User login
Sing In with your email
Send
Our Price:
Regular Price:
Shipping:Tk. 50
প্রিয় ,
সেদিন আপনার কার্টে কিছু বই রেখে কোথায় যেন চলে গিয়েছিলেন।
মিলিয়ে দেখুন তো বইগুলো ঠিক আছে কিনা?
Share your query and ideas with us!
Was this review helpful to you?
or
এককথায় বলতে গেলে অসাধারণ। তবে শেষের দিকে লেখক ফিনিশিং দিতে গিয়ে খুব তাড়াহুড়ো করেছেন বলে মনে হয় আমার।যদিও এটা সম্পূর্ণ আমার ব্যক্তিগত মতামত।আর বাদবাকি দুই একটা শব্দচয়নে ভুল হয়েছে।তারপরও প্লটটি সত্যিই খুবই ইন্টারস্টিং।প্রথমদিকে একটু স্লো মনে হতে পারে,কিন্তু এরপরথেকেই গল্পের স্বাদ পেতে থাকবেন।
Was this review helpful to you?
or
প্রতিনিয়ত স্বপ্নের স্থলন হয়, আমরা কেউই জানিনা আগামিকাল কি ঘটবে। কেউ হটাত করে মরে যেতেই পারে, সেই ঘা’ও শুকিয়েও যায় মাসের ব্যবধানে। কিন্তু ইচ্ছে অনিচ্ছায় শতবছরের ভিটেমাটিকে ছেড়ে চলে যাওয়ার কষ্টটা বয়ে বেড়াতে হয় আজীবন, এটা একধরনের পাপ বৈকি। তবে সব পাপের আবার শাস্তি নেই। কিছু কিছু পাপ সংগঠিত হয় শান্তির জন্য, তেমনই শান্তি আর অশান্তির গল্পকে সাহিত্যের নিখাঁদ সেলাইতে বুনে এক করেই ‘নিঃশব্দ’ লিখেছেন তরুণ লেখক সাইফুদ্দিন রাজিব। লেখকের প্রতি পাঠকের বিশ্বাস তৈরি হয় তার লেখা পড়ে, যেটা দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার। কিন্তু লেখকের যখন প্রথম প্রকাশ, তখন হয় যত চিন্তা। দীর্ঘ উপন্যাসটি প্রচারে লেখক বা প্রকাশকের পক্ষে দু-একশ শব্দে তুলে ধরা সম্ভব হয়ে ওঠে না। কাহিনীর ভেতরের গল্পগুলো তুলে ধরা প্রায় অসম্ভব বলেই অঙ্কুরে হারিয়ে যায় কিছু লেখক আর তার সমৃদ্ধ সেই সৃষ্টি। তবে নিঃশব্দ উপন্যাসটি পাঠক আপন বিশ্বাসে খুঁজে নেবে বলেই আমার বিশ্বাস। কারণ উপন্যাসটির চিত্র বা প্লটকে আমার একটা বটবৃক্ষ মনে হয়েছে। আশির দশকের শেষের এই সামাজিক চিত্রকে তুলে আনতে লেখক যে রীতিমত মাঠে নেমে গবেষণা করেছেন বইটির সামগ্রিক চিত্রে তাই দারুণভাবে ফুটে উঠেছে। নিঃশব্দ উপন্যাসটা হাতে নেবার সাথে সাথে সবথেকে আকর্শনীয় বিষয় বইটির প্রচ্ছদ ও নামকরণ। উপন্যাসটা শেষ করে আবার ফিরে আসতে হয় লেখক আর প্রচ্ছদশিল্পী কতটা সার্থক ঠিক এই জায়গায়। গল্পের কাহিনীই যেন ফুটে উঠেছে এই দুই দৃশ্যপটে। প্রচ্ছদে স্থান পাওয়া নিঃশব্দ নামের সাথে একটা শিশুর অবয়ব। আক্ষরিক অর্থেই মনে হয় কাহিনীর মুল চরিত্র এই ছোট শিশু অপু, পরবর্তিতে দুরারোগ্য ব্যাধি ‘হাইপোগ্লোসাল নিউরাইটিসে’ আক্রান্ত হয়ে শিশুটি বাকশক্তি হারিয়ে ফেলে। সুতারং সে অর্থে নামকরণের একটা সার্থকতা ছিল ঠিকই কিন্তু তারপরেও লেখক সেখানে সীমাবদ্ধ থাকেননি। পুরো বইটির প্রতি পরিচ্ছেদে সামাজিক বার্তা ছড়িয়েছেন যা পাঠক হিসাবে আমাকে বেশ নাড়া দিয়েছে। ধর্মীয় সম্প্রীতি, সামাজিক-পারিবারিক দায়বদ্ধতা, কুসংস্কার, জাত-পাত ভেঙে চুরে লেখক কলম চালিয়েছেন বেশ দৃঢ়ভাবে। দায়িত্ববোধের গভীর নিদর্শন দেখিয়েছেন উপন্যাসের দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রধান চরিত্র সোমনাথ ও ভারতী দেবী। যুগপৎ ভাবে বর্ণনা করা উপন্যাসের মুল চরিত্র মুসলিম মা হিন্দু বাবার ঘরে জন্ম নেওয়া ছোট শিশু অপু। সামাজিক বিভীষিকার শিকার হয়ে স্ত্রীকে বাংলাদেশে ফেলে শিতের রাতে আট মাসের শিশু সন্তানকে নিয়ে কলাগাছের ভেলায় ইছামতী নদী পার হয়ে পশ্চিমবঙ্গে যেতে বাধ্য হয় সরকারী কর্মকর্তা সোমনাথ। বাগেরহাটের মোজাফফর সরদারের পরিবারকে দুইহাতে টেনে তুলেছিলেন সৌমেন বিশ্বাস ও পরের দিকে সোমনাথ বিশ্বাস। অথচ সেই পরিবারের সন্তানের নির্যাতনের শিকার হয়ে শুধুমাত্র শিশুসন্তানটিকে বাঁচাতেই দেশ ছাড়তে বাধ্য হয় সোমনাথ। উপন্যাসে পরের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র ভারতী দেবী। দারিদ্রতার করাল অক্টোপাসে বেঁধে থাকা এই বিধবা নারী দেখিয়েছেন দায়িত্বশীলতা আর মমত্ববোধের সর্বোচ্চ নিদর্শন, সেটা কখনো নিজ ভাই অথবা ভ্রাতাস্পুত্র পরশ এবং পরবর্তীতে শিশু সন্তান অপুর প্রতি। আজীবন দুঃখ বয়ে বেড়ালেও ব্যক্তিগত কষ্ট যখন ধীরে ধীরে লোপ পাচ্ছিল তখনই অসুস্থ অপুকে কোলকাতার হাসপাতালে বাকশক্তি হারাতে দেখে শোক সামলে উঠতে পারেননি। সকল নির্মমতাকে জয় করা ভারতী দেবী নিজেই পৃথিবী নিঃশব্দে। উপন্যাসটির এই সময়ে এসে কোন পাঠকের শরীর হিম হয়ে আসবে। থমকে যাবে চোখের পলক। লেখক হিসাবে সাইফুদ্দিন রাজিবকে খুবই নির্দয় মনে হয়েছে ভারতী দেবীর এই ঘটনায়। তবে সব দৃশ্যপট বদলাতে থাকে তার মৃত্যুর পরে, পদে পদে কষ্ট সইতে হয় ভারতী দেবী ও নিখোঁজ বাবাকে খুঁজে ফেরা শিশু সন্তান অপুকে। মুখে মুখে অপয়া বনে গেলেও মুদ্রার উল্টো পিঠে তাকে বুকে আগলে রাখার মত কিছু মানুষ থেকেই যায়। লেখককে এখানে সার্থক মনে হয়েছে, তিনি যেমন সামাজিক কুসংস্কার দেখিয়েছেন একইভাবে বোধের বিপরীত দিকও দেখিয়েছেন তার লেখনশৈলীতে। গল্পের অন্য পিঠে লেখক দেখিয়েছেন দুই স্ত্রী ও চার সন্তানকে নিয়ে মোজাফফর সরদারের সংসার। মমত্ববোধ, ধর্মীয় সম্প্রীতি ও সামাজিক দায়বদ্ধতার গুচ্ছ নিদর্শন ‘নিঃশব্দ’ উপন্যাসটি যে একটা দারুণ বটবৃক্ষ তার প্রমান মোজাফফর সরদারের পরিবার। সেখানে সামান্য পাণ বানানোতে যেমন রহিমা বেগম স্বামীর ভালবাসা খুঁজে পান তেমনি সন্তান জন্মদানে অক্ষম ছোট স্ত্রী নূরানি বেগম পেয়েছিলেন আকিবের মত ছোট্ট শিশুও। পারিবারিক ভালবাসায় কতটা ডালপালা ছড়াতে পারে লেখক সেটা গভীর ভাবে তুলেছেন নিঃশব্দের দৃশ্যপটে। মোজাফফর সরদারের চেয়ারম্যান হবার পরে সমাজের প্রতি নিবিড় দায়বদ্ধতার নিদর্শন হতে পারে যে কোন নেতৃত্ব দেওয়া ব্যক্তিরও। সাইফুদ্দিন রাজিব দেখিয়েছেন কীভাবে সুচারুরূপে ন্যায় অন্যায়কে আলাদা করা যায়। ব্যক্তিগত অভিমত হল ঔপন্যাসিক হিসাবে সাইফুদ্দিন রাজিব কতটা সফল হবেন সেটা হয়ত সময়েই জানা যাবে। তবে নিঃশব্দ উপন্যাস পড়ে যে কোন পাঠকই অপেক্ষা করবেন তার পরবর্তি সৃষ্টির জন্যে। লেখকের একটা বিষয় আমার কাছে চোখে পড়েছে তা হল ভাষাগত স্থলন। চরিত্রের প্রয়োজনে আঞ্চলিকতা এনেছেন হয়ত, কিন্তু বর্ণনায় বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের ভাষার মিশেল লক্ষ্য করেছি। যদিও উপন্যাসটি দুই অঞ্চলের পট নিয়ে তৈরি। তবে তার সাবলীল বর্ণনায় লেখককে নতুন মনে হয়নি। এক কথায় বললে, ‘নিঃশব্দ’ সামাজিক বার্তায় ভরপুর একটি উপন্যাস। বই: নিঃশব্দ; লেখক: সাইফুদ্দিন রাজিব; প্রকাশক: নালন্দা প্রকাশনী; ধরন: সমকালীন উপন্যাস
Was this review helpful to you?
or
বই: নিঃশব্দ লেখক: সাইফুদ্দিন রাজিব প্রকাশনী: নালন্দা প্রকাশ কাল: বইমেলা ২০১৮ পৃষ্ঠা: ২৫৪ প্রচ্ছদ: হিমেল হক মুদ্রিত মূল্য: ৪৫০৳ কাহিনী সংক্ষেপ: দেশ ভাগটা কেবলই যেন ধর্মের রেশ ধরে। নিজেদের শিকড় উপরে তাই হতে হয়েছে দেশান্তরী। তবে তা মোটেই যে ইচ্ছের নয়। বাপ দাদার ভিটে মাটি ছেড়ে যাবার ইচ্ছে তাদের কোন কালেই ছিলল না। তবে ভারতবর্ষ মানেই হিন্দুর দেশ, মুসলমানের ঠিকানা পূর্বপাকিস্তান মানে বাংলাদেশ। সেই বাংলাদেশের কোলঘেষে বয়ে চলা ইছামতী নদী, যার এককূলে ভারত অন্যদিকে বাংলাদেশ। কাঁটাতারের বেড়ায় অাটকে গেল তাদের অবাধ যাতায়াত। লুকিয়ে চুরিয়ে অাসতে গেলেও ধরা পরলে বন্ধুকের নলের মুখে দিতে হয় প্রাণ। যে মাটিকে ভালোবেসে একহাড়ির ভাত খেত হিন্দু মুসলিম, একই যাদের মায়ের ভাষা তারাই হয়ে গেল একে অন্যের শত্রু। দেশ ভাগকে কেন্দ্র করে বাঙালির যে মর্মভেদী অার্তনাদ সেই সব কাহিনী গেঁথেই পটভূমি রচনা নিঃশব্দের। ইছামতির পাড়ে প্রায়ই দাঁড়িয়ে থাকে চার/ পাঁচ বছরের এক ছোট্ট ছেলে অপু তাকে ঘিরেই এ উপন্যাস। যদিও অপুর কোন সংলাপ উপন্যাসে নাই অার এখানেই যেন নামকরনের স্বার্থকতা গল্পের। সোমনাথের বাবা সৌমেন বিশ্বাস ছিল মোজাফফর সরদারের আড়তের মুহুরি। ব্যবসার থেকেও তাদের মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্কটাই বেশি ছিল যেন। তাই হঠাৎ সৌমেনর মৃত্যু হলে সরদার দিশেহারা হয়ে পরে। সোমনাথই তাই হাল ধরে ব্যবসার এক বিপদ থেকে সরদারকে হাত ধরে তুলতে গিয়ে অন্য বিপদে ফেলে দেয় যেন। ভেতর বাড়িতে যাতায়াত করার ফলে এক সময় সরদারের মেয়ে নাসিমা দুর্বল হয়ে পড়ে সোমনাথের উপর। পালিয়ে বাঁচতেই যেন নিজের অবস্থান ঢাকায় ফিরে অাসে সোমনাথ কিন্তু ভালোবাসার টানে ধর্মের শৃঙ্খল ভেঙ্গে সোমনাথের কাছে এসে ওঠে নাসিমা। উঁচুজাতের প্রেমিকা নিধি তাকে মেনে নিতে না পারলেও ভিন্ন ধর্মের নাসিমার ভালোবাসার কাছে হেরে যায় সোমনাথ। তাই অার ফিরিয়ে দিতে পারে না নাসিমাকে। একসময় জন্ম হয় অপুর কিন্তু বিধিবাম হলে যা হয় সন্তানের জীবন বাঁচাতে শীতের রাতেই সোমনাথকে পারি দিতে হয় ইছামতি। নদীর এপারে থেকে যায় মা নাসিমা। সোমনাথের দূর সম্পর্কের অাত্মীয় ভারতী দেবী। অল্প বয়সে বিধবা হবার পর খেটে খুঁটে সন্তাদের মানুষ করলেও বৃদ্ধ বয়সে ভাইয়ের সন্তাই যার ভরসা হয়। অভাবের সাথে সংগ্রাম করে প্রতিনিয়ত যে বেঁচে থাকার লড়াই করে যায়। ক্ষুধার জ্বালায় যেখানে নিজ ভাই, ভাইয়ের বৌয়ের অপমৃত্যু দেখতে হয়েছে তাকে। অাট মাস বয়সী অপুকে নিয়ে তার কাছেই এসে ওঠে সোমনাথ। অভাবের সংসারের মুখ বাড়লেও কখনো অবহেলা করেনি অপুকে ভারতী দেবী। তার মায়াময় চোখের দিকে তাকিয়ে যেন সব ভুলে থাকা যায়। কিন্তু এভাবে তো সংসার চলে না। একদিন তাই সোমনাথ বাংলাদেশে ফেলে রাখা জমি বিক্রি করতে অাসে। দিনের পর দিন চলে যায় সোমনাথ অার ফিরে অাসে না। এদিকে অসুস্থ হয়ে বাকশক্তি হারিয়ে ফেলে অপু। শোক সামলাতে না পেরে অপুর একমাত্র অাশ্রয়কেন্দ্র ভারতীদেবীও পৃথিবী থেকে নিঃশব্দে প্রস্থান করে। নানা ঘরে নানান জনের ভালোবাসা কিংবা অনাদরে বেড়ে ওঠে অপু। অপু থেকে কখনো কখনো অপয়া বলতেও তাই দ্বিধা হয় না মাতৃতুল্য শোভা, ফুফু এমনকি পাড়ার মানুষদের। নিরব অভিমান বিসর্জন কিংবা বাবার প্রতিক্ষায়ই হয়তো সে দাঁড়িয়ে থাকে নদীর কিনারায়। নিজস্ব মতামত: বইমেলার শুরু থেকেই বইটা নিয়ে এতো এতো পাঠক প্রিয়তা অার রিভিউ দেখছি যে কখন একটু ছুঁয়ে দেখতে পাবো তার তীব্র অাকাঙ্ক্ষা ছিল। প্রচ্ছদটা এতো নজর কাড়া সাথে নামটাও তাই খুব অাগ্রহ নিয়ে ছিলাম। অবশেষে বইমেলায় না হলেও পরে কিনতে পারি তবে পড়ার সময় অার হয় না। যাই হোক অবশেষে পড়ে শেষ করছি। তবে প্রথম দিকে সেই তীব্র অপেক্ষার বা অাগ্রহে যেন পানি ঢেলে দিছে। তাই শুরু করেও অাগাতে পাড়ছিলাম না। এরকিছু পরেই যেন চমক শুরু সেই নির্জিব বর্ণনা অার নেই। লেখায় বুঝি এবার প্রাণ পেল। শেষ পর্যন্ত খুব ভালোই লাগলো এতোদিনের অপেক্ষা যেন অার হতাশ করলো না। ভারতীয় বাঙালিদের কথায় যে অালাদা বৈশিষ্ট্য লেখক অানতে চেয়েছেন তা কেন জানিনা মিশ্র মনে হয়েছে এছাড়াও কিছু কিছু শব্দ অামার কাছে ভালো লাগে নি। তবে উপন্যাসের কাহিনী, রাজনীতিকে ছাপিয়ে সামাজিক দৃশ্যপটের চিত্র অংকন বেশ মন ছুয়ে যায়। ধর্মকে ডিঙিয়ে ভালোবাসার বন্ধন এভাবেই দ্বিগবিজয় করে।
Was this review helpful to you?
or
প্রথিতযশা লেখকদের কথা বাদ দিলে বাংলাদেশের বর্তমান প্রজন্মে মৌলিক সাহিত্য নিয়ে লেখা যেকটা বই ২০১৮ সালের বইমেলা উপলক্ষ্যে বের হয়েছে বা হবে বলে প্রচার চলছে তারমধ্যে সব থেকে সমৃদ্ধ বইটির নাম 'নিঃশব্দ'। বইটির শেষ ফ্লাপে চোখ আটকে যায়, লেখক গল্প বলতে ভালবাসেন। মাটির গল্প, মানব পটের গল্প। গল্প করেন প্রেম, দ্রোহের বাইরেও সমাজের গল্প। বিশ্ব নাগরিক হিসাবে তিনি স্বপ্ন দেখেন সম্প্রীতির চেতনায় কাঁটাতার পেরিয়ে বাংলা সাহিত্য ছড়িয়ে পড়বে বিশ্বজুড়ে। লেখকের ভাবনা আমার বিস্ময়ে নাড়া দিয়েছিল, ২০১৭ সালের শেষাংশে এসে এমন একটা বিষয় নিয়ে লেখা যে কোন পাঠককে থমকে দেবেই। কিছু বই হয় কষ্ট, আনন্দের মাঝে শিক্ষার যে শিক্ষা আপনাকে ভাবতে বাধ্য করবে। নিঃশব্দ উপন্যাসটি তেমনই এক সৃষ্টি। ইতিমধ্যে বইটি নিয়ে বহু রিভিউ বাংলাদেশের গ্রুপগুলোতে দেখা গিয়েছে, এমনকী জাতীয় দৈনিকেও। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দরকার হয় তখন যখন সম্প্রদায়গুলো কলুষিত হয়। সবাই সম্প্রীতির কথা বললেও হিংসা থেকে উত্তরণের পথ না পেয়ে দেশান্তর হওয়ার প্রক্রিয়ায় সেঁকল পরাতে পারেনি কোন সরকারই। সেই কোটি মানুষের ভিড়ে নিঃশব্দ উপন্যাসের লেখক সাইফুদ্দিন রাজিব এমনই কিছু লোকের কথা বলেছেন যার সাথে মিশে আছে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের মানুষের দুই রকম দৃশ্যপট। অনেকেই সে বিষয়ে আলোকপাত করলেও যেটা কেউ করেনি আমি সেটাই তুলে ধরতে চাই। আর সে অর্থে উপন্যাসটি আমার কাছে 'দায়িত্ববোধের অসামান্য দলিল'। সংক্ষিপ্ত চিত্রঃ বইটি মূলত চার বছরের বাকশক্তি হারানো ও প্রত্যক্ষভাবে বাবা-মা'হীন শিশু সন্তান অপুকে কেন্দ্র করে সামাজিক, পারিবারিক দায়িত্ববোধের গল্প। বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে সোমনাথ বিশ্বাসের মাত্র সাতমাস বয়সী শিশুসন্তানকে নিয়ে ইছামতী নদী পার হয়ে বসিরহাটের এক গ্রামে নিকটাত্মীয় দরিদ্র ও বিধবা ভারতী দেবীর বাড়িতে আশ্রয় হয়। লেখক গল্পে যুক্ত করেছেন দায়িত্ববান তরুন সুকুমারের কথা, পিত্রবিয়োগের পরে বাংলাদেশ থেকে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য ভারতে আসার পরে বেশ সমস্যার মুখোমুখি পড়তে হয়। লেখক এখানে বলতে চেয়েছিলেন দেশ ছাড়লেই সেখানে সবাই ভাল থাকেনা। তার মানে তিনি নানা প্রতিবন্ধকতায়ও দেশ না ছাড়ার ব্যাপারে মৌন ভাব প্রকাশ করেছেন। ঘটনাক্রমে ভারতী দেবীর অষ্টাদশী কন্যা উমার সাথে সুকুমারের বিয়ে হয়। আর সেভাবেই সুকুমারও একটা পরিচয় পেয়ে ধীরে ধীরে নিজেকে তুলতে চেষ্টা করে। ঠিক ওই সময়ে অপুর বাবা বাংলাদেশে গিয়ে নিখোঁজ হলে অপু কেন্দ্রিক সকল জটিলতা শুরু হয়। অসুস্থ হওয়া, বাকশক্তি হারানোকে ঘিরে ততদিনে দুই অতঃপর তিন বছরের শিশুটিকে কেন্দ্র করে ঘটে চলে নানা সামাজিক সমস্যা ও কুসংস্কার। ২৫৪ পৃষ্ঠার বইটিতে লেখক সমাজের প্রায় সব সমস্যাই গভীরভাবে তুলে ধরতে যেমন চেষ্টা করেছেন, চরিত্র বিন্যাস করে অকপটে বলে দিয়েছেন তার উত্তরণের ব্যবস্থাও; মূলত দুইভাগে ভাগ করা কাহিনীকে বইটিতে নিজের মত করে সাজিয়েছেন লেখক, কাহিনীর অন্য দিকে তিনি দেখিয়েছেন বাংলাদেশের বাগেরহাটের মোজাফফর সরদারের পরিবারকে। সোমনাথের বাবার বন্ধু ও মহাজন মোজাফফর সরদার, যার সমস্ত ব্যবসা দেখাশোনা করতেন বাবা সৌমেন বিশ্বাস। পিত্রবিয়গের পরে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া সোমনাথ বাগেরহাটে এলে বুঝতে পারেন পরিবার কাকে বলে। রহিমা বেগমের মাতৃস্নেহে সোমনাথ নিজেকে সাম্প্রদায়িকতায় আলাদা করতে পারেনি, দায়িত্ববোধের ভাবনায় বাবার হাতে গড়া ব্যবসাকে সাময়িক সময়ের জন্য নিজে দায়িত্ব নিলে নানা ঘটনায় মোড় নেয়। চমৎকার কাহিনীবিন্যাসে লেখক দেখিয়েছেন একই পরিবারের আলাদা চিত্র। এইভাগে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র নিধি, সোমনাথের বিশ্ববিদ্যালয়ের এই বান্ধবীর সাথে অনেকটা আত্মিক ও প্রেমের সম্পর্ককে লেখক দেখিয়েছেন হিন্দু ধর্মের মাঝেও সম্প্রীতির চিত্রে। নমঃশূদ্রের ছেলের সাথে উচ্চ শ্রেণীর যে সম্পর্ক হতে পারে বা পারেনা তা নিয়ে নীলাভ প্রেমের গল্প সাজিয়েছেন আধুনিক পাঠকের কথা ভেবেই। আশির দশকের ঢাকা শহরের যে বৃষ্টির প্রতি ফোঁটায় ভাবনার অর্থ থাকতে পারে তা সাইফুদ্দিন রাজিব দেখিয়েছেন নিধির মাধ্যমে। তবে এই গল্পে বিরহ ছিল ছুঁয়ে দেবার মত। সে বিরহকে আপনার কাছে প্রতারণা মনে হতেই পারে কিন্তু লেখক এখানেও দেখিয়েছেন দায়িত্ববোধের বিচরণ। কোন পরিবারে পুত্রবিয়োগ হবার পরেও পুত্রবধূ যে ছেলে-মেয়ে দুটোর বেশে সেই ঘরের বৃদ্ধা-দ্বয়ের মাথায় ছায়া হয়ে থাকতে পারে, তার উদাহরণ 'নিঃশব্দ'। নিজস্ব মতামতঃ কেউ এলেন আর জয় করে গেলেন। যতদুর জানি লেখকের এটা প্রথম উপন্যাস। বৃহৎ পরিসরের গল্প বলতে ভালবাসেন ফ্লাপেই দেখেছি। কিন্তু সেই গল্প যে এভাবে কথা বলবে সেটা বইটি না পড়ে বোঝা যাবেনা। কয়েকটি ভাবনাকে বিশাল আঙ্গিকে জোড়া দিতে গিয়ে কিছুটা অপরিপক্বতার ছাপ পড়েছে বইটির শুরুর দিকে। কিন্তু কাহিনীতে ঢুকলেই বোঝা যায় রীতিমত গবেষনা করেছেন এই লেখক। আমাদের দেশীয় প্রকাশকগণ সম্পাদক প্যানেল করেন না, তাই বেশিরভাগ নতুন লেখকের বইয়ে বাক্যে জড়তা থাকে। তবে যদি সম্পাদক রিভিউ করা হত তবে যে কোন পাঠক বলবে গোছানো 'নিঃশব্দ' এই সময়ের সেরা উপন্যাস। লেখককে নিয়ে আমার বলার কিছু নেই, ব্যক্তিগতভাবে চিনি না তাকে। তবে তিনি 'নিঃশব্দে' যা বলে গেলেন তার ধাঁরা যদি ধরে রাখতে পারেন তবে তিনি নিজের পায়ের নিচের মাটি শক্ত করেই পদার্পণ করেছেন বাংলা সাহিত্যে। এখন দরকার অভিজ্ঞদের সহায়তা। একজন লেখক যখন আপনাকে সমাজের সমস্যার কথা বলবেন, সমস্যায় জর্জরিত মানুষের কথা বলবেন আবার সে তার কাহিনীর চরিত্রের মাঝে তার উত্তরণের রূপরেখা দেবেন তাহলে সেটা দলিল না হয়ে যায় কোথায়! নিঃশব্দ'কে ঘিরে আমার বিস্ময়ের জায়গাটা আরো গভীরে, একটা উপন্যাসে চরিত্র অনেক থাকতে পারে। কখনো তা হয়ত আপনাকে বিভ্রান্ত করবে কিন্তু নিঃশব্দর এমন কোন চরিত্র আপনার কাছে অপ্রয়োজনীয় মনে হবেনা। বরং সেই চরিত্র না থাকলে সামগ্রিক চিত্রপটই বদলে যেত। প্রতিটা চরিত্রকে কাহিনীর সাথে আঁটকে রাখার দক্ষতা আমাকে আঁটকে রেখেছে লেখকের প্লট-বিন্যাস চরিত্র ভাবনায়। আমি একাধারে সোমনাথ, ভারতী দেবী, সুকুমার, পরশকে দেখেছি অন্যদিকে রহিমা বেগম, রূহানী আর সোমনাথের বন্ধুদের দেখেছি। পুরো বইটিতে খুব ছোটছোট জায়গায়ও মোহনীয় আত্মিক টান, ভালবাসা দেখিয়েছেন, সেখানে কোন নারীর স্বামীর প্রতি ভালবাসা আবার কোন নারীর স্বামীর প্রতি অবজ্ঞাও ছিল। তেমনি স্ত্রী'র প্রতি দায়িত্ববোধের চমৎকার সংমিশ্রণও দেখিয়েছেন। লেখক পরেরবার কি নিয়ে আসবেন জানিনা, তবে এমন সামগ্রিক ভাবনার চিত্র বর্তমান যুগে মেলে কালে-ভদ্রে।
Was this review helpful to you?
or
#রকমারি_বইপোকা_রিভিউ_প্রতিযোগিতা #ডিসেম্বরঃ ২৬ বইঃ নিঃশব্দ লেখকঃ সাইফুদ্দিন রাজিব প্রকাশনীঃ নালন্দা প্রচ্ছদঃ হিমেল হক পৃষ্ঠাঃ ২৫৪ মুদ্রিত মূল্যঃ ৪৫০টাকা রকমারি মূল্যঃ ৩১৫টাকা . "গাহি সাম্যের গান- যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান, যেখানে মিশছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুস্লিম-ক্রীশ্চান।" উপন্যাস টা পড়ার পর থেকেই কাজী নজরুল ইসলামের এই লাইনগুলোই মাথায় ঘুরছে শুধু। কেন যেন মনে হচ্ছে এই উপন্যাসের ক্ষেত্রে এরচেয়ে ভালো উপমা আর হতেই পারেনা। . পাশাপাশি দুটি দেশ, দুই বাংলা। মাঝখানে কাঁটাতার। ধর্মীয় ভিত্তিতে দেশভাগের পরে এখন ধর্ম আলাদা, ভূখণ্ড আলাদা, শাসন ব্যবস্থা আলাদা। তবুও কোথায় যেন এই দুই প্রান্তের মানুষ এখনও মিলেমিশে এক হয়ে আছে। উপমহাদেশের ইতিহাসে হিন্দু মুসলমান এই দুই সম্প্রদায়ের গুরুত্ব অপরিসীম। সেই ব্রিটিশ শাসন আমল থেকেই তারা কখনও কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে, একতাবদ্ধ হয়ে লড়াই করেছে, অথচ পরে থাকতে হয় আলাদা মানচিত্রে। দেশভাগের পরেও ধীরে ধীরে আলাদা আরো আলাদা হয়েছে। কখন সাম্প্রদায়িক কারণে আবার নিজেদের প্রয়োজনে। কিন্তু তবুও কোথায় যেন তাদের একটা মিল রয়ে গেছে। কালে কালে ভারতবর্ষের ইতিহাস লেখা হলে কখনওই এই দুই সম্প্রদায়ের একটিকে বাদ দিয়ে লেখা সম্ভব না। তারা একে অপরের পরিপূরক। ঠিক তেমনিভাবে দুই প্রান্তের দুই সম্প্রদায়কে নিয়ে, দুই প্রান্তের গল্প নিয়ে এগিয়েছে এই উপন্যাস। . লেখক সাইফুদ্দিন রাজিবের লেখা প্রথম মৌলিক উপন্যাস নিঃশব্দ। পশ্চিমবঙ্গের গোপালনগর বিভূতিভূষণ স্মৃতি জাদুঘরে বসে তিনি প্রথমবারের মতে নিজের লেখা ছাপা অক্ষরে দেখার স্বপ্ন বুনেছিলেন। তিনি গল্প করতে ভালোবাসেন, মাটির গল্প, মানব পটের গল্প। গল্প করেন প্রেম দ্রোহের বাইরেও সমাজের গল্প, সম্প্রীতির গল্প। বিশ্ব নাগরিক হিসেবে স্বপ্ন দেখেন সম্প্রীতির চেতনার কাঁটাতার পেরিয়ে বাংলাসাহিত্য ছড়িয়ে পড়ুক বিশ্বজুড়ে। লেখক নিজের সেই স্বপ্ন, সেই চেতনাকে "নিঃশব্দ" উপন্যাসের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছেন। পুরো উপন্যাস জুড়ে লেখক কখনও তুলে ধরেছেন এদেশের মানুষের গল্প, সুখ-দুঃখ। কখনও তুলে ধরেছেন কাঁটাতারের ওপারে থাকা মানুষের জীবন-ব্যবস্থা, হাসি-কান্না। . নামকরণে সার্থকতাঃ প্রতিটি গল্প, উপন্যাস, কবিতায় নামকরণ অতি গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। কোন উপন্যাস, গল্প, কবিতা না পড়লেও সেটির নামের মাধ্যমে বিষয়বস্তু সম্পর্কে আমরা একটু হলেও ধারণা করতে পারি। নিঃশব্দ উপন্যাসে প্রতিটি চরিত্র গুরুত্বপূর্ণ এবং বেশ কয়েকটি মূল চরিত্র থাকলেও, তার মধ্যে অপু চরিত্রটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। যার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে সম্পূর্ণ উপন্যাস। যার সাথে কোন না কোনভাবে জড়িয়ে আছে এই উপন্যাসের প্রতিটি চরিত্র। অপু যেন ঠিক নির্দিষ্ট কোন ভূখণ্ডের নয়, কোন নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের নয়, সে দুই দেশের, দুই সম্প্রদায়েরই আপন। সে ধর্ম, জাত, গোত্র, দেশ বোঝেনা। সে শুধু বোঝে ভালোবাসা, মায়া, আদর, স্নেহ। সে নিরবে সবকিছু দেখে, সে বোঝে অবহেলা কি, কিন্তু কিছুই বলেনা। শুধু নিরবে চোখের পানি পড়ে। তার নতুন পরিচয় হয় নিঃশব্দ। সে চোখের কোণে গড়িয়ে পড়া অশ্রুর অর্থ ঠিকই জানে। এই ছোট্ট শিশুটিকে কেন্দ্র করে যেহেতু পুরো উপন্যাস, সেক্ষেত্রে উপন্যাসের নাম নিঃশব্দ যথাযথ হয়েছে। . কাহিনী-সংক্ষেপঃ ভারতী দেবী একজন রীতিমতো জীবন যুদ্ধে লড়াই করা শক্ত সামর্থ মহিলা। যিনি সারাটা জীবন তীব্র অভাব, অসহ্য যন্ত্রণার সাথে লড়াই করে জীবন সংগ্রামে এগিয়েছেন। হঠাৎ স্বামীর মৃত্যু, চোখের সামনে আপন দাদা- বৌদির আত্মহত্যা, ছেলেদের দূরে থাকা, তীব্র অভাবে সংসার টানা এতকিছুর পরেও তিনি একটুও ভেঙ্গে পড়েননি। অথচ সেই মহিলা একটি শিশুর হঠাৎ বাকশক্তি হারিয়ে ফেলার কথা শুনে অজ্ঞান হয়ে যান। কিন্তু কেন? এমনটা তো হওয়ার কথা ছিলো না! শিশুটিতো ভারতী দেবীর রক্তের সম্পর্কের কেউ না। তাহলে কেন? . অপুর বাকশক্তি হারানো ঘিরে আশেপাশের মানুষদের আচরণ, ভাবভঙ্গি খুব দ্রুত বদলে যেতে থাকে। সমাজের কুসংস্কারে আটকে থাকা মানুষেরা মনে করে অপু অপয়া। ওর উপর অসুর ভর করেছে, ওর সংস্পর্শে যে কারো সর্বনাশ হতে পারে। অবহেলায়, অনাদরে পিতৃ-মাতৃহীন অপু খোঁজে একটু আশ্রয়, একটু ভালোবাসা। সমাজের নির্মম-নিষ্ঠুর আচরণ, মানুষের পাল্টে যাওয়া সে বোঝে। নীরবে চোখের জল ফেলে, ছবি আঁকে। এতো অবহেলায় সব মানুষের ভিড়ে সে তার বাবাকে খুঁজে। অপুর বাবা মা কোথায়? কি হয়েছে তাদের? . মোজাফফর সরদারের আড়তে কাজ করতেন সোমনাথে বাবা সৌমেন বিশ্বাস। তাদের দুজনের মধ্যকার সম্পর্ক ছিলো ভাইয়ের মতন। হঠাৎ সৌমেন বিশ্বাসের মৃত্যু হলে মোজাফফর সরদার কিছুটা ভেঙ্গে পড়েন। সৌমেন বিশ্বাস অনেক বিশ্বস্ত মানুষ ছিলেন। সরদারের ছেলেরাও এই ব্যবসা পুরোপুরি ধরে রাখতে পারবেনা। তারও বয়েস হয়েছে। হঠাৎ বাবার মৃত্যুতে সোমনাথ ভেঙ্গে পড়ায় এবং সরদারের ব্যবসার কথা চিন্তা করে সোমনাথ সেখানে কিছুদিন থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু সোমনাথের কাছে সরদার বাড়ির আবদার আস্তে আস্তে বাড়তেই থাকে। এদিকে মোজাফফর সরদারের বড় ছেলে রহমান একটু উগ্র প্রকৃতির। সোমনাথের সাথে তার একটি ঘটনার রেশ ধরে বাড়াবাড়ি হলে মোজাফফর সরদার ছেলেকে গুরুতর আঘাত করে। সেই থেকে সোমনাথের প্রতি একটা প্রতিশোধের নেশা জাগে রহমানেরর মনে। ঘটনাচক্রে সোমনাথ ও সরদার পরিবারে এক নতুন মোড় আসে যেটা রহমানের প্রতিশোধস্পৃহাকে আরো বাড়িয়ে দেয়। সোমনাথ ও তার আটমাসের ছেলেকে খুন করতে উদ্যত হয় সে। ভাগ্যের ফেরে সোমনাথ তার ছেলেকে নিয়ে ভারতে পালিয়ে যায়। . পাঠ-প্রতিক্রিয়াঃ একজন যতই ভালো কিছু করুক, তারমধ্যে একটু খারাপ থাকলে সেটাই সবার আগে নজরে আসে। এক্ষেত্রেও প্রথমেই খারাপ দিকগুলো নিয়ে আলোচনা করি। আমার মনে হয়েছে প্রথমদিকে কাহিনী একদম স্লো। মনোযোগ ধরে রাখতে কষ্ট হচ্ছিলো খুব। ভীষণ অসুস্থও ছিলাম তখন, তার উপর কাহিনীর এই ধীরতায় বিরক্তই হয়েছিলাম একটু। তারপর কয়েকটা বানান ভুল ছিল চোখে পড়ার মতো। ২৪৪ পৃষ্ঠায় "কিন্তু অপু যে এতদিনে বড় হয়ে গেছে সেটা উত্তম বুঝি জানেনা।" এখানে উত্তম নামের জায়গায় যথাসম্ভব পরশ হবে। ২৪৫পৃষ্ঠায় "কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো তার বাবা মা দুজনেই তাকে না জানিয়ে ভারতে গিয়েছে। ছোট মা খুলে বলে কেন তারা ভারতে গিয়েছেন। কার খোঁজে গিয়েছে না।" এখানে ১ম ও ৩য় বাক্যে সম্ভবত গিয়েছেন হবে। গিয়েছে না শব্দটা বেখাপ্পা মনে হচ্ছে, এটা কোন অর্থবহন করে না। এই খারাপগুলো চেয়ে যে অসংখ্য ভালো দিক আছে এইবার সেগুলো বলি। প্রথমদিকে কাহিনী স্লো হলেও পরবর্তী তে লেখক সেটা পুষিয়ে নিয়েছেন। একশ পৃষ্ঠার পর(তারচেয়ে বেশি বা কমও হতে পারে) থেকে রুদ্ধশ্বাসে পড়ে গেছি। তারপর কাহিনী এতো আকৃষ্ট করেছিলো যে চোখের পাতা ফেলতে পারছিলাম না। প্রথমদিকে লেখা কিছুটা অপরিপক্ব মনে হলেও শেষের দিকে পরিপক্ব বলেই মনে হয়েছে। গল্পের প্লট, লেখার ধরণ ছিলো অসাধারণ। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে ভালোবাসা বিষয়টাই লেখক উপন্যাসে ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন। আসলে ভালোবাসার বিষয়গুলো লেখক এতো অসাধারণ ও গভীরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন যে পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিলো আমি নিজেই সেই ভালোবাসার আবেশে জড়িয়ে যাচ্ছি। আর ঘৃণা, অবহেলাগুলো এতো তীব্রভাবে তুলে ধরেছেন যে যা সত্যি হৃদয়কে নাড়া দিয়ে যায়। প্রতিটি ভালোবাসার কাহিনী লেখক এতো জীবন্ত করে ফুটিয়ে তুলেছেন যে পড়তে পড়তে মুগ্ধ হয়েছি। সাধারণত প্রেম কাহিনী গুলো ন্যাকা ন্যাকা ধরণের হয়। সেগুলোতে কেবলমাত্র দুটি নরনারীর প্রেমের কথা উল্লেখ থাকে। কিন্তু সে সম্পর্ক ছাড়াও যে আরো অনেক রকম সম্পর্ক থাকতে পারে লেখক সেটাই উপন্যাসে অসাধারণ ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। . আমাদের সমাজে কুসংস্কার যে কতটা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে এবং তার প্রভাব যে কতটা ভয়ঙ্কর সেই বিষয়টা এই উপন্যাসে ভালোভাবে প্রকাশ পেয়েছে। এ উপন্যাসে পরশ আর সুকুমার চরিত্র দুটি খুবই ভালো লেগেছে। রক্তের সম্পর্ক না থাকার পরেও, ছেলে হয়েও পিতৃ-মাতৃহীন অপুকে যে ভালোবাসা তারা দিয়েছেন, আগলে রেখেছেন তা সত্যিই অতুলনীয়। উপন্যাসের শেষটা ভালো ছিলো। পড়ার সময়ে মনেপ্রাণে চেয়েছিলাম আর কিছু হোক না হোক অন্তত শেষ পর্যন্ত নিষ্পাপ ছেলেটার যেন একটা গতি হয়। সবশেষে উপন্যাসটি আমার কাছে অনেক সুপাঠ্য মনে হয়েছে। খুবই ভালো লেগেছে, অসাধারণ একটি উপন্যাস। . যে কারণে উপন্যাসটি পড়বেনঃ বর্তমানে যেখানে অনুবাদের ছড়াছড়ি, সেখানে মৌলিক লেখাগুলো প্রায় হারিয়ে যাচ্ছে। কয়েকটা যাও লেখা হচ্ছে সেগুলোও সঠিক মূল্যায়ন, সমালোচনা-আলোচনার অভাবে মুখ থুবড়ে পড়ছে। অধিকাংশ লেখকই তাই মৌলিক লিখতে চাইনা। আর লিখলেও বেশিরভাগ সময় তা সুপাঠ্য হয় না। সেক্ষেত্রে প্রথম বারেই ২৫৪পৃষ্ঠা লেখা সহজ কথা নয়। নিজ ভাষা, সংস্কৃতি, সাহিত্যকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে মৌলিক লেখার কোন বিকল্প নেই। তাই অন্তত আলোচনা-সমালোচনা করার জন্য হলেও বইটি পড়া উচিত। লেখক এখানে দেশ, ধর্ম, বর্ণ, জাতি, গোত্র নির্বিশেষে ভালোবাসার যে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, যে অসাধারণ বর্ণনা দিয়েছেন সেজন্য হলেও বইটি পড়া উচিত। বইটির প্রচ্ছদ এককথায় অসাধারণ। যারা বই সংগ্রহে রাখতে ভালোবাসেন, সাজাতে ভালোবাসেন তারা এত সুন্দর প্রচ্ছদের কারণে বইটি কিনতে পারেন। রেটিং:- ৫/৫
Was this review helpful to you?
or
ধর্মীয় গোঁড়ামি, সামাজিক প্রভাব বলয়ের অবক্ষয়ে প্রতিনিয়ত কত মানুষের জীবন যায়। কেউ আবার কোনমতে নিজের জীবনটা নিয়ে পালিয়ে বাঁচে। এই বাঁচাকে কখনোই বুক চিতিয়ে বেঁচে থাকা বলে না। বরং মাথা নিচু করে কটু কথা শুনে বেঁচে থাকতে হয়। নিজের জন্মভিটে ছেড়ে বুকে পাথর চেপে বেঁচে থাকা মানুষগুলোই জানে তারা কেমন আছে। কালে কালে এই চলে যাওয়া, পালিয়ে যাওয়ার ধাঁরা থেমে নেই। বাংলাদেশে এর গোড়াপত্তন হয়েছিলো ব্রিটিশদের দেশ ভাগ করে রেখে যাওয়ার সময় থেকেই। যেটা পরবর্তিতে চলছে, বাংলাদেশ হবার পরেও এখনো তার রেশ টেনে ধরা সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশ থেকে মুলত সেই জীবন বাঁচানো আবার নিজ ইচ্ছেতে দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যাওয়াদের বেশীরভাগই আবার হিন্দু। নিঃশব্দ উপন্যাসে মুসলিম মা ও হিন্দু বাবার ঘরে জন্ম নেওয়ার পরে বাবা-মাহীন বেড়ে ওঠা চার বছরের কথা না বলতে পারা শিশুটিকে আবর্ত করে চমৎকার হৃদয়স্পর্শী একচিত্র ফুটে উঠেছে। আর সেইসাথে গল্পে আশির দশকে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলে মেয়ের রোমান্স, হিন্দু-মুসলিম পারিবারিক সৌহার্দ্য, সামাজিক দায়িত্ববোধ, এবং জাতিস্বত্ত্বাকে দারুণ ভাবে ফুটে উঠেছে বইয়ে। কাহিনি সংক্ষেপঃ সোমনাথ-রহিমার ঘরে জন্ম নেওয়া শিশু অপু পশ্চিমবঙ্গের ইছামতী কোলঘেষা বরুনহাট গ্রামে বাবার মাসি/মামি ভারতী দেবীর কাছে বেড়ে উঠতে থাকে। তারই কোন এক সময়কালে গল্পের শুরু করেছেন লেখক। বাগেরহাটের ব্যবসায়ী মোজাফফর সরদারের কর্মচারীর ছেলে সোমনাথ হটাত করে বাবার মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে বাগেরহাটে চলে আসে। বাবার হাতে গড়া মোজাফফর সরদারের ব্যবসা ততদিনে বেশ ভালই চলছিল। সোমনাথের বাবা সৌমেন বিশ্বাস আর মোজাফফর সরদার পরস্পর খুব ভাল বন্ধুও ছিল। বাবা নির্ভর ওই ব্যবসা কাঁচা হাতে পড়ে ক্ষতি হয়ে যেতে পারে দেখে নিজে দায়িত্ব নেয়। এরপরে বাবা-মাহীন সোমনাথ মুসলিম পরিবারের মাঝে নিজের আপন পরিবার খুঁজে পায়। বছরান্তে সরকারী চাকুরী হলে সে ঢাকায় চলে যায়। ঘটনাচক্রে মোজাফফর সরদারের মেয়ে নাসিমার সাথে সোমনাথের বিয়ে অতঃপর সন্তানের জন্ম হয়। কিন্তু ধর্মীয় বিভীষিকার শিকার আটমাস বয়সী অপুকে সঙ্গে নিয়ে কনকনে শিতে ইছামতী নদীতে কলার ভেলায় চেপে দেশ ছাড়ে সোমনাথ। জায়গা হয় ভারতী দেবীর কাছে। মধ্যবয়স্ক এই বিধবা তার তিন ছেলে আর এক মেয়েকে নিয়ে জীবনযুদ্ধে টিকে থাকার সংগ্রামে ব্যাস্ত। তিনছেলে বড় হয়ে মাকে একা রেখে চলে গেলে যায়, পরবর্তিতে ভারতী দেবী মেয়ে উমাকে বিয়ে দেন বাংলাদেশ থেকে আসা সুকুমার এর সাথে। আর ছোট থেকে মানুষ করা ভাইয়ের ছেলে পরশকেও বিয়ে দেন বাংলাদেশ থেকে চিকিৎসা করতে আসা দীননাথ কৈরীর মেয়ে শোভার সাথে। বিয়ে দিয়ে তাদের ও আলাদা করে দেন ভারতী দেবী। সোমনাথ ও তার ছেলে অপু বাংলাদেশ থেকে এখানে পাড়ি দেয়ায় তাকে একা থাকতে হয়নি। এক সময় সোমনাথ পারিবারিক কাজে বাংলাদেশে ফিরলে বিরল রোগে আক্রান্ত হয়ে অপু কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলে। এরপরেই শুরু হয় কুসংস্কারের নতুন অধ্যায়। প্রায় সবার কাছেই অপু হয়ে হঠে অপয়া। লেখক এখানেও কিছু মানুষকে স্রোতের বিপরীতে রেখে কুসংস্কারের সংস্কার করার চেষ্টা করেছেন। সেই দলে সুকুমার, পরশ অন্যতম। বইটির কয়েকটি অংশে পাঠকের দৃষ্টি বিবেচনায় প্রেম নিয়ে এসেছেন। যেমন সোমনাথ-নিধি। পরবর্তিতে পরকীয়া প্রেম দেখিয়েছে শোভা-উত্তমের মাঝে। রহস্যে ভরা সামাজিক উপন্যসে ছিল কিছু, প্রশ্ন যার জন্য পড়তে হবে বইটিঃ ১. সোমনাথ কেনো জেলে যায়? ২. নাসিমা কোথায়? ৩. অপু কি ফিরে পাবে বাবা-মাকে? ৪. পরিবারের অন্য সদস্যরা কোথায় আছে? ৫. রহমান সরদার যার জন্য এতো সমস্যার সম্মুখীন হতে হলো তার কি হবে? ৬. রুহানিই বা কি করছে এখন? ৭. শোভা কি ফিরে আসবে পরশ এর জীবনে? ৮. উমা কি তার ভুল বুঝতে পারবে যে অপু অপয়া নয়? ৯. দেশ ত্যাগি মানুষরা সব বিক্রি করে চলে যায়, দেশ কি পায়? তারাই বা সুখি কি হয়? ১০. সোমনাথ কে সবাই মেনে নিবে? ইত্যাদি... ব্যক্তিগত প্রতিক্রিয়াঃ লেখকের প্রথম উপন্যাস 'নিঃশব্দ'। নতুন হিসেবে উপন্যাসটি বেশ ভালো লেগেছে। কাহিনী চিত্রায়ন করেছেন দারুণভাবেই। তবে শুরুতে কিছুটা অগোছালো ছিল, অনভিজ্ঞতার স্পষ্ট ছাপ ছিল। দুয়েক যায়গায় বানান ভুল চোখে পড়েছে। বর্ননা, চরিত্রগুলোকে একাধিকবার পরিচয় করিয়েছেন। ২৫৪ পৃষ্ঠার ৫০ পৃষ্ঠা যাবার পরেই মুলত পাঠক গল্পের ধারার মাঝে ঢুকতে পারবে। যেভাবে তিনি শুরু করেছিলেন শেষের দিকের মনে হয়েছে দ্রুত শেষ করতে চেয়েছেন। কাহিনীতে চরম খিদে ছিল। আরো আলোচনা হতে পারতো শেষ দিকে। তবে মৌলিক কাহিনীচিত্রের বুননটা দারুণ ছিল। হাসি-কান্নার সংমিশ্রণে রচিত হয়েছে বইটি। অনেকদিন পর এমন একটি বই পড়লাম। প্রতিটা চরিত্রই বৈশিষ্ট্য উজ্জ্বল এবং চোখে পড়ার মতো। কিছু কিছু চরিত্রে নিজেকে আবিস্কার করেছি। কিছু চরিত্রে মনে হয়েছে মানুষ হিসাবে যদি সুকুমারের মত হতে পারতাম! ভালো লাগা কিছু লাইনঃ ১। অনেক ভালোবাসার নাম থাকতে নেই, কিঞ্চিৎ বিশ্বাসেই মিটমিট করে ভালোবাসার সেই পিদিম জ্বলতে থাকে। ২। ঈশ্বর তাদের সত্যিই ভালোবাসে। ভালোবাসে বলেই তারা দিনে তিনবারের জায়গায় দুবার খেয়েও বেঁচে থাকে। ৩। আমরা খুব দুঃখ পেলে আকাশের দিকে তাকাই, কিন্তু কেন? আকাশ কি কথা বলতে পারে? ৪। কোনো কোনো মানুষের প্রতি গভীর টান অনুভূত হয়, যে টানের নাম থাকে না। তাকে গভীরভাবে অনুভব করা হয়, কিন্তু ছুঁয়ে দেখা হয় না। ৬। আমি চাই, আমার অন্তত আরেকজন ভাবার মানুষ বাড়ুক, যে আমাকে নিয়ে চিন্তা করবে। ৭। তার যেন কোন কিছু হারায়নি, অথবা যা হারিয়েছে তা তার কখনো ছিলও না। ৮। এখানে দুঃখ আছে হয়তো, কষ্টও আছে, কিন্তু নিশ্বাস নেবার মতো যতটুকু শক্তি সে এখানে পাচ্ছে তা গত সাড়ে চার বছরে ভারতে পায়নি। হয়তো পাবেও না। বই পড়ুন, বইয়ের সাথেই থাকুন।
Was this review helpful to you?
or
২০১৭ সালে বসে একজন মানুষ সেই আশির দশকের ভারতবর্ষে দেশ বিভাগের পটভূমিতে কতটা বাস্তব চরিত্র রূপায়িত করা যায় তা লেখকের লেখা না দেখলে বোঝার উপায় নেই। উপন্যাসের গোড়া থেকেই তিনি হিন্দু মুসলিম সম্প্রীতির বার্তা দিতে চেয়েছেন। সাথে দেশ বিভাগের ফলে মানুষের দুরবস্থার চরম পর্যায়, অভাবের শেষ সীমা সহ্য করতে না পেরে আত্মাহুতি আর সংকটাপন্ন জীবনের রোষানলে ছোট ছোট ইচ্ছেগুলোর উড়তে না দেয়া সবটাই একে একে ব্যক্ত করেছেন উপন্যাসের কাহিনী থেকে চরিত্রগুলোর মধ্য দিয়ে। লেখকের প্রথম উপন্যাস হিসেবে লেখনী ও ভাষাশৈলী ছিল অসাধারণ। প্লট বর্ণনায় আধিক্য থাকলেও কাহিনীর বৈচিত্র ছিল ক্ষণে ক্ষণে। সব মিলিয়ে যারা ক্লাসিক ঘরানার বই পড়তে ভালোবাসেন তাদের জন্য ‘নিঃশব্দ’ বইটি অবশ্যই সুখপাঠ্য হবে।
Was this review helpful to you?
or
বই : নিঃশব্দ লেখক : সাইফুদ্দিন রাজিব প্রকাশনী: নালন্দা প্রচ্ছদ: হিমেল হক পৃষ্ঠা: ২৫৪ মূল্য: ৪৫০ কাহিনি সংক্ষেপণ :লেখক ক্ল্যাসিক্যাল ঘরানায় আশির দশকের ধর্মীয় সম্প্রতি আর দেশ ভাগ হওয়ার বিচ্ছেদ বেদনাকে তুলে ধরার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। উপন্যাসের শুরুতে ভারতী দেবীর মতো অশিক্ষিত এক বিধবা মহিলার ৩ছেলে আর মেয়েকে নিয়ে জীবনযুদ্ধে টিকে থাকার সংগ্রাম তুলে ধরেছেন লেখক। কিন্তু ছেলেরা সব বড় হয়ে মাকে একলা রেখে চলে যায়। মেয়ে উমাকে বিয়ে দিয়ে ছোট থেকে মানুষ করা ভাইয়ের ছেলে পরশকেও বিয়ে দিয়ে যিনি একা বাঁচার লড়াই করে যান। এ সময়ে তার জীবনে পূর্ণতা দিতে আসে অপু। সোমনাথের আটমাসের বয়সী ছেলে অপু। মুসলিম মা এবং হিন্দু বাবার ঘরে জন্ম নেয়া ছোট্ট শিশু অপু এই উপন্যাসের মূল চরিত্র। উপন্যাসের আরেকদিকে দেখা যায় সৌমেন বিশ্বাস এবং মোজাফফর সরদার দুই বন্ধু ভিন্ন ধর্মের হওয়া সত্ত্বেও ভাইয়ের মতো একসাথে ব্যবসা পরিচালনা করে। যদিও সৌমেন ছিলেন মোজাফফরের ম্যানেজার। হঠাত সৌমেনের মৃত্যুতে দিশেহারা হয়ে পড়েন মোজাফফর। কারণ সৌমেন ছাড়া তার ব্যবসা একেবারে অসম্ভব। সৌমেন মোজাফফরের ম্যানেজার হলেও কখনোই বেতন নিতেন না প্রয়োজনীয় টাকাটুকু ছাড়া। সেই বেতনের টাকা দিয়ে মোজাফফর কিছু জায়গা কিনে রেখেছিলেন সৌমেনের নামে। বাবার মৃত্যুর পর সৌমেনের বিশবিদ্যালয় পাস ছেলে সোমনাথ ফকিরহাটে এসে জড়িয়ে পড়ে নিয়তির লীলাখেলায়। শুরু থেকেই মোজাফফরের ছেলে রহমান সোমনাথকে অপছন্দ করতো। সোমনাথের উপর রাগান্বিত অবস্থায় ছুঁড়ে ফেলা আড়তের হিসাবের লাল খাতাটা গিয়ে পড়ে মোজাফফরের পায়ের কাছে। সেই অবজ্ঞা মেনে নিতে না পেরে হাতের লাঠি দিয়ে রহমানের মাথায় আঘাত করেন। অথচ সেই অবস্থায় সোমননাথই হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করে। এমনকি মাদ্রাজ নিয়ে গিয়েও সুস্থ করে আনে। কিন্তু এতে রহমানের রাগ মোটেও প্রশমিত হয় না বরং মনে মনে সে সোমনাথকে খুন করার পরিকল্পনা করে। নিজের পড়ার ক্ষতি করেও সে মোজাফফরের আড়ত দেখে প্রায় বছরখানেক। ভুলতে বসে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন তার ভালোবাসার মানুষ নিধির কথা। যদিও এর মাঝে নিধির সাথে তার দেখা হয়েছে। এতকিছুর পরেও সোমনাথ রহমানের হাতে আড়তের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে ঢাকায় চলে আসে। মাস্টার্স শেষ হওয়ার আগেই সোমনাথের মন্ত্রণালয়ে চাকরি হয়। এ পর্যায়ে গল্পে অন্যদিকে মোড় নেয়। মোজাফফরের মেয়ে নাসিমা এসে উঠে সোমনাথের বাসায়। আত্নহত্যার ভয় দেখিয়ে জোর করে বিয়ে করে সোমনাথকে। দীর্ঘ ৬ মাসের মতো কষ্ট সহ্য করে নাসিমা সোমনাথের মন জয় করে। সোমনাথ- নাসিমা বাসা পালটে পালিয়ে থাকে আত্মরক্ষায়। কিন্তু যে পরিবারের জন্যে বাবা- ছেলে দুহাতে দিয়ে গেছেন সে পরিবারের জন্যেই তাকে তার জীবনের মূল্যবান অনেক কিছু হারাতে হয়। আট বয়সী ছেলে অপুকে বাঁচাতে নাসিমাকে না জানিয়ে ভারতে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয় সে। এরপর ভারতী দেবীর কাছে দুবছরের অপুকে রেখে সোমনাথ বাংলাদেশে যান জায়গাজমি বিক্রি করে আসতে। কে জানতো এই যাওয়াই যে তার জন্যে কাল হয়ে দাঁড়াবে। এদিকে সোমনাথ যাওয়ার পরে অপু জ্বরে পড়ে। অপুকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হলে সেখানেই তার বাকশক্তিহীন হওয়ার কথা শুনেই আকস্মিক মারা যান ভারতী দেবী। দুইবছরের ছেলে অপুকে নিয়ে বিপাকে পড়ে উমার স্বামী সুকুমার,শাশুড়ি নমিতারানী, পরশসহ সবাই। শিক্ষিত ছেলে সুকুমার অপুকে নিজেদের কাছে রাখার চেষ্টা করে। কিন্তু সে পরশের বউ শোভা ছাড়া আর কারো কাছে যেতেই রাজি নয়। কিন্তু শোভা ভারতী দেবীর মৃত্যুর পরে অপুকে অপয়া মনে করতো। কিছুতেই অপুকে সহ্য করতে পারতোনা। শোভার অত্যাচার দেখে সুকুমার এত চাওয়ার পরেও অপু শোভাকে ছেড়ে যেতে রাজী নয়। সুকুমার অপুকে খুব ভালোবাসতো। হয়তো দুজন একই দেশের সন্তান বলে তার এ ভালোবাসা। সুকুমারেরও কোনকালেই ইচ্ছে ছিল না ভারতে আসার। মায়ের জোরাজুরিতেই সে দেশ ছেড়ে আসে। বিশেষ বুঝশক্তি নিয়ে বেড়ে উঠা অপু অল্প বয়সেই বুঝছিল তার জীবন সহজ নয়। একের পর এক রহস্য ঘটে চলে। প্রায় ৫ বছর পর মোজাফফর সরদারের পরিবারের সাথে সোমনাথের আবার জেলে দেখা হয়। সোমনাথ জানতে পারে নাসিমা আত্নহত্যা করেছে। কি ঘটে অপু- সোমনাথের ভাগ্যে? কি হয়েছিল মাঝের দুবছরে। বাবা- ছেলে কি শেষ পর্যন্ত এক হতে পেরেছিল? জানতে হলে পড়তে হবে নিঃশব্দ। পাঠ প্রতিক্রিয়া: নিঃশব্দ লেখকের নতুন উপন্যাস হিসেবে আমার কাছে যথেষ্ট ভালো লেগেছে। আমার মনে হয়না প্রথম বইয়ে এর চাইতে আর ভালো হতে পারে। তবে কিছু জায়গায় গোঁজামিল ছিল। টাইপিং মিস্টেক ছিল দু-এক জায়গায়। তবুও সব মিলিয়ে বলা যায় বইটা ভালো ছিল। বইয়ের প্রতিটা চরিত্রেরই আলাদা কিছু বৈশিষ্ট্য ছিল। প্রতিটা চরিত্রের সাথে পড়ার সময় আমিও যেন হারিয়ে গেছিলাম সেই সময়টায়। তবে বইয়ের ৩টি চরিত্র আমার বেশ ভালো লেগেছে। সুকুমার, সোমনাথ এবং নিধি। এছাড়া মোজাফরের বউ রহিমা বেগমের স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ে মেনে নিয়ে ক্ষুদ্র ভালোবাসা নিয়ে সন্তুষ্ট ব্যাপারটাও ভালো লেগেছে। সুকুমারের দেশপ্রেম, সোমনাথের দেশপ্রেম আর মানুষকে আপন করে নেয়ার ক্ষমতা এবং নিধির ভালোবাসাকে দূরে সরিয়ে ধর্মীয় ভীতি এবং সামাজিক সম্মানটাকে যে সম্মান দিয়েছে তা অতুলনীয়। নিধির গভীরতম সুন্দর ভাবনাগুলো মনে দাগ কেটেছে। এই বইয়ে নিধির কথাগুলোই সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে আমার। একাকী পথে নিধির পাশে পাশে হেঁটে নিরবতা ভেঙ্গে বলে- " এভাবে আর কতদিন চলবে?" নিধি বলে, " চলতে কি খুব বিশেষ কিছু লাগে?" সোমনাথ বলল, " কেন লাগে না? লাগে তো। নাহলে মানুষ পথবিচ্যুত হয়ে যায়।" নিধি চুপ করে থাকে, তার যেন বলতে ইচ্ছে করছে। অব্যক্ত কিছু কথা। কিছু ভাবনা, যা সে প্রতিটা মুহূর্ত ভাবে, " এই পৃথিবীর ভিড়ে যখন তোমার মতো কিছু মানুষের স্মৃতি হৃদয়ে আটকে যায়, তখন শত শূন্যতার মাঝেও পৃথিবী তার নিজস্ব গতিপথ থেকে বিচ্যুত হতে পারেনা। গতিপথেই চলতে থাকে, বাঁচার জন্য। বাঁচানোর জন্য.....।" ১৩৫ পৃষ্ঠার কবিতাংশটুকু ভালো লেগেছে- " আমার বাক্সবন্দি আর্তনাদ, আমার হৃদয়জুড়ে কালো আমার একটুকু সুখ তুমি, তুমি আমার মতোই ভালো।"
Was this review helpful to you?
or
'নিঃশব্দ' গুচ্ছ সমাজের হৃদয়স্পর্শী গল্প। ---------- প্রতিনিয়ত স্বপ্নের স্থলন হয়, আমরা কেউই জানিনা আগামিকাল কি ঘটবে। কেউ হটাত করে মরে যেতেই পারে, সেই ঘা'ও শুকিয়েও যায় মাসের ব্যবধানে। কিন্তু ইচ্ছে অনিচ্ছায় শতবছরের ভিটেমাটিকে ছেড়ে চলে যাওয়ার কষ্টটা বয়ে বেড়াতে হয় আজীবন, এটা একধরনের পাপ বৈকি। তবে সব পাপের আবার শাস্তি নেই। কিছু কিছু পাপ সংগঠিত হয় শান্তির জন্য, তেমনই শান্তি আর অশান্তির গল্পকে সাহিত্যের নিখাঁদ সেলাইতে বুনে এক করেই 'নিঃশব্দ' লিখেছেন তরুণ লেখক সাইফুদ্দিন রাজিব। লেখকের প্রতি পাঠকের বিশ্বাস তৈরি হয় তার লেখা পড়ে, যেটা দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার। কিন্তু লেখকের যখন প্রথম প্রকাশ, তখন হয় যত চিন্তা। দীর্ঘ উপন্যাসটি প্রচারে লেখক বা প্রকাশকের পক্ষে দু-একশ শব্দে তুলে ধরা সম্ভব হয়ে ওঠে না। কাহিনীর ভেতরের গল্পগুলো তুলে ধরা প্রায় অসম্ভব বলেই অঙ্কুরে হারিয়ে যায় কিছু লেখক আর তার সমৃদ্ধ সেই সৃষ্টি। তবে নিঃশব্দ উপন্যাসটি পাঠক আপন বিশ্বাসে খুঁজে নেবে বলেই আমার বিশ্বাস। কারণ উপন্যাসটির চিত্র বা প্লটকে আমার একটা বটবৃক্ষ মনে হয়েছে। আশির দশকের শেষের এই সামাজিক চিত্রকে তুলে আনতে লেখক যে রীতিমত মাঠে নেমে গবেষণা করেছেন বইটির সামগ্রিক চিত্রে তাই দারুণভাবে ফুটে উঠেছে। নিঃশব্দ উপন্যাসটা হাতে নেবার সাথে সাথে সবথেকে আকর্শনীয় বিষয় বইটির প্রচ্ছদ ও নামকরণ। উপন্যাসটা শেষ করে আবার ফিরে আসতে হয় লেখক আর প্রচ্ছদশিল্পী কতটা সার্থক ঠিক এই জায়গায়। গল্পের কাহিনীই যেন ফুটে উঠেছে এই দুই দৃশ্যপটে। প্রচ্ছদে স্থান পাওয়া নিঃশব্দ নামের সাথে একটা শিশুর অবয়ব। আক্ষরিক অর্থেই মনে হয় কাহিনীর মুল চরিত্র এই ছোট শিশু অপু, পরবর্তিতে দুরারোগ্য ব্যাধি 'হাইপোগ্লোসাল নিউরাইটিসে' আক্রান্ত হয়ে শিশুটি বাকশক্তি হারিয়ে ফেলে। সুতারং সে অর্থে নামকরণের একটা সার্থকতা ছিল ঠিকই কিন্তু তারপরেও লেখক সেখানে সীমাবদ্ধ থাকেননি। পুরো বইটির প্রতি পরিচ্ছেদে সামাজিক বার্তা ছড়িয়েছেন যা পাঠক হিসাবে আমাকে বেশ নাড়া দিয়েছে। ধর্মীয় সম্প্রীতি, সামাজিক-পারিবারিক দায়বদ্ধতা, কুসংস্কার, জাত-পাত ভেঙে চুরে লেখক কলম চালিয়েছেন বেশ দৃঢ়ভাবে। দায়িত্ববোধের গভীর নিদর্শন দেখিয়েছেন উপন্যাসের দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রধান চরিত্র সোমনাথ ও ভারতী দেবী। যুগপৎ ভাবে বর্ণনা করা উপন্যাসের মুল চরিত্র মুসলিম মা হিন্দু বাবার ঘরে জন্ম নেওয়া ছোট শিশু অপু। সামাজিক বিভীষিকার শিকার হয়ে স্ত্রীকে বাংলাদেশে ফেলে শিতের রাতে আট মাসের শিশু সন্তানকে নিয়ে কলাগাছের ভেলায় ইছামতী নদী পার হয়ে পশ্চিমবঙ্গে যেতে বাধ্য হয় সরকারী কর্মকর্তা সোমনাথ। বাগেরহাটের মোজাফফর সরদারের পরিবারকে দুইহাতে টেনে তুলেছিলেন সৌমেন বিশ্বাস ও পরের দিকে সোমনাথ বিশ্বাস। অথচ সেই পরিবারের সন্তানের নির্যাতনের শিকার হয়ে শুধুমাত্র শিশুসন্তানটিকে বাঁচাতেই দেশ ছাড়তে বাধ্য হয় সোমনাথ। উপন্যাসে পরের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র ভারতী দেবী। দারিদ্রতার করাল অক্টোপাসে বেঁধে থাকা এই বিধবা নারী দেখিয়েছেন দায়িত্বশীলতা আর মমত্ববোধের সর্বোচ্চ নিদর্শন, সেটা কখনো নিজ ভাই অথবা ভ্রাতাস্পুত্র পরশ এবং পরবর্তীতে শিশু সন্তান অপুর প্রতি। আজীবন দুঃখ বয়ে বেড়ালেও ব্যক্তিগত কষ্ট যখন ধীরে ধীরে লোপ পাচ্ছিল তখনই অসুস্থ অপুকে কোলকাতার হাসপাতালে বাকশক্তি হারাতে দেখে শোক সামলে উঠতে পারেননি। সকল নির্মমতাকে জয় করা ভারতী দেবী নিজেই পৃথিবী নিঃশব্দে। উপন্যাসটির এই সময়ে এসে কোন পাঠকের শরীর হিম হয়ে আসবে। থমকে যাবে চোখের পলক। লেখক হিসাবে সাইফুদ্দিন রাজিবকে খুবই নির্দয় মনে হয়েছে ভারতী দেবীর এই ঘটনায়। তবে সব দৃশ্যপট বদলাতে থাকে তার মৃত্যুর পরে, পদে পদে কষ্ট সইতে হয় ভারতী দেবী ও নিখোঁজ বাবাকে খুঁজে ফেরা শিশু সন্তান অপুকে। মুখে মুখে অপয়া বনে গেলেও মুদ্রার উল্টো পিঠে তাকে বুকে আগলে রাখার মত কিছু মানুষ থেকেই যায়। লেখককে এখানে সার্থক মনে হয়েছে, তিনি যেমন সামাজিক কুসংস্কার দেখিয়েছেন একইভাবে বোধের বিপরীত দিকও দেখিয়েছেন তার লেখনশৈলীতে। গল্পের অন্য পিঠে লেখক দেখিয়েছেন দুই স্ত্রী ও চার সন্তানকে নিয়ে মোজাফফর সরদারের সংসার। মমত্ববোধ, ধর্মীয় সম্প্রীতি ও সামাজিক দায়বদ্ধতার গুচ্ছ নিদর্শন 'নিঃশব্দ' উপন্যাসটি যে একটা দারুণ বটবৃক্ষ তার প্রমান মোজাফফর সরদারের পরিবার। সেখানে সামান্য পাণ বানানোতে যেমন রহিমা বেগম স্বামীর ভালবাসা খুঁজে পান তেমনি সন্তান জন্মদানে অক্ষম ছোট স্ত্রী নূরানি বেগম পেয়েছিলেন আকিবের মত ছোট্ট শিশুও। পারিবারিক ভালবাসায় কতটা ডালপালা ছড়াতে পারে লেখক সেটা গভীর ভাবে তুলেছেন নিঃশব্দের দৃশ্যপটে। মোজাফফর সরদারের চেয়ারম্যান হবার পরে সমাজের প্রতি নিবিড় দায়বদ্ধতার নিদর্শন হতে পারে যে কোন নেতৃত্ব দেওয়া ব্যক্তিরও। সাইফুদ্দিন রাজিব দেখিয়েছেন কীভাবে সুচারুরূপে ন্যায় অন্যায়কে আলাদা করা যায়। ব্যক্তিগত অভিমত হল ঔপন্যাসিক হিসাবে সাইফুদ্দিন রাজিব কতটা সফল হবেন সেটা হয়ত সময়েই জানা যাবে। তবে নিঃশব্দ উপন্যাস পড়ে যে কোন পাঠকই অপেক্ষা করবেন তার পরবর্তি সৃষ্টির জন্যে। লেখকের একটা বিষয় আমার কাছে চোখে পড়েছে তা হল ভাষাগত স্থলন। চরিত্রের প্রয়োজনে আঞ্চলিকতা এনেছেন হয়ত, কিন্তু বর্ণনায় বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের ভাষার মিশেল লক্ষ্য করেছি। যদিও উপন্যাসটি দুই অঞ্চলের পট নিয়ে তৈরি। তবে তার সাবলীল বর্ণনায় লেখককে নতুন মনে হয়নি। এক কথায় বললে, 'নিঃশব্দ' সামাজিক বার্তায় ভরপুর একটি উপন্যাস।
Was this review helpful to you?
or
একজন মানুষ কি নিজে থেকে বদলে যায় ? নাকি আশেপাশের মানুষেরা তাকে বদলে যেতে বাধ্য করে?..... ক্ষেত্র বিশেষে দুটোই ঠিক। সময়ের সাথে সাথে জীবনের গল্পে পরিবর্তন আসে। আর সেটা মেনে নিয়ে নিজেদের বদলে ফেলার নামটাই যেন বেচে থাকা। গল্প পটে সে কথাটাই বলতে চেয়েছে নিঃশব্দ। ওইসব মানুষের প্রতিচ্ছবিই বহন করেছে নিঃশব্দের একেকটা চরিত্র। নিঃশব্দ সাইফুদ্দিন রাজিবের লেখা প্রথম উপন্যাস। পশ্চিমবঙ্গের গোপালনগরে বিভূতিভূষণ স্মৃতি জাদুঘরে বসে, প্রথমবারের মতো নিজের লিখা ছাপার অক্ষরে দেখার টান অনুভব করেন লেখক। যার ফলশ্রুতিতে ২০১৭ বইমেলায় আসে তার প্রথম গল্পগ্রন্থ। এরপরেই বড় ক্যানভাসে (নিঃশব্দ) একে ফেলেছেন আশির দশকের শেষদিকের দেশান্তরী কিছু মানুষদের সামাজিক চিত্র। বর্তমান সময়টা যখন থ্রিলার আর অনুবাদের পাল্লা ভারী । কিছু মৌলিক ভালো উপন্যাস মাঝেমাঝে উকি দিলেও, যখন তাদের পেজ দেড়শ'র গণ্ডি পেরোয় না। তখন সামাজিক পটে লিখা দীর্ঘ উপন্যাস 'নিঃশব্দ' আলাদা একটা মর্যাদা আদায় করে নেয় নিজে থেকেই। আর সেই সাথে গল্পটা যদি হয় মন ছুঁয়ে যাবার মতো, তাহলে তা একজন পাঠকের জন্য ষোলকলা পূর্ণ। সমাজে আজো জীবন্ত কুসংস্কার, হিঃসা, জাতি ভেদাভেদের চিত্র যে কয়টা ভয়াবহ হতে পারে, তা আলোকপাত করতে চেয়েছেন লেখক। তেমনি বিপরীত চরিত্র এঁকে বুঝিয়ে দিয়েছেন এ সমাজে দু ধরনের মানুষই বিদ্যমান । দু মলাটের মাঝে দুটো চরিত্রকে দাড় করিয়ে দিয়ে পুরো সমাজের চিত্র ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন তিনি। চেষ্টা করেছেন জাত, ধর্ম ডিঙ্গিয়ে সম্প্রীতির গল্প বলতে। ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির খণ্ডখণ্ড চিত্র বুনে দিয়েছে একটি গল্পে। যেখানে প্রেম-বিরহ, পাওয়া-হারনো, আনন্দ-বেদনা, ভালো-মন্দ সব মিশে গিয়েছে একে অপরের সাথে। . . কাহিনী সংক্ষেপ:: মাতৃতুল্যা ভারতী দেবী মরে যাবার পরে আশেপাশের আপন মানুষদের পালটে যেতে দেখলো অপু। তারা মনে করেন ভারতী দেবী মারা যাবার জন্য সে'ই দায়ী। মনেই বা করবেনা কেনো ! যে মহিলা স্বামী হারিয়ে, ছেলেদের থেকে দূরে থেকে, অভাবের সাথে লড়াই করে দিব্যি বেচে ছিল। সে কি না হঠাত অজ্ঞান হয়ে গেল অপুর বাকশক্তি হারানোর কথা শুনে ! আর সে রাতেই কেউ বোঝার আগেই চলে গেলেন না ফেরার দেশে। অথচ এমনটা তো হবার কথা নয়। সংসারের নির্মম পরিহাস যে মানুষটিকে কিছুই করতে পারেনি। রক্তের সম্পর্কহীন দুই বছরের এক শিশুর বিরল রোগে আক্রান্ত হবার কথাতে, তার কেনো এমন হবে ? সমাজের কুসংস্কারের বেড়া জালে জড়িয়ে থাকা কিছু অশিক্ষিত মানুষ মনে করে অপু পানোতি, অসুর, অপয়া। নাহলে দৃঢ় প্রাণশক্তির স্ব অভিমানী ভারতী দেবীর অধ্যায়টা এভাবে শেষ হতোনা। নিকৃষ্ট সমাজের মানুষদের পাল্টে যাওয়া দেখে ছোট শিশুটির দুচোখ তার বাবাকে খোঁজে ফেরে। এদিকে অপুর বাবা সোমনাথ গিয়েছে বাংলাদেশে, যাত্রাকালে বলেছিল মাত্র পনের দিনের ব্যাপার। কিন্তু দেখতে দেখতে তা দুবছর ঘুরিয়ে গেল। কিন্তু ফিরে এলেননা তিনি। অনেক জায়গায় খবর লাগিয়েও কোনো খোজ পাওয়া যাচ্ছেনা তার। লেখক অপুর জীবনের চলমান চিত্র যখন বর্তমানকে স্থির করে লিখে চলছেন। ঠিক তখনি পাশাপাশি চলে গিয়েছেন সোমনাথ এর অতীতে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া সোমনাথ বাবা মারা যাবার খবর পেয়েই ছুটে যায় ফকিরহাটে। নিজের আপনজন বলতে শেষ মানুষটাকে শেষবারের মতো চোখের দেখা দেখতে। কিন্তু নিয়তির বিধানে সেও আটকে যায় সেখানে। যে পরিবারটাকে উপরে টেনে তুলেছিলেন তার পিতা সৌমেন বিশ্বাস। মোজাফফর সরদারের এখানে কিছুদিন থেকে সবকিছু গুছিয়ে ফিরে যাবে বলে ভেবে নেয় সোমনাথ। কিন্তু দেখতে দেখতে সময় কেটে যায়। অথচ মুখ ফুটে বলা হয়না ফিরে আসার কথা ।ওদিকে সরদার পরিবারের আবদার বেড়েই চলছে তার কাছে। এরমধ্যে একদিন রহমান সরদার আপদারের বদলে আদেশ করে বসলে সে অবজ্ঞা করে। মালিক হয়ে সেটা সহ্য হয়না রহমানের। সে হিসেবে খাতা ছুড়ে ফেলে দিলে সেটা দেখতে পায় পিতা মোজাফফর। ছুটে এসে তিনি আঘাত করে বসে রহমানকে। মাসের পরে মাস সেই গ্লানি টেনে যখন সে সুস্থ হয়, তখন থেকেই প্রতিশোধগ্রহণের ইচ্ছা জাগে তার। মনে মনে ছক একে রাখে সোমনাথকে খুন করার। ঘটনাচক্রে সেই প্রতিশোধের স্পৃহা আরো দ্বিগুণ করে দেয় ভাগ্যরেখা। যেখানে সোমনাথ নীরব দর্শকমাত্র। এভাবেই গল্প পৌঁছে যায় মাতৃহীন আট মাস বয়সের শিশুকে নিয়ে ভারতে পালিয়ে আসার স্মৃতিতে। . . পাঠ-প্রতিক্রিয়া:: প্রথমেই আসি নেতিবাচক কিছু দিকে। পড়তে পড়তে কিঞ্চিত অস্বস্তিতে ভুগছিলাম যেসব কারণে :- একজন লেখকের লিখায় যে গুণটা সবথেকে বেশি থাকা প্রয়োজন, তা হলো পাঠককে পাতার পরে পাতা টেনে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা। গল্পের প্লট যেমনি হোক, লিখার ভঙ্গী এমন হওয়া উচিত, যেন পাঠক শেষ পর্যন্ত পড়ে যাওয়ার মতো আকর্ষণ থাকে লিখায়। অথচ নিঃশব্দে এটি ছিলনা। গল্পের প্লট, কাহিনী চিত্র খুব ভালো ছিল। কিন্তু লিখনী খুব একটা আকর্ষণীয় মনে হয়নি আমার। এরপরে যে সমস্যাটি হয়েছে, তা হলো শব্দের ব্যবহার। প্রথম বাক্যে যেখানে শেষ হয় 'গিয়েছিল' দিয়ে। পরের বাক্যে বাক্য সেখানে শেষ হয়েছে 'রাখল' দিয়ে। এমন সেম অবস্থা প্রায় সব জায়গাতে ছিল। যেটা ভালো লাগেনি। এটা লেখকের লেখার আর্ট হতে পারে। কিন্তু একই প্যারাতে দুধরনের টেন্স না দিলে পড়ে আরাম পাওয়া যেত বলে মনে হয়। প্রথম দিকে 'যদিও', 'তা নয়', 'ততক্ষণে' এমন কিছু মুদ্রাদোষ দেখতে পেয়েছিলাম। পরের দিকে না থাকলেও প্রথম কিছু অংশে পরিমানটা বেশি। 'অক্টোপাস' শব্দটা বারবার একই উপমা হিসেবে ব্যবহার করায় বিরক্ত লেগেছে। উপমার চেঞ্জ আনলে বেশি ভালো লাগতো। একটা চরিত্রের বিশেষ যে বৈশিষ্ট্য, সেটা তাকে যতবার ফোকাস করা হয়েছে, ততবার বলা হয়েছে। যার কোনো দরকার ছিলনা। একবার তাকে পরিচয় করিয়ে দেবার সময়ই তো সেগুলো বলা হয়েছে। তাহলে বারবার বলার কি দরকার? শেষটা হ্যাপি এন্ডিং করতে চেয়েছেন লেখক। তাতে সমস্যা নেই। কিন্তু সবাইকে একসাথে মিলিয়ে দেয়ার ব্যাপারটা সিনেমাটিক মনে হয়েছে আমার। এগুলো কি নেগেটিভ দিক? উত্তর হবে 'না'। এসব সমস্যা একবারের জন্যেও আটকে যাবেনা পড়ার সময়। লেখক একবার বলেছিলেন, তার লিখার দুর্বল অংশ তুলে ধরলে, আগামী লিখায় সেগুলোর দিকে খেয়াল রাখবেন। তাই পড়ার সময় যেসব বিষয় আমার চোখে লেগেছে, বা যার কারণে কনসেন্ট্রেশন ধরে রাখতে সমস্যা হচ্ছিল, সেগুলো তুলে ধরলাম। নিঃশব্দ সামান্য কিছু ত্রুটির ভিতরে অসামান্য এক স্নিগ্ধ গল্প। প্রথম লেখাতেই সাইফুদ্দিন রাজিব দেখিয়ে দিয়েছেন তার লিখার বৈচিত্র্য। গল্পের প্লট, কাহিনী এগিয়ে যাবার ভঙ্গি, সব মিলিয়ে অসাধারণ। লিখার ধরণ পরিপক্ব হলে বলতে পারতাম বর্তমান সময়ের অতুলনীয় লিখা। পড়ার সময় বারবার হারিয়ে গিয়েছি চরিত্রগুলোর মাঝে। দোল খেয়েছি তাদের সাথে। নস্টালজিক হয়ে পরেছি তাদের অতীত স্মৃতিচারণায়। ডুবে গিয়েছিলাম কিছু বাক্যে। যেখানে কেউ বলে ওঠে "...কেন বৃষ্টি ভালো লাগেনা তোমার? ঝুম বৃষ্টি। ঘন ফোঁটার মুষলধারে বৃষ্টি। যে বৃষ্টিতে ভাবনারা দোল খাবে, অব্যক্ত কোনো বিভ্রমে জীবনের স্বপ্ন দেখবে.... " "... যার ভাবনায় বিকেলগুলো সন্ধ্যা হয়, রাতগুলো নির্ঘুম সকাল হয়ে ফিরে আসে, অথচ সে কোনোদিন একটিবার ফিরেও তাকায় না... " "আমার একটুক সুখ তুমি, তুমি তোমার মতই ভালো। " সেজন্য বলতে বাধ্য। নিঃশব্দ শুধু সামাজিকতার দায়বদ্ধতেই থমকে থাকেনি। ছুটে বেড়িয়েছে প্রেম ভালোবাসায়। পিছু ফিরে তাকিয়েছে দেশেরটানে। তুলে ধরেছে প্রতিনিয়ত চোখের সামনে থেকেও, আড়াল হয়ে যাওয়া কিছু মানুষের গল্প। নালন্দার প্রকাশককে তাদের প্রোডাকশন নিয়ে বরাবরই উচ্চস্বরে কথা বলতে দেখেছি। কিন্তু আমার কাছে আলাদা বা চোখে পড়ার মতো বিশেষ কিছু মনে হয়নি। বাইন্ডিং অনেক হার্ড, এজন্য পেজ মেলে পড়তে সমস্যা হচ্ছিল। তাছাড়া লাইনের মধ্যবর্তী স্পেস কম হয়ে গিয়েছে। অন্তত প্যারা থেকে প্যারার দূরত্ব বেশি হওয়া উচিত ছিল । ২৫৪ পেজের বইয়ের মুদ্রিত মূল্য যখন ৪৫০ টাকা হয়, তখন আরো বেটার কিছু হতে পারত। বই:: নিঃশব্দ লেখক:: সাইফুদ্দিন রাজিব রেটিং:: ৩.৫/৫ (কাহিনী রেটিং ৪.৫/৫)
Was this review helpful to you?
or
:::রিভিউ::: দক্ষিণ এশিয়া, আমরা যদি পরিসংখ্যান দেখি সমগ্র বিশ্বের সাত জনের মানুষের দুইজনের বাস এই অঞ্চলের দেশগুলোতে। কিন্তু এই বিশাল জনসংখ্যার অঞ্চলে কয়েকটি ধারকের উপস্থিতি মানব সংখ্যাকে প্রকৃত মানব সম্পদে পরিণত হতে দেয়নি। আর সেগুলো হলো ধর্ম, কুসংস্কার, জাতিবাদ এবং অশিক্ষা। তরুণ লেখক সাইফুদ্দিন রাজিব তার নিঃশব্দ উপন্যাসে দুইবাংলার সমাজবদ্ধ মানুষের মাঝে চলে আসা এই ধারকগুলোকে খুব স্পষ্ট করে তুলে ধরেছেন যা আমাদের প্রথাগত সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বেরিয়ে এসে নতুন করে ভাবতে আহবান জানাবে। উপন্যাসের নামঃ নিঃশব্দ লেখক: Saifuddin Rajib (সাইফুদ্দিন রাজিব) জনরাঃ সমকালীন/ সামাজিক প্রকাশকঃ নালন্দা প্রথম প্রকাশঃ ফেব্রুয়ারী, ২০১৮ পৃষ্ঠাসংখ্যাঃ ২৫৪ ধর্মের ভিত্তিতে ভারতীয় উপমহাদেশকে ভাগ করার সিদ্ধান্ত নিলো রাজনৈতিক উপর মহলের মানুষেরা, সেখানে সাধারণ মানুষের কোন প্রভাব নেই কিন্তু আছে তার ভাগ্যের সিদ্ধান্ত। ফলশ্রুতিতে উভয়পক্ষের মৌলবাদীরা ৪৬ সালে দেশকে দাঙ্গা আর বিশৃঙ্গলার কালো অন্ধকারে ডুবিয়ে দেয় সমগ্র ভারতবর্ষকে। আপনজনের ১০ লক্ষ লাশ ডিঙ্গিয়ে দুকোটি কোটি বাস্তুচ্যুত মানুষের অচেনা পথের উদ্দেশ্যে অনিশ্চিত যাত্রায় মুখোরিত হয়েছে বাংলা আর পাঞ্জাবের সীমান্ত। কিন্তু হিংসার এই গল্প এখানে শেষ হয়নি। ৪৭ গেলে আসে ৭১। আবার এক কোটি মানুষ গৃহহীন, লক্ষ লক্ষ মানুষে লাশের স্তুপ। বেঁচে থাকার তাগিদে তখন সেই মানুষগুলো এসে পাড়ি জমায় ওপার বাংলায়। এই উপন্যাসের রূপক চরিত্র ভারতী দেবী সেই বাস্তুচ্যুত মানুষের একজন প্রতিনিধি। নিজের পরিচিত ঘর, নিজের হাতে গড়া সোনার সংসার ছেড়ে ভিনদেশে এসে হতদরিদ্রের মত বেঁচে থাকা কি ভারতী দেবীর প্রাপ্য ছিল? ছিল না। তবুও বেঁচে থাকার অমোঘ শক্তি ভারতী দেবীকে দিয়ে লড়াই চালিয়ে নিয়ে যায়। ভারতী দেবীকে দেখলে আমরা বুঝতে পারি আজ যারা এপার থেকে গিয়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে তাঁদের পিছন রেখে এসেছে সংগ্রামের দীর্ঘ এক ইতিহাস। কিন্তু দুই ভূখন্ড আর দুই ধর্মের মানুষের হিংসা আর ঘাত প্রতিঘাত দিয়ে শুধু এই গল্প শেষ হয়ে যায়না। সেখানে বিদ্যমান বিশ্বাস আর ভালোবাসাকেও উপেক্ষা করা যায় না। যেমন দেশভাগের সাম্প্রদায়িকতার সেই লেলিহান শিখাকে ভয় না পেয়ে সোমনাথের পিতা সৌমেন ঠিকই মাতৃভূমির প্রতি মায়া, শেকড়ের টানে থেকে যায় এখানে। তার বন্ধু এবং কর্মস্থলের অভিভাবক মোজাফফর সরদার তাকে আগলে রাখে। শুধু এখানেই শেষ নয়। সৌমেনের মৃত্যুর পর সোমনাথের উপর কর্তব্য পালনে প্রচণ্ড সচেষ্ট দেখা যায়। অন্যধর্মের একটি যুবককে নিজের পরিবারের একজন সদস্য করার ব্যাপারে মুজাফফরকে কখনো দ্বিধান্বিত দেখা যায়নি। সোমনাথ আর মুজাফফর সরদার এবং তার পরিবারের এই সম্প্রীতি শুধু একটি গল্প নয় এদেশে বসবাসরত দেড়কোটি হিন্দুর জীবনে কখনো না কখনো মুজাফফর সরদারের মত সংখ্যাগরিষ্ঠে শ্রেণীর মানুষের ছায়া প্রয়োজন হয়েছে সেই বাস্তবতার প্রতিবিম্ব। এই অঞ্চলের মানুষের জীবনের গুপ্ত ঘাতক হলো কুসংস্কার। এই কুসংস্কারের বলি হয়ে আজ একুশ শতক এসেও প্রতিদিন সহস্র মানুষের জীবন অন্ধকারের আর মিথ্যা অভিশাপে শেষ হয়ে যাচ্ছে। উপন্যাসটি আমরা এর চমৎকার একটি দৃষ্টান্ত দেখতে পাই। অপুর বাকশক্তি রহিত হবার পরে তার আশপাশের মানুষ জুড়ে কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটতে থাকে। ভারতী দেবীর আকস্মিক মৃত্যু থেকে সূচনা হয় অপুকে নিয়ে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গির। কুসংস্কারপ্রিয় মানুষ গুলো এই ঘটনাগুলোর মাঝে অপুর যোগসূত্র খোঁজার চেষ্টা করে এবং তারা বিশ্বাস করে অপু নামের শিশুটি তার নিজের সাথে এই দুর্ভাগ্যকে বয়ে নিয়ে এসেছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, “মনুষ্যত্বের শিক্ষাটাই চরম শিক্ষা আর সমস্তই তার অধীন” কবিগুরুর এই বাণী যেন উপন্যাসের সোমনাথ চরিত্রটি তার ব্যক্তিত্ব দিয়ে বার বার স্পষ্ট করে তুলেছে। মুজাফফর সরদার এবং তার পরিবারের প্রতি সোমনাথের দায়বদ্ধতার চিত্র থেকে এটা পরিস্কারভাবে বোঝা যায় শুধু মাত্র সোমনাথ প্রচলিত উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া পর্যাপ্ত ছিল, মনুষ্যত্বের শিক্ষাটাও ছিল অপরিহার্য। আর এই ধর্ম উপর ভিত্তি করে অর্জন করা যায়না। মূলত দুই ধর্মে মাঝে সহস্র ব্যবধান, শত হিংসা, ঘৃণা পেরিয়েও যে দুই ধর্মে মানুষ একবিন্দুতে মিলিত হতে পারে তার চমৎকার একটি উপস্থাপনা এই উপন্যাসটি। সমালোচনাঃ প্রথমে বলে রাখি, বইটির গল্পের সাথে সাথে প্রচ্ছদ অনবদ্য সুন্দর। বইটি হাতে নিয়ে প্রচ্ছদে হাত বুলাবে না এমন পাঠক সম্ভবত কেউ থাকবে না। কিন্তু পড়তে গিয়ে সমস্যা হয়েছে উপযুক্ত লাইন স্পেসিং এর অভাব। বইটি অন্তত ৩০০ পৃষ্ঠার হওয়া উচিৎ। তাহলে পাঠকেরা পড়তে আরামবোধ করবে। নামকরণের স্বার্থকতাঃ “নিঃশব্দ” পাঠক বইটির কতখানি গভীরে প্রবেশ করেছেন তার পরিমাপক হিসাবে কাজ করবে এই নামটি। আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে অপুর দুরারোগ্য ব্যাধিতে বাকশক্তি হারিয়ে ফেলা নামকরণের ক্ষেত্রে মূল প্রভাবক হিসাবে কাজ করেছে কিন্তু পাঠক যখন অপুকে কেন্দ্রে রেখে উপন্যাসটির চরিত্রগুলি আর দুইদেশের মানুষের সামাজিক বাস্তবতা আর সাদৃশ্যগুলো অনুধাবন করতে পারবেন তখন উপন্যাসটির প্রকৃত নাম পাঠকের হৃদয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠবে। শুধু অপুর নিঃশব্দ নয়, হিংসা, মৌলবাদ আর ঘৃণার আড়ালে লক্ষ লক্ষ মানুষের মাঝে নিঃশব্দে গড়ে ওঠা ভালোবাসা আর বিশ্বাসের গল্প হলো নিঃশব্দ। ব্যক্তিগত অভিমতঃ পুরো উপন্যাসটিকে মূলত দুইটি ভিন্ন ধারায় যুগপৎভাবে রচনা করা হয়েছে। একটি ধারায় আমরা অপুকে প্রধান চরিত্র রূপে দেখতে পাই আর অপর ধারায় আমরা অপুর পিতা সোমনাথকে আর দেখি মুখ্য চরিত্রে। ব্যাপারটা সহজ নয়। তবুও তরুণ লেখক দুই ধারার সমন্বয় ঘটিয়ে নিজেকে প্রমাণ করেছেন। সাহিত্য সম্ভবত মেধার জগতে একমাত্র স্থান যেখানে প্রাক্তন বলে কিছু নেই, প্রবীণ বলে হারিয়ে যাওয়া নেই। সাহিত্যে একটি মানুষকে সময়কে জয় করার অমোঘ শক্তি প্রদান করে। সে একজন মানুষ থেকে হয়ে ওঠে একজন কালের বিজেতা তথা একজন লেখক, একজন কবি। কিন্তু প্রয়াত কালের বিজেতাদের উপস্থিতিতে তরুণ কলমের অভিযাত্রীরা নিজেদের মেলে ধরতে পারছেনা। যারা হয়তো একটু উৎসাহ, একটু বিশ্বাস পেলে সাহিত্যের এক একটি অগ্নিশিখা থেকে উজ্জ্বল প্রদীপে রূপ নিতে পারে । অন্তত তরুণ লেখক সাইফুদ্দিন রাজিবের লেখা নিঃশব্দ উপন্যাসটি পড়ে আমার এমনটি মনে হয়েছে। তাই আমি প্রত্যাশা তার এই লেখাটি শত শত পাঠক হৃদয়ে স্থায়ী ঠাই খুঁজে নিতে সক্ষম হবে।
Was this review helpful to you?
or
ভারতবর্ষের ইতিহাসে হিন্দু ও মুসলিম শব্দ দুটি একে অপরের পরিপূরক। কোনো একটাকে বাদ দিয়ে এই অঞ্চলের ইতিহাস লেখা অসম্ভব। শতশত বছর ধরেই এই ধর্মের দুই ধর্মের মানুষ সহাবস্থান করে আসছে। কখনো কাধে কাধ মিলিয়ে দেশ গড়ার কাজে ঝাপিয়ে পড়েছে। আবার কখনো নিজেরাই দেশকে ভেঙে নিজেদের মত সুখে থাকার চেষ্টা করেছে। তা সে যাই ঘটে থাকুক, ভারতবর্ষে মুসলিম আর হিন্দু যেন দেহ আর আত্মার মত। লেখক সাইফুদ্দিন রাজিবের লেখায় চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে এই সমগ্র বিষয়টি। ভারতী দেবী একজন খেটে খাওয়া মানুষ। অল্প বয়সে স্বামীকে হারানোর পরে ছোট ছেলেমেয়েদের নিয়ে সংগ্রাম করে বাচতে হয়েছে। সেই ছেলেরা বড় হয়ে মাকে ভুলে গিয়ে নিজেদের মত সুখি হলো। ভারতী দেবী সুখের আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন। একমাত্র মেয়েকে বিয়ে দিয়ে তার সুখের জীবন শুরু হয়েছিলো। নিজের পেটের সন্তান যা করেনি, তাই করেছিলো অপরের ছেলে পরশ। অবশেষে শেষ জীবনে সুখ খুজে নিয়েছিলেন সোমনাথের ১ বছর ৮ মাসের সন্তান অপুর মাঝে। সেই সুখ স্থায়ী হতে পারতো, কিন্তু বিধাতা হয়ত কপালে অন্য কিছু লিখে রেখেছেন। সৌমেন বিশ্বাস আর মোজাফফর যখন একত্রে আড়তদারি শুরু করে তখন মোজাফফর মালিক আর সৌমেন তার ম্যানেজার থাকলেও মোজাফফর সৌমেনকে কখনো তেমন চোখে দেখেন নাই। ব্যাবসার হিসাবের কিছুই বোঝেন না মোজাফফর। ব্যাবসার সব হিসাব সব সৌমেনের কাছেই থাকত। বিনিময়ে প্রয়োজনের বেশি এক টাকাও নেয়নি সৌমেন। পরিবারের সবাই ওপার বাংলায় চলে গেলেও নিজের দেশ ছেড়ে কোথাও যায়নি সৌমেন। ছেলে সোমনাথকে উচ্চশিক্ষিত করে তুলেছে। সেই সৌমেনের অকাল মৃত্যুতে ভেঙে পরে মোজাফফর। সৌমেন তার জন্য যা করেছে তার কোনো তুলনা হয় না। সেও চেষ্টা করেছে সাধ্যমত তার জন্য কিছু করার। সৌমেনের বেতনের টাকা জমিয়ে এগার বিঘা জমি কিনে রেখেছে। পিতার প্রতি মোজাফফর সরদার আর তার পরিবারের ভালোবাসা দেখে বিমোহিত হয়ে যায় সোমনাথ। কিভাবে সে মোজাফফরের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করবে! মাস্টার্সের পড়া লস দিয়ে মোজাফফরের আড়ত দেখলো এক বছর। দুই ধর্মের দুই পরিবারের এই সম্পৃতি আমার কাছে এই উপমহাদেশের আয়না হয়েই ফুটে উঠেছে। সুখ যেখানে থাকে, সেখানে দুঃখ দানা বাধতে সময় নেয় না। সেটা নাহয় আপনাদের জন্য তোলা থাক। মানুষ তার জীবনে সুখ খুজে বেড়ায়। কিন্তু জীবন চলে আপন গতিতে। সুখ আর দুঃখ নিয়েই জীবন। গল্পে দুই বাংলার মানুষের জীবনের একটা সেতুবন্ধন ঘটিয়েছেন লেখক। দুইটা আলাদা টাইমলাইনে বয়ে চলা গল্পে কখনো মূল চরিত্র অপু, আবার কখন মূখ্য চরিত্র অপুর পিতা সোমনাথ। খারাপ লাগাঃ খারাপ লাগা বলতে গেলে প্রথমেই বলতে হবে লেখার ফ্রন্টের কথা। এত দাম দিয়ে একটা বই কিনে পাঠক যদি পাইরেটেড বই পড়ার ফিল পায় তাহলে কেউ খুশি হবে বলে মনে হয় না। বইটা ৩০০ পৃষ্ঠার কাছাকাছি হওয়া উচিত ছিলো। ছাপার মান আরও ভালো হতে পারতো। লেখকের গল্প বলার ভঙ্গি একটু অগোছালো মনে হয়েছে। আরও সাবলিলভাবে গল্পটা বলা যেত বলে মনে হয়। কিছু জায়গায় মনে হয়েছে যে, লেখক যা বোঝাতে চাচ্ছেন তা বোঝাতে পারছেন না। ফলে লাইনের পর লাইন লিখে যাচ্ছেন। অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আরও হাইলাইট করা দরকার ছিলো কিন্তু সেটা না করে অপ্রয়োজনীয় বিষয়কে বেশি টেনে নেওয়া হইছে বলে আমার মনে হয়। বেশ কিছু জায়গায় ধোয়াশা থেকে গেছে, যার কোনো ব্যাখ্যা পাইনি। প্রথমদিকে মনোযোগ ধরে রাখা কষ্টকর ছিলো। জোর করে পড়ে গেছি। ভালো লাগাঃ প্রথমদিকে মনোযোগ না রাখতে পারলেও অর্ধেক পার হওয়ার পরে আর থেমে থাকতে হয়নি। গল্পের ভিতরে হারিয়ে গেছিলাম। অনেক লেখককে দেখেছি একটা মাত্র চরিত্রের উপরে ফোকাস করতে। অনেকগুলো চরিত্র একত্রে টেনে নেয়া দুরূহ কাজ। সেই কাজটা করার চেষ্টা করেছেন লেখন। পুরোপুরি সফল না হলেও ব্যার্থ হয়েছেন এমন দাবি করতে পারবো না। তাছারা আপনাকে বলে রাখি, এটা লেখকের প্রথম উপন্যাস। গল্প বলার ভঙ্গি বা প্রথমে বিরক্ত লাগলেও গল্পের জোরেই আমাকে শেষ পর্যন্ত টেনে নিয়ে গেছেন। নিধি চরিত্রটা খুব অল্প সময়ের জন্য থাকলেও তার গভিরতা অনেক। যুগ যুগ ধরে এই অঞ্চলের মানুষরা বিভিন্ন ধর্ম বিশ্বাস নিয়ে পাশাপাশি থেকে শান্তিতে বাস করছে। নিধি যেন এই সকল মানুষের প্রতিনিধি। অন্য ধর্মকে শ্রদ্ধা করে নিজের ধর্ম পালন করেও যে ধার্মিক হওয়া যায়, নিধি যেন তার জলন্ত উদাহরন। সবশেষে প্রচ্ছদের কথা না বললে নয়। শুধু ঘরের শোভা বর্ধনের জন্যও বইটা কেনা যায়। বাংলা সাহিত্যে ক্লাসিকের যুগ কি শেষ! মাথার ভিতরে মাঝেমধ্যে এমন চিন্তা ঘুরপাক খায়। যারা গত হয়েছেন তাদের মত কি কেউ হতে পারবেন না? এই দ্বন্দ হয়ত আরও চলবে। তবে নিঃশব্দ দিয়ে লেখক আমার আশঙ্কা অনেকটাই দুর করেছেন।