User login
Sing In with your email
Send
Our Price:
Regular Price:
Shipping:Tk. 50
প্রিয় ,
সেদিন আপনার কার্টে কিছু বই রেখে কোথায় যেন চলে গিয়েছিলেন।
মিলিয়ে দেখুন তো বইগুলো ঠিক আছে কিনা?
Share your query and ideas with us!
Was this review helpful to you?
or
গল্প রচনার সুনির্দিষ্ট কোনো ট্র্যাক নেই। বড় কোনো ‘বিধি-নিষেধ’ না থাকায় যে কোনোভাবেই ফেনিয়ে তোলা যায় গল্পকে। হালের কবিতারও কি ট্র্যাক তৈরি হয়েছে? উত্তরে ‘না’ বলাটাই যুক্তিযুক্ত। যা ছিলো, সবই তো ভেঙ্গেচুরে গেছে, আরো অনেকটাই যাওয়ার পথে! হয়তো ট্র্যাক তথা ফরমেট মেনে সাহিত্যরচনার দিন ফুরিয়েছে। কবিতা কত রকম হতে পারে? কত রকম এবং কী কী ধরনের কবিতা রচিত হয়ে আসছে বাংলা সাহিত্যে, বিশ্বসাহিত্যে? সঠিক এবং যথার্থ উত্তর প্রচুর অনুসন্ধান করেও হয়তো পাওয়া যাবে না। কবিতার মতো গল্পের ক্ষেত্রটা বোধকরি অতটা বড় নয়। বিশেষ করে নীতিকথাসমৃদ্ধ গল্প। যে গল্পে কোনো না কোনো শিক্ষণীয় বিষয় থাকে। গল্পটা শুধু ‘গল্প শোনানো’র জন্য নয়- অন্য উদ্দেশ্য থাকে এর ভেতর। এ ধারার গল্প লিখেছেন ঈশপ। ঈশপের গল্প নামে তার গল্পগুলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে বিশ্বজুড়ে। ঈশপের প্রতিটি গল্পেই রয়েছে নীতিকথা, নীতিশিক্ষা। গল্পগুলো ছোটবড় সবার পাঠ্য হলেও মূলত ছোটরাই গল্পের মূল সুর নিজের জীবনে প্রতিফলিত করতে পারে। গল্প থেকে শিক্ষা নিয়ে সে অনুযায়ী গঠিত হয় তাদের রুচি, জীবনবোধ। বাংলাদেশে যেমন ঈশপের গল্প বহুল পঠিত, তেমনি সারাবিশ্বের বিভিন্ন দেশেও। ঈশপের জন্ম এবং বেড়ে ওঠা নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। তবে ধারণা করা হয়, যিশু খ্রিস্টের জন্মের ৬০০ বছর আগে তিনি গ্রিসে জন্মগ্রহণ করেন। এক ক্রীতদাস পরিবারে। গ্রিসের এ্যাথস নামে জনৈক ব্যক্তির ক্রীতদাস ছিলেন ঈশপ। কেউ কেউ ধারণা করছেন, ঈশপ ছিলেন বিকলাঙ্গ। জনশ্রুতি আছে, এক দেবী তাকে গল্প বলার ক্ষমতা দেন। বরপ্রাপ্ত হয়ে ঈশপ গল্প বলে মুগ্ধ করে তোলেন মানুষকে। অনন্য গুণের পরিচয় পেয়ে প্রভু এ্যাথস তাকে মুক্ত করে দেন। ঈশপ না থাকলেও শতাব্দীর পর শতাব্দীর তার গল্পগুলো মোহমুগ্ধ করে রাখছে মানুষকে। দিচ্ছে সঠিক পথের দিশা। বুঝিয়ে দিচ্ছে ভালোমন্দের প্রভেদটুকু। ঈপশের মতো এমন জাদুকরী গল্পবলিয়ে বিশ্বসাহিত্যে আর নেই। এখনো সম্ভাবনাময় কোনো গল্পবলিয়ে আবিষ্কৃত হননি- যিনি প্রতিনিধিত্ব করবেন গোটা বিশ্বের, মানবসম্প্রদায়ের। গল্প অবশ্যই শিণীয় মাধ্যম। জীবনবোধ তৈরির অন্যতম মাধ্যমও। গল্পের শক্তি অসীম। মানুষ যাপিতজীবনের জটিল কিছু সমস্যার সমাধান পেয়ে যায় গল্প থেকে। কিছু কিছু গল্প দর্শন এবং জীবনবোধে ঋদ্ধ- পড়ার পর নানারকম ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া শুরু হয় পাঠকের মনোজগতে। কখনোসখনো বাহির জগতেও। বাংলাদেশের গল্পকাররা নীতিকথার গল্প লেখেন না। পাঠকও ‘অযাচিত’ খবরদারি পছন্দ করেন না। সূক্ষ্মভাবে অনুসন্ধান করলে বোঝা যাবে- অনেক গল্পেই কোনো না কোনোভাবে লুকিয়ে আছে নীতিকথা, সমস্যার সমাধান। প্রচ্ছন্নভাবে এ ধরনের গল্প পাঠজনিত বোধ কাজ করে পাঠকের ভেতরে। এই বোধের ভেতরেই পাঠক তাড়িত হন; আলোড়িত হয়ে দৈনন্দিন জীবনে নানা রকম কাজ করেন, সিদ্ধান্ত নেন- যা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পাঠক নিজেও বোঝেন না! ০২. হাজার বছরের বাংলা কবিতার প্রবহমান ধারায় বিশেষ একটি স্থান অধিকার করে আছে নীতিকবিতা। কবিতার বাঁক বদলের ধারাবাহিকতায়, রবীন্দ্র পরবর্তীকাল থেকে নীতিকবিতার চর্চা ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে যায়। এর নেপথ্যে রুচিবদল, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের উন্মেষ কিংবা অন্য কোনো কারণ লুকায়িত থাকতে পারে। সাহিত্যের ল্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে বহুধা বিভক্ত মত রয়েছে। সাহিত্যিক শুধু নৈর্ব্যক্তিকভাবে লিখে যাবেন, কোনো তত্ত্ব বা উপদেশ দেয়ার এখতিয়ার তার নেই- এমনটি মনে করেন এরকম মানুষের সংখ্যাও কম নয়। যেহেতু সাহিত্যিক পাঠকের মাস্টার নন সেহেতু সাহিত্যের মাধ্যমে কাজ শিা দেয়াটা তার কাজ হতে পারে না। সাহিত্য মানুষকে বিনোদন তথা আনন্দ যোগাবে, কখনোবা এই আনন্দের ভিতর দিয়েই খুলে দেবে ভাবনাদুয়ার। ক্ষেত্রবিশেষে উস্কে দেবে পাঠকের মন ও মনন, আলোড়িত করবে; পাঠকের ভেতরটাকে লণ্ডভণ্ড করে দেয়ার মতা একটা ভালো রচনার থাকে। তা শুধু কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ বা উপন্যাসের ক্ষেত্র নয়, সাহিত্যের প্রতিটি শাখার জন্যই প্রযোজ্য। নীতিকবিতা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সূচনালগ্ন থেকেই রচিত হয়ে আসছে। অবশ্য সংস্কৃত ভাষায়ও লিখিত হয়েছে, কিন্তু বাংলা ভাষায় এসে এটা আরো পরিপুষ্ট হয়, বৃহৎ আকার ধারণ করে। মোটামুটি ঊনিশ শতক পর্যন্ত প্রবহমান ছিলো ধারাটি। তারপর কালের বিবর্তন, সংস্কৃতির পালাবদলে ধীরে ধীরে ক্ষীণ হয়ে আসে স্রোতটি। প্রাচীন বাংলাসাহিত্যে নীতিকবিতার আধিক্য ছিল চোখে পড়ার মতো। এমনও কবি আছেন, যাদের সাহিত্যকর্ম বলতে শুধু রয়েছে নীতিকবিতাই, এর বাইরে অন্যকিছু লেখেননি। একটা সময় সাহিত্যের কাছেই মানুষ নীতিশিা চাইতো। শুধু কবিতা নয়, গল্পেও নীতিকথা খোঁজার প্রবণতা ছিল পাঠকের। নীতিকবিতা লেখা হয়েছে প্রচুর, কিন্তু সে তুলনায় গ্রন্থাকারে প্রকাশিত বই রয়েছে কমই। নীতিকবিতা অনেকেই লিখেছেন, কিন্তু পরিমাণে কম বা বেশি যা-ই হোক, আলাদা করে বই লেখেননি তথা নীতিকবিতাগুলোকে এক মোড়কে আবদ্ধ করেননি। অনেকের সমগ্র রচনার ভেতরই এই ধরনের কবিতা ঠাঁই পেয়েছে সাধারণ এবং বিশেষ কবিতা হিসেবেই। নীতিকবিতার বইয়ের মধ্যে উল্লেখ করা যায় রজনীকান্ত সেনের অমৃত (প্রকাশকাল : ১৯১০), সদ্ভাব কুসুম (প্রকাশকাল : ১৯১৩); কুমুদরঞ্জন মল্লিকের শতদল; রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের নীতি-কুসুমাঞ্জলি; কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের সদ্ভাবশতক (প্রকাশকাল : ১৮৬১); হেয়াত মামুদের সর্বভেদ বাণী (প্রকাশকাল : ১৭৩২); আবদুল হালিমের নূরনামা; ভারতচন্দ্র রায়ের অন্নদামঙ্গল (প্রকাশকাল : ১৮১৬); রামনিধি গুপ্তের গীতিরত্ন; ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের হিত-প্রভাকর (প্রকাশকাল : ১৮৬০); মোজাম্বেল হকের জাতীয় মঙ্গল ইত্যাদি। সংস্কৃত ভাষায়ও লেখা হয়েছে বেশকিছু বই- ভতৃহরির নীতিশতক, সদানন্দের নীতিমালা, শম্ভুরাজের নীতিমঞ্জরি, বেতালভট্টের নীতিপ্রদীপ, চাণক্যদেবের চাণক্য শ্লোক, সোমদেবসুরীর নীতিবাক্যমৃত প্রভৃতি। তবে মূলত বাংলা ভাষায়ই এ কবিতা বিকাশ লাভ করে ও সর্বজনগ্রাহ্য হয়ে ওঠে। নীতিকবিতা লিখে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছেন- চণ্ডীদাস, আবদুল হাকিম, ভারতচন্দ্র রায়, হেয়াত মামুদ, রামনিধি গুপ্ত, লালন ফকির, মদনমোহন তর্কালঙ্কার, মোজাম্বেল হক, রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, হেমচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়, ভুদেব মুখোপাধ্যায়, মনোমোহন বসু, হরিশ্চন্দ্র মিত্র, কালীপ্রসন্ন ঘোষ, হাসন রাজা, স্বামী বিবেকানন্দ, কুসুমকুমারী দাশ, মতীয়র রহমান খান, রাজচন্দ্র পাঁড়ে, মুকুন্দদাস, কুমুদরঞ্জন মল্লিক, সুকুমার রায়, হরিনাথ মজুমদার, নবীনচন্দ্র সেন, কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার, শেখ হবিবুর রহমান, কামিনী রায়, সুফী মোতাহার হোসেন, কালিদাস রায়, রজনীকান্ত সেন, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, শেখ ফজলুল করীম, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ডা. লুৎফর রহমান, সুকুমার রায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, গোলাম মোস্তফা, ফররুখ আহমদ, কাজী কাদের নেওয়াজ, বন্দে আলী মিয়া, আবদুল কাদির, কাজী নজরুল ইসলাম, সুকান্ত ভট্টাচার্য, জসীম উদ্দীন, জীবনানন্দ দাশ প্রমুখ। বিদ্যালয়ে পাঠ নেয়া মধ্যবিত্ত বাঙালির মানসকাঠামো তৈরি এবং বিকাশে নীতিকবিতার অবদান অনেকখানিই। গুণীজনেরা বলে থাকেন- শৈশবে যে ভালো কবিতা পড়ে আত্মস্থ করেছে- তার পক্ষে কোনো অনৈতিক কাজ, বড় ধরনের অপরাধ সংঘটন সম্ভব নয়। নীতিকবিতা ভিতরে যে মূল্যবোধ তৈরি করে দিয়েছে- এ ‘গণ্ডিবদ্ধ’ মানসিকতার বাইরে যাওয়া কঠিন। সুতরাং বলা চলে দীর্ঘকাল ধরে বাঙালি চরিত্র, নৈতিকতা, মূল্যবোধ তৈরি হওয়ার পিছনে নীতিকবিতার প্রভাব ব্যাপক। একটি শিশু যখন পড়তে শেখে, পাঠ্যবইয়ের কিছু কবিতা বাধ্যতামূলকভাবে মুখস্থ করতে হয় তাকে। কবিতার ভাব ও উদ্দেশ্য আত্মস্থ করে, পরীার খাতায় লিখে তবেই তাকে পাশ করতে হয়। বলাবাহুল্য, স্কুল পর্যায়ে শিশুরা যে কবিতা পড়ে থাকে, তার অধিকাংশই নীতিকবিতা। সহজ-সরল ভাষায়, ছন্দোবদ্ধ কবিতা শিশুমনে এমনভাবে গেঁথে যায়- সারা জীবন সে আর ঐ কবিতার কথা ভুলতে পারে না। ০৩. বর্তমানে নীতিকবিতা তো নেই-ই, বরং কবিতার সমস্ত ট্র্যাক ভেঙেচুরে নতুন ধরনের কবিতার চাষ হচ্ছে। ছন্দোবদ্ধ কবিতা এখন আর দেখা যায় না বললেই চলে। সে জায়গায় স্থান করে নিয়েছে গদ্যকবিতা। যা গদ্যের ঢঙে রচিত। বর্তমানে যদি নীতিকবিতা লেখা হয়, তবে সেটা কাদের ল্য করে লিখতে হবে? কোন শ্রেণি ও বয়সের পাঠক- ছোটরা? বড়দের নতুন করে ‘নীতি-নৈতিকতা’ গ্রহণের বালাই নেই, তাদের জন্য সে চেষ্টা করাও যাবে না। তাহলেও প্রশ্ন এসে দাঁড়ায়, এ কবিতা ছোটদের কী কাজে আসবে? আজকের শিশু আর আগেকার শিশুর মধ্যে বিস্তর ফারাক। এখনকার ছেলেমেয়েরা নানা দিক থেকে এতো বেশি স্মার্ট- ছোটবেলা থেকেই কম্পিউটারে পারদর্শী হয়ে ওঠে। ঠাকুরমার ঝুলি, রূপকথা বা ভূতের গল্প, শিশুতোষ ছড়া-কবিতা তারা চেনে না, চেনে সুপারম্যান বা হ্যারি পটার জাতীয় চরিত্রকে; নানা ধরনের গেমস, কার্টুন তো আছেই। ডরিমন, মীনা এ সময়ের অন্যতম জনপ্রিয় কার্টুন চরিত্র- এসবই তারা ভালো চেনে, বোঝে। বনমানুষ, দানব, রাক্ষস-খোক্কসের গল্প বলে ভয় পাওয়ানো শুধু কঠিনই নয়, হাস্যকরও। তারা এতোই অগ্রসর যে ইন্টারনেটেই চষে ফেলছে বিনোদন-দুনিয়াসহ কৌতূহলের নানাদিক। এ অবস্থায় নীতিকবিতার বই কতটা প্রভাবক হতে পারে? ভার্চুয়াল দুনিয়ার মোহ ছেড়ে এ ধরনের কবিতার বইয়ে মুখ গুঁজবে এমন শিশু কই! এমনকি সে শিশু যদি দরিদ্র পরিবারেরও হয়, তবু বইয়ের সঙ্গে তার একটা দূরত্ব ঠিকই থেকে যাচ্ছে! আজকাল পরিবার থেকেও নীতিশিা দেয়ার দায়িত্ব পালন করা হয় না বললেই চলে। সভ্যতার অগ্রযাত্রার সাথে সাথে পেছাতে শুরু করেছে এ দিকটা। কাজী কাদের নেওয়াজের শিকের মর্যাদা, সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের উত্তম ও অধম-এর মতো কবিতা এখনকার শিশুদের কাছে কতটা প্রাসঙ্গিক প্রশ্নটা উঠতেই পারে! বর্তমানে শিক এবং শিার্থীর সম্পর্ক, শিাব্যবস্থার পরিবর্তনসূত্রে অনেকটাই পাল্টে গেছে। অনেকটুকুই আজ টলে গেছে শিক্ষকদের জন্য সেই সম্মানজনক আসন। এখনকার বাবা-মায়েরা কি ভাবেন সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের অধম ও উত্তম কবিতার মতো? শিক্ষকরাও এখন আর শিক্ষক নন, অর্থের বিনিময়ে নিয়েজিত ‘প্রাইভেট টিউটর’ বা ‘স্যার’ মাত্র। আনুমানিক ১৪-১৫শ শতাব্দীর কবি চণ্ডীদাসের কবিতা এখনো মানুষ যেভাবে আওড়ায়, এ ধারে-কাছেও কি ঘেঁষতে পারে সমকালের কোনো কবিতা- সবার উপরে মানুষ সত্য/তাহার উপরে নাই। সপ্তদশ শতাব্দীর কবি হেয়াত মামুদ যখন বলেন- সুখের সময় সবে বন্ধু বটে হয়/অসময়ে হায় হায় কেউ কাহার যে নয়। দেশকাল-সময়-পরিবেশ-প্রতিবেশ সব একাকার হয়ে যায়! এ কবিতার আবেদন কি এখনো একটুও ক্ষুণ্ন হয়েছে? তবে কি সময়ের সাথে সাথে অনেক কিছু পাল্টালেও মানবচরিত্র থেকে যাচ্ছে একই রকম? জিন এখানে ‘জিনের’ মতোই ঘাপটি মেরে আছে! নীতিকবিতা বাঙালি চরিত্রের শাশ্বত রূপই বর্ণনা করে না, সত্যকে মহাসত্যে রূপান্তরিত করার জন্যও সদাজাগ্রত! কবিতার যে সৌন্দর্য, ভাব, ভাষা তাও চিরন্তন। নিরন্তর বয়ে যাওয়া সময়ের ব্যবধানে পাল্টেছে যেমন অনেককিছু, আবার পাল্টায়নি অনেককিছু। যেমন, সত্য, সুন্দর, সম্পর্ক, জীবনযাপন। হাজার বছর আগে যে সত্য যেখানে ছিল, এখনো সেখানেই রয়ে গেছে। হয়তো থেকে যাবে অনাদিকাল ধরে। কবি মানেই ত্রিকালদর্শী। নইলে সপ্তদশ শতকে রামনিধি গুপ্ত কেন লিখবেন- নানান দেশের নানান ভাষা/বিনে স্বদেশী ভাষা পূরে কি আশা! ইশ্বরচন্দ্র গুপ্তের এ কথা কি এতোটুকু ম্লান হয়েছে এখনো, নাকি হবে কোনো কালে- পুঁথিপাঠ করে কিন্তু, নাহি তার মন/কেমনে পাইবে সেই, জ্ঞানরূপ ধন? মদনমোহন তর্কালঙ্কারের- সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি/সারাদিন আমি যেন ভালো হয়ে চলি। কবিতাটি পড়েননি এবং এখনো মুখস্থ নেই শিতি-অশিতি এমন বাঙালি ক’জন আছে? স্বাধীনতার যে দুর্মর বাসনা, স্বাধীনতা লাভের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে প্রতিনিয়ত রক্তয় হচ্ছে, ভাষার জন্য হাসতে হাসতে জীবন দিচ্ছে লাখো জনতা, একাত্তরে যেভাবে দিয়েছি আমরা, বাংলাদেশিরা। রঙ্গলাল সেন সেটাই মূর্ত করে তুলেছেন- স্বাধীনতা-হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে/কে বাঁচিতে চায়? ছোট-বড় বিভেদের যে দ্বন্দ্ব এবং যুদ্ধ, সেটার সমাধান দিয়ে গেছেন হরিশ্চন্দ্র মিত্র- আপনারে বড় বলে, বড় সেই নয়/লোকে যারে বড় বলে, বড় সেই হয়। সুখের জন্য মানুষের এতো যে হাপিত্যেস, কেবল মনে হয় পৃথিবীতে আমিই বুঝি সবচেয়ে দুঃখী, অন্যরা সুখী। এই সুখদুঃখ, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির সুন্দর মীমাংসা ধরা দিয়েছে ঋষিকবি রবীন্দ্রনাথের কলমে- নদীর এ পার কহে ছাড়িয়া নিশ্বাস/‘ও পারেতে সর্বসুখ আমার বিশ্বাস।’ ‘আদর্শ ছেলে’ জীবনানন্দ দাশের জন্মদাত্রী কুসুমকুমারী দাশ সেই কবে বলে গেছেন- আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে?/কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে। কবির এ আপে কি এখনো চেতনাজুড়ে আর্তনাদ করছে না! তৃতীয় নয়ন, ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বা ‘দৈববলে’ কবিরা অনেককিছুই সহজে বুঝতে পারেন। যেমন শেখ ফজলুল করীম বুঝেছেন- কোথায় স্বর্গ? কোথায় নরক? কে বলে তা বহুদূর?/মানুষের মাঝে স্বর্গ নরক- মানুষেতে সুরাসুর। শুধু পথ দেখিয়ে দেয়া নয়, কখনোসখনো কবি সরাসরি পথনির্দেশও করেন- জোটে যদি একটি পয়সা/খাদ্য কিনিয়ো ুধার লাগি;/দু’টি যদি জোটে তবে অর্ধেকে/ফুল কিনে নিয়ো, হে অনুরাগী! বাঙালির সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির যে উদাহরণ দিয়েছেন কাজী নজরুল ইসলাম তা লাখো কথার সার-নির্যাস- মুসলিম আর আর হিন্দু মোরা দুই সহোদর ভাই/এক বৃন্তে দুটি কুসুম এক ভারতে ঠাঁই। তমসাচ্ছন্ন সময়ে, বিবমিষা উদ্রেককারী মানুষের যে আস্ফালন, তা যেন নতুন করে স্মরণ করিয়ে দেন রূপসী বাংলার প্রেমিককবি জীবনানন্দ দাশ- অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে পৃথিবীতে আজ/যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দেখে তারা। সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘একটি মোরগের কাহিনী’ শুধু কাহিনীকাব্য নয়- শ্রেণিবৈষম্যের নগ্ন এক উদাহরণ। এই বৈষম্য, অনাচার থেকে মানবজাতি এখনো এগোয়নি একবিন্দু। বরং পেছাচ্ছে, ক্রমশ পিছিয়ে যাচ্ছে...। একটি মোরগ স্বপ্ন দেখে প্রাসাদের ভেতরে ঢোকার। অভুক্ত মোরগ জানে, প্রাসাদের ভেতরে রয়েছে রাশি-রাশি খাবার। মোরগ একদিন ঠিকই ঢুকে যায় প্রাসাদে, তবে খাবার খেতে নয়, খাবার হয়ে! কবিতাটি পড়ে বুকে মোচড় অনুভব করবেন না এমন পাঠক কয়জন আছেন! মানুষের সংবেদনশীলতাকে তুমুলভাবে উস্কে দেয় এ কবিতা। ০৪. নীতিকথা বলতে হয়তো অনেকেই পছন্দ করেন, কিন্তু শুনতে কারোরই ভালো লাগে না! বরং ‘ভালো কথা’ বিষের মতো লাগে। তাহলে নীতিকবিতা এবং নীতিগল্পের কী হবে? এগুলোর জীয়নঘণ্টা কিংবা মরণঘণ্টা নিয়ে ভেবে লাভ নেই। হাহুতাশ করাও বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। সব সাহিত্যের ভেতরই প্রচ্ছন্নভাবে কোনো না কোনো নীতিকথা, শুভ ইঙ্গিত থাকেই। যারা গ্রহণ করতে পারবেন, নিজের মতো করেই গ্রহণ করবেন। যারা পারবেন না, তো পারলেন না! এ সরল মীমাংসা বর্তমানের জন্য যেমন প্রযোজ্য, তেমনি ভবিষ্যতের জন্যও!