User login
Sing In with your email
Send
Our Price:
Regular Price:
Shipping:Tk. 50
প্রিয় ,
সেদিন আপনার কার্টে কিছু বই রেখে কোথায় যেন চলে গিয়েছিলেন।
মিলিয়ে দেখুন তো বইগুলো ঠিক আছে কিনা?
Share your query and ideas with us!
Was this review helpful to you?
or
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান তাঁর কর্মময় এবং বর্ণিল জীবনের আশিটি বছর পার করে একাশিতে পা রেখেছেন। এই দীর্ঘ জীবনে তিনি তাঁর জ্ঞান, পাণ্ডিত্য, সৃজনশীলতা, উদার মানবিকতা এবং সত্য ও সুন্দরের নিরন্তর সাধনায় নিজেকে এমন এক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন যে এখন তিনিই তাঁর তুলনা। এজন্য তাঁর নামের আগে-পরে কোনো বিশেষণের প্রয়োজন পড়ে না। কোনো আসরে অথবা সভা-সম্মিলনে প্রথা মেনে তাঁকে পরিচিত করানোর জন্য তাঁর নামটি উচ্চারণ করাই যথেষ্ট। আমাদের দেশে তাঁর মতো বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষকে সম্মান করা হয়। কিন্তু অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে শুধু এই কারণে কেউ যদি সম্মান জানায়, তাহলে তাঁর স্বভাবজাত তারুণ্যের জন্য তাঁকে অভিবাদনও জানাতে হবে। এই তারুণ্য তাঁর জীবনকে অনুভব এবং উপভোগ করার, এক আশাবাদী এবং সম্মুখ-নিবদ্ধ দৃষ্টিতে উজ্জীবিত হবার এবং বাঙালির সংস্কৃতি ও লোকায়ত দর্শন থেকে শক্তি সংগ্রহের। তাঁর সঙ্গে যাঁরাই পরিচিত হয়েছেন, তাঁরাই প্রশংসা করবেন তাঁর প্রাণশক্তির প্রাচুর্যের, তাঁর সূক্ষ্ম রসবোধের, তাঁর সৌজন্যের। এজন্য তাঁর আশি বছর পূর্তির উৎসবটি কিছু আপাত-বিরোধী অনুধাবনের বিষয় হয়ে দাঁড়ায় : আমরা কি একজন অশীতিপর মানুষের পথচলার এক মাইলফলককে উদ্যাপন করছি, নাকি তাঁর এক জীবনের একইসঙ্গে তারুণ্যভরা এবং প্রজ্ঞামণ্ডিত অর্জনগুলি উদ্যাপন করছি, জীবনের পথচলার এই মাইলফলকটি যার একটি উপলক্ষ মাত্র? আমরা কি এক গর্বিত বাঙালির স্থানীয়তা, তাঁর অভিঘাত এবং অনিবার্য উপস্থিতিকে উদ্যাপন করছি, নাকি এক বিশ্বপথিক, আন্তর্জাতিক মননের আধুনিক মানুষকে অভিবাদন জানাচ্ছি? আমরা কি এক অমায়িক, নির্বিরোধ মানুষের সহযাত্রাকে প্রশংসা করছি, নাকি এক দৃঢ়চিত্ত, নীতিনিষ্ঠ, আপন বিশ্বাসে অটল মানুষকে সম্মান জানাচ্ছি? এই আপাত-বৈপরীত্য অথবা বিভ্রমের কারণ, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান একইসঙ্গে বহু অবতার ধারণে সক্ষম। তিনি একজন শিক্ষক, কিন্তু তিনি বন্ধুও বটে; তিনি সভা-সেমিনারে-শ্রেণিকক্ষে গভীরতাসন্ধানী এবং তাত্ত্বিক আলোচনাতে যেমনকুশলী, তেমনি ব্যক্তিগত আলাপচারিতা এবং আড্ডাতেও; তিনি পোশাকে-আশাকে চিরায়ত বাঙালি, কিন্তু তাঁর জীবনাচরণ এবং রুচিতে রয়েছে পশ্চিমা আধুনিকতার শ্রেয়তর প্রকাশগুলির উপস্থিতি। তিনি তাঁর জ্ঞান ও মনীষায় বুদ্ধিবৃত্তিক এক সমুন্নতি ঘটান, আবার দেশের ও সমাজের প্রয়োজনে তিনি রাজপথে নেমেও আন্দোলন-বিক্ষোভে অংশ নেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার অথবা নানান উগ্রবাদের বিস্তার; শিক্ষার অধিকার, পরিবেশ সংরক্ষণ অথবা সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রশ্নে তিনি যে সক্রিয়তা দেখান, তাতে, পশ্চিমে যাকে পাবলিক ইন্টেলেকচুয়াল বলে, সেই অবস্থানে তিনি সহজেই অধিষ্ঠিত হন। পাবলিক ইন্টেলেকচুয়াল হওয়ার একটি বিপদ অবশ্য আমাদের দেশে আছে, এবং তা হলো : নীতি, আদর্শ বা অধিকারের প্রশ্নে সামাজিক প্রতিবাদ বা প্রতিরোধে অংশগ্রহণ ছাড়াও প্রতিদিনের অনেক কর্মকাণ্ডে তাঁকে উপস্থিত থাকতে হয়, কিছু ব্যক্তিগত দায়মোচন ছাড়া যেগুলির বিশেষ কোনো মূল্য নেই। এতে তাঁর সময় ও শক্তির ওপর অনাবশ্যক টান পড়ে, যদিও অধ্যাপক আনিসুজ্জামান হাসিমুখে তা মেনে নেন। সম্প্রতি তাঁর স্বাস্থ্যগত কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছিল, প্রাথমিকভাবে যেগুলোকে গুরুতর মনে হয়েছিল। আমাদের সকলের উদ্বেগ নিরসন করে তিনি বিদেশের হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা শেষে সুস্থ হয়ে দেশে ফিরলে আবার প্রাত্যহিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন। তাতে ডাক্তারের এবং পরিবারের নিষেধ অমান্য হলেও তিনি নিজে তেমন ক্লেশ বোধ করলেন নাÑঅথবা করলেও সৌজন্যের কারণে তা স্বীকার করলেন না। বাংলাদেশে তাঁর পৌরোহিত্য যে-কোনো অনুষ্ঠানকেÑতা কোনো গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন হোক অথবা কারও জন্মবার্ষিকী পালন করা হোকÑএকটি উন্নত মর্যাদা দেয়। তাঁর মতো এতটা উদারতায় আর কাউকে কারও প্রয়োজনীয় অথবা অপ্রয়োজনীয় অনুরোধ রাখতে দেখিনি। অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের সাম্প্রতিক অসুস্থতার কথা উল্লেখ করেছি। এই অসুস্থতা আমাদের শঙ্কিত করেছিল। ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে তাঁকে দেখতে গেলে এক ডাক্তার আমাকে বলেছিলেন, ‘বাইরের কাজ তাঁকে একেবারে কমিয়ে দিতে হবে। তা না হলে তাঁর সুস্থতা নিশ্চিত হবে না।’ অধ্যাপক আনিসুজ্জামান একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসককে ভুল প্রমাণ করেছেন; তাঁর ‘বাইরের কাজ’ মোটেও তেমন কমাননি। এখনও তিনি সপ্তাহে এক দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হাজিরা দেন, নানান মঞ্চে সভাপতির পদ অলংকৃত করেন, আরও অনেক অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকেন। এর একটি কারণ তাঁর স্বভাবসুলভ তারুণ্য, অন্যটি তাঁর প্রেরণাদায়ী স্বভাব। তিনি মানুষকে কখনও শ্রেণি, সামাজিক মর্যাদা, পেশা অথবা বিত্তের মাপে বিচার করেন না। তাঁর কাছে ছোটো-বড়ো বিভাজনটি একটি উত্তরাধুনিক বৈচিত্র্য বা বহুত্ব উদ্যাপনের মতো। একেবারে তরুণ একজন কবির সঙ্গে তিনি যেভাবে কথা বলবেন, প্রবীণ এক কবির সঙ্গেও বলবেন ঠিক সেইভাবে। অর্থাৎ তরুণ অথবা অভিজ্ঞের গুরুত্বকে তিনি খাটো করেন না। সেজন্য তিনি সকলের জন্যই অনুপ্রেরণার এক উৎস। তবে কারও রুচির অভাব থাকলে তাকে তিনি এড়িয়ে চলেন, যদিও লোকটি সম্পর্কে কোনো উচ্চবাচ্য তিনি করেন না। তাঁর একটা পক্ষপাতিত্ব অবশ্য থাকে আপন ও প্রিয়জনদের জন্য। তাঁর বন্ধুত্বের পরিসরটি বড়ো। তাতে সব বয়সের মানুষের সমাবেশ দেখা যায়।আমার কাছে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান একজন সক্রিয় চিন্তার মানুষ, মার্কিন চিন্তাবিদ-লেখক-প্রকৃতিপ্রেমী র্যালফ ওয়াল্ডো এমার্সনের ভাষায় গধহ ঃযরহশরহম। এই সক্রিয় চিন্তার মানুষ তাঁর আবেগকে রাখেন বুদ্ধির শাসনে, ইতিহাস ও সময়কে দেখেন বস্তুনিষ্ঠ দৃষ্টিতে, সংকটে-সন্তাপে থাকেন স্থিরচিত্ত। এই মানুষের কাছে মানবিকতা আর সামাজিক অংশগ্রহণ গুরুত্ব পায়। সক্রিয় চিন্তার মানুষ অতীতকে আবিষ্কার করেন বইয়ের মধ্য দিয়ে, গবেষণার মধ্য দিয়ে; প্রকৃতিকে কল্পনা করেন মানসগঠনের পেছনে বড়ো একটি প্রভাব হিসেবে এবং সংস্কৃতির শক্তিতে পেতে চান তার সকল শুদ্ধতা নিয়ে। এসবই আমি অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের মধ্যে পাই। সমকালীন ইতিহাসকে তিনি এক দীর্ঘদৃষ্টিতে দেখেন, ফলে রাজনীতির পালাবদলে অথবা বিপর্যয়ে তিনি বিচলিত হন না। দেশে যখন সাম্প্রদায়িকতা শক্তি অর্জন করে, তিনি আমাদের শঙ্কিত না হতে বলেন, যেহেতু তিনি জানেন, ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, সমাজ বিবর্তনের পথে এই ধরনের বাধাবিপত্তি আসে। এগুলো অবিচল থেকে সামাল দিতে হয়। ১৯৬১ সালে পাকিস্তান সরকার রবীন্দ্রনাথকে নির্বাসনে পাঠাবার চেষ্টা করলে তিনি তার প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছেন। তাঁর সম্পাদনায় রবীন্দ্রনাথের ওপর নানা প্রবন্ধের যে সংকলনটি বেরোয়, তা একটি মোক্ষম জবাব ছিল পাকিস্তানি কূটচালের। এটি বলার অপেক্ষা রাখে না যে বইটি শুধু রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকীর্তিকেই তুলে ধরেনি, রবীন্দ্রনাথকে আমাদের কেন প্রয়োজন, তিনি কী উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারেন আমাদের জন্যÑএরকম অনেক জিজ্ঞাসারও উত্তর দিয়েছে। ১৯৭১-এ তিনি বাংলাদেশের জন্য বিশ্বজনমত সৃষ্টিতে ভূমিকা রেখেছেন। আফ্রো-এশীয় লেখক সংঘের তিনি ছিলেন এক সক্রিয় কর্মী। নিজের দেশের সীমানা ছাড়িয়ে দুই মহাদেশে ব্যাপৃত ছিল তাঁর কর্মক্ষেত্র। ফলে বাংলাদেশের পক্ষে এই দুই মহাদেশের লেখক-শিল্পীদের সমর্থন আদায়ে তাঁর বেগ পেতে হয়নি। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের কপালে যদি একাত্তরের ঘাতকরা একটা কলঙ্কতিলক এঁকে দেয়, আরেকটি এঁকে দিল পঁচাত্তরের আগস্টের ঘাতকেরা। এ দুই ঘাতকদলের বিরুদ্ধে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান সরাসরি দাঁড়িয়েছিলেন। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান আমার শ্রেণিকক্ষের শিক্ষক ছিলেন না। তাঁর ও আমার বিষয় ভিন্ন। শিক্ষক বলতে আমরা যা বুঝিÑজ্ঞানসাধক ও জ্ঞান-উৎপাদক, আদর্শ ও মূল্যবোধের ধারক, যাঁর সংস্পর্শে এলে সেই জ্ঞান ও মূল্যবোধ কিছুটা হলেও সঞ্চালিত হয় প্রত্যাশীর মধ্যেÑতিনি প্রকৃত অর্থে তাই। একজন শিক্ষক, পথপ্রদর্শক অধ্যাপক আনিসুজ্জামানও তরুণদের পথ দেখান। তারাও তাঁর ছাত্র। এজন্য তাঁর ছাত্ররা ছড়িয়ে আছে সারা দেশে। যারা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েনি, তাদের অনেকেও তাঁর জ্ঞান ও জীবনদর্শনে অনুপ্রাণিত হয়েছে। তাঁকে শিক্ষক হিসেবে মেনে নিয়েছে। তিনি শিক্ষার সেই সংস্কৃতির ঐতিহ্যে নিজেকে স্থাপন করেছেন, যা উনিশ শতক থেকে নিয়ে এ পর্যন্ত বাংলাদেশে জ্ঞানচর্চার স্রোতটি বেগবান করেছে, যাতে সংস্কৃতির মূল চিন্তাগুলো এবং শিক্ষার আদর্শগুলো এক চমৎকার জায়গায় এসে মিলেছে। শিক্ষার এই সংস্কৃতি জীবনমুখী, প্রাগ্রসর; এর বিশ্বাস যুক্তিতর্ক-ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে; এটি একদিকে আধুনিক, সমকালীন; অন্যদিকে ঐতিহ্যসচেতন। যাঁরা এই সংস্কৃতির সাধক, তাঁরা কুসংস্কার ও কূপমণ্ডূকতা, বর্ণবাদ ওজাত্যভিমান, উগ্রতা আর অসহিষ্ণুতা, সন্ত্রাস আর অনাচারের বিরুদ্ধে চিন্তার প্রতিরোধ করেন। মানুষকে চিরাচরিত কিছু মূল্যবোধ, উদারপন্থা, মানবিকতা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের পতাকা তুলে ধরতে আহ্বান জানান। তাঁরা নারীর প্রতি বৈষম্য ও সংখ্যালঘুদের প্রতি অবহেলার বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টি করেন; তাঁরা প্রগতিকে জ্ঞান ও সাংস্কৃতিক অর্জনের প্রেক্ষাপটে বিচার করতে মানুষকে অনুপ্রাণিত করেন। একসময় শিক্ষার এই সংস্কৃতি ও চিন্তার সক্রিয়তাটা খুবই সবল ছিল। এখন এটি দুর্বল হয়েছে নানা কারণে। কিন্তু অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, তাঁর আরও সহযাত্রীর সঙ্গে, সংস্কৃতির এই স্রোতটিকে সঞ্জীবিত করে তাকে বেগবান করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। চিন্তার সক্রিয়তা অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের সহজাত। বাংলা সাহিত্য ও বাংলাদেশের সমাজ নিয়ে তাঁর পঠনপাঠন গভীর ও পরিব্যাপ্ত। তিনি এ দুই অঞ্চলের শ্রেষ্ঠ চিন্তা ও জ্ঞানচর্চার অনুবর্তী এবং তাঁর নিজের জীবনেও সেগুলোর প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। আমাদের সময়ে একজন শিক্ষাবিদের ওপর অনেকগুলো দায়িত্ব বর্তায়। তিনি যে শুধু শ্রেণিকক্ষে পড়াবেন, গ্রন্থাগারের নির্জনতায় গবেষণা করবেন, তা নয়। তাঁকে তাঁর চিন্তাকে সক্রিয় করে, জ্ঞানকে সমাজবদলের হাতিয়ারে পরিণত করতে হয়। তাঁকে পথ দেখাতে হয়। পথে নামতে হয়। আর সবচেয়ে বড়ো যা, নিজের জীবনে জ্ঞানাদর্শগুলোকে প্রতিফলিত করতে হয়। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান প্রায় ছয় দশক ধরে এই কাজগুলো করে যাচ্ছেন। তিনি বাংলায় অধ্যাপনা করছেন, গবেষণা করছেন, বাংলা একাডেমির সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন; তাঁর সম্পাদনায় অনেক সাহিত্য ও গবেষণার কাগজ বেরিয়েছে। এখন তিনি কালি ওকলম-এর সঙ্গে যুক্ত আছেন। তিনি দেশের অনেক সাংস্কৃতিক সংগঠনের পেছনে অনুপ্রেরণাকারীর ভূমিকায় আছেন। রবীন্দ্রসংগীত থেকে উচ্চাঙ্গ সংগীতÑযখনই এসব বিষয়ে কোনো সম্মেলন হয়, তাঁরসহযোগিতা থাকে। শুধু ঢাকা নয়, ঢাকার বাইরেও তিনি ছুটে যান, যখন ডাক পড়ে। তিনি ‘রুখে দাঁড়াও বাংলাদেশ’-এর নেতৃত্ব দিচ্ছেন, যে সংগঠনটি সাম্প্রদায়িকতা, উগ্রবাদ এবং সহিংসতার বিরুদ্ধে একটা শক্ত অবস্থানে দাঁড়িয়ে কাজ করে যাচ্ছে। যখন ডাক পড়ে, তিনি বাংলাদেশের যে-কোনো জায়গায় গিয়ে প্রতিবাদ-প্রতিরোধে শামিল হন। তিনি বিবেকের পক্ষে তাঁর অবস্থানটি নিয়ে কখনও কোনো দুর্বলতা দেখাননি। অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে অনেকভাবেই দেখা যায়, তাঁর কাজ অনেকভাবেই পড়া যায়। তিনি শিক্ষক, চিন্তাবিদ, সাহিত্য ও সমাজগবেষক; তিনি সংস্কৃতি (এবং শুধু বাংলাদেশের নয়,বাংলার বাইরের সংস্কৃতিও) নিয়ে তাত্ত্বিক একটি ভূমি তৈরি করেছেনÑবলা যায় এ অঞ্চলে সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদের পঠনপাঠনেরও তিনি একজন পথিকৃৎ। তিনি সামাজিক-রাজনৈতিক নানা আন্দোলনের একজন নিষ্ঠাবান কর্মী। তিনি সম্পাদক এবং সমাজসচেতক। বাংলাদেশের সংবিধানপ্রণেতাদের মধ্যে তিনি ছিলেন, একাত্তরের ঘাতকদের বিচারের জন্য স্থাপিত গণ-আদালতের তিনি একজন সদস্য ছিলেন। অর্থাৎ আইন ও বিচারের ক্ষেত্রেও তাঁর স্পষ্ট মানবতাবাদী, বৈষম্যবিরোধী একটি অবস্থান আছে। তিনি বাংলাদেশের হলেও আফ্রো-এশীয় লেখক-শিল্পীরা তাঁকে আপনজন ভাবেন। ভারত সরকার তাঁকে ‘পদ্মভূষণ’ উপাধি দিয়েছে। তিনি বিশ্বের নানা বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা করেছেন। দেশের নানা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে তাদেরনানা পরিষদে রাখতে চায়, যেহেতু শিক্ষা নিয়ে তাঁর একটি দর্শন আছে, যার মূল ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিতে। অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের জন্মদিনটি পালনের জন্য আমাদের ব্যাপক প্রস্তুতি ছিল, কিন্তু তাঁর অসুস্থতার জন্য আমরা এর উদ্যাপন পিছিয়ে দিই। আমরা তাঁর জীবন আর কাজ নিয়ে একটি স্মারকগ্রন্থ প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছিলাম এবং তাতে সাড়া দিয়ে অনেকেই লেখা পাঠিয়েছেন। সেগুলো একত্র করে এই গ্রন্থটি সাজানো হয়েছে। তাঁর সম্পর্কে ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণের পাশাপাশি তাঁর মননশীল নানা কাজের এবং তাঁর চিন্তাভাবনা নীতি-আদর্শ এবং বুদ্ধিবৃত্তিক সক্রিয়তার মূল্যায়ন এবং বিশ্লেষণ এই গ্রন্থে তুলে ধরা হয়েছে। তাঁকে নিয়ে লেখা কবিতাও এখানে স্থান পেয়েছে। সব মিলিয়ে স্মারকগ্রন্থটি নানা আনিসুজ্জামানের একটি মালা আমাদের উপহার দেয়। আমরা তাঁর আশি বছর পূর্তি বা একাশি বছরে পদার্পণকেই শুধু উদ্যাপন করছি না, করছি তাঁর সারাজীবনের অর্জনকে, তাঁর আনিসুজ্জামান হয়ে ওঠাকে এবং আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতিতে তাঁর অনিবার্য উপস্থিতিকে। আমরা প্রার্থনা করি তিনি সুস্বাস্থ্য এবং তাঁর তারুণ্যের শক্তি নিয়ে আরও অনেক বছর আমাদের মধ্যে থাকুন, যাতে আমরাও তাঁর কাছাকাছি যাওয়ার অনুপ্রেরণা পাই। সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম