটস্থ। শেষ পর্যন্ত পাখির ভাগ্যে কি ঘটলো, তা জানতে পড়তে হবে এই গল্পটি। ‘প্রফেসর শঙ্কু’ লিখে সত্যজিৎ রায় নিজে যে নাম কুড়িয়েছেন, তা অক্ষুণ্ণ রেখেছেন এই গল্পের মাধ্যমে। ৯। লখনৌর ডুয়েলঃ- বাস্তবতার চাদরে ঢাকা এক ভৌতিক গল্প। লখনৌ শহরের প্রায় দুইশ বছর আগে ঘটে যাওয়া এক ডুয়েলের ঘটনার আজও নাকি প্রতি বছর পুনরাবৃত্তি ঘটে সেই একই জায়গায়। নিজের দেখা সেই অভিজ্ঞতার ঘটনা গল্পের ছলে কিশোরদের শুনিয়েছেন তারিণীখুড়ো। সত্যজিৎ রায় যে ভৌতিক গল্প রচনায় হাত পাকিয়েছেন তা বোঝা যাবে এই গল্পটি পড়ে। এই গল্পের তুলনা চলে শুধুমাত্র তাঁরই রচিত আরেক ভৌতিক গল্প ‘সাইমন’ এর সাথে। ১০। তারিণীখুড়ো ও বেতালঃ- এটিও প্রাচীন এক হিন্দু মিথের আধুনিক সংস্করণ। এই গল্পতেও পূর্বের গল্পের মত গল্পকথকের ভূমিকা পালন করেছেন তারিণীখুড়ো। যৌবনের এক ভৌতিক ঘটনার কথা শুনিয়েছেন কিশোরদের। তাঁর সাথেই পুনরাবৃত্ত হয়েছিল বিক্রমাদিত্য ও বেতালের ঘটনা। এই গল্পের একটি উক্তি বেশ মজার। ঘটনাটি হল, ভোজরাজ, তারিণীখুড়োকে জিগ্যেস করলেন, “এই যে এসব ভৌতিক কাজ কারবার করছ যে, তার প্রতি বিশ্বাস আছে তো তোমার?” তারিণীখুড়ো ঝটপট উত্তর দিলেন, “ আমার মনের সব কপাট খোলা, ভোজরাজজী আমি হাঁচি টিকটিকি ভূত-প্রেত দত্যি-দানা বেদ-বেদান্ত আইনস্টাইন-ফাইনস্টাইন সব মানি।” -------------------------------------------------------------------------- হলফ করে বলতে পারি বইটি একবার পড়া শুরু করলে তা শেষ না করে উঠা যাবে না। এমন স্বাদু রচনার জুড়ি মেলা সত্যিই ভার। এছাড়া এই বইয়ের আরেকটি আকর্ষণ হল, সত্যজিৎ রায়ের নিজ হাতে আঁকা অপূর্ব সুন্দর স্কেচ! শেষ পর্যন্ত জটায়ুর মত বলতে ইচ্ছা করে ‘জয় বাবা সত্যজিৎ রায়!’