User login
Sing In with your email
Send
Our Price:
Regular Price:
Shipping:Tk. 50
প্রিয় ,
সেদিন আপনার কার্টে কিছু বই রেখে কোথায় যেন চলে গিয়েছিলেন।
মিলিয়ে দেখুন তো বইগুলো ঠিক আছে কিনা?
Share your query and ideas with us!
Was this review helpful to you?
or
আহমাদ মোস্তফা কামাল শহুরে মানুষ। শহরের জটিলতার মাঝে তিনি ক্রমশ হারিয়ে যান। জটিলতার মাঝে গল্পকার হয়ে তিনি সাজিয়ে নেন তাঁর চরিত্রগুলোকে। তাঁর চরিত্রগুলো ক্রমশ এগিয়ে যায় জটিলতার দিকে। মুহূর্ত-সময়কে ধারণ করে চরিত্রগুলো হয়ে ওঠে রহস্যময়। মনের মাঝে প্রশ্ন এসে দাঁড়িয়ে থাকে। উত্তর খোঁজে। কিন্তু রহস্যময় আচরণগুলোর ব্যাখ্যা পাঠককে উত্তর দিতে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়ে যায়। পাঠকও আটকে যায় লেখকের ফাঁদে। পাঠককে এক নতুন ভাবনার দিকে নিয়ে যায়। ভাবতে ভাবতে পাঠক আবিষ্কার করতে পারে যেগুলোকে আমরা রহস্যময় কিংবা বলি জটিলতার অংশ আসলে সেটাই হলো বাস্তবতা। কারণ বাস্তব বড়ই জটিল। মানুষের জন্মই হয় একটি জটিল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তাহলে মানব যে জীবনটি লাভ করলো তা কেন সহজ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাবে? আহমাদ মোস্তফা কামালের পঞ্চম গল্পগ্রন্থ “অশ্রু ও রক্তপাতের গল্প” প্রকাশ পেয়েছে শুদ্ধস্বর প্রকাশনী থেকে। “অশ্রু” ও “রক্তপাত” দুটি শব্দই এখন নগর জীবনের সঙ্গী হয়ে উঠেছে। ঘরে ঘরে অশ্রুর বন্যা হচ্ছে। এর কারণ হলো মানুষের বৈকল্য যে রক্তপাতের সূত্রপাত করে সেখান থেকেই অশ্রুর উদ্রেক হয়। এই গল্পগ্রন্থে গ্রন্থিত হয়েছে ১১টি গল্প। এর অধিকাংশই ঢাকার বিভিন্ন সময়কে ধারণ করা হয়েছে। কিংবা দেশের সময়কালকে তুলে আনা হয়েছে। প্রথম গল্প “অশ্রু অথবা রক্তপাত” গল্পটি পড়লেই পাঠক বুঝে নেবেন ঠিক কোন সময়টিকে তিনি তুলে আনতে চেয়েছেন। সাংবাদিক কবীরের স্ত্রী শারমীনের চোখ দিয়ে পানি পড়ে না। কঠিন সব মুহূর্তগুলোতেও সে কাঁদতে পারে না। শারমীনের এমনই এক অদ্ভুদ রোগের কথা জানিয়ে শুরু হয় ঘটনা। এরপর ঘটতে থাকে কবীরের বিভিন্ন সাহসী কর্মকাণ্ড। টিভি টক-শোগুলো যে সামাজিক পরিবর্তন ঘটাতে পারে না সেটাও প্রকাশ পায় গল্পে। সামরিক শাসকের ছত্রছায়ায় থাকা সরকারকে তুলোধূনো করে কবীর। হয়তো লেখকই করেছেন তার নির্মিত চরিত্র দিয়ে। কবীরের উপর চাপ আসে উস্কানীমূলক বক্তব্য থেকে বিরত থাকার। কিন্তু সাহসী সাংবাদিক কবীর তা মানে না। এদিকে দেশে এক আজব রোগের কথা শোনা যায়। কেউ কাঁদতে পারছে না। সকলের চোখে রক্তজমাট বেঁধে যাচ্ছে। গল্পের শেষে দেখা যায় তার ঘরে আইডি কার্ড সাথে নিয়ে কিছু লোক প্রবেশ করে। তার একমাত্র সন্তানকে চোখের সামনে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করা হয়। কবীর বিস্মিত হয়ে দেখে। রাজনৈতিক ব্যক্তিদের নৈতিক পরিবর্তনের কথা বলে যারা দেশের শাসনভার নিয়ে বসে আছে। তাদেরই নৈতিক হাতে হত্যা হয় কবীরের সন্তান। অবশেষে সারা দেশের মানুষের রক্তজমাট চোখ থেকে অশ্রু নয় রক্ত ঝরা শুরু হয়। এমনই কাল্পনিকতা দিয়ে ঘটনার ব্যাখ্যা করেছেন আহমাদ মোস্তফা কামাল। মানুষ কাঁদতে কাঁদতে চোখের পানি শেষ করে ফেলেছে তাই হয়তো শরীরের রক্ত বের হয়ে আসছে চোখের পানি হয়ে। এ যেন সময়ের বিরুদ্ধে মানব দেহের বিক্ষোভ। অন্যান্য গল্পগুলোতেও শহুরে নানান কথা প্রকাশ পায়। তবে মাঝে মাঝে লেখকের মায়ের প্রতি ভালোবাসার কথাও উন্মোচিত হয়ে উঠে “হুইল চেয়ার” গল্পটিতে। দেখানো হয় একটি হুইল চেয়ার কি করে ঘরের মানুষগুলো এক এক করে ব্যবহার করছে। কখনও খালুর কখনও মায়ের। কখনও বড় ভাইয়ের ছেলে রাহুলের। মায়োপ্যাথি আক্রান্ত রাহুল চলাফেরা করতে পারে না। তার জন্য এই হুইল চেয়ার। দেখানো হয় একটি একান্নবর্তী পরিবার কীভাবে ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। সেই বাড়িটিকে জোড়া লাগানোর এক আপ্রাণ চেষ্টা লেখকের। মায়ের স্বপ্ন ছিল একদিন তিনি তাঁর বাড়িতে যাবেন। মা যায় তবে চিরতরে। সাথে যায় রাহুল। সেই রাহুলকে ভৈরবী নদীর পাড়ে নিয়ে যায় তার কাক্কু। গল্প-কবিতায় পড়া নদী দেখে রাহুল। অসাধারণ এক প্লট পড়ে মুগ্ধ হবে পাঠক। একটি হুইল চেয়ার ঘরের তিনটি মানুষ ব্যবহার করেছে। পরম্পরা হয়ে গেছে হুইল চেয়ারটি। প্রতিটি গল্পে বারবর উঠে এসেছে পরিবার। উঠে এসেছে সম্পর্ক। সম্পর্ক নামক নানান ধাঁধায় মানুষ আটকে যায়। সম্পর্কের যে একটা টান থাকে সেটাই লেখক তুলে আনতে চেয়েছেন। যেমন, “বন্ধুতা, বৃষ্টিপাত, অথবা গন্তব্য” গল্পটি পড়লে বোঝা যায় পুরনো বন্ধুদের সাথে সম্পর্কের টানের কথা। এখানে মূল চরিত্রের মাধ্যমে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারকে তুলে এনেছেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে স্বৈরাচারী আন্দোলনের মাধ্যমে উত্তেজনাময় মুহূর্তগুলো বর্নণায় আসে। পরবর্তী জীবনে বন্ধুদের সফলতার কথাও উঠে আসে। বহুদিন পর একে অন্যের সাথে দেখা হয়। আড্ডা হয়। হঠাৎ বৃষ্টি নামে। কিন্তু কেউ যেতে পারছে না। কারণ একজনের গাড়ি নেই। গাড়িহীন বন্ধুকে রাস্তায় একা রেখে কেউ যেতে পারছে না। অবশেষে চলে যায়। হঠাৎ ফেরত আসে পাপ্পু। বন্ধুকে একা বৃষ্টির মাঝখানে রেখে যাওয়ায় ওর বিবেক ওকে বার বার আঘাত করছিল। তাই হয়তো ফিরে এসেছে। এরপর সারা রাস্তা দুই বন্ধুর যুক্তি-তর্কের শুরু হয়। অবশেষে একটি প্রশ্ন রেখে শেষ হয় গল্প। প্রশ্নটি হলো- মানুষ তাহলে কতোদূর যেতে পারে? একেকটি গল্প একেকটি বাস্তবতার কথা দিয়ে শুরু এবং শেষ। কেয়ারলেস হুইসপারে বন্ধু নজরুল কবীরকে নিয়ে কথা। “মরিবার হলো সাধ” আরেক শহুরে জটিলতার গল্প। সাংসারিক জীবনে কলহ নেই। তাই উত্তেজনা নেই। আলোড়নহীন জীবন একদম পানসে। আর সেই পানসে জীবন থেকে বের হওয়ার জন্য মুরাদ খুন করে তার স্ত্রীকে। হয়ে যায় ফাঁসির আসামী। “স্বর্ণলতা” গল্পটি অনেকটা পুরনো দিনের বাংলা সিনেমার মতোই লাগছিল। গরীব নায়ক। তবে ব্রিলিয়েন্ট ছেলে। বুয়েট থেকে পাশ করা ইঞ্জিনিয়ার। নায়িকার পিতার দয়ায় বেড়ে ওঠা। তাই বিয়ের পর বউয়ের শর্তে নিজ পরিবারের সাথে সম্পর্ক বিচ্ছেদ। এসবই বাংলা সিনেমার ঘটনা। এমন গল্পকারের কাছে বাংলা সিনেমার ঘটনা পুনরাবৃত্তি হবে এমনটা বোধ করি কেউই আশা করেন না। আমি পাঠক হয়েও আশা করিনি। তবে, শেষে এসে পাঠককে ধাক্কা দেবেন লেখক। রঙহীন জীবন থেকে স্ত্রী চলে যায়। ঠিক কোথায় যায় সে ব্যাখ্যা লেখক খুব একটা স্বচ্ছভাবে বলেন নি। তবে পুরো গল্পজুড়ে নায়ককে একদম নিশ্চুপ করে রাখা হয়েছে। কথা কম বলে। সারাদিন চেয়ারে বসে সময় কাটায়। রঙহীন জীবন যেন তার নিজস্ব তুলিতে আঁকা। এবং সেটাই প্রকাশ পেল। তিলে তিলে নিজেকে শাস্তি দিয়ে তিনি এক রঙহীনতার সৃষ্টি করেছেন। মা-বাবার সাথে সম্পর্ক বিচ্ছেদের মতো কাপুরুষকতা কাজের শাস্তি এই রঙহীনতা। এ ধরনের মানুষের নিজস্ব সত্ত্বা নেই। তারা নির্জিব। ব্রিলিয়ান্ট, চমৎকার মানুষ কিন্তু শেকড় নেই। নিজস্ব অস্তিত্ব নেই। একদম স্বর্ণলতার মতোই দেখতে সুন্দর কিন্তু অন্যের ওপর ভর করে বেঁচে থাকতে হয়। রঙহীনভাবে বেড়ে ওঠা গল্পগুলো পাঠককে দিয়ে যাবে বাস্তব জীবন নিয়ে নানান প্রশ্ন। আহমাদ মোস্তফা কামাল শহরের অন্তরাল থেকে খুঁজে আনা বাস্তবতার লেখক। গল্পের ভেতরেও গল্প থাকে তাঁর গল্পে। গল্পের ভেতর প্রশ্ন থাকে। ভাবনা থাকে। বিচ্ছিন্ন সব দৃশ্যের রচয়িতা তিনি। প্রতিটি গল্পে তার ভাষা সজীব, ঝরঝরে, প্রাণবন্ত। তবে তারপরও সেখানে আসে- হাতাশা, মানব চরিত্রের বৈকল্যতা। দেখতে পাওয়া যায় স্বপ্নের মৃত্যু কিংবা স্বপ্নের ধর্ষণ। আর সেইসব মৃত্যু নিয়েই ‘অশ্রু ও রক্তপাতের গল্প’।