User login
Sing In with your email
Send
Our Price:
Regular Price:
Shipping:Tk. 50
প্রিয় ,
সেদিন আপনার কার্টে কিছু বই রেখে কোথায় যেন চলে গিয়েছিলেন।
মিলিয়ে দেখুন তো বইগুলো ঠিক আছে কিনা?
Share your query and ideas with us!
Was this review helpful to you?
or
পথটা একেবেঁকে চলে গেছে শহর থেকে গ্রামে। সামনে ছোট একটা গ্রাম। বাঁশঝাড় আর আম বাগান। এই গ্রামে দাঁড়ালে, পূর্বদিকে দেখা যাবে পাহাড়ী একটা নীরব এলাকা ছিটেফোঁটা ঘরবাড়ি তার পরই রেখার মতো একটা বালুচর। লম্বা উত্তর থেকে দক্ষিণে চলে গেছে। এই হলো বিখ্যাত নদী শালকী। এই নদীর ওপাড়ে শ্যামল দত্তের বাড়ি। লোকে বলে ওটা জমিদারবাড়ী। শ্যামল দত্ত ওই বাড়ির একজন। শ্যামল হাঁটতে পারে না ঠিকই। কিন্তু মানুষ পেলে গল্প করে। জানতে চায় তার পরিচয় ইত্যাদি ইত্যাদি। কবি কান্ত ঘোষাল সেই গ্রামেই পা রাখলেন হেমন্তের এক বিকেলে। কান্ত ঘোষালের মন চায় পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে বেড়ানো। যা দেখে তাই তিনি তার ডায়েরিতে লিখে রাখেন। নয়তো গ্রামে-গঞ্জে মানুষ ডেকে তা সুন্দর করে শোনান। যে কারণে তাকে যারা চিনে-জানে তারা তার নাম দিয়েছে কবিয়াল। ছন্দে ছন্দে কথা বলে বলেই কবিয়াল বলে ডাকে। কান্ত খুশিও তাতে। ছোটখাট মানুষ। মাথায় ঝাঁকড়া চুল। কাঁধে পাটের ব্যাগ। খদ্দরের পাঞ্জাবি আর পাজামা। এই নিয়ে কবিয়াল কান্ত ঘোষাল। তার ব্যাগে অতিরিক্ত একটা লুঙ্গি, গামছা, পাজামা আর পাঞ্জাবি। কাঠের পেন্সিল আর সাধারণ কলম। একা মানুষ। ব্যাগের মধ্যেই তার সংসার। নিজের গ্রাম নেই। যেখানে যায় সেটাই তার গ্রাম, বাড়ি। তবে তার জন্মস্থান বলে একটা জায়গা আছে। সেটাকে তিনি নিজের বলে দাবি করেন না। তিনি একদিন এক সাহিত্য সভায় বলেছিলেন, নীলফামারী শহর থেকে আট কিলোমিটার দূরে আঙ্গারপাড়া গ্রাম। আমি সেই গ্রামের এক নগণ্য মানুষ। গ্রামের মক্তব থেকে পড়াশুনা শুরু। নীলফামারী হাই ইংলিশ স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করার পর গ্রাম ছেড়েছি। তবে ওই গ্রামের জন্য কষ্ট হয়। কারণ বাড়ির পাশের ইছামতি নদীর ঢেউ যখন আছড়ে পড়তো পাড়ে, তখন ঢেউয়ে গা ভাসিয়ে চলে যেতাম ভাটিতে। বর্ষা এলে মাছ ধরতাম। বটগাছের লেজ ধরে ঝাঁপিয়ে পড়তাম স্রোতস্বীনি নদীতে। স্বচ্ছ নদীর সেই বালুভেজা পানিÑ এখনও মনে আছে। তবে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘরছাড়া। মা-বাবাকে হারিয়ে একা আমাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম পথে, পৃথিবীর পথে। এরপর আর পিছনে ফেরা হয়নি। ঘুরছি গ্রাম-গঞ্জে। দেখছি মানুষ, নানা রঙের জনপথ। ডিঙি নৌকায় তিন মিনিটের পথ পাড়ি দিয়ে কান্ত ঘোষাল পা রাখলেন শ্যামল দত্তের বাড়ির সীমানায়। দূর থেকে তার মনে হচ্ছিল এই গাঁয়ে কস্মিনকালেও কেউ পা রাখেনি। আসেনি ভুলেও। কিন্তু নাÑ কাছে এসে সব কিছুই পাল্টে গেল। বিশাল এক পুকুর। মধ্যখানে লাল শাপলা। তাদের ঘিরে খেলা করছে দূর গায়ের অতিথি পাখি। আর কিছু রাজহাঁস। সেই পুকুরের গা ঘেঁষে একটি ভবন। ভবনের চারপাশে বাঁশের বেড়া দেয়া দো-চালা টিনের ঘর। বাড়ির আঙ্গিনায় তুলসী গাছ। ফুলের বাগান। সবগুলোই যেন অযতেœ বেড়ে উঠেছে। ডালিমের দু’-একটা গাছ তাও দেখে মনে হবে কত বছরের পুরনো। এরা সবাই আগলে রেখেছে বাড়িটিকে। শ্যামল দত্ত বসে হুঁকো টানছেন একটা অতিকালের কাঠের চেয়ারে। খামির মাখানো তামাকের গন্ধে মৌ মৌ করছে গোটা জমিদারবাড়ী। শ্যামল দত্তের বসার ভঙ্গিমা দেখে কান্ত ঘোষালের বুঝার বাকি রইলো না- এই শ্যামল দত্ত। বিশাল আকৃতির এক মানুষ। নাকের নিচ দিয়ে পাকা গোঁফ ঝুলে আছে। দেখতে ঠিক লাউয়ের ডগার মতো। পায়ের নিচে বাঁশের তৈরি খড়ম। মাটিতে বসে আছে তার নিত্যসঙ্গী অমীয় রায়। অমীয় রায়ের কাজ হলো তার সবকিছু দেখভাল করা। জমি-জিরাত, বাজার-সওদা থেকে তার ভালোমন্দের সবকিছুই। শ্যামল দত্তকে কিছু বলতে গেলে অমীয় রায়ের অনুমতি নিতে হয়। তার অনুমতি ছাড়া এই গ্রামে ভালো কিংবা মন্দ কোনো কাজেই হয় না। অমীয় রায়কে মানুষ বড্ড ভয় পায়। কুকুর ছাগলও তাকে দেখলে মুখ লুকিয়ে অন্যদিকে চলে যায়। তবে, ভালো মানুষ হিসেবে তার খ্যাতি দশ গ্রামে। বিপদে-আপদে সে সবার বন্ধু কানো কিছুর বিনিময়ে সে কোনো কাজ করে না। অমীয় একা মানুষ। বিয়ে করেছিল বহু আগে। কিন্তু সেই স্ত্রী সন্তান মারা যায়। এরপর সে আর বিয়ে থা করেনি। এখন তার শেষ ঠিকানা জমিদারবাড়ী। শ্যামল দত্তের সঙ্গে ছায়ার মতো লেপ্টে থাকে। কান্ত ঘোষাল তার ডায়েরিতে লিখেছিলেন, অমীয় আর যাই হোক, সুদর্শন বটে। বলতে পারেন নিখুঁত একটা সুন্দর মানুষ। বড় বড় চোখ, লম্বা তেমনি ফর্সা। যে কোনো রমণী তাকে দেখলে রাত যাপনের ইঙ্গিত না দিয়েই ছাড়বে না। তবে অমীয় সে সুযোগ কোনো রমণীকে দেয়নি। তার কাছে সাহায্য কিংবা অভিযোগ করলে সে ঠিক সেই সম্বোধনই করেন, যেখানে মা-বোন কিংবা মেয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়। শুনেছি পারতলী গ্রামের এক মহিলা তাকে পাবার জন্য সে তার স্বামীকে হত্যা করেছিল। অমীয় তার উগ্র স্বভাবের ঘৃণা করেছে ধিক্কার দিয়েছে। নিরুপায় ওই মহিলা একদিন গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করে। নমস্কার। মাথা তুলে খুব গম্ভীর স্বরে উত্তর দিলেন শ্যামল দত্ত। নমস্কার। আমি কান্ত ঘোষাল। লোকে কবিয়াল কান্ত ঘোষাল বলে ডাকে। ঘর-বাড়ি নেই। অজানাকে জানা আর সেটি লিখে রাখা আমার নেশা। ঘর সংসার নেই। বাস্তুভিটা নেই। বহু কষ্টে এতোদূর চলে আসা। ভালোই করেছেন। কান্ত ঘোষাল উপর থেকে পা পর্যন্ত দেখলেন শ্যামল দত্তকে। কী গুরুগম্ভীর মানুষ। বড় বড় চোখ। শ্যামল দত্তকে জিজ্ঞেস করলেন, চেয়ারটার বয়স কত? জানি না। শুনেছি ঠাকুরদা এই চেয়ারে বসতেন। তিনি ইহলোক ত্যাগ করেছেন। তা দেড়শ’ বছর হবে। এখন এই চেয়ার, ভাঙা দালান আর এক চিমটি মাটি ছাড়া কিছু নেই। তাদের স্মৃতি ধরে রাখতে পারলাম কই। দেখছেন না, দালানের ইট, সুরকি খসে পড়ছে। ছোট ছোট গাছ-গাছালির শেকড় দেয়াল ফাটিয়ে করছে উৎসব। চড়–ই পাখি বাসা বেঁধে বৃন্দগান গাইছে। রাত হলে ঝিঁঝির ডাক। আর ফাঁক-ফোকড়ে লুকিয়ে থাকা সাপের ফিসফিসানি শুনি। এমন নির্জন নীরব এলাকায় একা থাকতে ভয় করে না? শ্যামল দত্ত হাসলেন। কিছু বললেন না। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। তার বাপ-দাদার ভাঙা দালানের বাসিন্দারা আসতে শুরু করেছে। ঝাঁকে ঝাঁকে আসছে বাদুড়। কলাগাছের পাতায় আর পুরোনো একটা বট গাছের ডাল ধরে ঝুলে পড়ছে তারা। অবাক হয়ে কান্ত ঘোষাল দেখছেন প্রকৃতির রঙ্গলীলা। শ্যামল দত্ত তার কক্ষে নিয়ে গেলেন কান্ত ঘোষালকে। বিশাল একটি কক্ষ। এই কক্ষের পূর্ব দিকে ময়লা নিয়ে ঝুলে আছে ঠাকুরদার হাতে আঁকা দশটা ছবি। এক কোণে বাঘের চামড়া সেঁটে দেয়া হয়েছে দেয়ালে। তার উপরে হরিণের চামড়া। শালকাঠের বিশাল দোতলা খাট। যার কারিগর ছিল কুড়িজন। বছর তিনেক সময় লেগেছিল খাটের কাজ শেষ করতে। এমন নিখুঁত নকশা আর পালিশÑ যা এ সময়ের কোনো কারিগর তৈরি করার সাহস পাবে বলে মনে হয় না। ছোট একটা মই। এই মই দিয়ে শ্যামল দত্ত খাটের উপরে ওঠেন। খাটের পূর্বদিকে মাথা বরাবর একটা ছবি। সম্পূর্ণ নগ্ন। বিশেষ ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে। মুখে সামান্য হাসি। ছবিটার কাছে বাঁশের একটা স্ট্যান্ড। রাত হলে ওই স্ট্যান্ডের ওপর মাটির থালা। সেখানে মোমবাতি জ্বালিয়ে রাখেন। এই আলোতেই শ্যামল দত্ত এক ঘরে স্মৃতি মন্থন করেন পুরনো দিনের। শ্যামল দত্ত ইশারা করে ডাকলেন অমীয় রায়কে। বললেন, কবিয়ালকে খেতে দাও। খাওয়া শেষ হলে রাজবাড়ীটা দেখিয়ে নিও। আর এই নাও চাবি। হল রুমটাও দেখিয়ে দিও। রাত একটা। চারদিক নিঝুম নিস্তব্ধ। কোথাও কোনো প্রাণীর শব্দ নেই। বাড়ির বাইরে যতদূর চোখ যায় জোনাকী পোকার আলো ছাড়া কিছু চোখে পড়ে না। একটা খেঁকশিয়াল পর্যন্ত ডাকছে না। এমন নীরব এলাকায় প্রাণীরাও হয়তো ভয়ে থাকে না। সেই জনমানবহীন অরণ্যে কি করে শ্যামল দত্ত থাকেন ভাবতেই পারছে না কান্ত ঘোষাল। অমীয় বলতেন, স্যার আসেন। বিল্ডিংয়ের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে পৌঁছতে প্রায় আধা ঘণ্টা লেগে গেল। ওই সময় কান্ত জানতে চেয়েছিল শ্যামল বাবু পরিবার আছে কিনা? অমীয় তার কথা এড়িয়ে তাকে ডান দিকে নিয়ে গিয়ে বলেছিলেন, বামের কক্ষে থাকতেন শ্যামল বাবুর তিন নম্বর মা অদ্বীতিয়া দত্ত। পাশের কক্ষে থাকতেন তার মা সুরবালা। অন্য চার মা থাকতেন দক্ষিণের ওই তিনটি কক্ষে। পার্শ্বের কক্ষটা দেখছেন, ওটা কোনো শোয়ার কক্ষ নয়। ওই কক্ষে পাতালে যাবার সিঁড়ি আছে। রানী মা সহ এই বাড়ির সবাই পাতাল হয়ে পুকুর ঘাটে যেতেন স্নান করতে। এ বাড়ির কোনো নারী সূর্যের আলো দেখতে পেতেন না। এরপর দু’জনে সিঁড়ি বেয়ে উঠলেন উপরের তলায়। এক, দু’ করে চারটা গেইট পেরিয়ে প্রবেশ করলেন দু’জনে রঙ্গশালায়। এখানেই বসতো গানের জলসা। শহর থেকে আসতো নর্তকী আর গাইন। জমিদারবাড়ীর কোনো নারী এই রঙ্গশালা দেখেননি। এখানে তাদের আসতে ছিল মানা। অমীয় বললো, আমি রঙ্গশালার নৃত্য দেখিনি। শ্যামল বাবুও না। আমরা শুনেছি। কলকাতা থেকে বাঈজীরা আসতো। তিন-চার দিন থেকে তারা চলে যেত। এভাবেই সরগরম থাকতো রঙ্গশালা। রাত তখন শেষ প্রায়। পাখিরা ডাকতে শুরু করেছে। পূর্বাকাশে আলো চোখ মেলছে। দু’জনেই বড্ড ক্লান্ত তখন। কান্ত পশ্চিম দিকের কক্ষটি দেখিয়ে বললেন, এ কক্ষে তালা বন্ধ কেন? অমীয় দ্রুত জবাব দিয়ে বললো, এটা জমিদার বাবুর অষ্টম স্ত্রী সুরবালা থাকতেন। তিনিই ছিলেন শ্যামল দত্তের মা।