User login

Sing In with your email

Email Address
Password
Forgot Password?

Not Account Yet? Create Your Free Account

Send

Recipients:
Message:

Share to your friends

Copy link:

    Our Price:

    Regular Price:

    Shipping:Tk. 50

    • Size:
    • Color:
    QTY:

    প্রিয় ,

    সেদিন আপনার কার্টে কিছু বই রেখে কোথায় যেন চলে গিয়েছিলেন।
    মিলিয়ে দেখুন তো বইগুলো ঠিক আছে কিনা?

    Please Login to Continue!

    Our User Product Reviews

    Share your query and ideas with us!

    Customer Reviews

      By Sakib

      28 Jun 2023 05:32 AM

      Was this review helpful to you?

      or

      #কালচক্র #পাঠ_অনুভূতি ♦এক নজরেঃ •উপন্যাসের নামঃ কালচক্র •লেখকঃ আবদুল্লাহ আল ইমরান •ধরনঃ সামাজিক •প্রকাশনীঃ অন্বেষা প্রকাশন •প্রচ্ছদঃ সানজিদা পারভীন তিন্নি •মুদ্রিত মূল্যঃ ৩৫০ •পৃষ্ঠা সংখ্যাঃ ২০০ •প্রকাশকালঃ গ্রন্থমেলা ২০১৮ লেখনীতেঃ রিফায়াত হাসান সাকিব ♦ভূমিকাঃ কিছু বই থাকে না? যেগুলো কেনা হয় হুট করে । হঠাৎ করে একদিন পড়া হলে জগৎ ছাপিয়ে আফসোস করতে বসে যেতে ইচ্ছে করে । ইচ্ছে করে, মায়া মায়া চোখে তাকিয়ে একটা নিঃশ্বাস নিতে । আবার আফসোস করার পাশাপাশি বারবার মনে হতে থাকে যেন এই আফসোসেও সুখ থাকে । মায়ায় ঘেরা সুখ । মনে হয় যেন বইগুলো নিজের পাঠক জীবনকে তৃপ্তি দেয়ার জন্যই বুঝি মনের দরজায় কড়া নাড়ে । হয়তো সেরকম বইগুলো দেরিতে পড়লেও আমার আফসোসের থেকেও বেশি শান্তি লাগে । শান্তি আর সুখ যেখানে আছে, সেখানে তা মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় । ♦পারিপার্শ্বিক দিকঃ এই বইটা যেদিন আমি কিনেছিলাম সেদিন আমি হঠাৎ করেই বইটা নিয়ে ফেলেছিলাম । বারবার মনে হচ্ছিল যেন বইটা নেই । সেই থেকে সময় কত কেটে গেল । আজকে যখন কোনো বই পড়বো বলে ভাবছিলাম, অনেক ভাবনা চিন্তা করার পরে মনে হলো যেন এই বইটিই পড়ি । ঠিক রাত ১২টা ৩০ মিনিটে বইটি পড়তে শুরু করেছিলাম, যখন পড়া শেষ হয়ে গিয়েছে তখন সময়টা রাত ৪টা ৩০ মিনিট । ♦নামকরণঃ পৃথিবীটা বৃত্তের মতো । সেই বৃত্তে মাঝে মাঝে সুখ, শান্তি, দুঃখ, কষ্ট কিংবা রাগ হয়তো একটু অভিমান চক্রের মতো ঘুরে বেড়ায় । সময় পরিক্রমায় কত কিছু জীবনে চলে আসতে চায় । এসে যেন সবার কেটে যাওয়া জীবনে একের পর এক এসে যেন হাতড়ে বেড়ায় । সেই জীবনে কত কিছু ঘটে যায় । কালের পরিবর্তনে সময়ের কতশত রূপের সাথে কত মায়া এবং ছন্নছাড়া নামক পরিবর্তন ঘটে । কিন্তু চক্র নামক বৈশিষ্ট্য যেন কালের সাথে জুড়েই থাকা সারাজীবন ধরে । কালচক্র বয়ে যাওয়া এই সুতা যেন মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ এর মতো করে মানুষের জীবনের ওপর দিয়ে বয়ে যায় । এই কালচক্র সারাজীবন বয়ে যায়, বয়ে যেতে থাকে সুখ দুঃখ নিয়েও এক আখ্যান । ♦ফ্ল্যাপে লেখাঃ ‘...শীতে তার কষ্ট হচ্ছে না ঠিক । কিন্তু অন্য এক কষ্ট শরীর কাঁপিয়ে ভেতরে ভেতরে নীল করে দিচ্ছে । ভয়ানক সেই কষ্টের নাম স্মৃতিকাতরতা । মানুষের জীবন হারানোর জীবন । জন্মের পর থেকেই হারানোর তালিকাটা তাই দীর্ঘ হতে থাকে । শৈশব হারায়, কৈশোর হারায়, হারিয়ে যায় যৌবনও । হারায় বাবা-মা, স্বামী-স্ত্রী, কারো কারো সন্তান । একসময় চুল, দাঁত, এমনকি চোখের দৃষ্টিশক্তিও হারায় মানুষ । জীবন থেকে এভাবে একের পর এক সবকিছু হারাতে থাকলেও স্মৃতি হারায় না । বুকের গহিনে ঠিকই গুটিশুটি মেরে থেকে যায় । স্মৃতির প্রতি তীব্র কাতরতা থেকে তাই আমৃত্যু মুক্তি মেলে না মানুষের । আশালতা দেবীরও মেলেনি...’ জীবনের এমন অজস্র জটিল হিসাব-নিকাশের গল্প নিয়ে এ উপন্যাস । গল্প অসংখ্য হারিয়ে ফেলা অনুভূতিরও । কাহিনী যত এগোবে, তত উন্মোচিত হবে মৃত এক শিল্প অঞ্চলের বহুমাত্রিক মানুষের বৈচিত্র্যময় জীবনবোধ । ‘কালচক্র’ পাটকলনির্ভর নদীঘেরা জনপদের ওপর রচিত এমন এক মানবিক আখ্যান, যেখানে জীবনের ভাঙা-গড়া, আনন্দ-বেদনার গল্পেরা চক্রাকারে বয়ে চলে অবিরাম । ♦প্রচ্ছদঃ এই প্রচ্ছদটি দেখলেই যেন মনে হয় ভৈরব নদের অববাহিকায় তৈরি গ্রামের রূপটি চোখের সামনে ভেসে উঠছে যেন । কি যে মায়া নিয়ে ঘেরা প্রচ্ছদ লাগে এটি । হলুদের ছিটেফোঁটা থাকা প্রচ্ছদটা আমার বেশ ভালো লেগে যায় । হাত বুলিয়ে দেখতে ইচ্ছে করে খুব । ♦পাঠপ্রতিক্রিয়াঃ √উপন্যাসটি যখন আমি পড়া শুরু করলাম । প্রথম সময়টিতে মনে হলো আমার খুব আস্তে আস্তে পড়া দরকার উপন্যাসটি । প্রথম কয়েক পৃষ্ঠা তাই যেন খুবই সময় নিয়ে পড়লাম । একবার যখন কাহিনীর মাঝে চলে গেলাম আমি ধীরে ধীরে মুগ্ধ হতে লাগলাম । এই উপন্যাসের পটভূমি বেশ অন্যরকম । আর এই ধরনের পটভূমিকে আমি খুবই মুগ্ধ হয়ে খেয়াল করি । বারবার মনে হয় যেন, এগুলো পড়তে কি যে ভালো লাগা । কি যে তীব্রতা । ভৈরব নদের অববাহিকায় তৈরি গ্রাম, যার নাম ভবানীপুর । যে গ্রামের মানুষের জীবন চলে পাটের মিলের মাধ্যমে । এই নয়নতারা পাট মিল, ভবানীপুর গ্রাম এবং ভৈরব নদ তিনটির ত্রিকোণ আখ্যানে গড়ে উঠে উপন্যাসের পটভূমি এবং তাকে ঘিরে থাকা প্রতিটি দৃশ্যপট । উপন্যাসে একবার জড়িয়ে পড়া শুরু করলে মনে হবে যেন এ মায়া কাটানোর আর কোনো উপায় নেই । পটভূমিতে আছে সাময়িক সুখ, কিছুটা আনন্দ, অনেকখানি স্মৃতিচারণা । প্রতিটি দৃশ্যপট যেন বারবার নতুন করে এক অনুভূতি দিয়ে যায় । এই উপন্যাসের পটভূমিতে গভীরতা বেশ গুরুত্বপূর্ণ । যা দারুণভাবে মুগ্ধতায় ফেলে । উপভোগ করতে করতে উপন্যাসের প্রতিটি নিঃশ্বাসের শব্দ যেন মিলে মিশে যায় নিজের সাথে । কালচক্র নামক এক গভীর আখ্যানে তাই পটভূমি এবং ঘটনাপ্রবাহে মিশে যাই আমি বারবার ‌। প্রতিটি ঘটনাপ্রবাহে ছাপ, কিংবা দৃশ্যপটে একই ধাঁচে বর্ণনা করা হয়েছে । এবং তা একই সুতায় গাঁথা বলে উপন্যাসটিকে বেশ লেগেছে আমার । √সাধারণত নদী তীরবর্তী জায়গা কিংবা পাট মিল নির্ভর বা কোনো ধরনের বিশেষ কিছুকে নির্দেশিত করা উপন্যাসগুলোতে চরিত্র গঠন এবং তাদের দিয়ে যেভাবে উপস্থিতি দেখানো হয় তা বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয় । এবং অসাধারণ ভাবে সাজানো হয় । এখানেও তাই । এই উপন্যাসের প্রতিটি চরিত্র, এমনকি প্রত্যেকটি চরিত্র অসাধারণ ভাবে গঠন করা হয়েছে এবং তাদের উপস্থিতি অসাধারণ ছিল । বিশেষ করে কয়েকটি চরিত্র গঠন এবং তাদের বিশ্লেষণ অসাধারণ ছিল । তাদের চরিত্রের গভীরতা উপন্যাসের দৃশ্যপটকে আরো সুন্দর করেছে । এছাড়াও চরিত্রগত শিক্ষার মান হিসেবে ভাষাগত কিছু পার্থক্য দেখানো হয়েছে যেভাবে তা দারুণ লেগেছে আমার । আমজাদ প্রেসিডেন্ট চরিত্রটি তার মাঝে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ একটি চরিত্র । যার উপস্থিতিতে প্রতিটি মুহূর্ত এবং সংলাপ বেশ ভালো ছিল । ধীরস্থির স্বভাবের, সবকিছু হিসেব করে মিলিয়ে নেয়া মানুষটি প্রচণ্ড সাহসী এবং বুদ্ধিমান । যা করবে তা আগে থেকেই ভেবে নেয়া থাকে । এছাড়া সোলায়মান চরিত্রটিও বেশ সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে । সংসারের প্রতি খানিকটা উদাসীন মানুষটি ভীষণ সৎ এবং মাঝেমাঝেই পরিবারকে ভীষণভাবে ভালোবাসতে চায় । মিষ্টি চরিত্রের ভালোবাসা পাওয়ার এক আজন্ম অপেক্ষা দারুণ ভাবে মুগ্ধ করে দেয় । পলাশ, রকিব এর স্মৃতিচারণ কিংবা বন্ধুত্ব ওই দৃশ্যপটে মুগ্ধতার পরিচয় দেয় । তাছাড়া ওই আবহে ভালোলাগাও দেয় । চন্দ্রলেখার জন্য ভীষণ ভালোলাগা কাজ করে । পরিবারকে ভালোবাসতে চাওয়া মেয়েটি পরিবারের জন্যই চুপ করে থেকে যায় । পরেশ ঠাকুর এর ভালোবাসায় অপেক্ষা কিংবা নরেশ ঠাকুর এর এড়িয়ে চলা দিনযাপন তাদের চরিত্র গঠনকে সুন্দর করে । জগলু্র হতাশা কিংবা হারুন এর প্রেম উপন্যাসে নতুন মাত্রা দেয় । এরকম করে উপন্যাসে যতগুলো চরিত্র আছে প্রতিটি চরিত্রই উপন্যাসকে গেঁথে রাখে যেন জীবনভর! একেকটি চক্রের মতো করে । এই চক্রই বয়ে চলে যায় । ♦প্রিয় অংশঃ এই উপন্যাসের সবথেকে প্রিয় যে বিষয়টি, তা হলো আবহ । এত সুন্দর ভাবে আবহ তৈরি করা হয়েছে যে প্রতিটি দৃশ্যপট আমার প্রিয় হয়েছে । দৃশ্যপট কিংবা ঘটনাপ্রবাহ ফুটিয়ে তোলার জন্য যেভাবে আবহ সৃষ্টি করা হয়েছে সেক্ষেত্রে সামান্য ইতিহাসের মতো করে একটু বর্ণনা কিংবা যে দৃশ্যপট থাকে তার সাথে সংযুক্ত অন্যান্য ঘটনাকে যেভাবে গভীরতা রেখে বলে দেয়া হয়েছে বর্ণনায় মুগ্ধতা রেখে তা বেশ সুন্দর ছিল । উপন্যাসে জীবনের প্রতি দায়বদ্ধতা কিংবা নিজ পরিবারের সাথে তীরবর্তী অঞ্চলের মানুষের বিবাগী জীবনের যে ছাপ এই ধরনের আবেগ এবং আবেশ আমাকে সবসময়ই ভালোলাগায় ভরিয়ে দেয় । সেইসাথে যোগ হয়েছে পাট মিল এর মাধ্যমে জীবিকা অর্জন করার মাধ্যমে এটাকে দৃশ্যপটে নিয়ে আসা । এই ধরনের পটভূমি আমার খুব প্রিয় । কারণ উপন্যাসের পটভূমিতে গভীরতা এবং দৃশ্যপটে তীব্রতা আমি ভীষণ ভাবে পছন্দ করি এবং তা কল্পনা করে নিতে আমার সুবিধা হয় । যে কারণে এই অংশগুলো আমার খুব প্রিয় । প্রকৃতিগত টানাপোড়েন কিংবা জীবনের টানাপোড়েনে দুঃখ-কষ্টের ছাপ মানসিকতায় যেভাবে প্রভাব ফেলে তাও বেশ সুন্দর করে দেখানো হয়েছে । উপন্যাসে একটা রহস্য দেখানো হয়েছে । যে রহস্যটি শুরুতেই বারবার আন্দাজ করছিলাম আমি । শেষে রহস্যের ধাঁচটা মিলে গেলেও এর প্রভাবে আমি খানিকটা সময়ে অবাক হয়ে কথা হারিয়ে ফেলেছিলাম খুব । মাঝে মাঝে কিছু বিরহ উপন্যাসকে সুন্দর করে । কারণ এ সময়ে আবহে, প্রকৃতিতে নিঃসঙ্গতা আসে । সংলাপের ভাষায় মাধুর্যতা আসে । যা এখানে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ভালো ভাবে ‌। কিছু অনুভূতির জন্য ব্যবহৃত বিশ্লেষণ কিংবা অনুভূতি প্রকাশ মুগ্ধ করে খুব । কালচক্র, বিরহের সাথে সময়কে জড়িয়ে ধরে নেয়া আখ্যান যেন । ♦অন্যান্য বিষয়ঃ √প্রকাশনীঃ অন্বেষা প্রকাশন এর বই আমার খুব কম পড়া হয়েছে । যাহোক এই বইটির বাঁধাই বেশ ভালো ভাবে করা হয়েছে । বইটি হাতে নিয়ে পড়তে তাই বেশ ভালো লাগা কাজ করে । এছাড়া প্রচ্ছদটি সুন্দর ফুটিয়ে তোলা হয়েছে । হাত বুলিয়ে দিতে ইচ্ছে করে । তাছাড়াও বইতে পৃষ্ঠার ধাঁচ সামান্য সময়ের জন্য চিরায়ত আবেগের একটা ছাপ দিয়ে যায় । উপন্যাসে সামান্য কিছু ত্রুটি থাকলেও তাতে পড়তে সমস্যা হয় না । ♦লেখক প্রসঙ্গেঃ লেখক আবদুল্লাহ আল ইমরান এর বই পড়ার ইচ্ছা আমার অনেকদিনের । এমনকি আমার বই কেনার যে তালিকা তাতে তার বেশ কয়েকটা বই নেওয়ার ইচ্ছাও অনেকদিন ধরে । কিন্তু নেয়া হয়নি । অবশেষে এই বইটি নিয়ে ফেলেছিলাম শুধু । আজকে পড়ে ফেলাও হলো । এখন আমার মনে আফসোস হচ্ছে একটা কারণে, মনে হচ্ছে আগে কেনো পড়া হলো না আমার । অসাধারণ ভাবে কোনো উপন্যাসের পটভূমি সাজানো এবং একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে সেই পটভূমিতে আবহ সৃষ্টি করার ব্যাপারটা দারুণ ভাবে করেছেন । তাছাড়াও ভাষাগত দিক থেকে যারা লেখাপড়ায় সামান্য শিক্ষিত কম, তাদের থেকে যারা শিক্ষিত বেশি তাদের ভাষার মধ্যে কিছুটা পার্থক্য দেখানো হয়েছে । যা বেশ সুন্দর ভাবে তুলে ধরেছেন লেখক । সংলাপে শব্দপ্রয়োগ এবং বাক্যালাপ সুন্দর হয়েছে । এছাড়াও বর্ণনামূলক দৃষ্টিভঙ্গিও দারুণ ভাবে এসেছে ‌। সামান্য ইতিহাসের মতো দেখানোর পাশাপাশি জলছাপে চরিত্রগুলো গঠন এবং উপস্থিতিও সুন্দর ভাবে দেখিয়েছেন লেখক । বিরহ, কষ্ট এবং সুখ পাওয়ার এক চেষ্টায় কিছু মুগ্ধতা রয়ে যায় প্রকৃতির মাঝে । যার আবছায়া টান এসেছে উপন্যাসে । লেখকের লিখনশৈলী এর প্রতি মুগ্ধতা আমার রয়ে যাক । তার পরবর্তী লেখার জন্য শুভকামনা রইলো । ♦রেটিংঃ ৪.৯/৫ ♦উপসংহারঃ পাঠক হিসেবে এরকম উপন্যাস পড়ার পরে মনে হয়, আরো যত নতুন ধরনের অন্যরকম পটভূমিতে উপন্যাস পড়তে পারবো তত নিজেকে সমৃদ্ধ হওয়ার পাশাপাশি ওরকম সংবলিত থাকা চরিত্রগুলোকে কাছ থেকে অনুভব করে বুঝতে পারবো । যা ভীষণই ভালোলাগা দেয় আমাকে । মনে হয় এতে অনুভূতি প্রকাশ এবং নতুন নতুন কত ভিন্ন রকমের পটভূমি কিংবা দৃশ্যপটের প্রতি আবেগ সৃষ্টি হতে দেখব এর জন্য । যে আবেগতাড়িত অনুভূতিকে নতুন করে অনুভব করার এক চেষ্টা করতে হয় । আর কে না জানে, পৃথিবীতে মানুষের তৈরি হওয়া প্রতিটি অনুভূতিই তার একান্ত নিজস্ব, এবং প্রতিটাই নিজের থেকেও আলাদা!

      By Rakibul Hossain

      31 Mar 2022 12:40 PM

      Was this review helpful to you?

      or

      একটি সুন্দর বিরিহগাথা

      By muntasir 22

      21 Mar 2022 11:18 AM

      Was this review helpful to you?

      or

      'কালচক্র'- কালের আবর্তে আবর্তিত হতে থাকা জীবনের এক রূপ। ----------------- মানবজীবনকে একটা রহস্যেঘেরা অলীক জগতের সাথে তুলনা করা যায়।যার খুব দ্বারপ্রান্তেই আমরা দাঁড়িয়ে থাকি,সচেতন কিংবা অবচেতন মনে সেই জগতকে ছুঁইও ক্ষণে প্রতিক্ষণে,অথচ তার অন্দরে লুকিয়ে থাকা ধোঁয়া দেখতে পাই না। আপনি আমি এই সমাজেই বাস করি,এই সমাজেরই উপকরণ আপনি আর আমি।এই জীবনের শত অলিগলি, ঝঞ্ঝাট, কণ্টকাকীর্ণতা,বৈচিত্রতা এসবকিছু জীবনেরই অপ্রত্যাশিত কিংবা অব্যক্ত কিছু অংশ।আব্দুল্লাহ আল ইমরানের লেখা 'কালচক্র' আপনার আর আমার জীবনের এই গল্পই তুলে ধরেছে।যদি বলা হয়,জীবনের প্রতিচ্ছবিই এই 'কালচক্র'- খুব একটা অত্যুক্তি করা হবে না। বইয়ের শুরুতেই লেখক বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে পাঠককে গল্পে আটকে দিতে সক্ষম হয়েছেন।গল্পের ক্ষুদ্র অথচ অসামান্য চরিত্র 'মহুয়া পিসি'র রশিতে ঝুলে আত্মহত্যার মত থ্রিল আপনাকে গল্পের শেষ খুঁজতে বাধ্য করবে। গ্রামীণ জনপদেরই মানুষ আমরা।আমাদের অস্থিমজ্জা বলতে প্রকৃতির নদী নালা,পাল তোলা নৌকা,রাস্তার পাশে মাথা তুলে দাঁড়ানো কোন বটবৃক্ষ, ভাঙা টিন বা খড়ের বেড়া দিয়ে তৈরি করা বাতাসে কেঁপে উঠার মত কিছু বসতবাড়ি- এসবই আমাদের অনুষঙ্গ।উপরন্তু,কালচক্রের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য চিত্র গুলোই ছিল আপনার আর আমার জীবন ঘেরা এই উপাদান গুলো।যা আপনাকে গল্পের এক পৃষ্ঠার পর অপর পৃষ্ঠায় টেনে নিয়ে যাবে মুগ্ধতার সাথে। লেখক তার যেই দর্শন থেকে গল্পটাকে লিখেছেন,সেই দর্শনে কেবল নিখাদ এক ভালবাসার প্রতিকায়ই ভেসে উঠেছে। পুরো গল্প জুড়ে এক অনির্বাণ ভালবাসার সৌরভ। 'মমতার উর্ধ্বে কিছুই নয়- কিংবা ধর্মই সবসময় নৈতিকতার মাপকাঠি নয়' তা লেখক খুব সচেতনতার সাথে গল্পে দেখিয়ে দিয়েছেন গল্পের 'হারুন আর মিষ্টি বৌদি' অথবা 'পলাশ-চন্দ্রলেখা'র বিশুদ্ধ এক মেলবন্ধের মাধ্যমে।পক্ষান্তরে, মোল্লা নামধারী ছদ্মবেশী কিছু লোকও যে সমাজ-জীবনের বিষকাটা স্বরূপ সেটাও পরিস্ফুটন করেছেন লেখক। 'কালচক্র'এর প্রধান বৈশিষ্ট্য হিসেবে উল্লেখ করতে হলে সর্বাগ্রে যেটা স্থান পাবে তা হল 'কালচক্র' একমুখী গল্প নয়। তবে কি বহুমুখী? এই প্রশ্নের উত্তরে 'কালচক্র স্বয়ং এক জীবন-প্রতিচ্ছবি' উত্তরটাই আমি শ্রেয় মনে করি।এবং সেই দৃষ্টিকোণ থেকে 'কালচক্র বহুমুখী গল্প' বিশেষণটা এসে যাওয়াটা প্রাসঙ্গিক এবং যথার্থ। গল্পের সর্বপ্রথমেই আত্মহনন করা মহুয়া পিসির করুণ জীবননাশও যে এক ঠাকুর পরিবারের জন্য অমানিশা হতে পারে,তার নেপথ্য বর্ণিত এই গল্পটা আপনাকে শিহরিত করবে। সাধারণ মানুষ হয়েও অসাধারণ ও সুগঠিত ব্যক্তিত্বের 'মিষ্টি বৌদি'র মাধ্যমে আপনি বুঝতে পারবেন সাধারণ হয়েও কিভাবে অনিন্দ্যা হওয়া যায়।তার অল্পে তুষ্ট-মনোভাব,আন্তরিক মনোজগত,সবাইকে আপন করে নেওয়ার ক্ষমতা আপন মহিমায় 'কালচক্রে' এক উজ্জ্বল উপমা যেন।কুঁড়েঘরের মেঝেতে শোয়া এক নারীর স্বকীয় সতীত্ব রক্ষায় দুর্গারূপী হয়ে উঠার মাধ্যমে শ্রেষ্ঠা হয়ে উঠার বিবৃতিও এই 'কালচক্র'। এসবকে ছাপিয়েও এক নারীর চারপাশে তার ব্যক্তিত্বে গড়ে উঠা কঠোর দেয়াল ভেদ করে সহজ-সরল হারুনের ভীরু কিছু অনুভূতির বহিপ্রকাশও রয়েছে 'কালচক্রে'। পাশাপাশি রয়েছে মিষ্টি বৌদির স্বামী বিষ্ণুর মত কিছু অমানুষিক চরিত্রও।ভালবাসা ও বিষাদের মত এমন ত্রিভুজাকৃতির গল্প আপনার মধ্যে দ্যোতনা সৃষ্টি করবে।প্রশ্ন জাগাবে,আক্ষেপ তৈরি করবে। গল্পের প্রধান কিছু চরিত্রের মধ্যে অন্যতম একজন আমজাদ মোল্লাকে নিয়ে কিছু লিখতে গিয়েও ভেতরে ঘৃণার উদ্রেক হওয়াটা লেখকের বিরাট সফলতার ইঙ্গিতবহ।এই আমজাদ মোল্লাই জীবনের গূঢ় অর্থ গেয়ে যাওয়া গল্প 'কালচক্র'এর মুখ্য ভূমিকা রাখা দুর্জন। তিনি এমন এক চরিত্র,যাকে নিয়ে অবতারণা করা প্রতিটা লাইন তার প্রতি আপনার মনকে বিষিয়ে তুলবে। দুর্নীতি,ক্ষমতালিপ্সা,প্রাণের উপর দাঁড়িয়ে নিজের কর্তৃত্বের জানান দেওয়ার মত কিছু উগ্র মানসিকতার এক লোক আমজাদ মোল্লা। এই জগতসংসারের অর্ধেকেরও বেশি অংশ জুড়ে থাকা মধ্যবিত্তের জীবনও কথাও বাদ পড়েনি 'কালচক্র' হতে।আর এমন সুচারুরূপ বর্ণনার মধ্য দিয়ে ঘাটতিহীন পরিপূর্ণতার নিদর্শনের সাথে ষোলকলা পূর্ণ হয়েছে 'কালচক্র'।জীবনের নানা বাঁকের নিখুঁত ব্যাখার মাঝে লেখক তুলে এনেছেন উদাসীন-বেখেয়ালী এক বাবা 'সোলায়মানের' গল্পও- এনেছেন সহস্র অভাব অনটনের মাঝেও সর্বজয়া এক মা 'সাজিয়ার' গল্পও।যা আপনার আমার জীবনের গল্পও বটে। 'কালচক্রের' হৃদয়-শরীর স্পর্শ করার এক অনবদ্য আখ্যানভাগ পলাশের এই সংসার। এতসব প্রতিবন্ধকতার পথে হাঁটা সত্ত্বেও সোলায়মান-সাজিয়ার সন্তান পলাশের সাদা ফুলের মত সুবাস ছড়ানো এক কাঁচা প্রেমের গল্প আপনাকে ভাললাগার জগতও ঘুরিয়ে আনবে।'কালচক্র' যে অসাম্প্রদায়িক পৃথিবী গড়ারও এক মানস,ভিন্নধর্মী দুজন কিশোর কিশোরী পলাশ-চন্দ্রলেখার প্রেম তারই সাক্ষী। কিশোর বয়সের অপরিপক্ক প্রেমে যে শত স্বপ্নের ইমারত বিরাজ করে তা বুঝবার অপূর্ব এক উপাখ্যানও কী সুনিপুণভাবেই না বলে গিয়েছেন লেখক।পাঠক হিসেবে অতৃপ্তির জায়গা এখানে এসেই রয়ে গিয়েছিল।এই দুটো মানব-মানবীর প্রণয়কে আরো একটু বর্ধিত করলে হয়ত নদীমাতৃক গল্পটায় প্রাণ জুড়োনোর কিছু পুঁজিও পাওয়া যেত। তবে পাঠকের এই গৌণ তৃপ্তির চেয়েও লেখকের বড় করে দেখা 'জীবনের সুদীর্ঘ চক্রকে' তুলে ধরতেই 'কালচক্রে' নানান চরিত্রের আগমণ।২০০ পৃষ্ঠার এই বইয়ের কোন একটি চরিত্রও অকারণে বিবৃত হয়নি।হয়নি পলাশ,রকিব,শামিম,রনি,সোহেলের অকৃত্রিম বন্ধুত্বের কথাও। সাবলীল গতিতে এগোনো এই বইয়ের প্রতিটা শব্দে লেখক জীবনানুভূতি গেঁথে দিয়েছেন-প্রতিটা লাইন আর অনুচ্ছেদে বাঁধাই করে দিয়েছেন জীবনের অন্তর্কথন আর অপার ভালবাসার সুপ্ত কিছু ভাষা।না হয় রক্ত-মাংসের ভারী চামড়া ভেদ করে 'কালচক্র' আপনার মনকে ছুঁতো না। পর্যালোচনার অন্তিমলগ্নে লেখকের সার্থকতা নিয়ে খানিকটা বলা উচিত। বর্তমানে সাংবাদিকতায় নিয়োজিত আব্দুল্লাহ আল ইমরানের 'কালচক্রে' উদ্ধৃত প্রতিটা চরিত্র এককভাবে প্রতিটা পাঠকের মনে আধিপত্য বিস্তার করবে আমি মনে করি। মহুয়া পিসির মৃত্যুতে আপনার কষ্ট হবে,নরেশ ঠাকুরদের কোণঠাসা করে দেওয়া সমাজের প্রতি আপনার ধিক্কার আসবে,মিষ্টি বৌদি কিংবা হারুনের জন্য যেমন ভালবাসা টের পাবেন,ঠিক তেমনই ঘৃণার উদ্রেক হবে বিষ্ণু চরিত্রটায়।নির্ভেজাল পলাশ-চন্দ্রলেখার অপরিণামদর্শী প্রেম আপনার মধ্যে শঙ্কা তৈরি করবে,ওদিকে আতঙ্ক জন্মাবে ছুঁচালো ব্যক্তিত্বের আমজাদ মোল্লায়- সার্থকার ধাপটিতে লেখক সফলতার স্বাক্ষর রেখে গিয়েছেন এভাবেই।বাস্তবতার সুতোয় বেঁধে লেখক জীবন ও কালচক্রের সমন্বয় করেছেন এভাবেই। পারিবারিক দুঃখ দুর্দশা,সামাজিক জীবনের দুর্যোগ,অপ্রাপ্তি আর বিষাদের রূঢ় বাস্তবতা,কৈশরের নির্ঝঞ্ঝাট নির্মলতা আর অব্যর্থ ভালবাসায় 'কালচক্র' বাংলা সাহিত্যে এক অন্যন্য সংযোজন। ------------------ রিভিউ দাতা: নাম: মুনতাসির বিল্লাহ।

      By Md Ashikur Rahman Khan

      01 Mar 2022 05:38 PM

      Was this review helpful to you?

      or

      কালচক্রঃ কালের বিবর্তনে জীবন চক্রের গল্প অজস্র ধারার অজস্র গল্প যখন অদৃষ্ট স্রষ্টার হাতে প্রাণ পায়, তখন তার নাম হয় জীবন। নানা স্বাদের, নানা ঢঙের বিপুল বৈচিত্র্যতায় ঠাসা সেসব গল্পের সমন্বয়ই জীবন। বর্তমান আর ভবিষ্যত নিয়েই তার যতো কাজকারবার। একেবারেই ক্ষণস্থায়ী বর্তমান ঘড়ির কাঁটার সাথে পাল্লা দিয়ে যখন ইতিহাসের বুকে গিয়ে মুখ লুকোয়, তখনই তার নাম হয়ে যায় অতীত। এমন সময়ের আবর্তন নিয়েই জীবনের পথচলা। বহু বৈচিত্র্যের ডালা সাজিয়ে বসে থাকা এক জীবনের কতো যে রূপ-রস, তা ভাবলে অবাক না হয়ে পারা যায় না। এমনই বৈচিত্র্যে ভরপুর জীবনের গল্প নিয়ে লেখা উপন্যাস "কালচক্র" নিয়ে পাঠক সমাজে হাজির হয়েছেন এ কালের বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক ও ঔপন্যাসিক আবদুল্লাহ আল ইমরান। শাশ্বত গ্রাম বাংলার প্রবাহমান জীবনের চিত্রকে সুনিপুণ কথাশিল্পীর কলমের ছোঁয়ায় বইয়ের পাতায় তিনি তুলে এনেছেন৷ নাগরিক সমাজ নিয়ে বাংলা সাহিত্যে অনেক লেখা হলেও তুলনামূলকভাবে গ্রামীণ সমাজের কথা বাংলা সাহিত্যে কমই আলোচিত হয়েছে। এতোদিনের সে অভাবকে কিছুটা হলেও দূর করবার প্রয়াসে হাতে কলম তুলে নিয়েছেন এই শব্দযোদ্ধা। গ্রামীণ সমাজে আধিপত্য বিস্তার ও ক্ষমতার দ্বন্দ্বের বিষয়টিকে অত্যন্ত সুচারুভাবে বইয়ের পাতায় তুলে এনেছেন। এছাড়া গ্রামীণ অর্থনীতি, জীবনযাত্রা থেকে শুরু করে নরনারীর চিরাচরিত মিলন— কোনো কিছুই তার লেখাতে বাদ পড়েনি। অর্থাৎ গ্রামের আবহে চলমান জীবনের নানা দিক তার লেখাতে উঠে এসেছে। এবার আসি উক্ত উপন্যাসের কাহিনী সংক্ষেপের আলোচনায়৷ ভৈরবের অববাহিকায় গড়ে ওঠা গ্রাম ভবানীপুরের ঠাকুরবাড়ির মতো হিন্দু রক্ষণশীল পরিবারে বেড়ে ওঠা মেয়ে মহুয়ার আত্মহত্যার ঘটনার মধ্য দিয়ে উপন্যাসের কাহিনীর সূত্রপাত হয়। এই আত্মহত্যাকে কেন্দ্র করে নানা রসময় গল্প সমাজে ডালপালা ছড়াতে শুরু করে। ঠাকুর পরিবারের এই দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে তাদের সকল সম্পত্তি দখল করবার পাঁয়তারা শুরু করে স্থানীয় চেয়ারম্যান সিরাজ মোল্লা। অপরদিকে, এই কাহিনীর পাশাপাশি ঠাকুর পরিবারের কিশোরী মেয়ে চন্দ্রলেখার সাথে ভিন্ন ধর্মের কিশোর পলাশের প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তাদের এই ভালোবাসায় কোনো খাদ না থাকলেও, নির্মম বাস্তবতা যে তাদেরকে এক হতে দেবে না কিংবা এই সম্পর্ক যে কখনোই আলোর মুখ দেখবে না, তা তারা আগে থেকেই খুব ভালো করেই জানতো। ভবিষ্যত অনিশ্চিত জেনেও তাদের এক জীবনের প্রতীক্ষায় সময় কাটতে থাকে। ঔপন্যাসিকের ভাষায়, "অনন্ত প্রতীক্ষার নাম জীবন। দূরে থাকা সেও তো কাছে আসারই প্রতীক্ষা মাত্র।" আচ্ছা, পরিবারের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মেয়ে মহুয়ার এমন আকস্মিক আত্মহত্যার রহস্য কি জানা যাবে শেষ পর্যন্ত? কিংবা চন্দ্রলেখা কি শেষ পর্যন্ত তার পলাশকে আপন করে নিতে পারবে? পাঠকের মনে জন্ম নেওয়া এমন হাজারো প্রশ্নের জবাব কেবল আপাদমস্তক রহস্যে ঢাকা এই উপন্যাসটি পুরোপুরি পড়লেই পাওয়া সম্ভব। এবার আসি উপন্যাসের চরিত্র ভিত্তিক বিশ্লেষণের গল্পে। এই আলোচনা শুরু করবার আগে যে কথাটি না বললেই নয়, তা হচ্ছে— এখানে কোনো একক কেন্দ্রীয় বা মূল চরিত্র খুঁজে পাওয়া যাবে না। গল্পের সামঞ্জস্য বজায় রাখবার জন্য এখানে ঔপন্যাসিককে অনেকগুলো চরিত্রের আশ্রয় নিতে হয়েছে। গল্পে সেসব চরিত্রের গুরুত্বের কিছুটা তারতম্য থাকলেও কোনো চরিত্রই একেবারে ফেলনা বা গুরুত্বহীন নয়। গল্পের প্রবাহ ধরে রাখতে একেক চরিত্র একেক সময় একেকভাবে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করেছে বটে; তবে সার্বিক বিচারে কোনো একক চরিত্র কেন্দ্রীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেনি কোথাও। যা হোক, এরকম একটা গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রের কথা বলতে গেলে শুরুতেই বলতে হয় আমজাদ প্রেসিডেন্টের কথা। কাগজে-কলমে শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি হলেও ভবানীপুর গ্রামের নয়নতারা পাটকলের অলিখিত সম্রাট তিনি। সত্যি বলতে, পুরো ভবানীপুর গ্রামেই তার প্রভাব রয়েছে। এই প্রভাব এতোটাই যে খোদ উক্ত এলাকার চেয়ারম্যান সিরাজ মোল্লা পর্যন্ত সমীহ করে চলে! স্থানীয় পাটকল শ্রমিকেরাই তার এই ক্ষমতার উৎস। এ কারণেই তাকে শ্রমিকদের আবেগ-অনুভূতি বুঝে পা বাড়াতে হয়। রাজনীতির মাঠের সেয়ানা খেলোয়াড় বলে পরিচিত আমজাদ প্রেসিডেন্ট নামক চরিত্রটির মধ্য দিয়ে ঔপন্যাসিক আবদুল্লাহ আল ইমরান এক সুবিধাবাদী নেতার চরিত্রকে ফুটিয়ে তুলেছেন। শ্রমিকবান্ধব নেতার মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে থাকা এক স্বার্থান্বেষী মানুষের প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে তার মধ্য দিয়ে। পাশাপাশি তাকে একজন আদর্শ পিতা হিসেবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এই উপন্যাসে। নানা রকম অবৈধ কাজকর্মের মধ্য দিয়ে রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়া এই মানুষটির মধ্যেও যে একজন ভালো মনের পিতার ছায়া লুকিয়ে থাকতে পারে, তা পাঠকের কাছে বেশ ভালোভাবেই তুলে ধরেছেন ঔপন্যাসিক। এক্ষেত্রে তিনি যে দারুণ মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন, তা আলাদা করে বলাই বাহুল্য। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে রাখা হয়েছে পলাশকে। একেবারে শৈশব থেকেই ভবানীপুরে বেড়ে ওঠা কিশোর পলাশ নয়নতারা মিলের স্থায়ী শ্রমিক সোলায়মান মিয়ার ছেলে। বন্ধুপ্রিয় হলেও পরিবারের কিছু দিক তাকেই দেখভাল করতে হয় তার মায়ের পাশাপাশি। কারণ তার সঙ্গীতপ্রেমী বাবার সংসারধর্মে একেবারেই মন নেই। এর পাশাপাশি একদিন হঠাৎ করেই তার সহপাঠিনী চন্দ্রলেখার সাথে প্রেম হয়ে গেল। শুরুতে ধর্মীয় বাধার কারণে পিছিয়ে আসতে চাইলেও শেষ পর্যন্ত তারা কেউই পিছিয়ে যেতে পারেনি। কিন্তু এই সম্পর্ক কি শেষ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখবে? এই চরিত্রের ভেতর দিয়ে ঔপন্যাসিক এক গ্রাম্য কিশোরের প্রতিচ্ছবি এঁকে চলেছেন। উঠতি বয়স; তাই আবেগটাও স্বভাবতই বেশি অন্যদের তুলনায়। নির্মম বাস্তবতাজ্ঞান সমবয়সী অন্যদের তুলনায় বেশি হলেও তা যথেষ্ট নয় এখনো। এখনো তার মনোজগৎ আবেগে টইটুম্বুর। চঞ্চলতা যে এখনো তার পিছু ছাড়েনি! যা হোক, এক্ষেত্রেও ঔপন্যাসিক তার নিজস্ব দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। উপরোক্ত দুইটি চরিত্র ছাড়াও এই উপন্যাসে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র পাঠক হিসেবে চোখে পড়েছে। সে চরিত্রের নাম "মিষ্টি"। এলাকার সবার কাছে " মিষ্টি বৌদি" নামে পরিচিত এই নারী নিজের নামের সার্থকতা ধরে রেখেছেন। গায়ের রঙ শ্যামবর্ণ হলে কী হবে? নিজের মায়াময় চেহারা ও মিষ্টি ব্যবহার দিয়ে অল্পদিনেই জয় করে নেন সকলের হৃদয়। তবে এ ব্যাপারটা একসময় তার জীবনে সাপে বর হয়ে আসে। নিজের সুন্দর চেহারা, অটুট যৌবন ও সুন্দর ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে এলাকার পুরুষেরা নানা অজুহাতে তার বাড়িতে আসতে শুরু করলে অন্য নারীদের চক্ষুশূলে পরিণত হতে খুব বেশিদিন সময় লাগেনি তার। এলাকার অনেকেই তার দিকে কামুক দৃষ্টিতে তাকালেও তার ভালো লাগে সদালাপী হারুনকে। অত্যাচারী, মাতাল স্বামী বিষ্ণুর অত্যাচার সইতে না পেরে একসময় মিষ্টি সাক্ষাৎ দেবীর মতো রুদ্রমূর্তি ধারণ করেন। এর মাঝে ঘটতে থাকে অনেক ঘটনা। ক্ষণে ক্ষণে রঙ পাল্টানোর সে গল্প জানতে চাইলে পড়তে হবে এই বইটি। এই চরিত্রের মধ্য দিয়ে আবদুল্লাহ আল ইমরান এক সদালাপী, মিষ্টভাষী অথচ সতিসাধ্বী নারীর চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন, যিনি কিনা জীবনের প্রয়োজনে মমতাময়ী মা কিংবা প্রেমময়ী স্ত্রী যেমন হতে পারেন, তেমনি অসুর বধকারিণী দেবী দুর্গা-ও হয়ে উঠতে পারেন। এক্ষেত্রে ঔপন্যাসিকের চরিত্র চিত্রণের দক্ষতা সত্যিকার অর্থেই প্রশংসার দাবি রাখে। উপরে আলোচিত তিনটি চরিত্র ছাড়াও উপন্যাসে আরো বেশকিছু চরিত্র চোখে পড়ে। উপরোক্ত তিনটি চরিত্রের মতো অধিক গুরুত্বপূর্ণ না হলেও গুরুত্বের বিচারে কেউ কারো চাইতে কোনো অংশে পিছিয়ে নেই। এসব চরিত্রের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু চরিত্র হচ্ছে— চন্দ্রলেখা, নাজিমউদ্দিন, মকবুল, সোলায়মান মিয়া, নরেশ ঠাকুর, গণেশ প্রমুখ। উপন্যাসের গল্পে নতুন কোনো দিক যুক্ত করবার উদ্দেশ্যে সৃষ্ট এসব চরিত্র উপন্যাসের মূলগল্পে কোনো রকম ব্যাঘাত ঘটায়নি; বরং তাতে এক নতুন ব্যঞ্জনার সৃষ্টি হয়েছে। এসব চরিত্রের সংযোজন প্রসঙ্গক্রমে উপন্যাসের কাহিনীকে এক নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। সার্বিকভাবে বলতে গেলে বলতে হয়, গল্পের প্রয়োজনে চিত্রিত এসব চরিত্র উপন্যাসের সাহিত্যগুণে কোনো রূপ অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়নি বা সৃষ্টি করেনি কোথাও। আশা করি, এই ব্যাপারটি কোনো পাঠকের কাছে বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়াবে না। এবার আসি বইটির ভাষাগত বিশ্লেষণের আলোচনায়। মূলত বইটিতে বাংলা ভাষার চলিত রীতি অনুসরণ করা হয়েছে। অত্যন্ত সহজবোধ্য ও প্রাঞ্জল ভাষায় লেখা বইটি কোনো পাঠকের কাছেই কঠিন লাগবে না বলে আমার বিশ্বাস। কোথাও কোথাও সংলাপের ক্ষেত্রে আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করা হলেও তাতে বইটির মূল ভাবগাম্ভীর্য একটুও বিনষ্ট হয়নি। বরং তাতে গল্পের আকর্ষণ আরো বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। শব্দচয়নের ক্ষেত্রেও বৈচিত্র্যতা সহজেই একজন পাঠকের চোখে স্পষ্ট হয়ে ধরা দিবে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে উপমার যথাযথ প্রয়োগ বইটির সাহিত্য মান বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। এর পাশাপাশি জীবন ঘনিষ্ঠ দর্শনের কথা একে আরো সমৃদ্ধ করেছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন কোনো বিষয়বস্তুকে ধরা ও সঠিক শব্দচয়নের মধ্য দিয়ে তাকে উপস্থাপনের ক্ষেত্রে আবদুল্লাহ আল ইমরানের দক্ষতার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। যা হোক, সবমিলিয়ে একজন সাধারণ পাঠক হিসেবে ভাষাগত কোনো ত্রুটি আমার নজরে পড়েনি। আশা করি, অন্যদের কাছেও ভালো লাগবে। উপরোক্ত বিষয়গুলো নানান দিক দিয়ে পাঠকের কাছে উপন্যাসটির মর্যাদা বৃদ্ধি করেছে। যথার্থ রিভিউ করতে গিয়ে কিছু কিছু ক্ষেত্রে মনে হয়েছে, পাঠক সমাদৃতি বাড়াতে ঔপন্যাসিকের আরো সতর্ক হবার সুযোগ ছিল। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, চরিত্র চিত্রণের কথা। জীবন ঘনিষ্ঠ এ রচনায় কোনো চরিত্রের গুরুত্ব কম না হলেও এ ক্ষেত্রে ঔপন্যাসিক আরো সতর্ক হতে পারতেন বলে পাঠক হিসেবে আমার মনে হয়েছে। এক প্রেক্ষাপট থেকে আরেক প্রেক্ষাপট দ্রুত পাল্টে যাবার ফলে এ কাজটা তেমন সহজ মনে হয়নি আমার কাছে। এক্ষেত্রে ঔপন্যাসিক আরো সতর্ক হলে তা উক্ত উপন্যাসের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধিতে আরো সহায়ক হতো বলে আমার ধারণা। সবশেষে বলা যায়, গ্রামীণ সমাজের নানা দিক তুলে ধরা এই উপন্যাসে বাংলার আপামর জনতার কথা তুলে ধরা হয়েছে। যেভাবে এখানে গ্রামীণ সমাজ ও প্রকৃতির আবহ তুলে ধরা হয়েছে, সেদিক দিয়ে এটিকে কালিদাসের "মেঘদূত" কাব্যগ্রন্থের সাথে তুলনা করা চলে। অন্যদিকে যেভাবে গল্পের ঘটনাবলী এগিয়েছে, তাতে এটিকে কোনো থ্রিলার বা রহস্য উপন্যাস হিসেবে আখ্যায়িত করা হলে তাতেও খুব একটা ভুল হবে না বলে আমার ধারণা। এক কথায় সার্বিক অর্থে বেশ ভালো লেগেছে বইটি। আশা করি, অন্য পাঠকদের কাছেও বইটি ভালো লাগবে। পাঠ অনুভূতি সুখের হোক! বই সংক্রান্ত তথ্যঃ বইয়ের নামঃ কালচক্র লেখকঃ আবদুল্লাহ আল ইমরান বইয়ের ধরণঃ সামাজিক উপন্যাস প্রকাশনাঃ অন্বেষা প্রকাশন প্রথম প্রকাশঃ অমর একুশে বইমেলা, ২০১৮ প্রচ্ছদঃ সানজিদা পারভীন তিন্নি আইএসবিএন নম্বরঃ ৯৭৮-৯৮৪-৯৩২৩৬-২-৪ পৃষ্ঠা সংখ্যাঃ ২০০ মুদ্রিত মূল্যঃ ৩০০ টাকা

      By Progga Chanda

      01 Mar 2022 05:33 PM

      Was this review helpful to you?

      or

      জীবন যেখানে কালের চক্রে বাঁধা মানুষ সময়ের চাকায় আশা বেঁধে কাটিয়ে দেয় জন্ম মৃত্যুর মধ্যের এই জীবন। জৈবিক প্রয়োজন পূরণ করে মানুষ ছোটে তার মনের প্রয়োজনের দিকে, সে চাহিদা সামাজিক বিধিনিষেধের তোয়াক্কা করে না, এগোতে থাকে লাগামহীন ঘোড়ার মতো। হুমরি খেয়ে পরে আবার আশায় বুক বেঁধে উঠে দাঁড়ায় আবার ছোটে, আমৃত্যু ছোটে। ভৈরবের শীতল বহমান স্রোতের পাশে দাঁড়িয়ে আছে ভবানীপুর গ্রাম। আর আছে নয়নতারা জুট মিল। গ্রামের দশটা পাঁচটা সাধারণ মানুষের সাতকাহনের মধ্যে দিয়ে এই কালচক্র জীবনের আখ্যান বলে। হেমন্তের বাতাসে গাছে দুলতে থাকা মহুয়া পিসির মৃতদেহ কিশোর পলাশকে হতভম্ব করে দেয়। কিন্তু মহুয়া পিসির আত্মহনন সবাইকে ততটা উদ্বিগ্ন করে না, যতটা ঠাকুরবাড়ির সম্মানের চিন্তা উদ্বিগ্ন করে। আর তখন গ্রামের মধ্যে মহুয়া পিসির চরিত্র নিয়ে আলোচনা সমালোচনা চলতে থাকে। মহুয়া পিসির আত্মহত্যার মূল কারণ কেউ খোঁজে না, সকলে তার চরিত্রে কাদা ছোড়াছুড়ি করতে থাকে। তবে লেখক অবশ্য শেষ পর্যায়ে সহানুভূতির সাথেই এই রহস্যের সমাধান করেন। মহুয়া পিসির মৃত্যুতে একরকম গৃহবন্দি হয়ে পরে ঠাকুরবাড়ি নরেশের মেয়ে চন্দ্রলেখা। কিন্তু চন্দ্রলেখার মন পরে থাকে নয়নতারা জুট মিলের সামান্য শ্রমিকের অসচ্ছল পরিবারে বেড়ে উঠা পলাশের কাছে। কৈশোরের বন্ধু, তার সীমানা ডিঙিয়ে আরো অনেকটা পথ হেঁটে চলে গেছে, এমন এক সম্পর্কের জন্ম হয়েছে যাকে শুধুই বন্ধুত্বের দলে ফেলে দেয়া যায়। যেখানে ধর্ম, সমাজ আর শ্রেণি বৈষম্য তাদের চারপাশ আগাছার মতো ঘিরে রেখেছে সেখানে ভালোবাসার সবুজ কুড়ি কিভাবে জন্ম নেবে। পলাশের বাবা সোলায়মানের চরিত্রে কোন সাংসারিক স্থিরতা নেই, কিন্তু তার এই কমতি পূরণ করে ছন্নছাড়া পরিবারের হাল ধরে সাজিয়া। ছেলে মেয়ে আর সংসারের চাহিদা যে কোন জাদু বলে পূরণ হয়ে যায় তা শুধু ওই স্নেহময়ী হাত দুটোই জানে। লেখকের কলমে সহানুভূতির ছাপ থাকলেও বাস্তবকে চিত্রিত করেছেন তিনি বাস্তবকে যথার্থভাবে ধারন করেই। চন্দ্রলেখা আর পলাশের সম্পর্কের কিনারা পাঠকেই খুঁজতে হবে। গল্পে পলাশ আর তার বন্ধুদের অসাধারণ এক অকৃত্রিম ভালোবাসাময় বন্ধুত্বের কাহিনি গাথাও আছে। যা লেখকের কলমে জীবন্ত হয়ে ধরা দেবে পাঠক হৃদয়ে, মনে করিয়ে দেবে শৈশব আর কৈশোরের স্মৃতি। সমাজের শুধু একদিক নয় অন্য আরেক দিকও দেখা যায় কাহিনির প্রবাহে। মানুষের মনের সেই ধূসর অন্ধকার দিক। যেখানে আছে জগলু, যে তেলের চোরাচালান করে সংসারের দারিদ্র্য ঘোচায়, তবে তার পিতৃস্নেহ কাহিনির শুরুতে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। জগলুর অপকর্মের পেছনে আছে আমজাদ প্রেসিডেন্ট, তবে সে জগলু ও তার পরিবারের প্রতি নিঃস্বার্থ সহানুভূতিশীল নয়, তার পরোপকারী মনোভাবের কারণ গল্পের শেষ ভাগে প্রকাশ পায়। জুট মিলেও তার কম অন্যায় সংগঠিত হয়নি, সে তার প্রতিদ্বন্দ্বী রাজুকে কৌশলে তার পথ থেকে সরিয়ে দেয়ার অপচেষ্টা চালায়, ভাগ্যক্রমে যদিও রাজু প্রাণে বেঁচে যায়। জীবনকে আরো বেশি ভোগবিলাসী করতেই এই অন্যায়ের পথে হাটে জগলু, আমজাদ প্রেসিডেন্টসহ গল্পের আরো কিছু চরিত্র। তাদের মধ্যে আছে নাজিমুদ্দিন, তার ছেলে মন্টুও। কালের চক্রে আরো একটি অপ্রাপ্তির গল্প আঁকা আছে। সে কাহিনি বিষ্ণু আর মিষ্টির। মদ্যপ বিষ্ণুর সংসারে কখনই সেই কাঙ্ক্ষিত ভালোবাসার সন্ধান পায়নি মিষ্টি। যে হাস্যোজ্জ্বল, সহজ জীবন বোধ অনুধাবন মিষ্টির চরিত্রে দেখা যায় তা ওই গ্রামের সাধারণ মেয়ের থেকে ভিন্ন। জীবনকে সে সহজ ভাবে বিচার করতে শিখেছে। সাংসারিক অভাব তাকে গ্রাস করেনি কিন্তু একটা ও সন্তানের কামনা তাকে কাতর করেছে। নিজের স্বামী যখন তার সাথে প্রতারণা করেছে, প্রতিবেশী রইজউদ্দিনের স্ত্রী রাহেলার সাথে পরক্রিয়ায় ব্যস্ত, তখনও তাকে সন্তানের অভাবই বেশি কষ্ট দিয়েছে। সে দেখেছে কিভাবে এই সমাজ তার শরীরের সৌন্দর্যের পূজারী, মনের মন্দির শূন্য পরে থাকে, শরীরের পূজায় সবাই ব্যস্ত। তার এই নিঃসঙ্গ জীবনে প্রবেশ করে হারুন, চোখে ভালোবাসার প্রতিজ্ঞা নিয়ে। মিষ্টির মন অন্তর্দ্বন্দ্বে পরে যায়, যে স্বামীর একবিন্দু প্রেমের জন্য সে ছটফট করেছে তাকে ছেড়ে সে অন্য কোন গলায় তার প্রেমের মালা তুলে দেবে! তবে মানুষের মন তাকে তার নিয়তির দিকেই ধাবিত করে। মিষ্টি, হারুন, বিষ্ণু আর রাহেলার চতুর্ভুজ প্রেম কাহিনির পরিনতিও পাঠককে বই পড়েই জানতে হবে। সার্থক চরিত্র সেটাই যার মধ্যে ইতিবাচক নেতিবাচক দুটো দিকই অবস্থান করে। ইতিবাচক দিক একটু বেশি থাকলে সে সচ্চরিত্র বলে উপন্যাসে গন্য, পাঠকের মনে নায়কের স্থান পায়, আর নেতিবাচক দিকটা বেশি হলে উল্টোটা ঘটে। মানুষের চরিত্র কখনই শুধু একমুখী হয় না, দ্বিমুখী চরিত্রগুলোই উপন্যাসকে বাস্তব ঘনিষ্ঠ করে তোলে। লেখক আবদুল্লাহ আল ইমরান এই কালচক্র উপন্যাসের এই চরিত্রের দ্বিমুখী প্রবাহ সাচ্ছন্দে বজায় রাখতে পেরেছেন। মানুষ জীবনের হিসাবকে সবসময় ঠিক রাস্তায় চালাতে পারে না, সে পথভ্রষ্ট হয়, জীবনেরই জন্য। ঘুরতে থাকে কলের চক্র আর তার সাথে ঘুরতে থাকে মানুষের জীবনের সুখ-দুঃখ, আশা-হতাশা, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির গল্প। বইয়ের নাম: কালচক্র লেখক: আবদুল্লাহ আল ইমরান ধরন: সামাজিক উপন্যাস প্রকাশনী: অন্বেষা প্রকাশন প্রথম প্রকাশ: অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৮ প্রচ্ছদ: সানজিদা পারভীন তিন্নি নামলিপি: দেওয়ান আতিকুর রহমান ISBN: 978-984-93236-2-4 পৃষ্টা সংখ্যা: ২০০ মুদ্রিত মূল্য: ৩০০.০০ টাকা রিভিউ: প্রজ্ঞা চন্দ বাংলা বিভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

      By Ishrat Jahan Emu

      01 Mar 2022 05:19 PM

      Was this review helpful to you?

      or

      -------- "যে চক্রের শেষ নেই - কালচক্র " -------- ছোটবেলায় একটা কথা সবাই আমরা কমবেশি শুনেছি যে, রাতের পর দিন আসে, আঁধারের পর আলো আসে, আর দু:খের পর আসে সুখ। এভাবে চক্রাকারে চলতে থাকে জীবন। প্রখ্যাত বিতার্কিক এবং বর্তমানে সাংবাদিকতা পেশায় নিয়োজিত লেখক আব্দুল্লাহ আল ইমরানের "কালচক্র " উপন্যাসে স্থান পেয়েছে পাটকল নির্ভর এক জনপদের সাধারণ মানুষের জীবনে সময়ের সাথে বয়ে চলা এই অবিরত চক্রের উপাখ্যান। গ্রামের নাম ভবানীপুর ,নদীর নাম ভৈরব। বইটির প্রচ্ছদটি একবার দেখলে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করবে। নদীতে ভেসে চলা দুটি নৌকা, প্রধান নৌকাটি আবার পাল তোলাও। আপনাকে যদি আপনার গ্রামের ছবি আঁকতে বলা হয়, অবচেতন মনে আপনি প্রথমেই পালতোলা নৌকা ভেসে বেড়ানোর চিত্র এঁকে ফেলবেন। নদী, নৌকা কিংবা পানি বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের জন্য তাই অতি স্বাভাবিক ব্যাপার, যা কিনা অবচেতন মনের কাজই স্মরণ করিয়ে দেয়! প্রচ্ছদ শিল্পীকে তাই ধন্যবাদ, পাটকলনির্ভর নদীঘেরা জনপদের উপর লিখা এই উপন্যাসটির জন্য একদম সঠিক চিত্রটি বাছাই করার জন্য। উপন্যাসটি মূলত ভবানীপুর গ্রামের নয়নতারা পাটকলের শ্রমিকদের জীবন নিয়ে রচিত। শ্রমিকদের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত শ্রমিক নেতা ছাড়া ও ভবানীপুর গ্রামের কিছু প্রভাবশালী পরিবারের কথাও এখানে বিশদভাবে স্থান পেয়েছে। যেমন : উপন্যাসটি শুরুই হয়েছে ঠাকুরবাড়ির একটি ঘটনা দিয়ে। ঘটনা না বলে দুর্ঘটনা বলাই শ্রেয়। মহুয়া পিসির আত্মহত্যার ঘটনাটা আসলেই মর্মান্তিক। সবসময় হাসি-খুশি এবং প্রাণোচ্ছল এই মহুয়া পিসির আত্মহত্যার আসল কারণ জানা যায় উপন্যাসের শেষাংশে। কিন্তু পুরো উপন্যাস জুড়েই চলতে থাকে গ্রামের মানুষের এই আত্মহত্যা নিয়ে তৈরি করা বিভিন্ন গুজব। আর নেতিবাচক খবর আসলেই খুব দ্রুত ছড়ায় এবং এর রেশও থাকে বহুদিন। তাই গ্রামের কারো জানতে বাকি থাকে না এই খবর। এবং বেশ কিছুদিন কেটে গেলেও এই ঘটনার রেশ শেষ হয় না। কেউ কোনো কারণ ছাড়া অবশ্যই আত্মহত্যা করে না।এরপর আত্মহত্যার ঘটনার পর ঐ পরিবারের সদস্যদের মানসিক অবস্থা হয় সবচাইতে করুণ। কিন্তু সমাজ বলি আর সাধারণ মানুষ বলি - সবাই খুবই নিষ্ঠুর। কারো পাশে না দাঁড়িয়ে কাঁটা গায়ে নুনের ছিটা দেয়াই যেন বাহবা পাওয়ার মতোন কাজ বলে মনে করে সবাই। ঠাকুরবাড়ির কর্তা নরেশ ঠাকুরকে তাই বেশ ভুগতে দেখা যায় পুরো উপন্যাস জুড়ে। তাঁর মা আশালতা দেবী, স্ত্রী অতসী রাণী, কন্যা চন্দ্রলেখা, ছোট ভাই পরেশ ঠাকুর সহ পরিবারের সবাই যেন এই ঘটনার পর হয়ে যান গৃহবন্দি। এর বাইরে তাদের এলাকা থেকে সরিয়ে জমি দখলের জন্য তৎপর সিরাজ মোল্লার কার্যক্রম তো আছেই। ও হ্যাঁ, একদম শুরুতে আরেকটি দুর্ঘটনার কথাও উল্লেখ ছিলো। উপন্যাসটি শুরুই হয় দুটি দুর্ঘটনা দিয়ে। দ্বিতীয় দুর্ঘটনায় দেখা যায় নদীতে গভীর রাতে চোরাই পথে তেল দেয়া -নেয়া করার এক পর্যায়ে সব তেল (ডিজেল) নদীতে পড়ে যায়। যদিও আপাতভাবে মনে হয় চোরাই তেল ব্যবসায়ী জগলু ও মাঝি হায়দার হয়তো ধরা পড়ে যাবে । মনের মধ্যে এই প্রশ্ন উঁকি দেয় যে দুর্ঘটনার পর সাঁতরে বাড়ি ফিরতে পারবো তো এরা দুইজন ? কিন্তু মজার ব্যাপার হলো এই ঘটনায় এটাই ছিলো প্রথম ও একমাত্র দুর্ঘটনা! গ্রামের মানুষ ডিজেল ভর্তি তেল নিয়ে শুরু করে মজার এক পর্ব! যা জানতে পড়ে ফেলুন বইটি! এবার আসি সাধারণ এক পাটশ্রমিক সোলায়মান মিয়ার গল্প নিয়ে। স্ত্রী সাজিয়া বেগম ,এস.এস.সি পরিক্ষার্থী পুত্র পলাশ, দশ বছরের কন্যা মুন্নি - এই নিয়ে তাঁর সংসার । কি খুব সাধারণ? মোটেই না। গানপাগল সোলায়মান মিয়া সংসারের প্রতি খুবই উদাসীন। সাজিয়া বেগমই যেন বহু কায়দা করে চালিয়ে নেন তাঁর এই ছোট্ট সংসারটি। মা'য়েরা যেন এমনই। যখন ভাবা হয় আর কিছুতেই সম্ভব না আর চালিয়ে নেয়া, ঠিক তখনই দেখা যায় কোনো না কোনোভাবে ঠিকই সামলে ফেলেন মা! সাজিয়া বেগমের চরিত্রটি তাই এক দায়িত্বপরায়ণ ও আদর্শ গৃহিণীর উদাহরণ যেন। এই পরিবারের গল্প মধ্যবিত্ত মানুষের নিজের জীবন ও পরিবারের কথা মনে করিয়ে দেয় যেন। পলাশ - মেধাবী এই ছেলেটির অনেক স্বপ্ন। কিন্তু শ্রমিকের সন্তান হয়ে পড়ালেখার চূড়ায় যে সে পৌঁছাতে পারবে না, তা ও ভালো করেই জানে। জানে বলেই পলাশের ইচ্ছে করে, বীজগণিত -পাটিগণিতের অহেতুক হিসাব বাদ দিয়ে জীবনের হিসাব মেলাতে। তার বাবার ভালো পাঞ্জাবি নেই। সে দেখেছে, প্রতি শুক্রবার বালিশের নিচে চাপা দিয়ে রাখা মলিন কোঁচকানো পুরাতন পাঞ্জাবিটা পড়েই বাবা জুমার নামাজ পড়তে যান। তাই তো, জীবনের প্রথম আয় দিয়ে বাবাকে একটা সুন্দর পাঞ্জাবি কিনে দেয়ার স্বপ্ন দেখে পলাশ। সংসারের প্রতি উদাসীন বাবা মাঝে মাঝে নিজের উদাসীনতার জন্য অনুতাপ বোধ করেন। স্ত্রীর প্রতি তিনি খুবই কৃতজ্ঞ ,সংসার এভাবে চালিয়ে নেয়ার জন্য। এতোসব অভাব-অনটন ও দু:খের মধ্যেও বাবা-মা'য়ের হাসির মধ্যে জোনাক পোকার মতো সুখের উড়াউড়ির দৃশ্য দেখে পলাশ । এটাই যেন নয়নতারা পাটকলের প্রতিটি শ্রমিকের জীবনের গল্প, পরিবারের গল্প। যেখানে বুদ্ধিদীপ্ত মায়েরা ঠিকই কায়দা করে সংসার চালিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা করেন। এবার চলে যাই পলাশ ও চন্দ্রলেখার প্রেমের গল্পে। সেই ছোটবেলা থেকে দুজন দুজনকে চিনে। ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত একই স্কুলে পড়ায় দিনে দিনে ওদের মধ্যে একটা বন্ধন গড়ে উঠেছিল। জগদীশ স্যারের নোট আদান-প্রদান, বড়ই কিংবা চালতা পেড়ে দেওয়া, নিরাপদ স্যারের কাছে অঙ্ক করার মধ্য দিয়ে নির্ভরশীলতার অদৃশ্য এক সাঁকো তৈরি হয়ে যায় দু'জনের। বন্ধুত্বের বাইরে পলাশের প্রতি এই নির্ভরতা, এই অনুভূতির অন্য কোনো নাম ছিল না চন্দ্রলেখার কাছে। নামটা দিল পলাশই। বলল, এই স্বর্গীয় অনুভূতির নাম আসলে ' ভালোবাসা '! অতি রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে চন্দ্রলেখা ভালোবাসার সম্পর্কে জড়াতে চায়নি কখনই। তার উপর আবার ভিন্ন ধর্মের কারো সাথে যেখানে সম্পর্কের ভবিষৎ পুরোপুরি অনিশ্চিতই বলা যায়। কিন্তু পলাশ তা মানতে নারাজ । ওর ভাষায়, যে ধর্ম দুটি ছেলে-মেয়ের ভালোবাসার অধিকার কেড়ে নেয়, যে সমাজ বয়সের তারতম্যে মানুষের অনুভূতি নির্ণয় করে সেই ধর্ম ও সমাজ মানুষে মানুষে কেবল বিভেদই বাড়ায়। পলাশের জীবনদর্শন মুগ্ধ করে চন্দ্রলেখাকে। হাজারো অনিশ্চিয়তার মধ্যেও ওরা পরিকল্পনা করে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার । ভবানীপুর ছাড়তে পারলে এবং পায়ের তলায় শক্ত মাটি থাকলে নিজের জীবনে সিদ্ধান্ত নেওয়াটা হয়তো কিছুটা সহজ হতে পারে তখন। ভালোবাসার মানুষটার জন্য চন্দ্রলেখা তার পরিবারের সাথে সম্পর্ক বিচ্ছেদেও রাজী। কিন্তু পলাশ যে তার বাড়ির বড় ও একমাত্র ছেলে। সে কি তার পরিবারের সাথে সম্পর্ক ছেদ করতে পারবে ? কিংবা এতো অভাব অনটনের মধ্যেও কি এতোদূর পড়াশোনার সুযোগ কি সে পাবে? উপরন্তু মহুয়া পিসির মৃত্যুর পর চন্দ্রলেখার পরিবারে ঝড় চলছে। অনিশ্চিয়তার এই পলাশ-চন্দ্রলেখা'র এই সম্পর্ক যেন আরো অনিশ্চিয়তার মুখে পড়ে। দুই কিশোর -কিশোরীর এই প্রেমের গল্প ও পরিণতি জানতে দ্রুত পড়ে ফেলুন এই বইটি! তারপর আসি পলাশ, রকিব ,মিলন, রনি,শামীম এবং সোহেলের বন্ধুত্বের গল্পে। যন্ত্রবিপ্লবের যুগে নদীতীরে শিল্পের যে বাজার শুরু হয়েছিল, নৌকা ভাসিয়ে সে বাজারে বসতি গড়েছিল ওদের পূর্বপুরুষেরা। সস্তা শ্রমে দিনে দিনে এ অঞ্চলে গড়ে উঠেছে পাটকল। এর মধ্য দিয়ে বিস্তৃত হয়েছে শ্রমিকের নগরসভ্যতা। যে সভ্যতা বরিশালের রনিকে মিশিয়ে দিয়েছে ফরিদপুরের রকিবের সঙ্গে। মাদারীপুরের মিলন আঁকড়ে ধরেছে নড়াইলের সোহেলকে। এরা প্রত্যেকেই পাটকলের শ্রমিকদের সন্তান ও পরস্পরের বন্ধু। কি দুরন্ত শৈশব আর কৈশোরই না কাটিয়েছে এরা। পূজার সময় ঠাকুরবাড়িতে গিয়ে গুড়ের নাড়ু খাওয়ার কাড়াকাড়িতে ওদের এই বন্ধনে ফাটল ধরে না, বরং আরো প্রগাঢ় হয়। পলাশ, রকিব আর সোহেলের বন্ধুন্ত যেন আরো বেশি ঘনিষ্ঠ ছিল। ওরা যেন ছিল প্রাণের সখা। তাই পলাশ যখন তার চন্দ্রলেখার সাথে সম্পর্কের কথা রকিবকে বলতে যায়, ওদের মধ্যে খুনসুটি ছিল বেশ উপভোগ্য! ফুলের লোভে দলবেঁধে প্রমত্ত ভৈরব পাড়ি দেয়া, একসাথে দাপিয়ে বেড়ানো, আড্ডা, বাবলা গাছে উঠা প্রভৃতি যেন নব্বই এর দশক ও একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে যারা গ্রামে শৈশব এবং কৈশোর কাটিয়েছেন তাদের স্মৃতিকাতর করে তোলে! আমাদের সময় মোবাইল ইন্টারনেট সহজলভ্য ছিলো না, কিন্তু আমাদের ছিলো একটুকরো সোনালি শৈশব। উপন্যাসের শেষ দিকে দেখা যায় বাবলা গাছের মগডাল থেকে পড়ে গুরতর আহত হয় সোহেল। নয়নতারা পাটকলের সমস্যায় ভবানীপুর থেকে সপরিবারে চলে যায় রকিব। যে পাটকল একদিন মিলিয়ে দিয়েছিল ওদের, সেই পাটকলই যেন কেড়ে নিল শৈশবের কাঁচা-মিঠা আনন্দ, স্পর্শে থাকার অধিকার। চোখের সামনেই ভেঙে দিল স্মৃতির খড়কুটোয় তৈরি বন্ধুত্বের বাবুই পাখির বাসাটা। যা আপনাকে মনে করিয়ে দিবে আপনার প্রিয় বন্ধুর সাথে বিচ্ছেদের সময়ের অনুভূতির কথা। "কালচক্র " কোনো না কোনো ভাবে আপনার জীবনেরও গল্পও বটে। এখন বলবো উপন্যাসটির অন্যতম আকর্ষণীয় চরিত্র "মিষ্টি বউদি"র গল্প। দেবীর মতো সুন্দরী মিষ্টি বউদি পড়াশোনাও করেছেন ক্লাস টেন পর্যন্ত। বছর দশেক আগে তিনি যখন পাড়ায় বউ হয়ে আসেন, একটা হুলস্থুল যেন লেগে গিয়েছিল। বিষ্ণুর মতো এমন বদমেজাজি আমড়া কাঠের ঢেঁকি এমন চমৎকার বউ কিভাবে জোটালো, সেটা ছিল সবার প্রশ্ন। প্রচন্ড মিশুক ও আন্তরিক এই বউদি খুব দ্রুতই সবার সাথে মিশে গেলেন। তাঁর জীবন দর্শন ও ভীষণ অন্যরকম । জীবনে কোনো অনুশোচনা নেই তাঁর। যা আছে, যতটুকু আছে তা নিয়েই সুখে থাকতে চান তিনি। অপূর্ব সুন্দরী এই বউদি কে দেখতে পাড়ার পুরুষেরা নানা উছিলায় মিষ্টি বউদির ঘরমুখো হতে থাকলেন। ফলে দ্রুতই পাড়ার অন্য মহিলাদের চোখের বিষে পরিণত হন তিনি। তবে স্বামী বিষ্ণুর সাথে তাঁর সংসার সুখের ছিলো না। মদের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা বিষ্ণু নিজের সংসারের প্রতি ভীষণ উদাসীন। মিষ্টি বউদিকে যা খুব কষ্ট দেয়। এর মধ্যে তিনি স্বামীর নানা কুকীর্তির ও প্রমাণ পান। বহু পুরুষের চোখে তাঁকে পাওয়ার বাসনা দেখলেও তাঁর শক্ত ব্যক্তিত্বের জন্য কাউকে পাত্তা দেন নি তিনি। এর মধ্যে হারুনের চোখেই তিনি দেখতে পান তাঁর প্রতি মুগ্ধতা। তিনি যা দেখতে চেয়েছিলেন বিষ্ণুর চোখে। হারুনের দুকূলে কেউ ছিলো না দেখে সে মিষ্টি বউদিকে খুব আপন ভেবে নেয়। তাই তো হাতে কিছু অর্থ আসার পর সে বউদির জন্য লাল শাড়ি কিনে আনে। উপন্যাসের শেষাংশে তাই দেখা যাবে মিষ্টি বউদি - বিষ্ণু - হারুনের ত্রিমুখী গল্প। মিষ্টি বউদি ও হারুন ভিন্ন ধর্মের দুটি মানুষ। উপরন্তু বউদি অন্যজনের বউ, কিন্তু যার বউ সেই তো অমানুষ। এই গল্পের শেষ দেখতে পড়ে ফেলুন বইটি। এবার যার কথায় আসবো তাঁর কথা না বললে রিভিউ অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। কারণ তাঁকে ছাড়া উপন্যাসটাই অসম্পূর্ণ। তিনি হচ্ছেন আমজাদ মোল্লা। প্রায় এক যুগ ধরে পাটকলের নির্বাচিত সভাপতি এই মানুষটির নাম বদলে হয়ে গিয়েছে আমজাদ প্রেসিডেন্ট। পনের বছর আগে এক সাধারণ পাট শ্রমিক হিসেবে ভবানীপুরে প্রবেশ তাঁর। এতো দ্রুত গ্রামের অন্যতম প্রভাবশালী ব্যক্তিতে পরিণত হন তিনি বুদ্ধির জোরে। শুধুমাত্র বুদ্ধি দিয়ে কাজ হয়নি, এর পিছনে আছে সীমাহীন দুর্নীতি ও নানাবিধ কূটচাল। নিজের পদ সুরক্ষিত রাখতে হাজীগ্রামের হাফেজকে দিয়ে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ভবানীপুরের উত্তরপাড়ার হামেদ আলীর পুত্র রাজুকে খুন করার নির্দেশ দেন তিনি। কিন্তু রাজু প্রাণে বেঁচে যান। হাফেজকে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। আমজাদ প্রেসিডেন্টের ষড়যন্ত্র ফাঁস হয়ে যাবার সম্ভাবনা উঁকি দেয়। এর মধ্যে আবার পাটকলে শ্রমিকদের বেতন আসা বন্ধ হয়ে যায়। মহাবিপদে পড়েন পাটকল নির্ভর ভবানীপুরের মানুষেরা। পাটকলকে ঘিরে ভবানীপুরের সবকিছু চক্রের মতো ঘুরে থাকে। বৃহস্পতিবারে সাপ্তাহিক বেতন দেতা হয়। বাজারের মুদি দোকানদার সারা সপ্তাহ শ্রমিকদের বাকিতে সদাইপাতি দিয়ে অপেক্ষায় থাকে বৃহস্পতিবারের। ঘর ভাড়ার টাকায় সংসার চলে যে গৃহস্থের, তিনিও সপ্তাহে সপ্তাহে তাগাদা দিয়ে মাসের ভাড়া তুলে নেন। এভাবেই এলাকার কাঠমিস্ত্রি, নৌকার মাঝি, কাঁচাবাজারের কসাই এমনকি ভ্যানচালকও অপেক্ষায় থাকেন বৃহস্পতিবারের। ভবানীপুরে বৃহস্পতিবার মানে উৎসব । এখানে বৃহস্পতিবার আসে অপার সম্ভাবনা নিয়ে। তাই হঠাৎ করে বেতন -ভাতা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এবং পাটকল বন্ধ করে দেয়ার গুজব শুরু হওয়ায় শ্রমিকেরা ভরসা হারাতে থাকেন আমজাদ প্রেসিডেন্টের উপর। সামনের সভাপতি নির্বাচনে রাজু দাঁড়ানোয় বড় রকমের প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে পড়েন তিনি। সেজন্য তিনি এক ধূর্ত পরিকল্পনার ফাঁদ পাতেন। একটুর জন্য নিজের ফাঁদা পাতে নিজেই মরতে বসেছিলেন আমজাদ প্রেসিডেন্ট। যাঁর জন্য এই অবস্থা থেকে মুক্তি পান আমজাদ প্রেসিডেন্ট, তাঁর পরিচয় জানলে অবাক হয়ে যাবেন নিশ্চিত। তাঁর এই সাহসিকতা ও আত্মত্যাগে শুধু আমজাদ প্রেসিডেন্টই নয়, ভাগ্য খুলে যায় পাটকলের প্রতিটি শ্রমিকেরও। এভাবেই এগিয়ে যায় গল্প..... গল্পের মাঝে আরো আছে নাজিমউদ্দিন চাচা তাঁর পুত্র মন্টুর কাহিনী। রেডিও ভবানীপুর খ্যাত মকবুলের চায়ের দোকানও বাদ যায়নি এই গল্প থেকে। উপন্যাসটির শেষ বাক্য - 'পলাশ কি জানে পৌষের রাতেরা বড় দীর্ঘ হয়! ' - এই শীতের রাতে এই বইটি পড়তে গিয়ে আপনি তাই কিছুটা হলেও স্মৃতিকাতরতায় ভুগবেন। বইটিতে একই সাথে আছে ধর্ম -বর্ণ নির্বিশেষে এক চমৎকার ভালোবাসার গল্প ,নিষ্ঠুর বাস্তবতার গল্প, হারানো শৈশব- কৈশোরের গল্প, জীবনের গল্প!

      By Israt Jahan Noor Eva

      01 Mar 2022 03:15 PM

      Was this review helpful to you?

      or

      কালচক্র : প্রত্যাশা আর অপ্রাপ্তির আলেখ্য ............................................ বাংলাদেশের হারিয়ে যাওয়া বিখ্যাত পাটশিল্পকে বর্তমান প্রজন্মের কাছে সাদাকালো মোড়কে তুলে ধরার এক সুকৌশলী চেষ্টার নামান্তরই "কালচক্র "। জুটমিলের মেশিনের আবর্তনের মতোই ভবানীপুরের মানুষের আবেগ, প্রণয় কিংবা আকুলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে প্রতিটি চরিত্রে যেখানে অসাম্প্রদায়িকতার প্রচ্ছদে মূল উপজীব্য হিসেবে আঁকা হয়েছে ভিন্ন সামাজিক মর্যাদার আর ধর্মের দুই কিশোর কিশোরীর প্রেমের আবেদনকে।সপ্তাহান্তে সোলায়মান মিয়া আর সাজিয়া বেগমের টানাপোড়েনের সংসারজুড়ে জোনাক পোকার মতো সুখের উড়াউড়ি দেখা পলাশ দ্বিধান্বিত হয় মহুয়ার আত্মহত্যা নাকি চন্দ্রলেখার অনুপস্থিতি তাকে বেশি তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। গল্পটা একদিকে যেমন ক্ষমতালোভী সিরাজ মোল্লা, আমজাদ প্রেসিডেন্ট আর নরেশের মতো লম্পটদের যদিওবা শেষ পর্যন্ত তার লাম্পট্য প্রমাণের দায়ভার লেখক পাঠকের ওপরই ছেড়ে দিয়েছেন ; তেমনিভাবে চিরায়ত বাংলার " শতছিন্ন সংসারের ঘানি টানতে টানতে চোখের সামনে বুড়িয়ে যাওয়া " সাজিয়া বেগমদের, "দুই হাত জুড়ে নিজহাতে লাগানো তুলসি তলায় শেষবারের মতো প্রণাম করে স্বামীর বসতভিটা থেকে বিদায় নিতে বাধ্য হওয়া "আশালতা দেবীদের ও।গল্পটা আরও হয়ে ওঠেছে ধর্ম আর সমাজের বাঁধার উর্ধ্বে থাকা কিশোরী চন্দ্রলেখার শালিক পাখির সংসার দেখতে যাওয়া, মহুয়ার মতো জীবনযুদ্ধে হেরে যাওয়া বহু নারীর কিংবা মিষ্টি বৌদির মতো প্রতিবাদী নারীর যারা ভালোবাসার প্রতীক্ষায় শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে অর্থপিপাসু স্বামীর পরকীয়া আর সিরাজ মোল্লাদের লালসাকে নিঃশেষ করতে বদ্ধ পরিকর হয়। চক্রটি গ্রাম্য জীবনের টানাপোড়েনের পাশাপাশি রকিব আর পলাশদের বন্ধুত্বের আবারও একত্রিত হওয়ার স্বপ্নের। তবে পুরো লেখনীতে আমজাদের বহুমাত্রিক চরিত্রায়নই লেখকের অন্যতম সার্থকতা যেখানে ধূর্ততা আর ক্ষমতার লোভের সাথে জায়গা পেয়েছে পিতৃপ্রেম।এছাড়া বাংলার আঞ্চলিকতাকে মৌলিকত্ব প্রদানের গুরুত্বটিও চোখে পড়ার মতো কৌশল।সবশেষে জগলু, মন্টুসহ ভবানীপুরের প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির বিন্যাস এই কালচক্র।

      By Dr. Asif Shufian Arnab

      14 Dec 2019 12:13 AM

      Was this review helpful to you?

      or

      'কালচক্র' নিঃসন্দেহে সাম্প্রতিক সময়ে পাঠ করা অনন্যসাধারণ এক সুখপাঠ্য বই যা যেকোন পাঠকের মন জয় করতে বাধ্য। আমার বিশ্বাস এ উপন্যাস এক সময় ক্লাসিকের মর্যাদা পাবে। সে দিন হয়তো বেশি দূরে নয়। পাঠক হিসেবে লেখকের প্রতি আবদার থাকবে, ভবিষ্যতে পাঠকদের এমন আরো সুন্দর লেখা উপহার দেবেন। শুভকামনা রইল। আর সাহিত্যমান সমৃদ্ধ ব্যতিক্রমি লেখা পড়তে চাইলে কালচক্র এই সময়ের মাস্টার পিস। পড়ে দেখার আমন্ত্রণ রইল।

      By Safikul Islam Jihad

      12 Sep 2019 01:43 PM

      Was this review helpful to you?

      or

      মৃত এক শিল্প অঞ্চল এবং এর অধীনস্থ মানুষদের আনন্দ-বেদনা, সুখ-দুঃখ, ভাঙা-গড়া আর বৈচিত্র্যময় জীবনবোধ নিয়ে লেখা উপন্যাস কালচক্র এর চক্র আবর্তন বাস্তবে আমাদের মানব সমাজের প্রতিটি ঘটনায় লুকিয়ে আছে। উপন্যাসের প্রতিটি চরিত্রকে লেখক খুব সুন্দরভবে ফুটিয়ে তুলেছেন। উপন্যাসটি খুলনার আঞ্চলিক ভাষায় রচিত হলেও সেখানে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ভাষা সামান্য সংযোজিত হয়েছে, যেটা বর্জন করলে উপন্যাসটি আরো সুন্দর রূপ পেত। মুদ্রণজনিত কারণে উপন্যাসের কিছু কিছু শব্দের বানান ভুল থাকলেও আব্দুল্লাহ আল ইমরানের কালচক্র উপন্যাসটি আধুনিক বাংলা সাহিত্যের নতুন সংযোজন এবং পাঠক মহলে এটি যথেষ্ট প্রশংসার দাবি রাখে।

      By Durdana Chowdhury

      14 Sep 2019 11:30 AM

      Was this review helpful to you?

      or

      কথাসাহিত্যিক আব্দুল্লাহ আল ইমরানের উপন্যাস কালচক্র পড়ে শেষ করলাম। এক কথায় আমি বিমোহিত! বইটি নিয়ে কয়েকটি কথা না বললে অন্যায় হবে। প্রথমেই সরল স্বীকারোক্তি জানাচ্ছি যে, শুরুতে আমি বইটা হাতে নিয়েছিলাম এই ভেবে যে, লেখক একজন জনপ্রিয় মানুষ, তার জন্যেই হয়তো বইটির এতো ভালো রিভিউ, চারিদিকে এতো প্রশংসা! পড়া শেষে বারবার মনে হচ্ছে, এ ভুল ধারণার জন্যে আমি খুব লজ্জিত। এবার বইয়ের কথায় আসি। কালচক্র উপন্যাস পুরোটাই কেমন মায়া জড়ানো । অনেকগুলো চরিত্র উপন্যাসে। সাধারণত আমার ক্ষেত্রে যেটা হয়, অনেক চরিত্র থাকলে আমি খুব একটা মনে রাখতে পারি না।বারবার পেছন ফিরে দেখে নিতে হয়, কে কোন জন। কিন্তু কালচক্রের মহুয়া পিসি, পলাশ, পরেশ কাকা, চন্দ্রলেখা, আমজাদ প্রেসিডেন্ট কিংবা হারুনদের বেলায় এমনটা ঘটেনি। হয়তো লেখক কোনো এক অদৃশ্য সুতোয় সবাইকে এমনভাবে আটকে রেখেছেন যে, তা পাঠকের নজর কাড়তে বাধ্য। পুরো উপন্যাসজুড়ে ছোট ছোট আবেগ অনুভুতির কী অসাধারণ প্রকাশ! মিষ্টি বউদি, চন্দ্রলেখারা আমায় আচ্ছন্ন করে রেখেছে শেষ হবার পরও। মিলের দুর্নীতি, শ্রমিক নেতাদের দাপট, পাটকল এলাকার জীবনযাপন- সাবলীলভাবে উঠে এসেছে উপন্যাসের পাতায় পাতায়। আমার কাছে এএ উপন্যাসের সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন দিক এর পরিমিতিবোধ। প্রথমেই ধরে নিয়েছিলাম পলাশ চন্দ্রলেখার টিনএজ প্রেমের সুতো বোধহয় বহুদুর টানবেন লেখক। আমার ধারণা ভুল এবং ভুল হতে পেরে আমি খুব আনন্দিত। মহুয়া পিসির আত্মহত্যার মতো জটিল এবং রহস্যময় ঘটনা লেখক মাত্র এক লাইনে এবং অপ্রত্যাশিত এক চরিত্রের কথনে শেষ করে দিয়েছেন। এর মধ্য দিয়ে লেখক যে আশ্চর্য পরিমিতিবোধ দেখিয়েছেন তা বোধহয় বহুদিন গেথে থাকবে আমার মনে। নিজ ভিটা-মাটি ছেড়ে যেতে কেমন লাগে?কেমন লাগে চিরচেনা পরিবেশ ছেড়ে চিরতরে চলে যেতে? আশালতা দেবীর সে অনুভুতি আমাকেও ওই একই ভাবনায় ডুব দিতে বাধ্য করেছিলো। সবমিলে কালচক্র সুখপাঠ্য এক উপন্যাস। আমার বিশ্বাস, যতো দিন যাবে, এ উপন্যাস বিদগ্ধ পাঠকের নজর কাড়বে। কালচক্র হবে কালোত্তীর্ণ । লেখকের অন্য বইগুলো পড়ার অপেক্ষায় আছি। একটি ভালো বই পড়লে তার কথা ছড়িয়ে দিতে হয়। তাই সবাইকে কালচক্র পড়ার আমন্ত্রণ রইল।

      By Md. Mahadi Hassan

      19 Jul 2019 01:58 AM

      Was this review helpful to you?

      or

      কালচক্রঃ কালের স্রোতধারায় জীবনের প্রতিচ্ছবি। বিগত কয়েকবছর ধরে বাংলা সাহিত্যে থ্রিলার ও অনুবাদের যে জোয়ার চলছে, তার মধ্যে সামাজিক উপন্যাস প্রায় চোখেই পড়ে না। হাতে গোনা যাও বা দু একটা লেখা হচ্ছে, তার একটা বড় অংশ জুড়ে রয়েছে প্রায় গতানুগতিক রোমান্টিক উপন্যাস, আর বাকিটা জুড়ে হুমায়ুন আহমেদীয় স্টাইলের মধ্যবিত্ত বা নিন্মবিত্তের জীবন নিয়ে উপন্যাস। এরকম একটা সময়ে কেবল স্রোতের বিপরীতে গিয়ে সামাজিক উপন্যাসই শুধু নয়, সুনির্দিষ্ট করে বলতে গেলে কোন একটা আঞ্চলিক জনগোষ্ঠী বা জনপদকেন্দ্রিক উপন্যাস রচনার দিকে হাত দেয়াটাই একটা বিশাল কৃতিত্বের কাজ বলে মনে করি। এবং সে কাজটা যখন অনায়াসে যথাযথ মুন্সিয়ানার সাথে সম্পন্ন করে তোলেন লেখক; তাও একজন নতুন, তরুন লেখক, তখন স্বাভাবিকভাবেই তার প্রতি শ্রদ্ধার ভাব চলে আসে৷ সত্যি বলতে এই আয়োজনের আগে আমি লেখক আবদুল্লাহ আল ইমরানের লেখার সাথে পরিচিত ছিলাম না একেবারেই। ধন্যবাদ এই আয়োজনকেও, এরকম চমৎকার একজন লেখকের খোজ পেলাম বলে। "কালচক্র" সামাজিক উপন্যাস । সুনির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে এটি জনপদকেন্দ্রিক উপন্যাস। যেমনটি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের "পদ্মানদীর মাঝি", তারাশংকরের " হাসুলিবাকের উপকথা" বা অদ্বৈত মল্লবর্মনের "তিতাস একটি নদীর নাম"। পদ্মানদীর মাঝি যেরকম পদ্মা ও তার নদী তীরবর্তী জেলেদের জীবনসংগ্রামকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে, তেমনই " কালচক্র" উপন্যাস গড়ে উঠেছে ভৈরব নদী আর তার তীরবর্তী নয়নতারা পাটকলকে কেন্দ্র করে। এধরনের উপন্যাসে সাধারণত কেন্দ্রীয় কোন চরিত্রের চেয়ে সেই এলাকার, এলাকার মানুষের সামগ্রিক জীবনটাই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র হয়ে উঠে৷ কালচক্রও এর ব্যাতিক্রম নয়। উপন্যাসের শুরুটা ভৈরবের তীরবর্তী ভবানীপুর গ্রামের ঠাকুরবাড়িতে, প্রাচীন ও সম্ভ্রান্ত এই ঠাকুরবাড়ির এক অন্তঃপুরবাসিনী মহুয়ার আত্মহত্যার মধ্য দিয়ে। গায়ের লোকের কানাকানিতে শোনা যায়, আত্মহত্যার সময় মহুয়ার পেটে বাচ্চা ছিল। ঘটনা সত্যি কি না, আর সত্যি হলেও অবিবাহিতা মহুয়ার এমন সর্বনাশের জন্য দায়ী কে সেটা নিয়ে গাঁয়ের লোকদের মত পাঠকদের মনেও কৌতূহল জেগে উঠে৷ গল্পের আরেকদিক, এবং মূল সুর যেটা, সেটা নয়নতারা মিল, মিলের আভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও এই মিলকে কেন্দ্র করে জীবিকা নির্বাহ করা নিম্নবিত্ত মানুষের জীবনধারা, তাদের সুখ দুঃখ, বঞ্চনার, প্রতারনার ইতিহাস নিয়ে। যে মিলে আছে আমজাদ প্রেসিডেন্টের মত সুচতুর স্বার্থান্বেষী শ্রমিক নেতা, সোলায়মান মিয়ার মত সহজ সরল কিন্তু ভাবুক সাধারণ শ্রমিক, কিংবা বিষ্ণুর মত বোকা মাতাল আর জগলুর মত মনিব আন্তঃপ্রাণ কর্মচারীর কথা৷ আর তাদের ঘিরে লতায় পাতায় জড়িয়ে আছে হারুন, মিষ্টি বৌদি, নাজিমুদ্দিন, সিরাজ মোল্লা, মন্টুর মত আরো অসংখ্য চরিত্র। ঠাকুরবাড়ির আভিজাত্য আর মিলের শ্রমিকদের দারিদ্রতার মধ্যে যোগসূত্র স্থাপনকারী দুই চঞ্চল কিশোর কিশোরী, চন্দ্রলেখা আর পলাশ৷ সাদামাটা ভাবে বলতে গেলে এটাই উপন্যাসের প্লট। বাস্তবিক অর্থেই মাত্র ২০০ পেইজের উপন্যাসে লেখক সমাবেশ ঘটিয়েছেন বেশ কয়েকটি চরিত্রের, সুতো ছড়িয়েছেন তাদের অনেক রকম গল্পের। কিন্তু উপন্যাস শেষে এত সুন্দর করে সব সুতোর জোড়া দিয়েছেন, অবাক, বিস্মিত হতে হয়। বিপুল চরিত্র আর বেশ কয়েকটা সাবপ্লটের পরেও খেই হারিয়ে না ফেলা, লেখকের চূড়ান্তরকম মুন্সিয়ানায় পরিচয়। উপন্যাসের মূল এন্টাগনিস্ট বলা যায় আমজাদ প্রেসিডেন্টকে, ব্যাপ্তি, বৈচিত্র্য আর উপস্থিতিতে যে কিনা প্রটাগনিস্ট পলাশকেও ছাড়িয়ে গেছে। তার চরিত্রের এত রকম শেড দেখা গেছে, মুগ্ধ হতে হয়। আমজাদ একাধারে ধূর্ত শ্রমিক নেতা, চতুর তেল ব্যাবসায়ী বা তেল চোর, দয়ালু মনিব, মমতাবান পিতা আবার রাজনৈতির মঞ্চের পাকা খেলোয়ারও৷ ক্ষমতাশালী হিসেবে সে দরিদ্র বা অসহায়ের অসহায়ত্বের সুযোগ নিবে, এ তো স্বাভাবিক, কিন্তু একটা মিলের শ্রমিক নেতা হয়েও ঘোড়া ডিঙ্গিয়ে ঘাস খাওয়ার মত করে এলাকার চেয়ারম্যানের উপরে টেক্কা নেয়াটা বেশ মজার, তৃপ্তিকরও বটে। এদিকে আমজাদ চেয়ারম্যান যেমন ধূর্ততা, ক্ষমতা, আর চালাকির মূর্ত প্রতীক, একেবারেই তার উলটো সোয়ামান মিয়া, আবেগী, বেখেয়ালি, সরল আর উদাস। বউ বাচ্চার সখ আহ্লাদের কথা বাদ দিয়েও পেটে ভাত জোগাতে পারে না বলে তার যেমন মন খারাপ হয়, নিজেকে ব্যার্থ মনে হয়, দুটো রোজগার বেশি করার চিন্তা মাথায় আসে, তেমনি জ্বর আক্রান্ত মুমূর্ষু বাউলের চিকিৎসার জন্যে সংসার চলবে না জেনেও নিজের বেতনের টাকা খরচ করতে সে দুবার ভাবে না। আমজাদ প্রেসিডেন্টের ক্ষমতার খেলায় শেষমেশ সোলায়মানের যে পরিনতি, এ তো হওয়ারই ছিল। যুগে যুগে, দরিদ্র সরল মানুষ গুলো তো এভাবেই নিজের জীবন পর্যন্ত বিসর্জন দিয়ে দিচ্ছে ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতার দৌড়ে। তাই আমাদের সোলায়মানের বোকামির জন্য রাগ হয় না, মায়া হয়। বিষন্নতার সাথে আমরা ভাবি, আহারে... এত রকমের চরিত্রের ভিড়ে পাঠকের মন কেড়ে নেয় কলোনির মিষ্টি বৌদি, আর ঠাকুরবাড়ির বৃদ্ধা আশালতা। নয়নতারা কলোনির এই মিষ্টি; ক্ষুধা-দারিদ্রে-প্রেমে-কামে সবাই যেখানে এক ছাঁচে গড়া, সেখান্র এই এক মিষ্টি যেন আর সবার চেয়ে আলাদা। রূপে আর দশজনের চেয়ে আলাদা, সেটা ঠিক আছে। কিন্তু তার স্বভাব, তার চলন, তার জীবনদর্শন, তার ভালবাসা নিয়ে যে মিষ্টি, সে মিষ্টি স্বতন্ত্র, নিজ মহিমায় ভাস্বর। মিষ্টি সুন্দরী, নিজের দেহের প্রতি পুরুষের লোভ সম্পর্কে সে সচেতন। কখনও বা তাদের দৃষ্টিতে প্রশংসা সে উপভোগও করে, কিন্তু নিজেকে সে সহজলভ্য করে নি৷ স্বামীর সংসারে অভাব, স্বামী সোহাগের অভাব কিংবা কোল জুড়ে একটা সন্তানের অভাব, কোন কিছুই মিষ্টির পদস্থলনের কারন হয় নি। বরং স্বামী পরনারীতে আশক্তি জেনেও, কারনে অকারনে স্বামীর শারীরিক নির্যাতন সহ্য করেও মিষ্টি বিষ্ণু অপেক্ষায়ই থাকে৷ মিষ্টির ভালোবাসা, ভাবনা, জীবন দর্শন আমাদেরও ভাবায়৷ ভীষন এক অজানা আবেগে আমরাও কি সারাটাজীবনই ভুল মানুষের কাছেই প্রত্যাশা করে যাই না? প্রতীক্ষায় থাকি না, একদিন ভুল মানুষটাই সঠিক হয়ে উঠবে? টেনে নিবে বুকের কাছে? কিন্তু মিষ্টির মত আমাদেরও সেই অনন্ত প্রতীক্ষার অবসান হয় কি? উপন্যাসের সবচেয়ে সুন্দর আর করুন দুটি দৃশ্যের একটি মিষ্টির দখলে। সেটা বিষ্ণুর মৃত্যু। সত্যিকার অর্থে আসলে মিষ্টির ভালোবাসার মৃত্যু৷ যে মিষ্টি শত অভাব অনটন, অবজ্ঞা, নির্যাতনের পরেও এক বিষ্ণর ভালোবাসাই চেয়ে এসেছে, হারুনের নিষ্পাপ ভালোবাসাকে উপেক্ষা করে, সেই মিষ্টির ভেতর থেকে যখন ভালোবাসা মরে যায়, পাঠক হৃদয় বেদনায় হুহু করে উঠে৷ দয়িতের প্রতি যে ভালোবাসা, সেই ভালোবাসার মৃত্যুর চেয়ে নির্মম আর কি হতে পারে? সেই শোকেই হয়তোবা মিষ্টির ঘোর ভাঙ্গে, নিজ হাতে তার অসুরবধের আনন্দ যেন তাই তার ভালোবাসার মৃত্যুর কাছে ম্লান হয়ে যায়। পাঠকের মনে লেগে থাকে। লাল টুকটুকে শাড়ীতে, রক্তমাখা দেবীরূপী মিষ্টির জন্য তাই আমাদের ভীষণ মমতাবোধ হয়৷ দুইটি করুন আর সুন্দর দৃশ্যের কথা হচ্ছিল। এর অপরটি বৃদ্ধা আশালতার স্বামীর ভিটে ছেড়ে কলকাতা গমনের আগ মুহুর্তে তুলসিতলায় প্রদীপ জ্বালানোর দৃশ্য৷ এই একটা দৃশ্যে, স্বল্প উপস্থিতিতে লেখক পুরো গ্রাম বাংলার শাশ্বত নারী রূপ ফুটিয়ে তুলেছেন পরম মমতায়৷ " আশালতা দেবী জবাব দিলেন না। সোজা হেটে গিয়ে থামলেন ঘরের দাওয়ার সামনে। নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে পড়লেন তার ঘর বরাবর। চৌকোনা ইটের বেষ্টনিতে মাটি ভরে তুলসি গাছ লাগিয়েছিলেন তিনি। গাছটার গায়ে আলতো করে হাত বোলালেন৷ বিড়বিড় করে কিছু বললেনও। কয়েক মুহূর্ত পর চাদরের নিচ থেকে ছোট্ট একটা প্রদীপ বের করলেন তিনি। শাড়ির আঁচলে বাধা দিয়াশলাইয়ের কাঠিতে আলো জ্বাললেন। পিটপিট করে জ্বলতে থাকলে সলতেটা। আঁধার কেটে মৃদু আলোর রেখা ছড়িয়ে পড়লো চারদিকে৷ আশালতা দেবী সামান্য পিছিয়ে এলেন। দুই হাত জুড়ে মাথায় ঠেকিয়ে প্রনাম করলেন দাওয়ায়। সহসাই সেই প্রনাম শেষ হলো না..." এই একটা দৃশ্য, স্বল্প কিন্তু শক্তিশালী এই দৃশ্যটুকুই, গোটা উপন্যাসের মাহাত্ম্য বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েক গুন। শেকড় ছাড়ার কষ্ট, নাড়ি উপড়ে ফেলার বেদনা, সাম্প্রদায়িকতার অসহায়ত্ব এত করুণ ভাবে ফুটে উঠেছে এ দৃশ্যটাতে, বুকের ভেতর বেদনায় মুচড়ে উঠে। আশালতা দেবীর চোখে সেই দিন জল ছিল হয়তো, হয়তো না। অন্ধকারে তা টের পাবার উপায় ছিল না, তবে আমার চোখে জল এসেছে। প্রাঞ্জল ভাষা উপন্যাসের প্রধান গুন। তারচেয়েও যেটা ভালো লেগেছে, অসম্ভব সুন্দর সব চিত্রকল্প, উপমা, উৎপ্রেক্ষার ব্যাবহার৷ "হাতের মুঠোয় হাওয়াই মিঠাই জীবন", " মন খারাপের বিবর্ন সামিয়ানা ", "মনের আকাশে বিষন্নতার ঘুড়ি", কিংবা "শালিক পাখির মতন ছোট্ট বুক"... এরকম শব্দগুচ্ছের ব্যাবহারে হঠাৎ হঠাৎ থমকে যেতে হয়। দু তিনবার আউড়ে নিয়ে পড়ে তৃপ্তি নিয়ে এগিয়ে যাই। উপন্যাসে কবিতার স্বাদ দেয়া সহজ নয়, আব্দুল্লাহ আল ইমরান এতেও স্বার্থক। কিন্তু তারচেয়েও বড় মুন্সিয়ানা বোধহয় লেখক দেখিয়েছেন চরিত্রগুলোর মনোজগৎ বিশ্লেষণের মাধ্যমে তাদের জীবন দর্শনের সাথে পাঠকের পরিচয় ঘটিয়ে। বিশেষত নারীমন বিশ্লেষণে লেখক অপ্রতিদ্বন্দ্বী, যার প্রমাণ পাওয়া যায় উপন্যাসের পৃষ্ঠায় পৃষ্টায়। বিশেষত মিষ্টির মাধ্যমেই লেখক প্রায় সমগ্র নারী জাতির অন্তর্জগতকে ফুটিয়ে তুলেছেন নিপুন শিল্পীর চোখে৷ ছোট খাটো দু একটা বিচ্যুতি মন খারাপ করে দেয়া। আঞ্চলিক উপন্যাস হিসেবে চরিত্রদের মুখে আঞ্চলিক ভাষা লেখার শিল্পগুন বাড়িয়ে দিয়েছে নিঃসন্দেহে। কিন্তু ঠাকুরবাড়ির মত সম্ভ্রান্ত পরিবারের মধ্যে আঞ্চলিকতা একটু চোখে লাগে। নরেশ ঠাকুরের কথায় আঞ্চলিকতা ছিল না, কিন্তু বৃদ্ধা আশালতার মুখে আঞ্চলিকতা কিছুটা চোখে লেগেছে। এরকম বংশের প্রাচীন একজন নারীর মুখে হয়তো শুদ্ধ বাংলাই বেশি মানাতো। তেমনি স্কুল পড়ুয়া চন্দ্রলেখার মুখেও। আর ২য় অধ্যায়ের পরে হায়দারের অনুপস্থিতিও সচেতন পাঠকের চোখে পড়বে৷ যেখানে ছোট বড় অন্য সব চরিত্রই পরিনতি পেয়েছে, সেখানে হায়দারকে একেবারেই ভুলে যাওয়াটা কিছুটা অস্বাভাবিক লেগেছে। সমগ্র উপন্যাসের প্রতিটা চরিত্র নিয়ে আলোচনা করতে গেলে আরেকটা উপন্যাস হয়ে যাবে বলে এখন মনে হচ্ছে। অথচ আমার বলা হলো না হারুনের সরল, নিষ্পাপ প্রেমের কথা, সাজিয়া বেগমের মত বাংলার ঘরে ঘরে থাকা আমাদের মায়ের কথা, যারা দশভুজার মত নিজের সন্তানের মুখে দুমুঠো অন্নের জন্য আকাশপাতাল এক করে ফেলতে পারে৷ বাদ রয়ে গেলো নাজিমুদ্দিনের কথা, সারাজীবন যে লোভ থেকে দূরে থেকেও শেষ বয়সে তার লোভের কারনে সর্বশান্ত হওয়ার কথা, কিংবা যে মন্টু ডাকাত, তার হৃদয়েও থেকে যাওয়া কোমলতার কথা। এরাতো সব আবহমান বাংলার প্রান্তিক জনগোষ্ঠীরই প্রতীক। সিরাজ মোল্লার মত ভন্ডদের আমাদের সমাজে খুজে পাওয়া মোটেই কঠিন নয়, তেমনি কঠিন না নরেশ ঠাকুরের মত চরিত্রের দেখা পাওয়াও। কালে কালে, সময়ের বিবর্তনে তো এরাই ঘুরে ফিরে আসছে, হয়তো নতুন নামে, নতুন পরিচয়ে। কিন্তু এই যে হিংসা, প্রতারণা, কামনা, লোভ, বিচ্ছেদ, প্রেম, কলহ, শোষন... এ সবই তো সময়ের স্রোতে ঘুরে ফিরে আসছে আমাদের জীবনে, নয়নতারা মিলের মানুষদের জীবনে। আমজাদ চেয়ারম্যানের মত ক্ষমতাশালীরা সব সময়ই যেখানে ক্ষমতাসীন থাকবে, সোয়ামানের মত সাধারণ জনতা ঘুটি হবে ক্ষমতাসীনদের খেলার, হয়তো মরবে কিংবা অথর্ব হয়ে যাবে৷ তারপর শোষন স্থানান্তরিত হবে পরবর্তী প্রজন্মে, যেমন সোলায়মানের স্থলাভিষিক্ত হয়েছে পলাশ। এমনি করেই তো জীবন কাটে। বয়ে চলে। চক্রাকারে ফিরে ফিরে আসা এইসব নিয়েই আমাদের কালচক্রের জীবন,যে জীবন জীবনের প্রতিচ্ছবি।

      By Sinthia shobnom

      02 Jul 2019 04:31 AM

      Was this review helpful to you?

      or

      ‌অসম্ভব পরিণত লেখা।বার বার পড়ার মত একটা বই।

      By Bibi Rasheda Afrin Rumi

      30 Jun 2019 11:28 PM

      Was this review helpful to you?

      or

      #রকমারি_রিভিউ_প্রতিযোগ_জুনঃ কালচক্র" বহমান জীবন চক্রের ইতিবৃত্তঃ জীবন স্রোতস্বিনী নদীর মত বহমান। কখনো সরল গতিতে, কখনো বিভিন্ন বাঁকে বয়ে চলে। ক্ষণস্থায়ী এই জীবনে রয়েছে কত রূপ, রং, কত বৈচিত্র্য। সংক্ষিপ্ত এই জীবনের গল্পও কি কম থাকে? থাকে কত গল্প, কত স্বপ্ন, থাকে উত্তান-পতন। কালচক্র এমনই নানান বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবনের উপাখ্যান। গল্প টা ভৈরব নদীর তীরে ছবির মত দেখতে সুন্দর একটি গ্রাম ভবানীপুরের গল্প। যেখানের অধিকাংশ মানুষই নয়নতারা পাটমিলের শ্রমিক। সেই পাটকলের মাধ্যমেই তারা তাদের জীবন নির্বাহ করে থাকে। গল্পটা সেখানের মানুষের সুখ-দুঃখ, উত্তান-পতনের গল্প। ঠাকুরবাড়ির রক্ষণশীল হিন্দু পরিবারের শান্তশিষ্ট, বিনম্র মেয়ে মহুয়া। যার আত্মহত্যা সারা গ্রামে হৈচৈ ফেলে দেয়। মহুয়ার এমন আত্মহত্যা নিয়ে জল্পনাকল্পনা শুরু হয়ে যায়। এটা নিয়ে মানুষের কৌতুহলের যেন শেষ নেই। এই আত্মহত্যার ঘটনায় রাতারাতি পাল্টে যায় ঠাকুর বাড়ির পরিস্থিতি। পাল্টে যায় দুটি কিশোর - কিশোরীর জীবন। তবে কি মহুয়ার আত্মহত্যার সাথে সাথে তাদের স্বপ্নেরও ইতি ঘটবে? কেন আত্মহত্যা করতে গেলো মহুয়া? কি এমন ঘটেছিল যার কারণে নিজের জীবনটাই শেষ করে দিলো? গল্পটা আমজাদ প্রেসিডেন্টের। যে কিনা বেশ কয়েকবছর ধরে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নয়নতারা মিলের প্রেসিডেন্ট হয়ে আসছে। এখন আর তাকে শুধু আমজাদ বললে কেউ চিনে না। নামের সাথে প্রেসিডেন্টও যোগ করতে হয়। ক্ষমতা এমন এক জিনিস যেটার জন্য যুগ যুগ ধরে কতশত যুদ্ধ বিগ্রহ হয়ে আসছে। সবাই ক্ষমতা চায়। যেটার জন্য মানুষ প্রাণ দিতে বা নিতেও দ্বিধা করে না। কেউ যদি একবার ক্ষমতা পেয়ে যায় তাহলে আর সেটা ছাড়তে চায় না। ক্ষমতা একটা নেশার মত। একবার পেয়ে বসলে ছাড়া বড় কঠিন। আমজাদ প্রেসিডেন্টকেও সে নেশায় পেয়েছে। কিন্তু হঠাৎ করেই তার এই ক্ষমতার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় ওই মিলেরই এক শ্রমিক রাজু। তবে কি এবার শ্রমিক ইউনিয়নের ক্ষমতার চাবি আমজাদ প্রেসিডেন্ট এর হাতছাড়া হয়ে যাবে? নাকি ক্ষমতায় বহাল থাকার জন্য প্রেসিডেন্ট অন্যকোন চাল দিবেন? গল্পটা সোলায়মান মিয়ার। যিনি সারা সপ্তাহ মিলে কাজ করে যখন বৃহস্পতিবার চেক পায়, তখন আর হুঁশ থাকেনা। গান পাগল মানুষটি গানের আসরে গিয়ে বুঁদ হয়ে থাকে। টাকা ওখানেই খরচ করে আসে। যার ফলে পুরো সপ্তাহ টা খুব হিসেব করে চলতে হয়। মাঝরাতে যখন বাড়ি ফিরে তখনো তার বউ ভাত নিয়ে পথ চেয়ে থাকে। সোলায়মান মিয়ার তখন নিজেকে খুবই অপরাধী মনে হয়। বউকে প্রতিশ্রুতি দেয় আর এমন হবে না। সোলায়মান মিয়ার স্ত্রীর খুব ইচ্ছা হয় স্বামীর প্রতিটা কথা বিশ্বাস করতে। কিন্তু সে জানে সপ্তাহ শেষে সোলায়মান মিয়া প্রতিশ্রুতির কথা বেমালুম ভুলে যাবে। সোলায়মান মিয়া কি এভাবেই প্রতিনিয়ত দায়িত্ব এড়িয়ে যাবেন? আচ্ছা হারুনের চোখে মিষ্টি বউদি যা দেখতে পায়, সেটা কি নিছকই কৌতুহল? নাকি অন্যকিছু? জগলুর বাচ্চার প্রতি তার মালিক আমজাদ প্রেসিডেন্টের যে টান ভালোবাসা, সেটা পিছনে কারণ কি? গল্পটা পলাশ ও চন্দ্রলেখার গল্প। যারা ভিন্ন ধর্মের হয়েও একই প্রান্তে এসে মিশে গিয়েছিলো। একজন মুসলমান এবং দরিদ্র পরিবারে ছেলে, অন্যজন কঠোর রক্ষণশীল সম্ভ্রান্ত হিন্দু পরিবারের মেয়ে। সমাজের কোন বাঁধা, বিধি নিষেধ যাদের কাছে পরাজিত হতে পারেনি। কি হবে তাদের ভবিষ্যৎ? তারা কি পারবে সমাজের সকল কিছুর উর্ধ্বে গিয়ে এক হতে? ভৈরব নদীর তীরে ভবানীপুরে গড়ে উঠা নয়নতারা পাটমিল। যেখানে রয়েছে অসংখ্য শ্রমিক। যাদের একমাত্র আশা ভরসা এই পাটমিলের চাকরি। যেটার মাধ্যমে তারা হাজারো সুখের স্বপ্ন বুনে। কিন্তু একদিন সেই পাটকল নেমে এলো চরম বিপর্যয়। শেষ পর্যন্ত কি হবে সেই শ্রমিকদের? গল্পটা মহুয়া পিসির আত্মহত্যা দিয়ে শুরু হলেও কাহিনীর পরিক্রমায় আসে নানান চরিত্র। যাদের আকুতি, পাওয়া, না পাওয়া ফুটে উঠে এই উপন্যাসে। জীবন একটি ঘূর্ণায়মান চক্র। এই চক্রটি প্রতিনিয়ত ঘুরতে থাকে। মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠের মত মানুষের জীবনেও রয়েছে দুটো দিক। এগুলো হলো সুখ ও দুঃখ। কথায় আছে দুঃখের পর সুখ আসে, সুখের পর দুঃখ। সত্যিই কি তাই? সবার জীবনেই কি সুখ ধরা দেয়? নাকি কারো কারো জীবনে সুখেরা অধরা থেকে যায়? এমনই সব পাওয়া, না পাওয়া, বাস্তবতা নিয়েই এই উপন্যাসের কাহিনী এগিয়েছে। পাট আমাদের দেশে একটি অন্যতম প্রধান শিল্প। বাংলাদেশে যে পরিমাণে পাট উৎপাদনে সম্ভাবনা রয়েছে। পৃথিবীর আর কোথাও তেমন সম্ভাবনা নেই। পাটকে আমাদের দেশের সোনালি আঁশ বলা হয়। কিন্তু কালের পরিক্রমায় এই শিল্প আজ ধ্বংসের মুখে। বাংলাদেশে পাট শিল্পকে কেন্দ্র করে একটি পরিপূর্ণ উপন্যাস হয়েছে কিনা আমার জানা যায়। লেখককেরা কেন যেন এই বিষয়টা এড়িয়ে গিয়েছেন। কিন্তু আজকের এই সময়ে এসে, এই উপন্যাসের মাধ্যমে লেখক আবদুল্লাহ আল ইমরান আমাদের সেই শিল্পকে সাহিত্যের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। তুলে ধরেছেন পাট কলের শ্রমিকদের জীবন ধারণ, সুখ-দুঃখ ও নানান অজানা কথা। এটা পড়ে তাদের সম্পর্কে কিছুটা হলেও ধারণা পেয়েছি। উপন্যাসটি নানান আবর্তনে পরিবর্তন হলেও মূলত একটা পাট মিলকে কেন্দ্র করেই এগিয়েছে পুরো কাহিনী। যে ঐতিহ্য একটু একটু করে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের থেকে, লেখক সেটাকেই তার উপন্যাসের মাধ্যমে আবদ্ধ করেছেন। পলাশ কি জানে পৌষের রাতেরা বড় দীর্ঘ হয়! জীবনের সব চাওয়া-পাওয়ার হিসেব কি মিলবে? পলাশ ও চন্দ্রলেখা, মিষ্টি বউদি ও হারুনের মাধ্যমে লেখক নিখাদ এক ভালোবাসা ফুটিয়ে তুলেছেন। যে ভালোবাসা সমাজের সকল কিছুর ঊর্ধ্বে। যে ভালোবাসা সমাজের নিষ্ঠুরতাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে দেয়। "রাজনীতি বিষয়টাই বেঈমানির। যে যত বেশি বেঈমানি করতি পারব, সে তত বেশি ওপরে উঠব, বড় নেতা হইব।" কথাগুলো আমজাদ প্রেসিডেন্টের। ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য মানুষ ঠিক কি কি করতে পারেন, সেটা আমজাদ প্রেসিডেন্ট এর মাধ্যমে লেখক ফুটিয়ে তুলেছেন। রাজনীতি যে ঠিক কেমন হতে পারে, তা আমরা আমজাদ প্রেসিডেন্ট এর কথাগুলোা থেকেই বুঝতে পারি। প্রতিটি উপন্যাসে অসংখ্য চরিত্র থাকলেও, কিছু নির্দিষ্ট চরিত্র থাকে যেগুলো কেন্দ্রীয় চরিত্র। কিন্তু এই উপন্যাসে নির্দিষ্ট কিছু চরিত্রকে কেন্দ্রীয় চরিত্র বললে বড্ড ভুল হয়ে যাবে। কারণ এই উপন্যাসে প্রতিটি চরিত্রই সমান গুরুত্ব বহন করে। লেখক প্রতিটি চরিত্রকেই পরম যত্ন ও মায়া দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন। আমার কাছে এটি একটি চরম মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস বলে মনে হয়েছে। বইয়ের প্রতিটি লাইনে রয়েছে গভীর ভাবপূর্ণ কথা। পুরো উপন্যাস জুড়ে লেখক অসংখ্য উপমা দিয়েছেন। যা খুব ভালো লেগেছে। বইটা পড়ার সময় পাঠকেরা একটা ঘোরের মধ্যে চলে যেতে বাধ্য। "শর্তহীন মনের কথা খুলে বলতে প্রতিটা মেয়েই একটা নির্ভরতা খোঁজে। সংসারে বহুবিধ টানাপোড়নে, অপ্রাপ্তির হতাশায় ডুবে যেতে যেতে মনে অসংখ্য বেদনা জন্মায়। সেইসব স্পর্শকাতর বেদনার গল্প শোনার মানুষ থাকেনা। এ এক অদ্ভুত একাকীত্ব।" লাইনগুলোর মাধ্যমে লেখক একটা নিঃসঙ্গ মেয়ের মনের তীব্র আকুতিকে ফুটিয়ে তুলে ধরেছেন। "বাগানবাড়ির মস্ত লিচু গাছের ডালে সুতোয় বাঁধা পুতুলের মতো দুলছেন মহুয়া পিসি। একবার ডানে, একবার বাঁয়ে।" এভাবে নাটকীয়তার মাধ্যমেই শুরু হয় এই উপন্যাস। প্রথম দুই লাইনেই পাঠক মনোযোগ দিতে বাধ্য। হুমায়ূন আহমেদের একটা বইয়ে পড়েছিলাম, একজন লেখকের সবচেয়ে বেশি কঠিন হয়ে দাঁড়ায় কোন বইয়ের প্রথম পৃষ্ঠা লিখতে। শুরু টা করতে পারলে পরে সবগুলো নিজ থেকেই এগুতে থাকে। সাধারণত অধিকাংশ উপন্যাসেই শুরুটা হয় অত্যন্ত সাদামাটা ভাবে। এই বইয়ে লেখক প্রথম লাইনেই পাঠকদের চমকে দিয়েছেন। উপন্যাসের শুরুতেই মহুয়া পিসি আত্মহত্যা করলেও, পুরো বইয়ে মহুয়া পিসির আবেদন এতটুকু কমে যায়নি। কথায় আছে, "সে মরে গিয়ে প্রমাণ করলো যে সে মরেনি।" মহুয়া পিসির ক্ষেত্রেও এই কথা খাটে। পুরো উপন্যাস জুড়েই তিনি নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছিলেন। বিষয়বস্তু উপস্থাপন ও ভাষা প্রয়োগের ক্ষেত্রে লেখক দারুণ দক্ষতা দেখিয়েছেন। প্রিয় উক্তিঃ ♦ভালোবাসার অপরাধী মানুষগুলোকে আমরা সারাজীবন ক্ষমা করতে পারিনা। ♦জগতে যত কঠিন কাজ আছে তার অন্যতম আনন্দ চেপে রাখা। ♦জগতের সব নারীই যেন পুরুষ চোখের ভাষা বুঝবার এক অপূর্ব ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছে।

      By Reaz Morshed

      17 Jun 2019 02:07 AM

      Was this review helpful to you?

      or

      "প্রবাহমান বাংলার হাজার বছরের জীবনযাত্রার এক ধ্রুপদী চিত্রায়নের নাম 'কালচক্র'।" উপন্যাস: কালচক্র লেখক : আবদুল্লাহ আল ইমরান প্রকাশক: অন্বেষা প্রকাশন প্রচ্ছদ: সানজীদা পারভীন তিন্নি আমার ব্যক্তিগত উপলব্ধি থেকে উপন্যাসটিকে তুলে ধরতে চাই। প্রথমেই বলতে হচ্ছে- বর্তমান সময়ের প্রায় সব ভালো প্রকাশনীর বইতেই একটা লাল ফিতা থাকে, কত পাতা পড়েছি সেটার চিহ্ন রাখার জন্য। এটা খুবই দরকারি একটা জিনিস যাতে সহজেই কোন পর্যন্ত পড়েছিলাম সেটা মনে রাখা যায়। "কালচক্র" উপন্যাসটি ২০০ পাতার বই হওয়া সত্ত্বেও এই লাল ফিতেটার কোন দরকার ছিলো না। কারণ বইটি আপনি একরাতে শেষ করতে না পারলেও কতদূর পড়েছেন সেটা ভুলে যাবার কোন সুযোগই নেই। এত সুখপাঠ উপন্যাসের সাধারণত অন্তর্নিহিত তাৎপর্য ভালো থাকে না। কিন্তু এভাবে এত সহজেই এই উপন্যাসকে খারিজ করে দেয়া যাবে না। কথায় আছে- বইয়ের মলাট দেখে বইটিকে মূল্যায়ন করতে নেই (Don't Judge a book by its cover)। আর এই বইয়ের প্রচ্ছদ দেখে মূল্যায়ন করলেও আপনি এটিকে আমলে না নিয়ে পারবেন না। প্রচ্ছদটি সত্যিই দৃষ্টিনন্দন ও অর্থবহ। গ্রাফিক্সের যুগে হাতে আঁকানো প্রচ্ছদ! ব্যাপারটা ভালো লাগার মত। 'কালচক্রে'র পাঠ পর্যালোচনা করার আগে একটু বলে নিতে চাই- আমি জানি যে আপনি দু'শ পাতার উপন্যাস পড়ে একটুও ক্লান্ত বোধ না করলেও আমার দুই পাতার রিভিউ পরে হাঁপিয়ে যাবেন। এখানেই ঔপন্যাসিকের সাথে ফেসবুকারের পার্থক্য। তরুণ লেখক আবদুল্লাহ আল ইমরানের এই উপন্যাসটি আমি প্রায় বছর দুয়েক আগে পড়েছিলাম। আজ আবার পড়লাম বইটির নতুন সংস্করণ। প্রথমবারেই উপন্যাসটি আমাকে খুব আলোড়িত করেছিলো। প্রথমবার পড়ে পেয়েছিলাম খুবই আবেগ জড়িত একটা অনুভূতি, খুবই মর্মস্পর্শী উপন্যাস। এমন কিছু ঘটনার সমন্বয়ে এই উপন্যাসের প্রবাহ তৈরী হয়েছে যে আপনি পাঠক হিসেবে ধাক্কা খেতে বাধ্য। প্রথম পাঠের সময়েই লিখেছিলাম একটি ছোট্ট রিভিউ। আমি ব্যক্তিগতভাবে চেয়েছিলাম এই বইটির মধ্যদিয়ে পাঠকগণ এসময়কার তরুণ লেখকদের লেখা সম্পর্কে জানুক। আসলে আমাদের দেশের সাংস্কৃতিক মান সত্যিকার অর্থেই শোচনীয়। সেটা সংস্কৃতির যেকোনো অঙ্গনেই। বড় গাছের নিচে যেমন ছোট গাছ বেড়ে ওঠার সুযোগ পায় না তেমনি প্রতিষ্ঠিত-জনপ্রিয় লেখক ছাড়া বাকি লেখকদের বইও পাঠক সমাজ পড়তে চায় না। এই একই কথা সংগীতের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তাহলে নতুন শিল্পের আবির্ভাব কিংবা বিকাশ হবে কিভাবে? তাই কবি-ঔপন্যাসিক-গায়ক-অভিনয় শিল্পী অনেকেই শেষ বয়সে স্বীকৃতি আর অর্থের অভাবে ধুকে ধুকে ভুগে মনোকষ্ট নিয়েই বিদায় নেয় অভিমানের পাহাড় বুকে চেপে। যেমন বিদায় নিয়েছিলো মানিক বন্দোপাধ্যায়, জীবনানন্দ দাস, লাকি আখন্দের মত উজ্জ্বল নক্ষত্রেরা। এটাও জেনো এক কালচক্র। যদিও "কালচক্র" উপন্যাসের কালচক্রের আবর্তন দেখানো হয়েছে একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের শ্রমজীবী মানুষের জীবনপ্রবাহকে কেন্দ্র করে। তবুও এ জেনো আমাদের এই ভূখণ্ডের হাজার বছরের জীবন ইতিহাস। মানুষের আচরণ, আবেগ, আশা-আকাঙ্ক্ষার সাথে কিভাবে এবং কতটা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে তাদের উৎপাদন সংগ্রাম ও জৈব প্রবৃত্তি তারও একটা সুচারু নির্লিপ্ত বর্ণনা পাবেন এই উপন্যাসের পুরোটা জুড়ে। উপন্যাসের শুরু থেকেই একের পর এক রহস্যময় ঘটনার পাশাপাশি ছিলো প্রকৃতির প্রতিটি সজীব সত্তার এক অপূর্ব বর্ণনা। আপাত দৃষ্টিতে উপন্যাসের একেকটি প্লটকে নিছক কল্পনাপ্রসূত গল্প মনে হলেও সার্বিকভাবে ঘটনাগুলোর মধ্যে শুধু সঙ্গতিই নয় আছে গভীর তাৎপর্য। উপন্যাসের সাহিত্যগুণ আর শিল্পমান প্রতিটি পাঠকের চোখেই ধরা পড়বে। কিন্তু এর যে আছে বিশেষ তাৎপর্য তা প্রথমবার পড়ে আমি ততটা ধরতে পারিনি। যে রাষ্ট্র-সমাজব্যবস্থার অধীনে নৈতিক হওয়ার তেমন কোন সুযোগ নেই সেই ব্যবস্থাকে লেখক ব্যবচ্ছেদ করেছেন দারুণভাবে! পাঠ পর্যালোচনা লিখতে গিয়ে উপন্যাসের এমন কোন সংক্ষিপ্তসার লিখবোনা যাতে পাঠকের বইটি পড়াই না লাগে। তবে ঘটনাপ্রবাহটা অল্প পরিসরে উল্লেখ করছি- ভবানীপুর নামের একটি প্রত্যন্ত গ্রামে ভৈরব নদীর পাড়ে নয়নতারা পাটকলকে ঘিরে গড়ে উঠেছে ওই অঞ্চলের জনপদ। শ্রমিকদের এই নগরসভ্যতায় পলাশ, রাকিব, সোহেলদের মত অনেকের ঠাঁই হয়েছে। ভবানীপুরের অভিজাত হিন্দু পরিবারের এক আশ্রিতা মহুয়া পিসির আত্মহত্যার মধ্য দিয়েই উপন্যাসের শুরু। মহুয়ার সম্বোধন কেনো পিসি করা হলো? এর কারণ সে উপন্যাসের অন্যতম গুরত্বপূর্ণ চরিত্র- চন্দ্রলেখার মহুয়া পিসি। চন্দ্রলেখা আর পলাশ ভিন্ন ধর্মের হয়েও বন্ধুত্ব থেকে প্রেমের দিকে পা বাড়ায়। ওদের কিশোর মন মানেনা কোন সংস্কারবোধ। ওরা ব্যক্তিগতভাবে সাম্প্রদায়িকতার উর্ধ্বে গিয়ে ভালোবাসাকে আঁকড়ে বাঁচতে চাইলেও এই সমাজেই বাস করে সিরাজ মোল্লার মত ধুরন্ধর রাজনৈতিক নেতা। তাই তাদের স্নিগ্ধ প্রেমের পরিণতি পাওয়া অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। এই সিরাজ মোল্লা সাধারণ মানুষের ধর্মীয় চেতনাকে কাজে লাগিয়ে হিন্দুদের জমি দখলের ফন্দিফিকির করে চলে। অবিবাহিত মহুয়া পিসি যে গর্ভবতী অবস্থায় আত্মহত্যা করেছে এই গোপন সত্যটিকে কাজে লাগিয়ে চলতে থাকে সিরাজ মোল্লার নোংরা কূটচাল। অন্যদিকে নয়নতারা জুট মিলের শ্রমিক নেতা আমজাদ প্রেসিডেন্ট শ্রমিকদের ব্যবহার করে গড়ে তুলেছেন বিশাল সাম্রাজ্য। চোরাই তেলের ব্যবসা করে ফুলেফেঁপে উঠেছেন। তাছাড়া আমজাদ প্রেসিডেন্ট ও অন্যান্য দুর্নীতিবাজ লোকের কারণে জুট মিল ক্ষতিগ্রস্ত হতেই থাকে। পাটকল ঘিরেই ভবানীপুর গ্রামের জনজীবন আবর্তিত হয়। সপ্তাহান্তে বৃহস্পতিবার পাটকলে কাজ করা লোকজন পারিশ্রমিক পেয়ে সংসারের খরচ মেটায়। সেই টাকায়ই সরগরম হয় গোটা জনপদ। বিষ্ণুর মত কেউ কেউ আবার এই উপলক্ষ্যে নেশায় মাতে। সোলায়মান মিয়ার মত বৈষয়িকপ্রশ্নে নির্লিপ্ত সঙ্গীতপ্রেমি লোক মজে লোকসঙ্গীতের মূর্ছনায়। বিদ্যমান সমাজে অনিয়ম করে আঙুল ফুলে কলা গাছ হওয়ার সুযোগ আছে বলেই মন্টুর বাপ নাজিমউদ্দিন তেমন লোভী না হয়েও কথিত রাডার নামক সীমানা পিলার কেনার মাধ্যমে কোটিপতি হওয়ার টোপে পা দিয়ে পেনশনের জমানো টাকা হারিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে পরে। অর্থলিপ্সায় মন্টু জড়িয়ে পড়ে ডাকাতিতে। পাটকলের সাথে ভবানীপুরের মানুষের জীবনযাত্রা মৌলিকভাবে জড়িত, তাদের জীবন পাটকলের বৃত্তেই আবদ্ধ। তাই হঠাৎ পাট শিল্পের দুঃসময় এলে তার তোপে দিশেহারা হয়ে যায় পুরো জনপদ। পলাশের বন্ধু রাকিবের মত অনেককেই ভিটেবাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হয় চিরদিনের জন্য, কারো অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটে। এক অবর্ননীয় সংকটে পড়ে যায় শ্রমিক পরিবারগুলো। ঝড় একটা সময় থামে, কিন্তু রেখে যায় তার করাল গ্রাসের অস্তিত্ব। উপন্যাসের শেষদিকটা খুবই করুণ তবে মোটেই বাস্তবতা বিবর্জিত নয়। আমার মন চাইছিলো দুর্বল অসহায় লোকগুলো অন্তত একবার জিতে যাক। পলাশ অন্তত ফিরে পাক চন্দ্রলেখাকে। এমন একটা আকুলতা হয়তো লেখকেরও ছিলো কিন্তু লেখক শেষবারও আকাঙক্ষা দ্বারা পরিচালিত হলো না। আমি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ভাবলাম- চন্দ্রলেখা জেনো মহুয়া পিসিরই ধারাপ্রবাহ! লেখক গোটা উপন্যাসেই রেখেছে বুক ঢিপঢিপ করা রহস্যাভরণ তাই ঘটনা বলে দিলে পাঠক উপন্যাস পাঠের উত্তেজনা হারাবেন। তাই আর না বলাই সমীচীন হবে। ব্যক্তিগত উপলব্ধি ও মূল্যায়নঃ আমি উপন্যাসটি পড়ে মর্মাহত হয়েছি। ভাবছি উপন্যাসে খুব সঠিক কথাই বলা হয়েছে- "বোধশক্তিহীন মানুষের বেদনা কম।" এমন আরো কিছু উক্তি আমি বারবার পড়েছি যেমন- "পৃথিবীর প্রতিটি মেয়েই পুরুষ চোখের ভাষা পড়তে ও বুঝতে পারার অবিশ্বাস্য এক ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়। কোন দৃষ্টিতে দেহের ভাঁজ খোঁজে, আর কোন দৃষ্টিটা খোঁজে মন, বুঝতে অসুবিধা হয় না মেয়েদের। তবু কিচ্ছু না বোঝার মেকি অভিব্যক্তি নিয়েই চলতে হয় জীবনভর।"- লেখক "যত কঠিন মেয়েই হোক না কেনো পুরুষ মানুষের মুখের প্রশংসা নৈবেদ্যের মতো লাগে।"- লেখক আমার ধারণা মিষ্টি বৌদির একটা ভাবনা নারীপুরুষ নির্বিশেষে সকল গভীর উপলব্ধির মানুষকেই ভাবিয়ে তুলবে- "কী ভীষণ এক আবেগে সারাজীবন আমরা ভুল মানুষের কাছেই প্রত্যাশা করে যাই। প্রতীক্ষায় থাকি, একদিন ভুল মানুষটাই সঠিক হয়ে উঠবে। টেনে নেবে বুকের খুব কাছে। কিন্তু আমাদের সেই অনন্ত প্রতীক্ষার আর অবসান ঘটে না। কেটে যায় একটা জনম।" পলাশ আর চন্দ্রলেখা দুটো কৈশোর পেরোনো ছেলেমেয়ের এক দুর্লভ নিষ্পাপ ভালোবাসার মধ্যে কিভাবে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় চারপাশের সামাজিক বাস্তবতা। মূলত এই অপরিণত প্রেমবোধকে উপজীব্য করেই উপন্যাসে দেখানো হয়েছে সামাজিক অনাচার স্বরুপ ধর্মীয় বিধিনিষেধ, সাম্প্রদায়িকতা, নোংরা রাজনীতি, সম্পদের প্রতি দুর্নিবার লালসা। সমাজবিজ্ঞানী এমিল ডুর্খেইম যে বলেছিলেন - "প্রতিটি আত্মহত্যাই একটি হত্যাকাণ্ড।" সেই বিষয়টি আমাদের সামনে অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে যাবে কালচক্র উপন্যাসে মহুয়া পিসির আত্মহত্যা ও সোলায়মানের আত্মহত্যা প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে। এখানে দুটো আত্মহত্যার সাইকোলজি সম্পূর্ণ ভিন্ন হলেও একটা বিষয় স্পষ্টভাবে দেখা যায় যে আত্মহত্যার জন্য ব্যক্তির ভূমিকা যতটা গুরুত্বপূর্ণ হলে একে আত্মহত্যা নাম দেয়া ব্যক্তির ভূমিকা ততটা নয়, মোটেই নয়। আপনি যদি সত্যিই মনযোগ দিয়ে পড়েন তাহলে পড়তে গিয়ে আপনার বুক ধরফর করবে। প্রতিটি চরিত্রের প্রতিই লেখক প্রচন্ডরকম মনযোগ দিয়েছেন। চরিত্রগুলোর একটা নাতিদীর্ঘ বর্ণনা দিয়ে শুরু করিয়েছেন। এমনভাবেই তার আলোচনা শুরু করেছেন জেনো আপনি কখনো পলাশ, কখনো চন্দ্রলেখা, কখনো মিষ্টি, কখনো হারুন হয়ে যাবেন। এমনকি প্রতি মানুষের কষ্ট আপনাকে আঁচড় দিয়ে যাবে। যেমন মন্টু যখন দৌড়ে পালাচ্ছে ডিবি পুলিশের ধাওয়া খেয়ে তখন আপনি সত্যিই চাইবেন ও খারাপ হওয়া সত্ত্বেও এই যাত্রা পালিয়ে বাঁচুক। কৃষক থেকে বাঁচার তাগিদে শ্রমিক হয়ে ওঠা সোলায়মান চরিত্রটা আপাত দৃষ্টিতে পাগলাটে, খামখেয়ালি গোছের মনে হতেই পারে কিন্তু এই চরিত্রের আছে একটি দুর্দান্ত ভূমিকা। চিরকাল লোভী সিরাজমোল্লা ও আমজাদ প্রেসিডেন্টের বিপরীতে জাগতিক বিষয়ে নির্লিপ্ত এই লোকটার যে কঠিন উপলব্ধি তা আমাকে রীতিমতো ভয় পাইয়ে দিয়েছে। আমি খুব বিস্মিত হয়েছি এই চরিত্রকে দিয়ে কি দুর্দান্ত কিছু কথা শুনিয়েছেন ঔপন্যাসিক- "জীবনকে সে দেখতে চেয়েছিলেন সবার থেকে পিছিয়ে পড়ে৷ একসঙ্গে দ্রুততালে চললে জীবনকে বোঝা যায় না, বাঁধা যায় না উপলব্ধির ফ্রেমে।" গানের প্রতি তার অনুরাগ ছাড়াও তার যে ভীষণরকম স্পর্শকাতর একটা হৃদয় আছে সেটা দেখতে পেয়েছি শ্রমিকদের স্বার্থে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করার ঝুঁকি নেয়ার মধ্য দিয়ে। এই ভালোমানুষগুলোর শ্রম-ঘাম-ত্যাগে দাঁড়িয়ে আছে যে সভ্যতা তা লুটেপুটে খায় শ্রমিক স্বার্থ বিরোধী শ্রমিক নেতা আমজাদ প্রেসিডেন্ট। অন্যদিকে রাজুর মত ত্যাগী লোকেরা নেতা হতে পারে না ইলেকশন মেকানিজমের কারণে। এ জেনো আমাদের বিদ্যমান সমাজেরই বাস্তব চিত্র! কালো টাকা, পেশিশক্তি আর কূটবুদ্ধিই যে নির্বাচনের ফলাফল এনে দেয় সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়েছেন আমজাদ প্রেসিডেন্ট। নাকি লেখক নিজে? এমন আরো কিছু রহস্যের জাল ধীরে ধীরে মেলে ধরলেও কালচক্রের আবর্তন ঘটছে ভাগ্যচক্র নাকি অনিয়মচক্রের হাত ধরে সেটা মীমাংসা না করেই শেষ হয়ে যাবে অনবদ্য উপন্যাস "কালচক্র"। এই উপন্যাস পড়ে বুঝতে পারি, 'কালচক্র' সৃষ্টির পেছন রয়েছে লেখকের বিরল জীবন অভিজ্ঞতা। পাটকল এলাকায় বেড়ে উঠে লেখক এই গভীর জীবন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন। আর এই অভিজ্ঞতাকে সুন্দরভাবে সার সংকলন করতে পেরেছেন তার শিক্ষা ও কর্মজীবনের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে। যার কারণে উপন্যাসে একাধারে স্থান হয়ে ক্ষুধা, দারিদ্র্য, প্রেম, ভালবাসা, কামবাসনা, বন্ধুত্ব, হাহাকার, প্রেমের শূণ্যতা, দৈন্যতা, শঠতা, রিক্ততা, অপরাধ প্রবণতা, সাম্প্রদায়িকতা, শ্রেণিসংগ্রাম। রয়েছে অন্তহীন বাসনার সীমিত জীবনকালের জন্য জীবনসংগ্রামী মানুষের নিরন্তর ছোটাছুটি। আর সর্বোপরি কতিপয় ক্ষমতাধর জঘন্য মানুষের কাছে খেটেখাওয়া সরলপ্রাণ মানুষের জিম্মি হয়ে থাকার এক করুণ ইতিহাস। যেখানে মন্দের কাছে ভালোর হেরে যাওয়ার দীর্ঘশ্বাস থেকেই হয়তো পাওয়া যায় পরিবর্তনের তীব্র আকাঙ্ক্ষা। উপন্যাসের কয়েকটি সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশেষ দিক আছে যেগুলো আমার চোখে গুরুত্বপূর্ণ- হাতপাতালের বিছানায় মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন নাজিমউদ্দিন সে কিনা বলছে- জাহাজ ফুটো হওয়ার এমন কাহিনি গত চল্লিশ বছরেও শোনেননি। নিজের চোখে এই দৃশ্য দেখতে পারলে বেশ হতো! এখানে লেখক অহেতুক রসবোধ দেখায়নি। দেখিয়েছেন মানুষের মধ্যে যে অদম্য কৌতূহল বিরাজ করে সেটা। প্রতি অধ্যায়েই আছে ঘটনার আকস্মিকতা কিন্তু মূল গল্প প্রবাহের ছেদ পড়েনি। এমন কিছু সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বেদনা আছে এই গল্পগুলোয় যে পাঠকের দম ফেটে মরার উপক্রম হবে কিন্তু লেখক পাঠকদের কিছুটা হলেও স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে এনেছেন মিষ্টি বৌদির চরিত্রটি। আপাতদৃষ্টিতে এমন মনে হলেও মিষ্টি বৌদির চরিত্রটি খুবই প্রভাবশালী নারী চরিত্র। তার চরিত্রের মধ্য দিয়ে পেয়েছি এমন কিছু বার্তা যেগুলো আপনাকে ভাবিয়ে তুলতে বাধ্য করবে। উপন্যাসের শেষদিকে মিষ্টির আত্মকথন ছিলো অন্যতম সেরা একটি কাজ। ফ্রয়েড পরবর্তী কোন লেখকই যেমন মানুষের মন বিশ্লেষণে তাকে না ছুয়ে যেতে পারেন না তেমনি সমাজ বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে মার্কসকেও খারিজ করার কোন সুযোগ থাকে না। লেখক খুব সফলভাবেই এদের মেথড ব্যবহার করেছেন। তবে এই মেথড ব্যবহার করার জন্য তার গল্পকে কোন কাঠখোট্টা ছাঁচে ফেলে দেননি। মিষ্টি বউদির সাহসিকতা তাকে কেবল হারুনের কাছেই নয় পাঠকের কাছেও অন্যন্যা বানিয়ে তুলেছে। টনটনে ব্যথাতুর ঘটনাপ্রবাহে আমাদের একমাত্র বিজয় এসেছে এই মিষ্টি বউদির দেবী রূপটায়। উপন্যাসে চন্দ্রলেখা আর পলাশের দুটো ছোট চিরকুট আকারের চিঠির আদানপ্রদানের আছে। আরো একটা চিঠি আছে মহুয়া পিসির লেখা। আত্মহত্যার আগে একটা উপহারের বাক্সের মধ্যে ছিলো সেই চিঠিটা। এই চিঠিগুলোর যে ভাষা কথন আর পরিমিতিবোধ তা আমি লিখে প্রকাশ করতে অক্ষম। চন্দ্রলেখার চিঠিটি ওর ভালোবাসার পলাশ যেমন অনেকবার পড়েছে তেমনি আমিও পড়েছি অনেকবার। এ জেনো এক শাশ্বত চিঠি, যেনো প্রতিটি প্রেমিকের বুক পকেটেই গোঁজা থাকে এমন কিছু কথামালা। লেখক অভিজাততন্ত্রের বিরুদ্ধেও লড়েছেন প্রচ্ছন্নভাবে। তার একটা স্পষ্ট নমুনা পাবেন যখন জানতে পার যায় মহুয়া পিসির গর্ভধারণ হয়েছে কার দ্বারা একপ্রকার ধর্ষিত হয়েই। উপন্যাসটির কলেবর ছোট হওয়ার কারণে অনেক চরিত্রেরই ভূতভবিষ্যৎ জানা যায়নি। তবে সকল চরিত্রের একটা সংক্ষিপ্ত বর্ণনা/পরিচয় দিয়েই শুরু হয়েছে। অনেকের কাছে চরিত্রগুলোর এই পরিচিতি তুলে ধরাকে অবাঞ্চিত মনে হতে পারে কিন্তু আমার ধারণা লেখক উপন্যাসটিকে কোন রম্যরচনা কিংবা দায়সারা গোছের "শিল্পের জন্য শিল্প" এই মানসিকতা থেকে লেখেনি। এই মনে হওয়ার পেছনে কারণ আছে। আপনারা উপন্যাসটি পড়লেই দেখবেন প্রতিটি চরিত্রেকে সে তুলে ধরেছেন পরম মমতায়। কোন ব্যক্তিকে অহেতুক খারাপ বানানোর জন্য দোষারোপ করেননি। আবার কাউকে অযথাই নায়ক বানিয়ে তোলেননি। বাস্তবে ব্যক্তি মানুষ যেমন বিভিন্ন ঘটনা ও অনুসঙ্গের ভেতর দিয়ে তার আচরণের ব্যক্তিগত মূল্যবোধ তৈরি করে সেভাবেই লেখক দেখিয়েছেন কিভাবে এই সমাজব্যবস্থার ভেতর দিয়ে মানুষ ভালো-খারাপ হয়। তবে আমার চোখে মনে হয়েছে লেখক খারাপ হওয়ার পেছনে তিনটি রিপুকে সামনে টেনে এনেছেন- ক্ষমতা, অর্থলিপ্সা ও যৌন কামনা। ধর্মকে নোংরাভাবে ব্যবহার করে কোন শ্রেণি এবং কিসের স্বার্থে সেটার একটা চিত্রপট দেখতে পাওয়া যায় উপন্যাস পড়তে পড়তে। সকল খারাপির পেছনেই যে একটা বৈষয়িক স্বার্থ আছে সেটা খুব স্পষ্টভাবেই দেখতে পেয়েছি উপন্যাস জুড়ে। ভাষার অলংকরণ ছিলো খুবই সাবলীল কিন্তু দ্বিরুক্ত পদের ব্যবহার ও উপমার প্রয়োগ হয়েছে অসাধারণ। প্রধান চরিত্র কে? সেটা নিয়ে দ্বন্দ্বে পড়ে যাবেন যে কেউ। এখানে সম্ভবত লেখকের সাথে আমার ব্যক্তিগত মতভেদও হতে পারে। কারণ লেখকের ভাবনাই শেষ কথা নয়, ঘটনা পরিক্রমায় আমার মনে হয়েছে আমজাদ প্রেসিডেন্টই প্রধান চরিত্র। অবাক হয়েছি যে অভিজাত হিন্দু বাড়ি বাগিয়ে নেয়ার জন্যে সিরাজ মোল্লা ও আমজাদের মধ্যকার লড়াইয়ে শেষমেশ আমজাদ প্রেসিডেন্টই জয়ী হয়েছেন। নামমাত্র মূল্যে কিনে নিয়েছেন বিশাল বড় বাড়ি ও জমি। এখানেও লেখক দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন। কারণ যেখানে গোটা জনপদের বেঁচে থাকার মাধ্যম নয়নতারা পাটকল সেখানে সেই পাটকলের শ্রমিক নেতা আমজাদ প্রেসিডেন্ট স্থানীয় ইউনিয়ন চেয়ারম্যান অপেক্ষা শক্তিশালী হওয়াই স্বাভাবিক। তাছাড়া আমাদের সমাজের যে ঐতিহাসিক রীতি তাতে ঝামেলা সৃষ্টিকারির চেয়ে মধ্যস্থতাকারীর লাভ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বেশি। তাছাড়া আমজাদ প্রেসিডেন্ট চরিত্রটি একটা আদর্শ মধ্যস্বত্বভোগী চরিত্র। উপন্যাস পড়ে লেখকের সাথে মতপার্থক্য হওয়ার স্বাধীনতাও পাঠকের আছে। জ্যাঁক দেরিদার ভাষা দর্শন এই এখতিয়ার দিয়েছে পাঠককে। লেখক খুবই চমৎকারভাবে সমাজের নানাবিধ অসঙ্গতি তুলে ধরেছেন কিন্তু সম্ভবত সচেতনভাবেই কোন পথ বাতলে দেন নি। পথের সন্ধান দেয়া সম্ভবত ঔপন্যাসিকের কাজ নয়। উপন্যাসটি সবাই পড়ুন, উপলব্ধি করতে চেষ্টা করুন এবং প্রতিচিন্তা দাঁড় করান। আমি আমার ভাবনা জানালাম। শুনতে চাই আপনার ভাবনাগুলোও।

      By Sabrin Afrin

      11 Jun 2019 07:04 PM

      Was this review helpful to you?

      or

      পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় প্রান্তিক জনপদের টিকে থাকার লড়াই, প্রেম- ভালবাসা - বিরহের এক কালজয়ী জীবনগাঁথা- "কালচক্র" "কালচক্র" আবদুল্লাহ আল ইমরান এর লেখা দ্বিতীয় উপন্যাস হলেও আমি তাঁর তৃতীয় উপন্যাস 'দিবানিশি' আগে পড়েছিলাম। 'দিবানিশি' পড়েই আমি তাঁর লেখার প্রেমে পড়েছিলাম। এরপর পড়লাম 'কালচক্র'। উপন্যাসটি পড়ে তরুণ এই কথাসাহিত্যিকের লেখকসত্তার প্রতি আমার মুগ্ধতা আকাশ ছুঁয়েছে। 'কালচক্র' একটি সামাজিক উপন্যাস। এ উপন্যাসে লেখকের পটভূমি নির্বাচন, পুঁজিবাদী সমাজের সুনিপুন চিত্র অঙ্কন, সমাজের নর-নারীর সম্পর্ক এবং তাদের মনোবিশ্লেষন, রাজনীতিমনস্কতা, জীবন ও দর্শন এবং ভাষার ব্যবহার উপন্যাসটিকে অনন্য মাত্রায় পৌঁছে দিয়েছে। লেখক সমাজ ও সমাজের মধ্যকার মানুষের স্বভাব, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করেছেন মার্কসীয় এবং ফ্রয়েডীয় দর্শনের আলোকে। উপন্যাসের পটভূমি তৈরি হয়েছে সমাজের প্রান্তিক মানুষ এবং তাদের যাপিত জীবন নিয়ে। প্রান্তিক মানুষের জীবনের এই গল্প উপন্যাসটিকে অত্যন্ত জীবনঘনিষ্ঠ করে তুলেছে। খুলনার ভৈরব নদীর তীরে নয়নতারা পাটকলকে কেন্দ্র করে উপন্যাসের পটভূমি বিস্তৃত হয়েছে। কাহিনীর বিস্তারও ঘটেছে এই পাটকলকে কেন্দ্র করে, যা একটি শ্রেনিবিভক্তি এবং পুঁজিবাদী চেতনার বিকাশ ঘটিয়েছে ক্রমে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, উপন্যাসের প্রারম্ভে একটি শক্তিমান চরিত্রের নিজেকে আড়ালে রেখে কর্মচারী জগলুকে দিয়ে স্বল্পদামে চোরাই ডিজেল কিনে বাজারে বিক্রি করার মধ্য দিয়ে পুঁজিবাদী সমাজের চিত্র ফুটে উঠে। অন্যদিকে, পাটকল ঘিরে গড়ে ওঠে নদীর দুই তীরের জনপদ। অথচ নদীর এপারে পাটকল সচল রাখা মেহনতী শ্রমিকদের ঘুপচি কলোনি এবং ওপারে পাটকলের বড়কর্তাদের দালানকোঠা এক শ্রেনিবিভক্ত সমাজের চিত্র চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। নিম্ন আয়ের শ্রমিকদের মধ্য হতে আমজাদের মতো মানুষের হটাৎ ফুলেফেঁপে আমজাদ প্রেসিডেন্ট হয়ে ওঠা, উৎপাদন কম এই অজুহাতে শ্রমিকদের বেতন বন্ধ করে বড়কর্তাদের বেতন চালু রাখা, রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য শ্রমিকদের ব্যবহার এবং সরকারের পক্ষে থেকে গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের নামে পাটকল বন্ধের ঘোষণা এবং ফের সেই শ্রমিকদের ব্যবহার করে আবার পাটকল চালু রাখা- এসব ঘটনার মাধ্যমে লেখক অত্যন্ত দক্ষভাবে একটি পুঁজিবাদী সমাজের আর্থ-সামাজিক অবস্থা তুলে ধরেছেন। এই উপন্যাসে লেখক এদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে সাম্প্রদায়িক ও অসাম্প্রদায়িক মনোভাবের চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন। কালীপূজা, সরস্বতী পূজাসহ ঠাকুরবাড়ির সব আয়োজনে এলাকার ছেলে-মেয়েরা প্রসাদ খেতে যায়। ভবানীপুর স্কুলের পিছনে পাল পাড়ায় বিশ্বাস কাকা, মনোহর দা, অভয়া দিদিরা ভীষণ মমতা এবং শ্রদ্ধায় গড়ে তোলেন দেবতার অবয়ব। ঢাকের তালে, বাঁশির সুরে, কাঁসার ঘন্টিতে শরতের বাতাসে বেজে উঠা পূজার এক উম্মাতাল আহ্বানে জাতি ধর্মের বিভেদ ভুলে সবাই ছুটে যায় শিববাড়ি মাঠে দেবী দর্শনে। অপরদিকে সংখ্যালঘু হওয়ায় ভয়ভীতি দেখিয়ে সিরাজ মোল্লা হিন্দুদের জমি দখল করে। ঠাকুরবাড়ির বাগান, জমি হাতানোর আশায় মহুয়ার আত্নহত্যাকে কেন্দ্র করে এক অস্থির পরিবেশ তৈরি করে ঠাকুর পরিবারকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করে। এঘটনা যেন সাম্প্রদায়িক কারণে এদেশের সংখ্যালঘু নির্যাতনের বাস্তব প্রতিচ্ছবি। সাম্প্রদায়িকতার বীভৎস রূপ বা সংখ্যালঘুর প্রতি হওয়া নির্যাতনে লেখকের দরদী মন হু হু করে কেঁদে ওঠে বলেই হয়তো এমন স্পর্শকাতর ব্যাপারটি নিবিড়ভাবে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন। লেখকের প্রতি কৃতজ্ঞতা। তরুণ এই কথাসাহিত্যিক তার দ্বিতীয় উপন্যাস কালচক্রে অত্যন্ত মুন্সিয়ানার সঙ্গে ফ্রয়েডীয় দর্শনের আলোকে মানুষের মনোজগতকে বিশ্লেষণ করেছেন। এক্ষেত্রে প্রথমেই যে চরিত্র দুটির কথা মনে পড়ে তা হলো মিষ্টি বউদি এবং হারুন। হারুন মিষ্টি বউদির পাঁচ বছরের ছোট। মিষ্টি বউদির প্রতি তার তীব্র আর্কষণ। এ আর্কষণের অনেকখানি শারীরিক এবং তার চেয়েও বেশি মানসিক। ঠাকুরবাড়ির ঘাটে স্নান করা ভিজে শরীরের মিষ্টি বউদিকে দেখে সে পুলকিত হয় কিন্তু এর চেয়েও বেশি মুগ্ধ হয় মিষ্টি বউদির কথা শুনে, তার মায়াবী হাসি দেখে। হাজারো কামনা ভরা চোখের ভিড়ে হারুনের চোখে মিষ্টি বউদি দেখতে পায় রাশি রাশি ভালবাসা এবং মুগ্ধতা। আর তাইতো স্বামীর ভালবাসার কাঙ্গাল অথচ ভালবাসাহীন মিষ্টি একটা সময় নিজেকে হারুনের কাছে সঁপে দিতে চায়। এ উপন্যাসে নিষিদ্ধ যৌনতাও রয়েছে। ঘরে দেবীর মতো বউ রেখে বিষ্ণু শরীরের চাহিদা মেটাতে যায় ধর্মের ডাক দেওয়া রইজউদ্দীনের বউ রাহেলার কাছে, বিষ্ণুকে নেশার টাকা যুগিয়ে দেওয়ার লোভ দেখিয়ে চেয়ারম্যান সিরাজমোল্লা আসে মিষ্টির ঘরে, আমজাদ প্রেসিডেন্ট নিজের কর্মচারীর বউয়ের সঙ্গে গড়েন অবৈধ সম্পর্ক, সর্বগ্রাসী যৌনতার ফসল পেটে মহুয়াকে বেছে নিতে হয় আত্নহননের পথ। উপন্যাসের প্রেক্ষাপট এবং জনপদ বিবেচনায় নিলে এসবই স্বাভাবিক, কেননা নিত্য টানাপড়েনে ভোগা শেকড়হীন মানুষের মাঝে নৈতিকতা, আদর্শের চাইতেও টিকে থাকার সংগ্রামটাই মূখ্য হয়ে ওঠে। চারিত্রিক দ্বৈতসত্তার স্পষ্ট প্রতিফলন রয়েছে এ উপন্যাসে। মনোবিদরা যাকে স্পিলিট পার্সোনালিটি (split personality disorder) বলে অভিহিত করেছেন। শুধু ভালো গুণে পরিপূর্ণ বা সমস্ত ভালো গুণ বিবর্জিত নেতিবাচক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব ছাড়াও যে কখনো কখনো ভালো এবং খারাপের সংমিশ্রণে মানব চরিত্র গঠিত হয় উপন্যাসে তার প্রমাণ মিলে। তেল চুরি করতে গিয়ে তেলের ডিপো দূর্ঘটনার মহাবিপদের সময়েও জগলু তার সহচর হায়দারকে খুঁজেছিলো এবং তাকে দেখতে না পেয়ে জগলুর বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠেছিলো। প্রবল স্বার্থান্বেষী আমজাদ প্রেসিডেন্ট যখন জগলুর কাছে বহুবছর আগে তার ৭ বছর বয়েসে কঠিন অসুখে ভুগে বিনে চিকিৎসায় মারা যাওয়া ছেলের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে চোখের অশ্রু মোছেন তখন আমরা তার কোমল পিতৃহৃদয়ের পরিচয় পাই। এ যেন হুমায়ূন আহমেদের বিখ্যাত উক্তি " পৃথিবীতে অসংখ্য খারাপ মানুষ আছে, কিন্তু একটিও খারাপ বাবা নেই" এর বাস্তব চিত্র। নারীর আবেগ,অনুভূতি আকাঙ্খা,অপরাগতার একটি চমৎকার ছবি রয়েছে এ উপন্যাসে। "পৃথিবীর প্রতিটা মেয়েই পুরুষের চোখের ভাষা পড়তে ও বুঝতে পারার অবিশ্বাস্য এক ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়। কোন দৃষ্টিটা দেহের ভাঁজ খোঁজে, আর কোন দৃষ্টিটা খোঁজে মন, বুঝতে অসুবিধা হয় না মেয়েদের। তবু কিচ্ছু না বোঝার মেকি অভিব্যক্তি নিয়েই চলতে হয় জীবনভর।" " সব নারীই পুরুষের চোখের মুগ্ধতা খোঁজে, ভালবাসা খোঁজে। কেউ পায়, কেউ পায় না। কিন্তু সেই মুগ্ধতা আর ভালবাসার জন্য বুকের গহিনের হাহাকার তাদের শেষ হয় না!" নারীর রহস্যময়ী ও বিচক্ষণ মনের প্রতিচ্ছবি লেখক এই দুটি উক্তির মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছেন যা ভীষণ সত্য। নারী মাত্রই এই উক্তির সাথে নির্দ্বিধায় একমত পোষণ করবেন। এই উপন্যাসের গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশজুড়ে কৈশোরের স্বার্থহীন প্রেম এবং বন্ধুত্বের ছবিও স্পষ্ট হয়ে ওঠে, যা পাঠককে একবার হলেও তার নিজের কৈশোরের প্রথম ভালবাসার মানুষটির কথা এবং একান্ত আপন বন্ধুটির কথা মনে করিয়ে দেবে, করবে আপ্লুত। 'কালচক্র' উপন্যাসে আরও একটি গুরুত্বপূর্ন বিষয় হলো ভাষার ব্যবহার। উপমা এবং আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার এ উপন্যাসটি অনন্য করে তুলেছে। তবে উপন্যাসে সবাই আঞ্চলিক ভাষায় কথা বললেও ঠাকুরপরিবারের প্রমীত ভাষা ব্যবহার কিছুটা খাপছাড়া লেগেছে। উপন্যাসের কয়েকটি চরিত্র- পলাশ, চন্দ্রলেখা, মিষ্টি বউদি, হরিহরন বাউল এবং আশালতা দেবীর মাধ্যমে উপন্যাসের প্রতিটি পরতে পরতে লেখক হয়তো নিজের গভীর জীবনবোধ এবং দর্শন ফুটিয়ে তুলেছেন । কালচক্র বইটির বিষয়বস্তুর সাথে বইটির প্রচ্ছদের দারুন সামঞ্জস্য রয়েছে। প্রচ্ছদ তৈরিতে সানজিদা পারভীন তিন্নি সূক্ষ্মভাবে নিজের শৈল্পিক সত্তার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। ভবানীপুরের মানুষের জীবনের প্রচ্ছন্ন আঁধারের ছবি যেন প্রচ্ছদেই ফুটে উঠছে। তবে বইটির মুদ্রনজনিত সমস্যা কারণে কিছু বানান ভুল রয়েছে যেটা কাম্য নয়। আবদুল্লাহ আল ইমরান একজন বস্তুবাদী এবং জীবনঘনিষ্ঠ লেখক এবং এ দুইটি বৈশিষ্ট্যের কারণে তিনি একদিন বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবে বিবেচিত হবেন- এ কেবল প্রত্যাশা নয়, দৃঢ় বিশ্বাসও। #বই_বিষয়ক_তথ্য উপন্যাস : কালচক্র প্রকাশক : অন্বেষা প্রকাশন প্রচ্ছদ : সানজিদা পারভীন তিন্নি মুদ্রিত মূল্য : ৩০০ টাকা #রিভিউ_প্রদানকারীর_তথ্য নাম - সাবরিন আফরিন শিক্ষার্থী, ইডেন মহিলা কলেজ

      By Rushoti Amin

      21 Dec 2018 01:49 PM

      Was this review helpful to you?

      or

      " বাগানবাড়ির মস্ত লিচু গাছের ডালে সুতোয় বাঁধা পুতুলের মতো দুলছে মহুয়া পিসি। একবার ডানে,একবার বাঁয়ে।" - ক্ষুদ্র দুটি লাইন। কিন্তু কী ভীষণ নাড়া দেয় ভেতরটাকে! হ্যাঁ, এই ভেতরে কাঁপন ধরানো রহস্যময় আবহাওয়াটুকুই উপন্যাসের প্রারম্ভিকা। যার পালে ভর করে ধীরে ধীরে এগিয়েছে অসংখ্য কাহিনীর ডিঙ্গি নৌকা। কাহিনী সংক্ষেপঃ ভৈরবের অববাহিকায় গড়ে ওঠা এক গ্রাম, নাম ভবানীপুর। ভবানীপুর গ্রামের মানুষ এর জীবন ও জীবিকা আবর্তিত হয় নদীর তীরের পাটকলকে ঘিরে। কেউ সেখানে শ্রম দেয়,কেউবা শ্রমিকের ঘামে মাখা অর্থ অসৎ উপায়ে আত্মসাৎ করে। গ্রামে যেমন আছে বড়ঘরের প্রাচীনপন্থী পরিবার,তেমনি আছে অর্থলোভী মানুষ রূপী পশু। আরও আছে দিন এনে দিন খেয়ে জীবন চড়কি ঘোরানো দরিদ্র আর অসহায় পরিবার। ভবানীপুর এর এক সম্ভ্রান্ত ঘর ঠাকুরবাড়ি। তিন পুরুষ পুরনো এই ঠাকুরবাড়িতে ঘটলো এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। ঠাকুরবাড়ির মেয়ে মহুয়া আত্মহত্যা করলো। চিরকাল ধরাছোঁয়ার বাইরে, সম্মান ও সমীহের বেড়াজালে আবদ্ধ থাকা ঠাকুরবাড়ির এই দুর্ঘটনা সাধারণ মানুষ এর কাছে এক দুর্বলতা রূপে ধরা দিল। আর মানুষ এর মজ্জাগত স্বভাব সামান্য ফাঁক-ফোঁকড়কে টেনে হিঁচড়ে বিশাল আকৃতি দান করা। ভবানীপুর এর মানুষও এর ব্যতিক্রম নয়। তাই সারা গাঁয়ে ছড়াতে লাগলো নানান গুজব। সত্যের উপর মিথ্যার মশলা মাখিয়ে মহুয়ার আত্মহত্যার ঘটনাকে ঝালমুড়ির মত গিলতে আর চাবাতে শুরু করলো আবালবৃদ্ধবনিতা সবাই। গাঁয়ের চায়ের স্টল থেকে শুরু করে মহিলাদের বৈকালিক আড্ডার মুখরোচক উপজীব্যে পরিণত হলো ঠাকুরবাড়ির মেয়ের আত্মহত্যার কাহিনী। আর এই সুযোগকে তড়িৎ বেগে লুফে নিলো ক্ষমতালোভী চেয়ারম্যান সিরাজ মোল্লা। দীর্ঘদিন ধরেই ঠাকুরদের জমিজমার উপর তার লোলুপ দৃষ্টি ঘুরে বেড়াচ্ছে প্রতিনিয়ত। সিরাজ মোল্লা কুটিল চাল চেলে ঠাকুরদের অপদস্থ করতে উঠেপড়ে লাগলো। এদিকে রাতের আঁধারে চোরাই তেল আনতে গিয়ে ভয়াবহ দুর্ঘটনায় জড়ালো জগলু। অন্ধকারের মাঝে অন্ধকার কাজে লিপ্ত জগলু বিপদের অন্তিম মুহূর্তে ভেবে পেল না এ যাত্রা সে বাঁচবে কিনা। মহুয়া পিসির মৃত্যুতে কিশোর পলাশ এর মনটা ছটফট করে। তার এ ছটফটানির সর্বত্ব জুড়ে শুধু মহুয়া পিসির ঘটনা নয়। এই হাহাকার,এই মন কেমন করা চন্দ্রলেখার জন্য। পলাশের সহপাঠিনী সে। ঠাকুরবাড়ির মেয়ে চন্দ্রলেখা। যার জন্য কিশোর পলাশের মনে আছে এক তীব্র মায়া,মন কেমন করা অনুভূতি। হয়তো এরই নাম ভালবাসা। ভিন্ন ধর্মাবলম্বী এই দুই কিশোর-কিশোরীর এহেন আবেগের পরিণতি যে ভয়ঙ্কর তা তারা জানে। চন্দ্রলেখা আরও বেশি জানে। চন্দ্র জানে এ সম্পর্ক হলো বিষধর সাপকে দুধ-কলা দিয়ে লালন করার মত। ভবিষ্যতে যার ছোঁবলে ক্ষত-বিক্ষত হতে হবে নিজেদেরকেই। তবুও চন্দ্র পিছপা হতে পারে না। না না করতে করতেও এক অমোঘ টানে,দুর্বার আকর্ষণে সামনে আগায়। স্বপ্ন বোনে মনের আকাশে। তারা একদিন বড় হবে,পরিপক্ক হবে আর সেই সাথে পরিণতি মিলবে এই অবুঝ প্রেমের। কিন্তু মহুয়া পিসির আত্মহনন কি আরও কণ্টক বিছিয়ে দিলো তাদের চলার পথে? গ্রামের নারী-পুরুষের কাছে এক জনপ্রিয় নাম মিষ্টি বৌদি। নারীদের কাছে চক্ষুশূল আর পুরুষের চোখে লোলুপতার অবয়ব। সবার সাথে প্রশ্রয় মাখা হাসিমুখে কথা বললেও মিষ্টি ওই সমস্ত খুবলে খাওয়া নজর সইতে পারে না। সে খোঁজে প্রেমের জলে ভাসা মুগ্ধতায় টলমল একজোড়া চোখ। কিন্তু মাতাল স্বামী বিষ্ণুর মাঝে তা নেই। আছে যুবক হারুণের কাছে। কিন্তু মিষ্টি কি গ্রহণ করবে হারুণের আকুলতা? যে পাটকলকে কেন্দ্র করে ভবানীপুর গ্রামের মানুষের জীবন চক্রাকারে ঘুরতে থাকে সেই নয়নতারা মিলে ঘটে গেল আরেক দুর্ঘটনা। উঠতি যুবক নেতা রাজুকে কারা যেন মেরে ফেলার চেষ্টা চালিয়েছে। রাজু কি বাঁচবে আর? অন্যায়ের বিরুদ্ধে রাজুর প্রতিবাদী রূপই কি রাজুকে ঠেলে দিল মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে? বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে রাজু হত্যা চক্রান্তের পেছনে মূল হোতা আমজাদ প্রেসিডেন্ট।নয়নতারা মিলের শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি আমজাদ মোল্লার পরিচয় আমজাদ প্রেসিডেন্ট হিসেবেই। ক্ষমতাশীল এক কালোবাজারি। অবৈধ পথে অর্থ উপার্জনে যার জুড়ি মেলা ভার। সেই আমজাদ প্রেসিডেন্ট ঠাকুরবাড়ির দখল নিতে উদ্যত সিরাজ মোল্লাকে ফাঁকা মাঠে গোল দিতে দিবেন এত সহজেই? সেই সাথে রাজু সংক্রান্ত ব্যাপারে সাধারণ শ্রমিকদের কাছে শত্রু হয়ে নিজের ক্ষমতা আর প্রভাব হারাতে দিবেন না। দক্ষ খেলোয়াড় এর মত পাশার দান উল্টে দিতে কলকাঠি নাড়তে আরম্ভ করলেন তিনি। পাঠ পর্যালোচনাঃ বর্তমান সময়ের জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক আবদুল্লাহ আল ইমরান এর লেখা পড়ার সৌভাগ্য হলো এই প্রথম। এমনকি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও লেখকের লেখার সাথে পরিচিত হবার সুযোগ মেলেনি। সে হিসেবে এই প্রথমবার একজন লেখকের সুদীর্ঘ এই উপন্যাস পড়ে আমি মুগ্ধ। কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন এই উপন্যাসের ব্যাপারে বলেছেন, " বিষয়কে ধরা এবং উপস্থাপন, তার জন্য ভাষা ও চরিত্র নির্মাণ এবং সবকিছুর মধ্য দিয়ে একটি শিল্পিত উপন্যাস পাঠককে উপহার দেয়ার দায়িত্ব লেখক এই উপন্যাসে দক্ষতার সাথে পালন করেছেন। " এই মন্তব্যের সাথে আমি পুরোপুরি একমত। গ্রাম্য এক জীবনের দারুণ এক রূপরেখা অসংখ্য চরিত্রের মাধম্যে লেখকে তুলে ধরেছেন তার চমৎকার লেখনীশক্তির মাধ্যমে। জড়তা নেই, বাহুল্যতা নেই আবার তাড়াহুড়োও নেই। সুচারুরূপে একেকটি ঘটনার সূত্রপাত ঘটিয়েছেন একেক অধ্যায়ে। এবং পরবর্তীতে সেই সমস্ত কাহিনীকে এক সুতোয় বেঁধে ফেলেছেন। আর প্রতিটি অধ্যায়ের শেষে জুড়ে দিয়েছেন এমন কিছু একটা, যার টানে পরের অধ্যায়ে ছুটতে হয় অমোঘ টানে। সামাজিক উপন্যাসে রহস্যের আমেজ তৈরি করে লেখক উপন্যাসকে আলাদা এক মাত্রায় নিয়ে গিয়েছেন। এই উপন্যাসে ছোট ছোট অনেক গল্প সন্নিবেশিত। বেঁচে থাকার নিত্য লড়াই, টিকে থাকার আপ্রাণ সংগ্রাম এর গল্প কালচক্র। এই সংগ্রাম কখনো শ্রম দিয়ে সৎ পথে,আর কখনোবা কুটিল মেধার মাধ্যমে অসৎ পথে। থমকে যেতে হয় সামাজিকতার এই ঘাত-প্রতিঘাত দেখতে গিয়ে। এবার আসি কিছু উল্লেখযোগ্য বিষয়ের বিশ্লেষণে। প্লট নির্বাচনঃ গ্রামীণ জীবনচিত্র এই উপন্যাসের মূল উপজীব্য। গ্রামের অসহায় দিনমজুর বা খেটে খাওয়া মানুষের ঘরের ভেতরের দৃশ্য ফুটে উঠেছে লেখকের কলমের কালিতে। দরিদ্র মানুষের সাংসারিক ও ব্যক্তিগত হাহাকার,অক্ষম পিতা কিংবা অবলা অসহায় বাঙালি মায়েদের ত্যাগের চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। সেই সাথে ক্ষমতাশীল মানুষ এর নোংরা রাজনীতি,হিংস্রতা,শঠতা ও হঠকারিতার ভয়াবহ দৃশ্য চোখে ভেসে উঠে। ধর্মীয় গোঁড়ামি,সাম্প্রদায়িকতাও উল্লেখযোগ্য। পলাশ-চন্দ্রলেখা কিংবা হারুণ-মিষ্টি বৌদির ধর্মীয় ভিন্নতা সত্ত্বেও যে ভালবাসার স্বরূপ লেখক দেখিয়েছেন তা মনের মাঝে কেমন এক মন খারাপের দোলা দেয়। সর্বোপরি মিশ্র গল্পের এই বিস্তৃত পরিসর এর উপন্যাস এর নদী ভিত্তিক পাটকল নির্ভর অর্থনৈতিক কাঠামোর চিত্রায়নে লেখকের মুন্সীয়ানার পরিচয় পাওয়া যায়। চরিত্র বিশ্লেষণঃ আমাকে যদি কেউ প্রশ্ন করে এই গল্পটি কার? উপন্যাসের মূল চরিত্র কে? আমি বলবো এই গল্প প্রত্যেকের। উপন্যাসে সকল চরিত্রের স্বতন্ত্র ভূমিকা রয়েছে। এখানে মূলত ঠাকুরবাড়ি,পাটকল আর কিশোর পলাশ অধিক জায়গা দখল করলেও প্রত্যেক চরিত্রের ছিলো আলাদা গল্প,আলাদা জীবন দর্শন। কোন চরিত্রই ম্রিয়মাণ হবার অবকাশ পায়নি। এখানে কিশোর পলাশ এর পাশাপাশি বৃদ্ধ নাজিমউদ্দিন এর হাহাকার, কিশোরী চন্দ্রলেখার পাশাপাশি বৃদ্ধা আশালতা দেবীর মনের হাপিত্যেশ প্রকাশ পেয়েছে। পলাশ ও চন্দ্রলেখা চরিত্র দুটি বয়ঃসন্ধিকালীন দুই ছেলেমেয়ের আবেগের আতিশয্য প্রকাশ করে। এই সময়ে সবসময় তাকে কেউ বুঝে না,কেউ বুঝতে চায় না - এই দোটানায় দুলতে দুলতে নিজেদের অজান্তেই খুঁজে নেয় মনের সাথী। যার কাছে মনকে মেলে ধরা যায় নির্দ্বিধায়। কিন্তু সমাজ তাদের আবেগের বেলুনে ফুটো করে শিখিয়ে দেয় বাস্তবতা। আমজাদ প্রেসিডেন্ট ও সিরাজ মোল্লা চরিত্র দুটি সমাজের সার্থপর,লোভী মানুষের প্রতীক। ক্ষমতার আলো অধ্যায় আর সমাজপতিদের নিপীড়ন এর ছবি পাঠকের চোখে ভেসে ওঠে এই চরিত্র দ্বয়ের কার্যকলাপে। চিরায়ত গ্রাম বাংলার নিত্য অভাবের সংসারে মুখ বুজে থাকা নারী চরিত্র পলাশের মা সাজিয়া। অভাবের সংসারকে কোন এক অদৃশ্য জাদুবলে টেনে নিয়ে যায় দিনের পর দিন। উড়ুউড়ু মনের স্বামীর প্রতিও কী গোপন এক ভালবাসায় বুঁদ হয়ে থাকা সাজিয়ার ত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধায় আর মুগ্ধতায় মাথা নুঁইয়ে আসে।মিষ্টি বৌদি চরিত্রটি অবহেলিত স্ত্রীর প্রতিমূর্তি। যার জন্য সবাই পাগল, শুধু ঘরের মানুষ ছাড়া। সবার সাথে হেসে হেসে কথা বলা সত্ত্বেও মিষ্টির চারিত্রিক দৃঢ়তা চোখে পড়ার মত। মিষ্টির প্রতি আকৃষ্ট হারুন ছেলেটি নিঃস্বার্থ, নিষ্কাম, শুদ্ধতম ভালবাসার নিদর্শন তুলে ধরে।ঠাকুরবাড়ির মেয়ে মহুয়া এতিম হয়েও স্নেহের আবেশে নতুন ঠিকানার দেখা পাওয়া এবং কৃতজ্ঞতায় নিজ গুণাবলীর জোরে সবার মন জয় করা এক চরিত্র। যার না থাকাতে পুরো বাড়িতেই নাই নাই হাহাকার ছেঁয়ে যায়।নরেশ ঠাকুর পূর্ব পুরুষ এর সম্পদ-সম্পত্তি নিয়েই গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসায়নি। বেছে নিয়েছেন শিক্ষিত জীবনধারা। ব্যাংকে চাকরি করেন। কিন্তু চিরাচরিত পারিবারিক গোঁড়ামি আর একগুঁয়েমি থেকে বের হতে পারেনি সে। নরেশ ঠাকুর পরিবারের কর্তাদের প্রতিচ্ছবি। পরেশ এর বাবা সোয়ালমান পাটকল শ্রমিক। ঘর - সংসার তাকে কেন জানি টানে না। জাগতিক মোহে ছুটতে মন সায় দেয় না তার। এই চরিত্রটি নিত্য জীবনযুদ্ধ ছেড়ে আত্মভোলা হতে উস্কানি দেয়। চরিত্রের দুই সত্তাঃ প্রত্যেক মানুষ এর ভালো খারাপ দুটি দিক থাকে। অতি পাষাণ মানুষ এর যেমন মনের মাঝে একটু মায়া থাকে, তেমনি খুব ভালো মানুষ এর আড়ালেও লুকানো খারাপ দোষ থাকে। উপন্যাসে লেখক চরিত্রের এই দুই দিককেই চিত্রিত করেছেন। আমজাদ প্রেসিডেন্ট একজন ক্ষমতালোভী পিশাচ হলেও তার মনে আছে পিতৃস্নেহ। তেমনি নরেশ ঠাকুর প্রচলিত ভালো মানুষের কাতারে পড়লেও তার আছে অপ্রকাশ্য কলুষিত দিক। সোলায়মান মিয়া বিবাগী মনের হলেও সন্তানের ক্ষুধার্ত কান্না তাকে কাঁদায়। মিষ্টি বৌদি হেসে হেসে কথা বলে কিন্তু নিজের সম্মানের দিকে রাখে প্রখর নজর। নাজিমউদ্দিন এর ছেলে মন্টু গোপনে বিপথে গেলেও পিতার জন্য তার আছে বুকভরা ভালবাসা। জগলু অসৎ পথের একজন লোক হলেও নিজ সন্তানের অসুস্থতা তাকে কুড়েকুড়ে খায়। চন্দ্রলেখা কিশোরী আবেগের মাঝেও বোধবুদ্ধিহীন নয়। সে জানে তার আর পলাশের প্রেমের ফল কেমন হতে পারে। এমনি ভাবেই চারিত্রিক দর্শনগুলো লেখক অতি দক্ষতার সাথে পাঠকের চোখে ফুটিয়ে তুলেছেন। প্রচ্ছদঃ উপন্যাসের নাম এবং কাহিনীর সাথে মানানসই স্বচ্ছ ছিমছাম প্রচ্ছদ। নদীতীরের জীবন এর চিত্র প্রচ্ছদশিল্পীর তুলিতে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সেই জীবন যে কিছুটা বিষাদমাখা অমানিশায় ঘেরা - প্রচ্ছদে গ্রামের অবয়বের আবছা কালো ভাব তাই যেন তুলে ধরে। নামকরণঃ সময়ের চাকা - কালচক্র। সময় এর চাকা কখন কার কোন দিকে ঘুরবে বলা মুশকিল। কখন সুসময় পরিণত হবে দুঃসময়ে,আর কখন যে দুঃসময়কে হারিয়ে দিয়ে সুসময় মাথাচাড়া দিয়ে জেগে উঠবে তার হিসেব মেলা দায়। গল্পের চরিত্রগুলোর সামাজিক মর্যাদার, ক্ষমতার হাতবদল কিংবা মানসিক দোটানার রূপ পরিবর্তন,সেই সাথে অর্থের প্রাচুর্য কিংবা টানাপোড়ন সবকিছুই কালের সাথে চক্রাকারে আবর্তিত হয়। তাই নিঃসন্দেহে এই নামকরণ উপন্যাসের মূল উপজীব্যকেই তুলে ধরে। অসঙ্গতিঃ পুরো উপন্যাসে সকল চরিত্রের সংলাপের ক্ষেত্রে কথ্য ভাষার প্রয়োগ করা হয়েছে। কিন্তু নরেশ ঠাকুর আর চন্দ্রলেখার কথায় মাঝে দুটোর মিশ্রণ চোখে লেগেছে। যে কোন একটি করলেই ভালো হতো। যেহেতু নরেশ শিক্ষিত লোক সেহিসেবে তিনি শুদ্ধ ভাষায় কথা বলেন, এমন হলে খুব একটা খারাপ লাগে না। কিন্তু দুটোর মিশ্রণ ব্যাপারটা কেমন জানি দৃষ্টিকটু। একটি বাক্য বলছেন শুদ্ধ ভাবে,ঠিক পরেরটি আবার কথ্য ভাষায়! চন্দ্রলেখার ক্ষেত্রেও ঠিক এমন। এটা কি লেখকের ইচ্ছাকৃত নাকি ভুলবশত আমার জানা নেই।আর একটি ব্যাপার চরিত্রের পরিচয় ফুটিয়ে তুলতে দীর্ঘ বর্ণনা দিয়েছেন। এত লম্বা ভূমিকার কারণে প্রথমদিকে কিছুটা একঘেয়েমি লাগছিলো। কিছু শব্দের বারবার প্রয়োগ পড়ার মাঝে বিরক্তির উদ্রেগ করেছে। ভালোলাগাঃ উপন্যাসের কাহিনী,তার বর্ণনা এবং সমাপ্তির পাশাপাশি আমি লেখকের লেখনশৈলীর প্রতি অত্যন্ত মুগ্ধ হয়েছি। বাক্যের উপস্থাপন,বর্ণনা কৌশল,শব্দ চয়ন,উপমার ব্যবহার,গ্রামীণ পরিবেশের রূপরেখার চিত্রায়ন, অনুভূতি প্রকাশের ধরণ সবকিছু খুব দারুণ! শিক্ষণীয় দিকঃ ছোটকাল থেকেই জেনে এসেছি সোনালি আঁশ পাট, আমাদের অর্থকরী ফসল। কিন্তু সেই পাট এখন আর আগের জৌলুশ ধরে রাখতে পারেনি। নগরায়ণের আড়ালে আধুনিক নানা পণ্যের ভীড়ে পাট হারিয়েছে তার চাহিদা। লেখক সেই পাটশিল্প এবং পাটকলের পতনের একটি রূপরেখা তুলে ধরেছেন পাঠকের সামনে গল্পের ছলে। যা যারপরনাই প্রশংসার দাবিদার। পরিশেষে বলবো শোষক আর শোষিত এর সময়ের সাথে ঘুরেফেরা এই চক্র হলো কালচক্র। লেখক এমনি আরও অসংখ্য লেখা পাঠকদের উপহার দেবেন এই আশা রাখি।

    • Was this review helpful to you?

      or

      "লোকায়ত জীবনবোধ ছাপিয়ে অস্তিত্ববাদের গল্প : কালচক্র " দুটি প্রজন্মের প্রধান পার্থক্য তাদের জীবনবোধে। বয়োবৃদ্ধির সাথে সাথে জীবনবোধের পরিপক্বতা আসে। ঘাত-প্রতিঘাত, দুরন্ত কৈশোর থেকে আস্তে আস্তে ছাড়িয়ে নিয়ে যায় টিকে থাকার লড়াই এ। আর এই টিকে থাকার লড়াই, এই অমোঘ অস্তিত্ববাদ "কালচক্র" র মুল উপজীব্য। আচ্ছা এই গল্পটা কার? কে এই গল্পের মুল চরিত্র? এ বই এর জন্য এপ্রশ্নের স্পেসিফিক জবাব দেয়া আসলে সম্ভব না। বইটার একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য এটি। এখানে গল্পটা নির্দিষ্ট কারো ওপর ফোকাস করা না। বরং গল্পটা নয়নতারা পাটকল এবং তার সংশ্লিষ্ট সবার। তবে বইটার প্রায় সবার ওপর কমবেশি প্রভাব রেখেছে আমজাদ প্রেসিডেন্ট। ভাসমান একটা মানুষ থেকে হয়ে ওঠেছে গ্রামের সবার ভাগ্য নির্ধাতা আর তারই অস্তিত্ববাদ আর প্রভাব রক্ষার জন্য কপটতা ছল-চাতুরীর আর এক বিপ্লবের গল্প কালচক্র। #কাহিনী_সংক্ষেপ__ মহুয়া পিসি আত্মহত্যা করলেন। আর তার মৃত্যুকে নিয়ে গুজব রটে গেল পুরো গ্রামময়। ছড়াতে থাকল নানা গল্প। বাজারের চায়ের স্টল থেকে মা মাসিদের আড্ডা পর্যন্ত ছড়াতে লাগল গল্পের দীর্ঘ শাখা। প্রভাবশালী এই ঠাকুরবাড়ির ভিত নড়িয়ে বিদায় নিলেন মহুয়া রেখে গেলেন সমালোচনা আর নিন্দা। জগলু রাতে চোরাই তেল আনতে গেল নৌকা করে। আর সেযাত্রায় ঘটল ভয়াবহ দুর্ঘটনা। জাহাজ ফুটো হয়ে পুরো নদী ভরে গেল তেলে। ঘরে রুগ্ন ছেলে, মালিকের রোষ সব মিলিয়ে অকুল পাথারে পড়ল সে। তার ওপর ঘটনাটা যদি চাউর হয়ে যায় তাহলে তো থানা পুলিশের ঝামেলা। সোহেল, রনি, রকিব, মিলন এদের সাথে দিনকাল ভালোই যাচ্ছিল পলাশের। কিন্তু সে তবুও স্বস্তি পাচ্ছে না। চন্দ্রলেখার সাথে পলাশের দেখা হচ্ছে না। ধর্ম, সামাজিকতা, লোকাচারের বাধা পেড়িয়ে তাদের গোপনে প্রেম হয়ে গেল কিভাবে যেন। সমাজে নিষিদ্ধ এই সম্পর্কের পরিণতি নেই জানা থাকলেও দুরন্ত কৈশোরের প্রথম প্রেম সে বাধা কি মানে? এদিকে পলাশের বাবা সোলেমান মিয়ার সংসারের প্রতি কোনো আসক্তি নেই। জীবনের অপ্রাপ্তি আর হতাশার থেকে মুক্তির পথ খোঁজে সে গানে। আর তাতে তার আয়ের সবটা চলে গেলেও তাতে দুঃখ হয় না তার। কিন্তু যখন প্রশ্নটা নিজের সন্তানের, যখন সময়টা বেতন না পেয়ে অগুনতি অভাবে টাল খাওয়ার? মিস্টি! পাড়ার মিস্টি বৌদি। ভরা যৌবন নিয়ে যখন চলে, হেসে কথা বলে তখন প্রতিটা চোখ যখন তাকে ছিড়ে খায় তখন সে ভালোবাসা খুঁজে মুগ্ধতা খোঁজে। পায়ও সেই নিখাদ মুগ্ধতা হারুনের নজরে। সেই মুগ্ধতা সে আশা করে তার স্বামীর কাছে, নেশায় বুঁদ হয়ে পরকিয়াতে জড়িয়ে পড়া তার স্বামী বিষ্ণুর চোখে। কিন্তু সে তো....... নয়নতারা মিলে ঘটে গেল ভয়াবহ দুর্ঘটনা। লড়াকু, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার রাজুকে কে যেন আধমরা করে ফেলেছে মেরে। কিন্তু আসল দুর্ঘটনা শ্রমিকদের বেতন আটকে যাওয়া। পুরো গ্রামের মুল চালিকা শক্তি ধুম করে থেমে গেল। কারো কোনো আয় নেই সঞ্চয় নেই। চারিদিকে হাহাকার। আর সেই ক্রান্তিলগ্নে ছড়াতে লাগল মিল বন্ধ হবার খবর। তবে কি?...... ঠাকুরবাড়ির অবস্থা দিন দিন আরো খারাপ হতে থাকল। মহুয়া পিসি আর পরেশ কাকাকে নিয়ে ডালপালা ছড়ানো গল্প ছেকে ধরতে থাকল পুরো পরিবারকে আর সেই অসহায়ত্বের সুযোগ নিতে পিছপা হবে না সিরাজ মোল্লা আর আমজাদ প্রেসিডেন্টের মত গুটিকতক প্রভাবশালী লোক। আমজাদ প্রেসিডেন্ট! নয়নতারা মিলের শ্রমিক সংঘের প্রেসিডেন্ট হলেও তার আয় বহুমুখী। কালোবাজারি, তেলের ব্যবসা থেকে শুরু করে সব অনৈতিক কাজের হোতা এই লোকটার স্বার্থে আঘাত হতে থাকল বারবার। রাজুর বেঁচে যাওয়া, তেলের জাহাজে ফুটো হওয়া, শ্রমিকদের অসন্তোষ। সব তার অস্তিত্বের অন্তরায় হয়ে দাঁড়াল একযোগে। বিপরীতে কেবল সে। একযুগের এই প্রভাব প্রতিপত্তি সে শেষ হয়ে যেতে দিতে পারে? #পাঠ_প্রতিক্রিয়া_ * প্লট নির্বাচন : উপন্যাসের সবচেয়ে এহেম অংশ হলো প্লট নির্বাচন। প্রান্তিক জনজীবন আর প্রভাবশীল কতিপয় লোকের সাথে জীবনসংগ্রামে লড়ে যাওয়া মানুষের দ্বন্দ্ব, জীবনযাত্রা , কৈশোর, অনিশ্চিত ভালোবাসা আর তথোকথিক সামাজিকতাকে কেন্দ্র করে এই উপন্যাসের প্লট নির্বাচিত হয়েছে। বইটার ভেতরকার থিম মুলত একশ্রেণীর লোকের অস্তিত্ববাদ। উপন্যাসের সব চরিত্র মুলত পাটকলের ওপর নির্ভরশীল আর পাটকলের কলকাঠি মুলত আমজাদ প্রেসিডেন্ট এর হাতে। এক কথায় পুরো উপন্যাস জুড়ে সব ঘটনার মুলে আমজাদ প্রেসিডেন্ট আর তার ক্ষমতায় টিকে থাকার আকাঙ্ক্ষা। পাশাপাশি গ্রাম্য লোকাচার, রাডার নিয়ে ভ্রান্ত ধারণা, ভালোবাসা, মানবিকতা সব মিলিয়ে পরিপুষ্টা একটা প্লট। লেখক উপন্যাসের প্লট নির্বাচনেই বাজিমাত করে দিয়েছেন। * সংলাপ ও বর্ণনা : বইটার লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো বইটা ন্যারেটিভ স্টাইলে লেখা। তার সাথে অল্প বিস্তর সংলাপের ব্যবহার ও আছে। বর্ণনা নির্ভর বইগুলোর ক্ষেত্রে পাঠকের হাপিয়ে ওঠার সুযোগ থাকে। আর তাছাড়া অতিবর্ণনা এবং অপ্রাসঙ্গিক বর্ণনা উপন্যাসকে কলুষিত করতে পারে। "কালচক্র" উপন্যাসের ক্ষেত্রে এবিষয়টা লেখক কাটিয়ে ওঠতে পেরেছেন। অযথা অপ্রাসঙ্গিক বর্ণনা ও আবেগ টেনে বইটাকে দীর্ঘায়িত করা হয়নি । তবে সংলাপের ক্ষেত্রে লেখক আরোকটু ফোকাস করতে পারতেন বলে আমার ধারণা। *যথার্থ শব্দচয়ন ও যথার্থ ভাষার ব্যবহার একটা উপন্যাসের বেশ গুরুত্ববাহী দিক। কালচক্রে আমরা একটা গ্রামীণ প্রেক্ষাপট পাচ্ছি। অতএব ভাষাগত দিকটা বেশ নজরে রাখা দরকার ছিল আর লেখক সেটা বেশ ভালো করেই বুঝতে পেরেছেন। শব্দচয়ন বেশ ভালো ছিল। তবে বেশ কিছু শব্দ ঘুরে ফিরে বারবার আসছিল। যাহোক সব মিলিয়ে ভাষাগত সৌকর্য বেশ ভালোভাবেই সম্পন্ন হয়েছে বইতে। * সাসপেন্স! সামাজিক উপন্যাস মুলত ফোকাস রাখে বর্ণনা রীতি আর প্রবাহের দিকে। কিন্তু তারপরও সাসপেন্স রাখাটাও বেশ জরুরি। বইটাতে প্রবাহ বেশ স্মুথ হলেও সাসপেন্স আর টুইস্টের অভাব বোধ করেছি। বেশ কিছু জায়গায় লেখক সাসপেন্স রাখতে চেয়েছেন যার পুরোটা ফলপ্রসু হয়নি এবং বেশ কিছু জায়গায় সেটা পূর্বেই অনুমান করা গেছে। হালকথা, পাঠক হিসেবে বইটার এদিকটা কিছুটা দুর্বল ছিল বলে আমি মনে করি। * চারিত্রিক স্বাতন্ত্র্য ও দ্বৈততা। ভালো মন্দ দুই ই মানবচরিত্রের বৈশিষ্ট্য, সুতরাং চারিত্রিক দ্বৈততা দেখাতে না পারলে, চরিত্রগুলো যদি কেবল একমুখী হয় তবে উপন্যাসের যথার্থতা হারাবার আশঙ্কা থাকে। এ বইটাতে চরিত্রগুলো স্বতন্ত্রভাবে প্রকাশিত আর দ্বৈততা ফলাও করে চোখে পড়ার মত। যেমন আমজাদ প্রেসিডেন্ট চরিত্রটা ক্ষমতালোভী, অস্তিত্ববাদী আবার যখন জগলুর ছেলের প্রসঙ্গ আসে তখন বেশ দরদী আবার কিছুক্ষণ পরেই শোষক ও নীচ চরিত্রের প্রতিচ্ছায়া। পলাশের বাবা একদিকে পুরোপুরিভাবে কেয়ারলেস আবার সন্তানবাৎসল্য তার কোনো অংশে কম নয়। মিস্টি মেয়েটা একদিকে যেমন ভালোবাসার কাঙাল তেমনি রক্ষণশীল। তেমনি প্রায় সবগুলো চরিত্রে এমন বিপরীত গুণের সমন্বয় বেশ উপভোগ্য। চরিত্র নির্মাণ ও গল্পের সাথে চরিত্রের সামঞ্জস্য রক্ষা করা উপন্যাসের একটা অন্যতম প্রধান দিক আর এ দিক বিবেচনায় বই পুরোপুরিভাবে সার্থক। *গল্পের সিকুয়েন্স : উপন্যাসকে আকর্ষণীয় করে তোলতে সিকুয়েন্স এর বিকল্প নেই। যেমন বই এর শুরুটা মহুয়া পিসির আত্মহত্যা দিয়ে হলেও মুহূর্তেই গল্পটা ফোকাস করেছে জগলুর তেল চুরির ঘটনায়। তারপর গল্পের শাখা ছড়িয়েছে পলাশ, পাটকল আর সেখানকার মানুষের মাঝে। গল্পগুলো সমান্তরালে চলতে থাকা সমাজের বিভিন্ন খন্ডের চিত্র দেখাতে দেখাতে অগ্রসর হয় সামনের দিকে। আর এই অনবদ্য সিকুয়েন্স বইটার সবচেয়ে স্ট্রং দিক। * নামকরণ, প্রচ্ছদ, প্রুফরিড : একটা নির্দিষ্ট সময়ের ভেতর একটা নির্দিষ্ট এলাকার কতিপয় লোকের জীবনের উৎকর্ষ অপকর্ষের চক্রাকারে আবর্তের মাধ্যমে বইটার নামকরণের সার্থকতা নিহিত। প্রচ্ছদের নদীর ছবি আর একটা হলুদাভ ব্যকগ্রাউন্ড একটা বিষণ্ন ভাব ফুটিয়ে তুলেছে। আবার নৌকার পালের রঙটা যেন বিষণ্নতার মাঝে আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। বইটার মুল থিম জীবনযাত্রা, আশা আকাঙ্ক্ষা, অপ্রাপ্তি, অস্তিত্ববাদ। এ বিষয়টা প্রচ্ছদে বেশ ভালো করেই প্রস্ফুটিত। বইটার প্রুফ নিয়ে আমি কিছুটা আশাহত, কিছু বানানে ভুল নজরে এসেছে। কিছু জায়গাতে লাইন ব্রেকের দরুন শব্দ ভেঙ্গে গেছে। এবিষয়গুলো নজরে রাখা উচিত ছিল। কিছু সমান্তরাল ঘটনার আর চরিত্রের মিথস্ক্রিয়ার ভেতর দিয়ে সুক্ষ্ম জীবনবোধ ফুটিয়ে তোলা একজন উপন্যাসিকের কর্তব্য। মানছি যেটা হালযুগের অনেক লেখকই পারেন না আর তার জন্যেই একগাদা সাদাকালো শব্দের আর পেজের বুনন কেবল লেখা হয়েই থেকে যায় । এ বইতে মুলত জীবনযাত্রার প্রতি নজর দিয়ে ছোট ছোট অনেকগুলো গল্পের সন্নিবেশ ঘটানো হয়েছে। বিস্তারিত প্রেক্ষাপটে এতগুলো চরিত্রের সন্নিবেশ বর্তমান লেখকদের মাঝে বেশ বিরল। অস্তিত্ববাদ নিয়ে বর্তমানে কিছু নতুন লেখক লিখছেন। যেমন "সুঁয়া উড়িল উড়িল জীবেরও জীবন" বইতেও অস্তিত্ববাদ নিয়ে বলা হলেও তাতে বেশ কিছু চারিত্রিক ত্রুটি চোখে পড়েছে। সমসাময়িক বইগুলোতে চরিত্র নির্মাণ ও যোগসুত্র স্থাপনে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে (অন্তত আমার তাই ধারণা) সে হিসেবে বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা লেখক কালচক্রে কাটিয়ে ওঠতে পেরেছেন। হালকথা যাদের সামাজিক উপ্যাখ্যানে রচিত বই পছন্দ তারা "কালচক্র" পড়ে অন্তত নিরাশ হবেন না। #প্রিয়_উক্তি মায়া জিনিসটা বাল্যবন্ধুর মতো। একবার সামনে এসে দাঁড়ালে তাকে আর এড়ানো যায় না। ভীষণ আবেগে জাপটে ধরতে হয়।

      By Hafizul Islam Hridoy

      02 Mar 2018 10:34 AM

      Was this review helpful to you?

      or

      ইমরান ভাইয়ের কালচক্র বই টা প্রথম দেখাতেই অর্ডার করে ফেলেছিলাম। বই টা পড়ার পড়ে এক অদ্ভুত প্রশান্তি পেয়েছি। মনে হচ্ছিলো পুরো দৃশ্য যেন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। বই কেনা টা সার্থক। ইমরান ভাইয়ের কাছে প্রত্যাশা, ভবিষ্যতেও যেন এমন বই আমরা পাই। পড়ুয়া দের জন্য বইটি একখানা মাস্টারপিস।

    •  

    Recently Viewed


    Great offers, Direct to your inbox and stay one step ahead.
    • You can pay using


    JOIN US

    icon Download App

    Rokomari.com is now one of the leading e-commerce organizations in Bangladesh. It is indeed the biggest online bookshop or bookstore in Bangladesh that helps you save time and money. You can buy books online with a few clicks or a convenient phone call. With breathtaking discounts and offers you can buy anything from Bangla Upannash or English story books to academic, research or competitive exam books. Superfast cash on delivery service brings the products at your doorstep. Our customer support, return and replacement policies will surely add extra confidence in your online shopping experience. Happy Shopping with Rokomari.com!