User login
Sing In with your email
Send
Our Price:
Regular Price:
Shipping:Tk. 50
প্রিয় ,
সেদিন আপনার কার্টে কিছু বই রেখে কোথায় যেন চলে গিয়েছিলেন।
মিলিয়ে দেখুন তো বইগুলো ঠিক আছে কিনা?
Share your query and ideas with us!
Was this review helpful to you?
or
দর্জির দোকানে কাপড় গুলো যখন কাঁচি আর মেশিনের কারসাজিতে রূপ নেয় একটি জামা কিংবা শার্টে, বাকি ছেঁটে ছুটে পড়ে থাকা কাপড়ের টুকরো গুলোকে নিয়ে তখন আর কেউ ভাবে না, অথচ সেই কেটে ছেঁটে ফেলা কাপড়ের টুকরোরও থাকে কিছু গল্প। আমাদের এই সমাজে, পৃথিবীতে নানান সিলেবাস আর সূচীপত্রে ঘিরে থাকা জীবন, এবং সেই জীবনের মানুষেরা। সূচীপত্রের বা সিলেবাসের ভেতরে যে জীবন গুলোকে বেমানান লাগে, অবহেলিত লাগে, সেই জীবন গুলোর গল্প কেউ করে না, লিখে না, পড়ে না। সেই জীবন গুলো কে কেউ আপন করে দেখে না, ওই জীবনে যাপন করা বা অভ্যস্ত হওয়া কোন মানুষের মতো কেউ হতে চায় না। দেখতে ভালো না, এবং রেজাল্ট খারাপ বলে ঢাকা ইউনিভার্সিটির “তরুণ” নামের যে ছেলেটি আত্মহত্যা করেছিল, তার জন্য খুব কষ্ট হয় আমার, অপরাধবোধ জাগে, এবং রাগও লাগে। একজন মানুষ কে তার বাহ্যিক রূপ নিয়ে কটাক্ষ এবং হাসি তামাশার একটা চর্চা আমাদের সমাজে আছে। কখনো সেটা বর্ণবাদী, কখনো সে আচরণ কে আমরা বলতে পারি বডি শেইমিং। মানুষের শরীরের গঠন, আকার, আকৃতি, গায়ের রঙ এই সব কিছুই একজন মানুষের অস্তিত্বের সাথে সম্পর্কিত। আমি বলবো না, মন টাই আসল, শরীর কোন ব্যাপার না। আমি যদি এটা বলি তবে আমি মিথ্যেবাদী। মানুষের মনের পাশাপাশি, মানুষের শরীরও গুরুত্বপূর্ণ। কৌশিক গাঙ্গুলীর একটা ছবি আছে, “শূন্য এ বুকে”। নারীর শরীরের চিরাচরিত ফ্যাসিনেশনের অদ্ভুত দ্বান্দিকতা নিয়ে সেই ছবির গল্প। সেই ছবির শেষ দৃশ্যের একটি সংলাপের ছায়া থেকে বলছি, এই পৃথিবীতে একজন মানুষ আরেকজন মানুষ কে অপমান করার অধিকার রাখে না, না তার আত্মসম্মান কে, না তার শরীর কে। আমার যদি তরুণের সাথে দেখা হতো, আমি তাকে এটাই বলতাম যে, তোমার শরীর কে যারা অপমান করেছে, তাদের মতো কুলাঙ্গারের জন্য আত্মহত্যা করতে চেয়ে, নিজেকে পুনরায় অপমান করো না। তরুণের মতো আরেকজনের সাথে আমার দেখা হয়েছে, এই ২০১৮ এর বই মেলায়, সে মিতা। মিতা দেখতে অসম্ভব কালো, তার দাঁত বেখাপ্পা রকমের উঁচু, রোগা, মাথায় চুল কম, সে ছাত্রীও ভালো না। অথচ মিতার মতো সুন্দর মানুষ আমি আর দেখিনি। এ যাবতকালে শিল্প সাহিত্যের নানান ক্ষেত্রে, উপন্যাসে,গল্পে লেখকের বর্ণনায়, নায়িকাকে দেখেছি “অত্যইন্ত রূপসী” হিসেবে। দুধে আলতা গায়ের রঙ, কিংবা শ্যামলাও যদি হয় তবে এমন সুন্দর যে, সুতির একটা সবুজ শাড়ি পরে, হালকা কাজল দিলেই অপরূপা লাগে, যেন অন্যান্যরা বলতে বাধ্য, তোমাকে না অপ্সরী দের মতো সুন্দর লাগছে। এবং নায়কও হবে অসম্ভব জিনিয়াস, ফুল স্কলারশিপ পেয়ে যাবে চোখের নিমেষে, এদের পাসপোর্ট-ভিসা লাগে না, আলাদীনের জাদুর কার্পেটে চড়ে এরা আমেরিকায় চলে যায় বউ নিয়ে। কিংবা নায়কগিরি ফলাতে এইসকল কিছু পেয়েও ছুঁড়ে ফেলে দেয়ার মতো এরা ক্ষমতাবান। অর্থ না থাকলেও এদের রাজপুত্রের মতো চেহারা থাকে, ঘুম থেকে উঠে ব্যাক ব্রাশ করে নিলেই সিনেমায় কাস্টিং করা যায় এমন, কিংবা থাকে চমকপ্রদ রেজাল্ট, মানে একটা না একটা কিছু থাকেই। কিন্তু সেইসব মানুষদের নিয়ে গল্প হয় না, যাদের এইসব কিছুই থাকে না, মানে অর্থ নয়, কীর্তি নয়, সচ্ছলতা নয়, যাদের রয়েছে শুধু এক বিপন্ন বিস্ময়, এই কিছুই না থাকাদের নায়ক নায়িকা বানিয়ে লেখে না কেউ। তো মিতা কে নিয়ে লিখেছেন, মারুফ রসূল। মিতা কে পাওয়া যাবে, মারুফ রসূলের আনন্দী উপন্যাসে। শুধু মিতাকে পাওয়া যাবে না, আনন্দী’তে আরো আছে অসাধারণ কিছু চরিত্র। আছে, খুব সাধারণ একজন মানুষের ভেতর অসাধারণ ভাবে প্রেম কে লালন করা শিপন, একজন নির্লিপ্ত অথচ দুর্ধর্ষ রাজু, দুইজন মা-আয়েশা বেগম ও মালেকা বানু, সঙ্গীতের নেশায় মাতাল লিয়াকত আলী, শিল্পিত ললিতা ও শিল্পী আউয়াল তবলচি, আছে বিদুষী কোহিনূর বেগম, আছে রিতা-মনসুর দম্পতি, আছে একজন স্মৃতি, আছে অকৃত্রিম বন্ধুত্ব নিয়ে দিব্যেন্দু। আনন্দীর শুরুর দিকে প্রতিটি চরিত্র যেন নিজের নিয়তিকে মেনে চলে অক্ষরে অক্ষরে, তারপর সবার জীবনে দিন বদলের রঙ নেমে আসে। সেই রঙের ছটায় কখনো পাঠক হিসেবে আমি চমকেছি, কখনো আনন্দ পেয়েছি, কখনো মনে হয়েছে এই চরিত্রের জীবন টা এমন হওয়ার পেছনে আসলে লেখক নিজেই দায়ী। এইসব সাধারণ ডাল ভাতের জীবনে থাকা, কখনো গুরুত্ব না পাওয়া মানুষেরা অসাধারণ হয়ে ওঠে লেখকের কলমের ব্যাস্ততায়, অস্থিরতায়, মমতায়। এটা যেন শুধু গল্প বা কাহিনী বলা নয়, এটা একটা ঘোষণা যে প্রেম নামক ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত সত্য। শতবার ঠেলে ধমকে, ধরে বেঁধে যে প্রেম কে হোস্টেলে পাঠিয়ে দেয়া হয়, সেই প্রেমকেই আবার ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে হোস্টেল ছাড়িয়ে বাড়ি ফিরিয়ে আনার গল্প যেন এটা। পল্লীকবি জসীমউদদীন তার “আরো বই পড়ুন” প্রবন্ধে, বই নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে যা বলেছেন সেই আলোকে বলা যায় যে বই হচ্ছে তিন রকমের। কোন বই কেবল পাতা উল্টিয়ে যেতে হয়। যেমন, খবরের কাগজ। খবর জানলেই পড়া শেষ হয়ে গেল। দ্বিতীয় স্তরে রয়েছে সহজ নভেল, যা একবার পড়লেই যথেষ্ঠ। আর তিন নাম্বারে পরে সেই বই গুলো যার ভেতরে নীরব অর্কেস্ট্রার মতো সুর আছে, ধ্বনি আছে, বারবার এগুলো পড়ে অন্তরের যে আরো একটি অর্কেস্ট্রা আছে তাকে বাজিয়ে নেয়া যায়। হয়ত প্রথম প্রথম পড়ে বোঝা যায় না, যেমন প্রথম দেখাতেই কারো সাথে অন্তরঙ্গতা হয় না। বার বার মিশতে হয়। ক্লাসিক লেখা সম্পর্কে জসীমউদদীন বলে ছিলেন, ইক্ষুদন্ড যেমন ভালো মতো না চিবালে তার রস পাওয়া যায় না, তেমনি এই ধরণের লেখা গুলির ভাষা উপমা অলংকরণের বর্ম ভেদ করে তবে তার ভেতরে প্রবেশ করতে হয়। মারুফ রসূলের লেখা প্রসঙ্গে অনেকেই হয়তো দাবী করেন যে, তার লেখার ভাষা কঠিন। আমি আসলে সেই তর্কে যেতে চাই না যে তাঁর লেখার ভাষা, কঠিন না তরল না বায়বীয়, আমি শুধু এটুকুই বলতে পারি, দুপুরে খেয়ে দেয়ে, ভাত ঘুমের আয়োজনে তাঁর বই বা লেখা গুলো, বিহারী ক্যাম্পের মশলা পানের মতো রসনায় বিলাস জোগায় না। নান্দনিক দ্বান্দিকতার লেখা গুলো যদি কিছু জোগায়, তবে তা চিন্তার খোঁড়াক এবং জানান দেয় ভাবনার জগতে বিচরণ যাত্রার হুইসেল। আনন্দী ইতিমধ্যেই পাঠক প্রিয়তা অর্জন করেছে, আরো আরো মানুষ নতুন ধাঁচের এই উপন্যাসটি পড়ুক এবং ভাত ঘুমে চোখ বুজে ফেলার বদলে, আনন্দে জেগে উঠুক। লেখক মারুফ রসূলের উপন্যাস আনন্দী প্রকাশিত হয়েছে, পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স থেকে। বইটির প্রচ্ছদ করেছেন, তৌহিন হাসান।