User login
Sing In with your email
Send
Our Price:
Regular Price:
Shipping:Tk. 50
প্রিয় ,
সেদিন আপনার কার্টে কিছু বই রেখে কোথায় যেন চলে গিয়েছিলেন।
মিলিয়ে দেখুন তো বইগুলো ঠিক আছে কিনা?
Share your query and ideas with us!
Was this review helpful to you?
or
4.5 out of 5 'ব্যবহৃতা' আনোয়ারা সৈয়দ হক এর একটি সমীক্ষা উপন্যাস। এই উপন্যাসে তিনি বলেছেন নিষিদ্ধ পল্লীর সেইসব মেয়েদের কথা যাদেরকে সমাজ একনামে চেনে 'বেশ্যা/নষ্টা' হিসাবে; এই শব্দটা কানে আসলে আমাদের অনেকেরই হয়ত ঘৃণা আর অবজ্ঞায় চেহারা কুঞ্চিত হয়ে যায়। তাদের বাস্তব জীবনটা সম্পর্কে কোন ধারণা না নিয়েই হয়ত আমরা একটা বিরূপ মন্তব্য করে বসি। লেখক যেহেতু একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, তাই ওনার এই দীক্ষার ছাপ এই উপন্যাসটির পাতায় পাতায়, প্রতিটি যৌনকর্মীর জীবনকথা বলার ভঙ্গিতে সহজেই চোখে পড়ে। এমনকি কিছু পীড়াদায়ক ঘটনাকে তিনি এমন মুন্সিয়ানার সাথে বর্ণনা করেছেন যাতে পাঠকের মনে কোন বিরূপ মানসিক চাপের সৃষ্টি না হয় এবং একইসাথে আসল ঘটনাটাও দৃষ্টিগোচর হয়। লেখক এদেরকে সম্বোধন করেছেন 'আদিম শ্রমজীবী' বলে। এদের সিংহভাগই এই পেশাকে বেছে নিয়েছে নিজের এবং পরিবারের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করে বাঁচতে। তবে এর ব্যতিক্রমও আছে; কেউ কেউ একটা চকচকে-বিলাসবহুল জীবন পেতে, কেউবা স্বামী, আত্মীয়-পরিজনের লাঞ্ছনার হাত থেকে রেহাই পেতে, অনেকের লেখাপড়া ভালো লাগছে না তাই, অনেকে শুধু শরীরকে মূলধন করে অর্থোপর্জনের সহজ পন্থা হিসাবে, অনেক বড়লোক গৃহিণী নিজের সংসারে নিজের স্বামীর দ্বারা তার যৌনতৃষা মেটাতে না পেরে এই ব্যবসায়ে নেমেছেন। এটাকে টাকা কামানোর শর্টকাট উপায় মনে হলেও বেশিরভাগ যৌনকর্মীই নিজেদের পেশা নিয়ে ভীষণ হীনম্মন্যতায় ভোগে। নিজেকে, নিজের শরীরকে, নিজের অস্তিত্বকে তারা ঘৃণা করে; আবার এই পেশা থেকে সহসা এক ঝটকায় তারা বেরিয়েও আসতে পারে না। মাদকদ্রব্যের মত বিকৃত জীবনেরও এমন এক টালমাটাল করা নেশা আছে, যার স্বাদ একবার পেলে তার কবল থেকে মুক্তি পাওয়া মুশকিল। বিশেষ করে এরা বয়ঃসন্ধির আগেই শারীরিক নিপীড়ন, ধর্ষণ, ইত্যাদির শিকার হয়। বয়সের সাথে সাথে মানুষের ভিতরে যে স্বাভাবিক বিচার-বিবেচনা-বিবেকবোধের জন্ম হয় তা তৈরি হওয়ার আগেই এরা শুধুমাত্র নিজের 'শরীর' এর ভিত্তিতে সবকিছুর হিসাব করতে শেখে; তাই শরীরকে পুঁজি করেই গড়ে ওঠে তাদের জীবনবোধ আর দৃষ্টিভঙ্গি। সুতরাং যৌনজীবন একটা দুষ্টচক্রের মত এদের ঘিরে ধরে। এটা যেন তাদের এক পাওয়ার গেম, পুরুষের ওপর নারীর, এক নারীর ওপর অন্য নারীর ক্ষমতা জাহির করার খেলা। এই একই খেলা জীবনের প্রতি তাদের তাচ্ছিল্য, মানসিক বিকারগ্রস্ততা আর বীতস্পৃহ ভাবের তৈরি করে, আত্মসম্মানবোধের অভাবই তার প্রধান কারণ। এই উপন্যাসে অবশ্য এমন কিছু দৃঢ়কণ্ঠী, আত্মপ্রত্যয়ী পতিতার দেখাও মেলে, যারা নিজ কমিউনিটির অধিকার আদায়ের দাবিতে মিছিল-মিটিং, আন্দোলন করে অ্যাসিডদগ্ধও হয়েছে। আবার অনেকের আন্দোলন সফল হওয়ায় আজকে তারা বাইরে বেরিয়ে মুখ ফুটে নিজের পরিচয় দিতে পারে, বাজারঘাট করতে পারে, অসুখে ডাক্তারের চিকিৎসা পেতে পারে, মায়ের পরিচয়ে সন্তানদের মানুষ করতে পারে। অনেক যৌনকর্মী আবার 'বনেদি' বাড়ির পর্দানশী মেয়ে; 'কাজ' এর পর তারা নিয়ম করে আল্লাহ-খোদার নামগান করে। আরও উল্লেখিত হয়েছে কান্দুপট্টি এবং টানবাজার, এই দুই বেশ্যালয় থেকে উচ্ছেদিত পতিতাদের প্রাথমিক থাকা-খাওয়ার অনিশ্চয়তার গল্প, এবং বিভিন্ন হোটেলে আর দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ক্যান্সারের মত তাদের ছড়িয়ে পড়ার কাহিনী। সবচাইতে অনিশ্চিত যাদের জীবন তারা হল বয়স্ক পতিতা এবং যৌনকর্মীদের ছেলে শিশুরা। বিভিন্ন এনজিও তাদের মেয়েদেরকে আঠার বছর বয়স পর্যন্ত দেখভাল করলেও বড় হতে হতে কোন দিকনির্দেশনার অভাবে তাদের ছেলেরা হয়ে ওঠে দালাল, মাদকব্যবসায়ী, চোরাকারবারি। প্রতিনিয়ত নৈতিক অবক্ষয় তাদের ভবিষ্যতকে অন্ধকারের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। দেশের কোন ব্যাংকই নাকি পতিতাদের 'হারাম' পয়সা জমা রাখতে চায় না, অর্থাৎ ভবিষ্যতের জন্য তাদের কোন সঞ্চিত অবলম্বন নেই। আর স্থানীয় ধাপ্পাবাজরা তাদের উপার্জন ছিনতাই করে নিয়ে যায়। এই সবকিছুর গভীরে যতই যাই শুধু একটা বিষয়ই স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হতে থাকে; আর তা হল পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পুরুষের একাধিপত্য, ঘরে-বাইরে পুংলিঙ্গের দাপট, আর প্রাক-যৌবনকাল থেকে আমৃত্যু পুরুষের জাজ্বল্যমান, অতৃপ্ত যৌনক্ষুধা। হুজুর-নাস্তিক, পুলিশ-সন্ত্রাসী থেকে শুরু করে, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, যুবক-বৃদ্ধ, মন্ত্রী-ব্যবসায়ী-চাকরিজীবী, সব পেশা, সব ধর্ম, সব বর্ণের পুরুষ এদের কাস্টমার। এদের বাড়িতে যেমন আছে সতী-সাধ্বী, বাইরে তেমন আছে বারবণিতা। ওখানে এমন বিকৃত মস্তিষ্কের নররাক্ষস আছে যারা একেবারে নাবালিকা-কুমারী-সতীকে তাদের বিছানায় চায়, কারও পছন্দ পোয়াতী পতিতা, এমনকি অনেকে 'কম রেটে' পতিতাদের কিশোর ছেলেদের নিয়ে ফুর্তি করে নিজের আশ মেটায়। লেখক তার উপন্যাসে বিশ্লেষণ করেছেন, কীভাবে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের গোড়াপত্তন থেকে নারীর জন্য পাতা হয়েছে এক সুদূরপ্রসারী চক্রান্তের ফাঁদ, কীভাবে নারীকে পরস্পর বিরোধী দুটি দলে বিভক্ত করে তথাকথিত সমাজ আর ধর্মের বেড়াজালে আটকানো হয়েছে। পুরুষ যেমন সংসারের সতীকে বাইরে যেতে দেয়নি, তেমনি বাইরের রক্ষিতাকে কোনদিন প্রবেশ করতে দেয়নি সংসারের গণ্ডিতে। অথচ নিজে অবাধে বিচরণ করে বেড়িয়েছে দুই ক্ষেত্রেই। ফ্রয়েড থেকে রবীন্দ্রনাথ, সবাই শুধু চেয়েছে ভোঁতা, নিরীহ, অবলা, সংযমী, আত্মত্যাগী, সতীকে। আর পতিতারা আখ্যা পেয়েছে 'ঈর্ষাকাতর', 'উচ্ছৃঙ্খল', 'কামরাক্ষসী'। আমার মনে হয় ১৮-২০ বছর বয়সের প্রত্যেক তরুণ-তরুণীর উচিত এই বইটা একবার পড়ে দেখা। এতে করে হয়ত নিজের অজান্তে কোন বিপথগামিতার দিকে তারা পা বাড়াবে না এবং একইসাথে এই বিষয়ের গভীরতা কতটুকু সেটাও উপলব্ধি করতে শিখবে।