User login
Sing In with your email
Send
Our Price:
Regular Price:
Shipping:Tk. 50
প্রিয় ,
সেদিন আপনার কার্টে কিছু বই রেখে কোথায় যেন চলে গিয়েছিলেন।
মিলিয়ে দেখুন তো বইগুলো ঠিক আছে কিনা?
Share your query and ideas with us!
Was this review helpful to you?
or
বহু বছর আগে রহু ও বাজিকররা পশ্চিমের এক ভূখন্ডে বাস করতো। তাদের জীবন ছিল সহজ সরল। তাদের বসতির কাছ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীতে ছিল অফুরন্ত স্রোত, বনে অসংখ্য শিকারের পশু এবং মাঠে অজস্র শস্য। তারপর একদিন বহিরাগতরা এসে প্রথমে রহুর সেরা ঘোড়াটি নিয়ে গেল। কিছুদিন পর বহিরাগতরা আবার সদলবলে ফেরত আসে। নদীর তীরে তাদের দেবতার মন্দির নির্মাণ করে তারা দেশে ফেরত চলে যায়। ফেরার পথে তারা রহুর জনপদের উপর ইচ্ছেমতো অত্যাচার করে। তৃতীয়বার তারা আরো শক্তিশালী হয়ে আসে, তখন তাদের সাথে ছিল পুরোহিতরা। তারা সেই মন্দিরে তাদের দেবতার পূজা করা শুরু করলো। তারা রহুর জাতিকে নদীর পবিত্র জল ব্যবহারে বাঁধা দিল। অবশেষে রহু এক সময় বুঝতে পারলো বহিরাগতদের অপসংস্কৃতি তার নিজ গোষ্ঠীতে অনুপ্রবেশ করেছে। রহু তার লোকজনকে ডেকে বলে, তার জাতিকে সে আর রক্ষা করতে পারবে না। তাদের অধঃপতন ঠেকাতে এই এলাকা থেকে সরে যেতে হবে। রহু বলেছিল, যারা তাকে অনুসরণ করবে তারা একদিন আবার পূর্ণ সমৃদ্ধি খুঁজে পাবে। রহুর অনুসারীরা তার পথ ধরে দেশান্তরী হয়। রহু তার হাড় দিয়েছিল বাজিকরদের। কালের বিবর্তনে তারা সেই হাড় হারিয়ে ফেলে। সেই হাড়ের খোঁজেই বংশ পরম্পরায় বাজিকর দনু, পিতেম, লুবিনি এবং সর্বশেষ শারিবার অভিযাত্রা চলতে থাকে। এই মহাযাত্রার শেষ কোথায়? ‘রহু চণ্ডালের হাড়’ সমাজের নিম্নবর্গের(সাব-অলটার্ন) মানুষের জীবন সংগ্রামের কাহিনি। লেখক অভিজিৎ সেন যাযাবর গোষ্ঠীর জীবনযাত্রার এক অদ্ভুত চিত্র-চরিত্র একেঁছেন এই উপন্যাসে। উপন্যাসের এই কাহিনি শুধু রাঢ়-বরেন্দ্র অঞ্চলের বাজিকরদের কাহিনি নয়, এই কাহিনি প্রায় দেড়শ বছরের ইতিহাসও বটে। পুরুষানুক্রমে এই উপন্যাসের চরিত্র দনু-পীতেম-ধন্দু-জামির-রূপা-শারিবার মধ্য দিয়ে যাযাবর গোষ্ঠীর অতীত-বর্তমানের কাহিনি বার বার ভিন্ন ভিন্ন চোখে ফিরে আসে আমাদের সামনে। আলোচনার জন্য উপন্যাসটিকে মোটাদাগে তিনটি অংশে ভাগ করা যেতে পারে। প্রথমে পৌরাণিক অংশ: রহুর কিংবদন্তি, ঐতিহাসিক অংশ: পুবের দেশের সন্ধান এবং তৃতীয়াংশ: বর্তমান। ★ ‘রহু চণ্ডালের হাড়ের’ পৌরাণিক অংশে আমরা দেখতে পাই, রহুর পৌরাণিক গল্পগাঁথা। বহিরাগত অপশক্তি রহুর জনগোষ্ঠীকে অত্যাচার করে,নিজেদের মন্দির প্রতিষ্ঠা করে অপসংস্কৃতি ঢুকিয়ে দেয়। কিন্তু এখানে রহুর প্রতিবাদ কোনো কাজে আসে না। শক্তিধর বহিরাগতদের কাছে রহুর অসহায়ত্বের সূচনার সাথে সাথে বাজিকররা তাদের নিজ ভূমিতেই নিম্নবর্গের মানুষে পরিণত হয়। বহিরাগত শক্তির এই উপনিবেশায়নের(colonization) স্বীকার হয়ে বাজিকররা হয় ভূমিহীন, দেশছাড়া। বাজিকররা বাপদাদাদের মুখে শোনা কিংবদন্তি রহুর হাড় খুঁজতে শুরু করে। খুঁজতে থাকে নিজেদের জন্য নতুন বাসস্থান, নতুন দেশ। বাজিকররা জানে রহুর হাড় ঐন্দ্রজালিক, বুজরুকি। তবুও রহু নামের পৌরাণিক চরিত্রের দেখানো স্বপ্ন নিয়ে বাজিকররা বেঁচে থাকার প্রেরণা পায়। রহুর হাড়ের সন্ধানে তারা কোনো দেশ-কালে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না। পীতেম তার বাপ দনুর নির্দেশে এই অভিযাত্রা শুরু করে, শেষ হয় প্রায় একশ বছরের পরিক্রমায় শারিবার মধ্য দিয়ে। সব বাজিকর নিজের বুদ্ধিবিবেচনা মতো রহুর হাড় খোঁজে। রহুর হাড় খুঁজতে গিয়ে পীতেম উপলব্ধি করে বাজিকরদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি হতে পারে তাদের হারানো রহু চণ্ডালের হাড়। অন্যদিকে সর্বশেষ প্রজন্ম শারিবা বর্তমান সমাজে মিশে যেতে চায়। তার ধারনা হয় সমাজে তাদের গ্রহনযোগ্যতাই হয়তো রহুচণ্ডালের হাড়। এখান থেকে আমরা স্পষ্ট বুঝতে পারি, বিচ্ছিন্ন বাজিকর গোষ্ঠী কেনো এত বছর পার হয়ে গেলেও রহুর হাড়ের সন্ধান পায়নি। তারা কখনো সমাজে থিতু হতে পারেনি বা চেষ্টা করেও বিফলে গেছে। তাদের সর্বশেষ প্রজন্ম শারিবার মধ্য দিয়ে তারা সেই স্থিতিশীলতা পায়, রূপক অর্থে যার নাম রহু চণ্ডালের হাড়। লেখক তার উপন্যাসে অত্যন্ত সফলভাবে প্রয়োগ করেছেন বাজিকর গোষ্ঠীর লোকজ মিথ ও তাদের রীতিনীতিকে। বইটা পড়ার সময় আপনার মনে হবে এতো সেই অতিপরিচিত বেদে যাযাবরদের মতো মানুষজন, যারা সাপের খেলা দেখায় আমাদের দেশের পথেপ্রান্তরে। উপন্যাসের শুরুতে দেখা যায়, নানি লুবিনি কথক হয়ে উপন্যাসের সব গল্প বলতে থাকে বালক শারিবাকে। লুবিনির বয়ানে আমরাও শুনতে থাকি রহুর কিংবদন্তি। কাহিনি বলতে বলতে একসময় কিংবদন্তি ও বাজিকরদের অতীত ইতিহাস একসাথে মিলে মিশে একাকার হয়ে যেতে থাকে। লুবিনি পুবের দেশের কথা শারিবাকে বলে। এক সময় এই পুবের দেশের কথা দনু বলেছিল তার ছেলে পীতেমকে। পীতেম বলেছিল পরতাপ, জামির ও লুবিনিকে। এভাবেই রহুর মিথ চক্রাকারে একই পরিবার, যাযাবর সমাজের মাঝে শতবর্ষব্যাপী ঘুরতে থাকে। এক সময় দেখা যায়, কালের বিবর্তনে রহুর মিথের সমান্তরালে আরেকটি নতুন মিথ ‘পুবের দেশ’ সৃষ্টি হয়েছে। এই দুটো মিথের সংযোগ করতে গিয়ে অভিজিৎ সেন জাদুবাস্তবতার প্রয়োগ ঘটান__”এক চাঁদনী রাতে পীতেম তাঁবুর বাইরে বেরিয়ে এসে একেবারে হতবাক হয়ে যায়। এত কাল যে গাছটার নীচে বসে সে একান্তে কাটালো, সে গাছটা কই? গাছটা সেখানে নেই….সেখানে দাঁড়িয়ে আছে পীতেমের বাপ দনু। দনু বলে, ‘পীতেম হে, পীতেম, পুবের দেশে যাও,বাপ’।“ ★ পুবের দেশের সন্ধানে অংশে, আমরা দেখতে পাই এক অপরিচিত দেশে বাজিকররা বসতি গড়েছে। ঘর্ঘরা নামের এক পবিত্র নদীর পাশে থাকতো বাজিগররা। প্রবল এক ভূমিকম্পে তাদের বসতি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। আর তার সাথে হারিয়ে যায় গোরখপুর বাজিগরদের সব বাড়িঘর। এই অবস্থায় পীতেম বাজিকর ঘুমের মধ্যে তার মরা বাপের নির্দেশ পেয়ে পুবের দেশের দিকে যাত্রা করে। গঙ্গা নদীর তীর ঘেঁষে রাজমহলে তাদের নতুন বসতি গড়ে উঠে। তারা রাজমহলে পাঁচ বিঘা জমির পত্তনি নেয়। কিন্তু পরে জানতে পারে এসবই ভুয়া। বাজিকরদের এখানে আরো সমস্যায় পড়তে হয়,যখন পীতেমের ছেলে ধন্দুর ঘোড়াটা নিতে চায় দারোগা। পাঠক খেয়াল করবেন, রহুর ঘোড়া ছিনিয়ে নেয়ার মতই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে এখানে (জাদুবাস্তবতায় একই ঘটনার বার বার পুনরাবৃত্তি ঘটার মতো)। একই সময়ে সাঁওতালদের সাথে বাজিকরদের ঘনিষ্ঠতার সূচনা হয়। বাজিকর যুবকদের একাংশ সাঁওতাল বিদ্রোহে যোগ দেয়। বিনিময়ে সাঁওতালরা বাজিকরদের স্থায়ী বসতির সন্ধান দিতে চায়। অন্যদিকে দেখা যায়, পীতেমের নাতি জামিরের সাথে লুবিনির বিয়ে হয়। জামির তরমুজের চাষ করে স্থায়ী আয়-ইনকামের চেষ্টা করে। তরমুজের বাম্পার ফলন ঘটার পর প্রতিপক্ষ সেই তরমুজ নষ্ট করে দেয়। জামির রক্তক্ষয়ী প্রতিশোধ নিলে যাযাবররা আবারো বিতাড়িত হয়। আবার তারা রহুর নির্দেশিত পথে চলতে শুরু করে। এই অংশের কাহিনি লক্ষ্য করলে খেয়াল করবেন, বাজিকররা এখানে বুঝতে পারে তারা আদতে দেশহীন, ধর্মহীন এক যাযাবরের জাত যাদের কোনো পরিচয় আমাদের আধুনিক সমাজে নাই। তাদের স্বপ্ন ঘুরতে থাকে রহুর মিথকে ঘিরে কারন রহুর কথা মতে পুরা দুনিয়াই তো বাজিকরদের। অথচ সেই দুনিয়ায় এক টুকরো জমিন পায় না বাজিকররা। তারা রহুর হাড়ের সন্ধানে তামাম দুনিয়া চষে বেড়ায়। তারা মুসলমানদের মতো নামাজ পড়ে না, হিন্দুদের মতো পূজা-আর্চনা করে না। অথচ তারা গরুও খায়, শূকরও খায়। দীর্ঘ একশো বছরে কেউ এসব নিয়ে অভিযোগ তোলেনি। যখন দেশভাগের সময় এলো তখনি ধর্ম, জাত-পাতের হিসাব এসে গেলো। দেশভাগের পর বাজিকরদের সামনে একটাই পথ খোলা থাকে, নতুন ধর্মীয় পরিচয় গ্রহণ করা। উপন্যাসের শেষে পাঠক বুঝতে পারবেন, রহুর দেখানো সেই ‘পুবের দেশ’ আদতে একফালি উর্বরা জমি ছাড়া আর কিছু নয়। ★ বর্তমান অংশে, দেখা যায় যাযাবররা বরেন্দ্র অঞ্চলে নতুন বসতি গড়েছে। এখানে দেখা যায়, জামির ও লুবিনির ছেলে রূপাকে দিনমজুরের কাজ করতে। জামিরের জেলহাজত ও রূপার অন্তর্ধানে যাযাবরদের অস্তিত্ব সংকট প্রকট হয়ে উঠে। এলাকার তসশিলদার হাজী সাহেব তাদের মুসলিম হবার প্রলোভনে স্থায়ী বাসস্থানের লোভ দেখায়। হাজী সাহেব তাদের পতিত জমি দেবে, বিনিময়ে মুসলমান হতে হবে বাজিকরদের। এই পরিচয়ে তারা নতুন জাত পাবে, নিজস্ব ধর্মীয় পরিচয়ে সমাজে গ্রহণযোগ্যতা পাবে। এর মধ্য দিয়ে বাজিকরদের একশ বছরের পরিভ্রমণের সমাপ্তি ঘটবে। এক পর্যায়ে রূপা যখন ফেরত আসে, তার ছেলে শারিবা ততদিনে বড় হয়ে গেছে। শারিবা শহরে যায় গ্যারেজের কাজ করতে। শহরে পরিবেশে শারিবার মধ্যে আমূল পরিবর্তন আসতে শুরু করে। বাজিকরদের নিজস্ব কিছু রীতিনীতি রয়েছে। তারা সাধারণত নিজেদের গোত্রের মধ্যে বিয়ে করে। এখানে দেখা যায়, শারিবা নমশূদ্র মেয়ে মালতীকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। অন্যদিকে ড্রাইভার হানিফ বাজিকর মেয়ে পলবিকে বিয়ে করতে চায়। এই দুই ঘটনাই মূলত একই সূত্রে গাঁধা। এই বৈবাহিক বন্ধনের মাধ্যমেই বাজিকররা একই সাথে হিন্দু মালতী ও মুসলিম হানিফের সমাজে প্রবেশ করে। এই ঘটনাগুলোর মধ্য দিয়ে বাজিকরদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের একটা বিষয় পাঠকের নজরে আসবে। তারা অন্যদের প্রতি সহানুভূতিশীল, অন্যের দুঃখে সহমর্মিতা তাদের মজ্জাগত। আধুনিক সমাজে থিতু হবার সাথে সাথে তাদের পরিচয় তৈরি হয়, জাত-পাতহীনের সমস্যা মিটে গিয়ে বাজিকররা হিন্দু-মুসলিম দুইভাগে ভাগ হয়ে পড়ে। তাদের নতুন ধর্মীয় পরিচয় সামাজিক স্বীকৃতি দিলে তাদের রহু চণ্ডালের হাড় অনুসন্ধানের সমাপ্তি ঘটে। বাজিকররা দেশ ও সমাজের স্থায়ী বাসিন্দা হবার স্বীকৃতি পায় কিন্তু হারিয়ে ফেলে তাদের শতশত বছরের লালন করা নিজস্ব পরিচয়। নিচু জাত হিসেবে তাদের অর্থনৈতিক অবস্থাও আগের মতই থেকে যায়। রহুর বাজিকররা যেমন উপনিবেশায়নের স্বীকার হয়ে নিজস্ব ভূমি হারিয়েছিল, বর্তমানের বাজিকররা সেই একইভাবে বিউপনিবেশায়নের(Decolonization) এর ভিতর দিয়ে গিয়ে এক খন্ড ভূমি পাবার বিনিময়ে নিজেদের বাজিকর পরিচয় হারায়। এই উপন্যাস বাজিকর গোষ্ঠীর আত্ম-অনুসন্ধানের, নিজেদের সুলুক-সন্ধানের গল্প বলে। অভিজিৎ সেন দেখিয়েছেন কীভাবে আমাদের সমাজে নিম্নবর্গের মানুষেরা সব সময় অবহেলিত, বাস্তুভিটাহীন হয়ে জীবনের শেষ পর্যন্ত থিতু হবার চেষ্টায় থাকে। লেখক শুধু গল্প বলেননি, তার উপন্যাসের ভিতর দিয়ে আবহমান কালের সব প্রান্তিক মানুষের বিশাল এক ইতিহাস উপন্যাসের রূপ পেয়েছে। এই উপন্যাসের চরিত্র তৈরি করতে গিয়ে অভিজিৎ সেন যেনো নতুন দেশ, নতুন এক বাস্তবতার সৃষ্টি করেছেন। এখানে বাস্তবতা যেনো জাদুর মতো অলৌকিক নয়, লৌকিক হয়ে সমাজের সাথে মিশে যায়। এই বাস্তবতায় কোনো প্রধান চরিত্র নেই, নারীপুরুষের ভেদাভেদ নেই। সব চরিত্রের পরিচয় একই, তারা বাজিকর। যখন দনু তার ছেলে পীতেমকে স্বপ্নে এসে রহুর পথে চলার নির্দেশ দেয়, তখন পীতেম তার বাপের আদেশ মেনে নিজেকে পরিণত করে শ্রেষ্ঠ বাজিকর নেতা হিসেবে। পীতেমের ভিতর প্রথমবারের মতো দেখা যায় আধুনিক চিন্তার একজন যাযাবর মানুষের পরিচয়। পুবের দেশের সন্ধানে এসে সাঁওতালদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি তার দুরদর্শিতার অপূর্ব নির্দশন। পীতেমের এই সফলতার পিছে সালমা নামের একজন নারীর সবচেয়ে বড় অবদান ছিল। বাজিকর সালমা পীতেমের সৎবোন কিনা সেটা নিয়ে দুজনেরই মনে সন্দেহ থাকায় তারা বিয়ে করে না। কিন্তু দুজনের বোঝাপড়া, অবৈধ ভালবাসা তাদের সম্প্রদায়কে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে বহুলাংশে সাহায্য করে। ধন্দুর ছেলে জামির হবার পর পীতেম বলে উঠেছিল,’রহু রহু’। পীতেমের এই পৌরাণিক বিশ্বাস বাস্তবের জামির ভিতর দিয়ে চিত্রায়িত করেন অভিজিৎ সেন। পীতেমের পর বাজিকর সমাজের সবচেয়ে যোগ্য নেতৃত্ব দেয় জামির। জামির পীতেমের অর্থনৈতিক মুক্তির চিন্তা বাস্তবে রূপ দেয়; ফসলি কাজ করে বাজিকরদের পুর্নবাসন প্রক্রিয়ার দিকে নিয়ে যেতে। লুবিনি চরিত্রটি মূলত এই উপন্যাসের কথক, লেখক অভিজিৎ সেনের কণ্ঠস্বর। শক্তিশালী কোনো চরিত্র নাহলেও লুবিনির জবানিতেই বাজিকরদের অতীত এবং বর্তমানের কাহিনি মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। লুবিনির গল্পগুলো শারিবার জন্য নতুন দিগন্ত তৈরি করে দেয়। বাজিকরদের অতীত কাহিনি শুনতে শুনতে ঋদ্ধ শ্রোতা শারিবাই ছিল বাজিকর সম্প্রদায়ের সবচেয়ে উদার ও আধুনিক চিন্তার মানুষ। হিন্দু বা মুসলিম কোনো পরিচয়ে না গিয়ে সে নিজের অস্তিত্ব জানান দেয় ‘শারিবা বাজিকর’ নামে; কাগজে-কলমে, সমাজের প্রতিটা জায়গায়। এই উপন্যাসের চরিত্রগুলা এতটাই বাস্তব যে উপন্যাস পড়তে গিয়ে পাঠক নিজেই চরিত্রগুলোর ভিতর ঢুকে যাবেন। উপন্যাসের শেষ পর্যায়, শারিবা বাজিকর সমাজ ছেড়ে নাগরিক জীবনে প্রবেশ করে রহুর দেখানো স্বপ্নের কাছাকাছি চলে আসে। শারিবার আমাদের সমাজে মিশে যাবার মধ্য দিয়ে সমাপ্তি ঘটে যাযাবরদের শতবর্ষব্যাপি অভিযাত্রা। অনিশ্চিত জীবন জেনেও রহুর দেখানো পথেই শারিবা আধুনিকতাকে মেনে নেয়, বাজিকর আত্মপরিচয়কে নিজের ভিতর সুপ্ত রেখে নাগরিক জীবনে নিজের অবস্থান তৈরি করে। এই সময় শারিবার কাছে শেষবারের মতো আসে রহু। রহু শারিবাকে জিজ্ঞেস করে, ‘তুমি কে?’ ‘আমি শারিবা।’ ‘শারিবা কে?’ ‘শারিবা বাজিকর।’ ‘তবে তো তোমার খুব দুঃখ।’ ‘হ্যাঁ, আমার বড় দুঃখ। আমার দুঃখের আসান নেই।’ বই: রহু চণ্ডালের হাড় লেখক: অভিজিৎ সেন প্রকাশনী: কবি প্রকাশন প্রথম প্রকাশ কাল : ১৯৮৫ কবি প্রকাশন এডিশন: ২০১৯
Was this review helpful to you?
or
সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব মানবজাতির নানা গোত্রে যে সদা ক্রিয়াশীল রয়েছে তারই জীবন্ত এক দলিল হোল রহুচণ্ডালের হাড়। বইটা পড়তে যেয়ে আগে পড়া আরো নানা বইয়ের চিত্র মগজে ভেসে আসে যেমন - গোর্কির ইতালীর রূপকথা বইয়ের সেই বুড়ি ইজেরগিল বা স্তেপভূমিজ সন্তান ডানকোর কথা, খোয়াবনামা উপন্যাসের সেই তমিজের বাপ ও তার পাকুরগাছের কথা, আরণ্যক উপন্যাসের ধাতুরিয়া ছেলেটির কথা বা পদ্মা নদীর মাঝি হুসেন আলী ও তার স্বপ্নের ময়না দ্বীপের কথা ইত্যাদি আরো অনেক চরিত্রের কথা। বইটা ভাবায় পুর্ববঙ্গের আজকের বাঙালি মুসলমানদের অতীতটি কি বাজিকর নলুয়া বাউদিয়া বাদিয়াদের অতীত নয়তো? ১৯৭১ পুর্ব আম-বাঙালি মুসলমান ও পিতেম রমজান শারিবাদের মধ্যে আর তফাত কতটুকু ছিল?১৯৭১ এ আমরা যা অর্জন করেছি তার মর্মার্থ আমরা কি আজো বুঝে উঠতে পেরেছি?