User login

Sing In with your email

Email Address
Password
Forgot Password?

Not Account Yet? Create Your Free Account

Send

Recipients:
Message:

Share to your friends

Copy link:

    Our Price:

    Regular Price:

    Shipping:Tk. 50

    • Size:
    • Color:
    QTY:

    প্রিয় ,

    সেদিন আপনার কার্টে কিছু বই রেখে কোথায় যেন চলে গিয়েছিলেন।
    মিলিয়ে দেখুন তো বইগুলো ঠিক আছে কিনা?

    Please Login to Continue!

    Our User Product Reviews

    Share your query and ideas with us!

    Customer Reviews

      By সাকিব আহমেদ

      21 Mar 2025 08:53 PM

      Was this review helpful to you?

      or

      নদীর ঢেউ আছড়ে পড়ে সীমানায়। প্রবল আক্রোশে গ্রাস করে নেয় স্থল। মানুষের জীবন কিংবা শেষ সম্বল বিলীন হয়ে যায় নদীকুলে। সুগন্ধা নদীর এমন তেজি হয়ে ওঠার গল্প বেশ পুরোনো। সর্বগ্রাসী এ নদীর গর্ভে বিলীন হয়ে গেল কত স্বপ্ন, মানুষ হারিয়ে ফেলল সবকিছু! তবুও এর তেজ কমে না। যেন পুরো চানপুরা গ্রামকে গ্রাস না করে সে থামবে না। গ্রামের নাম চানপুরা। যে গ্রামের প্রতিটি মানুষের জীবনে কোনো না কোনো গল্প আছে। আছে মনে গভীরে জমে ওঠা তীব্র হাহাকার। যে গল্প কেউ কাউকে বলে না। নীরবে, মনের অভ্যন্তরে থাকা সেসব গল্প নিয়ে এক জীবন কাটিয়ে দেয়। এই গল্পটা একজন মানুষের না। অনেকগুলো মানুষের জীবন এখানে এক সুতোয় গাঁথা। ভিন্ন ভিন্ন গল্পের অবতারণা হলেও একসাথে সকল গল্প নিজেদের মধ্যে যোগসূত্র তৈরি করে। হয়তো জীবনটাই এমন। আপনাআপনি এক অপরের সাথে সংযোগ তৈরি হয়। যে সংযোগ নদীর মতোই আপন গতিতে চলে। কখনও সর্বগ্রাসী হয়ে ভাঙন ধরে। এই ভাঙন যেমন নদীর কুলকে বিলীন করে, বিলীন হয়ে যায় জীবনের অনেককিছু। যেমন আশ্বিব তালুকদার লোভে পড়েই কি না ঘোষভিটা নিজের দখলে নিয়ে নিয়েছে। যেখানে মা মনসার মন্দির জানান দেয় হিন্দুবাড়ির কথা। সময়টা খুব সঙ্গীন। ভিন্ন ধর্মের বলেই পানির দরে নিজের বাড়ি বিক্রি করে অন্য বিভুঁইয়ে চলে যায় হিন্দুবাসী। যাওয়ার আগে মন্দিরের প্রতি অমর্যাদার না করার আরজি রেখে গেলেও তা কতটা পালিত হয়? যেখানে লোকে বলে, মা মনসার আশীর্বাদে কলসি ভর্তি গুপ্তধন পাওয়া যায়। ধর্ম মানুষের কাছে আবেগের বস্তু। এর অমর্যাদা করলে ঘোর অমঙ্গল নেমে আসে। হয়তো সে কারণেই বংশ নির্বংশের দ্বারপ্রান্তে তালুকদার সাহেব। ধর্মের নানান মত, নানান তরিকা আছে। সেই এক তরিকার অনুসারী ফকিরবাড়ি, যার খলিফা খবিরউদ্দিন। সদ্য স্ত্রী মারা গিয়েছেন। মেয়ে মায়মুনা মাকে দেখার শেষ ইচ্ছাটাও পূরণ করতে পারেনি। মানুষ লোভে পড়ে অর্থের, একই সাথে ক্ষমতারও। স্ত্রীর মৃত্যুর পর খবিরউদ্দিন নিজ জীবন নিয়ে সংশয়ে। যদি এমন হয়, হুট করে নিজেরই জীবনপ্রদীপ নিভে যায়? এই দরবারের হাল ধরবে কে? নিজের ছেলেকে প্রস্তুত করছে খবিরউদ্দিন। কিন্তু মেয়ের জামাইও যে কোনো অংশে কম যায় না। নিজেই বা জায়গা ছাড়বে কেন? তাই সে-ও চায় খবিরউদ্দিনের উত্তরসূরি হতে। যখন ক্ষমতা অর্জনের লোভ মনের মধ্যে বাসা বাঁধে, তখন আসলে মানুষ বিচারবুদ্ধি হারিয়ে ফেলে। ভুল তখন খুব স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। যে ঘোষভিটা অর্জন করেছে তালুকদার, তার দিকে অনেক আগে থেকেই নজর ছিল চেয়ারম্যান সাহেবের। কিন্তু শেষ বেলায় তালুকদারের বাজিমাত করে দেওয়া মানতে পারছে না কিছুতেই। তাই বেশকিছু ষড়যন্ত্রের বীজ ছড়িয়ে দিতে চাচ্ছে। যেকোনো ধর্মের ক্ষেত্রে স্পর্শকাতর বিষয় তাদের উপাসনালয়। এর অমর্যাদা কেউ মেনে নিতে পারে না। তাই ধর্মের দোহাই দিয়ে উস্কে দিয়ে নিজের কাজ হাসিল করার চেষ্টায় কতটা সফল হবে চেয়ারম্যান? এই গল্পটা রাবেয়ারও। এক সংগ্রামী নারী। স্বামী মতালেব যখন কোনো কিছুই করে না, উড়নচণ্ডী হিসেবে ঘুরে বেড়ায়; তখন সন্তানদের মানুষ করতে একা লড়াই করতে হয়। শুধু যে সংসার, তা নয়। পুরো পরিবারকে আগলে রাখতে হয়। মাথার উপর যে ছাদ, তাকেও ঘিরে তুলতে রাবেয়া নিজের এক জীবন শেষ করেছে। বিয়ের পর বড় ভাসুরের লাথি খেয়ে যখন বেরিয়ে পড়েছিল, তখন মাথা গোঁজার ঠাঁই ছিল না। নিজের একাগ্রতায় বাড়ি গড়লেও সুগন্ধার আগ্রাসী চোখ রাঙানি শঙ্কা জাগায়। দুই ছেলে কোনো এক দুর্ঘটনায় লাপাত্তা। বড় হতে থাকে সুন্দরী ছোট মেয়েকে বাজে ইঙ্গিত করে এলাকার বখাটে। এতকিছু সামলে নিজের লড়াই লড়তে হয় পরিবারের জন্য, স্বামীর জন্য। এই গল্পে হয়তো নূরীও গুরুত্ব পেতে পারে। মা মরা মেয়েটা একা হাতে পরিবার সামলেছে। যখন বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করল, তখন তারই উৎসাহ ছিল সবচেয়ে বেশি। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে সৎ মা তাকে সেই জায়গাটা দেয়নি। ভালোবেসেছিল নূরী। ফকিরবাড়ির শাহজালালকে মন দিয়েছিল। কিন্তু বাবা যে ফকিরবাড়ির তরিকা পছন্দ করে না। মেয়েকে অন্য জায়গায় বিয়ে দিয়ে দিল! সেই দুঃখেই কি না শাহজালাল পাগল হয়ে গেল, কে জানে! শাহজালালের মা-ও এই গল্পে প্রাধান্য পেতে পারে। তার জীবনের গল্পও যে খুব একটা সুখের না। এই দুঃখের অসুখ ছড়িয়ে যায় সবার মাঝে। সবার জীবনেই কোনো না কোনো ব্যথা বা বেদনা আছে। যা কেউ বলতে পারে না। নিজের ভেতরে গুমরে মরে। সে হতে পারে মায়মুনা, রাবেয়া না শাহজালালের মা। আবদুল্লাহ আল ইমরানের লেখা এর আগে কখনও পড়া হয়নি। “দিবানিশি” উপন্যাসটি বেশ ভালো লেগেছে বলা। গ্রামীণ পটভূমিতে তিনি বেশ কয়েকটি জীবনের গল্প বলেছেন, বেঁধেছেন এক সুতোয়। প্রতিটি ভিন্ন মানুষ, তাদের ভিন্ন জীবনযাত্রা সুখ দুঃখের মিশেলে বন্দী। সুখ যতটা সময় নিয়ে আসে, দুঃখ যেন তারচেয়েও বেশি সময় থিতু হয়। বইয়ের প্রতিটি অধ্যায় ভিন্ন ভিন্ন মানুষের গল্প লিপিবদ্ধ করে। বইয়ের যে বিষয়টি ইন্টারেস্টিং লেগেছে, তিনি গল্প বলতে বলতে অতীতকে সামনে এনেছেন। অতীত মানুষের জীবনের এক গুরুত্বপুর্ণ অংশ। এতে মানুষকে চেনা যায়। বেশ ভালোভাবে উপলব্ধি করা। এভাবেই তিনি প্রতিটি চরিত্রকে একটা জায়গা দিয়েছেন। খুব কম চরিত্র এখানে ছিল না। তারপরও প্রতিটি চরিত্রকে স্বল্প পরিসরে বেশ ভালোভাবেই উপস্থাপন করেছেন। এই গল্পে অংশ প্রধান চরিত্রের মধ্যে আমার মনে হয়েছে লেখক নারীদের এক অন্যরকম শক্তিতে উপস্থাপন করেছেন। রাবেয়া, নূরী, মায়মুনা, সালেহা কিংবা শাহজালালের মা। আমাদের সমাজ ব্যবস্থায়, বিশেষ করে গ্রামে নারীদের তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয় না। তাদের কথার তেমন কোনো দাম থাকে না। মায়মুনা বা নূরী সেই অবস্থার সাক্ষী। বাবা জোর করে মতের বিরুদ্ধে মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দেয়। এরপর মেয়ের কী হবে, ভালো থাকবে কি না সেই চিন্তা করে না। নিজেদের জেদ সবার আগে প্রাধান্য পায়। একসময় ঠিকই অনুতপ্ত হতে হয়। নিজের ভুলের কারণে প্রায়শ্চিত্ত করার সে সুযোগ থাকে কি না, সেটা অবশ্য প্রশ্ন রেখে যায়। অন্যদিকে রাবেয়া বা সালেহার মতো নারীরা সমাজের শক্তি হয়ে ওঠে। এই গল্পে সালেহা মৃত হওয়ার পরও তার গুরুত্বে একটুও ভাটা পড়ে না। ফকিরবাড়িকে যে আগলে রেখেছিলেন তিনি। অন্যদিকে রাবেয়া উড়নচণ্ডী স্বামী থাকার পরও একা থাকে যেভাবে সংসারকে ধরে রেখেছেন, ছেলে মেয়েদের মানুষ করেছেন। তার প্রশংসা করতেই হয়। তাছাড়া শেষ দৃশ্যে এসে অন্যায়ের সাথে যে আপসহীন পরিচয় রেখেছেন, এতেই দৃঢ় এক চরিত্রের আভাস পাওয়া যায়। নারীরাই সমাজের শক্তি। তারা সংসারকে এক অদৃশ্য সুতোয় বাঁধতে পারে। নারীরা যখন নিজেদের সংগ্রামের জানান দেয়, তখন পুরুষ সমাজ ক্ষমতা দখলের লড়াই করে। তালুকদার ও চেয়ারম্যান সাহেবের লড়াই বেশ প্রকাশ্য। তাছাড়া ফকিরবাড়ির মাথা হওয়ার চেষ্টায় ছেলে ও মেয়ের জামাইয়ের লড়াইয়ে মাথা কাটা যায় খবিরউদ্দিনের। ভক্তদের কী করে মুখ দেখাবে? আজগর কিংবা সোহেলের যে রূপ সামনে আসে, তা যেন সমাজের কিছু মানুষের প্রতিচ্ছবি। যারা মুখোশের আড়ালে অপকর্ম করে বেড়ায়। যেটা প্রকাশ্যে এলে থমকে যেতে হয়। গ্রামীণ এই সমাজে অজস্র কুসংস্কার আছে। সেই কুসংস্কারের প্রতিফলন ঘটিয়েছেন লেখক। মৃত্যু যেন অভিশাপ ও অমঙ্গলের ফসল। তার থেকে পরিত্রাণ পেতে হবে। ফলে মানত করা, দরবারে বৈঠক দেওয়া, পুজো-অর্চনার বলি দেওয়ার মতন ঘটনা ঘটে। এর কতটা বাস্তব, আর কতটা পরিত্রাণের উপায় কী জানে? বইটিতে গ্রাম্য কূটচাল ও রাজনীতির অনেক কিছুই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। লেখক সেগুলো ছেড়ে দিয়েছেন পাঠকের চিন্তাধারার উপর। আমরা বাহ্যিক মানুষকে যেভাবে বিচার করি, অভ্যন্তরীণ দিক তেমনটা নাও হতে পারে। বইটির শুরুটা সামাজিক উপন্যাসের মতন হলেও, যতটা সময় এগিয়েছে কিছুটা রহস্য, অল্প কিছু থ্রিলারের উপকরণ ছিল। যে রহস্য ছড়িয়ে দিয়েছিল পরবর্তীতে কী হবে তা জানার আকাঙ্ক্ষা তৈরিতে। ভালোই লেগেছে বলা যায়। জটিল কোনো গল্প না। সাদামাটা গ্রামীণ জীবনের অভ্যন্তরে যেসব রহস্য জমা থাকে, তাকে ভালোভাবেই উপস্থাপন করা হয়েছে। তবে কিছু বিষয় ভালো হতে পারত। বারবার বলা হয়েছে তালুকদারের বিরুদ্ধে হিন্দুরা অসন্তুষ্ট। কিন্তু সেই অসন্তোষ বলাতেই সীমাবদ্ধ ছিল। হিন্দুশ্রেণীর দিক দিয়ে বিষয়টা দেখানো যেত। তাছাড়া শেষের দিকে অনেককিছুই মীমাংসা না করেই গল্পের সমাপ্তি হয়েছে। তালুকদারের ছেলেদের কোন রোগ হয়েছিল, সেটার সমাধান হলো না। লেখক সম্ভবত ভেবেছিলেন সব রহস্যের সমাধান করতে হয় না। আমাদের জীবনই তো আপার রহস্যের আঁধার। সেখানে কত রহস্য খেলা করে তার সব কি সমাধান হয়? বইটির প্রোডাকশন কোয়ালিটি দুর্দান্ত। বানান ভুল নেই বললেই চলে। কাগজও বেশ উন্নতমানের। বাঁধাই থেকে শুরু করে প্রচ্ছদও বেশ দারুন লেগেছে আমার। পরিশেষে, আমাদের জীবনে কত চাওয়া পাওয়া থাকে। কত কিছুর করার ইচ্ছা জাগে। সবকিছু পূরণ হয় না। কখনও সামর্থ্যে কুলায় না, কখনও সুযোগ হয় না। জীবন কোনো এক সময় সুযোগ ও সামর্থ্য ঠিকই দেয় তারপরও ইচ্ছে পূরণ করা যায় যায় না। শাহজালালের কাছ থেকে মায়ের যেমন শাড়ি পাওয়া হয় না, স্বামীর কাছ থেকে নাকফুল পাওয়া হয় না রাবেয়ার। জীবন যুদ্ধে একসময় তাদের হারতে হয়। আবার নূরী কিংবা মায়মুনা অপ্রত্যাশিতভাবে অনেক কিছু পেয়েও যায়। নূরী জোর করে আদায় করে নেয় ভালোবাসা, মায়মুনা ভাগ্যের কাছে বিজয়ী হয়ে ওঠে। যেখানে মূল্যহীন ছিল, সেখান থেকে মূল্যবান কেউ। বিচিত্র জীবনে ভিন্ন মানুষ ভিন্নভাবে ভাগ্যকে রচনা করে। কারো প্রাপ্তি হলে কেউ বা অপ্রাপ্তির খাতায় নিজের নাম লেখায়। এভাবেই জীবন চলে, চলতেই থাকে… ▪️বই : দিবানিশি ▪️লেখক : আবদুল্লাহ আল ইমরান ▪️প্রকাশনী : অন্বেষা ▪️প্রকাশ সাল : ২০১৭ ▪️ব্যক্তিগত রেটিং : ৪/৫

      By Md Ashikur Rahman Khan

      01 Mar 2022 05:39 PM

      Was this review helpful to you?

      or

      দিবানিশিঃ পৃথিবীর আবর্তনে চলমান মানব জনমের গল্প ছোট্ট একটা মানব জনম। অথচ তাকে ঘিরে আমাদের রোজকার কতো আয়োজন! বেঁচে থাকার তাগিদে আমাদেরকে নানা ইহজাগতিক কর্মে যেমন দিনাতিপাত করতে হয়, তেমনি অন্তরাত্মার খোরাক জোগাতেও অনেক কিছুই করতে হয়। জগতে কিছু মানুষ থাকে, যারা আর দশজন মানুষের মতো সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয় না। বিপুল বৈচিত্র্যের বুননে গাঁথা মানব জীবনের এটাও আরেক ভিন্নতর রূপ। গ্রামীণ আবহের এমন কিছু ভিন্নতর জীবনের গল্প নিয়ে বর্তমান সময়ের জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক আবদুল্লাহ আল ইমরান পাঠক সমাজে হাজির হয়েছেন তার "দিবানিশি" উপন্যাস নিয়ে। প্রচলিত গ্রামীণ জীবনের সংগ্রামের গল্প থেকে শুরু করে মারফতি ঘরানার জীবনবোধ, বিশ্বাস ও নিত্যদিনের গল্প উপন্যাসের গল্প হয়ে উঠে এসেছে। একদিকে মারফতি নূরে উদ্ভাসিত কিছু মানুষের জীবনের গল্প; অন্যদিকে নিজের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার লড়াইয়ে মত্ত দুই ক্ষমতাধরের গল্প। এর পাশাপাশি ভিন্ন লড়াইয়ে মত্ত দুই সংগ্রামী নারীর জীবনচিত্র উপন্যাসটিকে পাঠক সমাদৃত করে তুলতে অত্যন্ত সহায়ক ভূমিকা রেখেছে। এছাড়া ঔপন্যাসিকের অন্যান্য লেখার মতো এখানেও বেশ সাবলীল ভাষায় গ্রাম্য সমাজ ও সংস্কৃতির নানা চিত্র অত্যন্ত সুন্দরভাবে উঠে এসেছে৷ এবার আসি উপন্যাসের কাহিনী সংক্ষেপের আলোচনায়। সুগন্ধা নদীর অববাহিকায় গড়ে ওঠা গ্রাম চানপুরার অন্যতম প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব আশ্বাব তালুকদারের ঘোষভিটা দখল ও ধনরত্নপূর্ণ কলসি পাবার আশায় মা মনসার মন্দির খোঁড়াখুঁড়ির ঘটনা দিয়ে উপন্যাসের গল্পের শুরু। এ ঘটনার পর তার দুই পুত্র মারা গেলে রহস্যের জাল ছড়াতে শুরু করে। সবার ধারণা, মা মনসার কুদৃষ্টি পড়েছে। সর্পদেবীর অভিশাপে তালুকদার বংশ নির্বংশ হয়ে যাবে। অন্যদিকে, জীবন সংগ্রামে লিপ্ত রাবেয়া একক প্রচেষ্টায় ছেলেমেয়েদেরকে মানুষ করে তোলে। সংসারবিমুখ মতলেব কখনোই সন্তানের ভবিষ্যত নিয়েই চিন্তিত নয়। এভাবে এগুতে থাকে তার জীবনের গল্প। অন্যদিকে, মারফতি ঘরানার লোক খবিরউদ্দিন ফকিরের দিন কাটে মারফতি চর্চা করে৷ ঔপন্যাসিকের ভাষায়, "কবোষ্ণ জলের ভাষায় রচনা করেছেন বেদনার মহাকাব্য।" এর পাশাপাশি বিবৃত হয়েছে নূরী নামক আরেক নারীর ভালবাসার লড়াইয়ের গল্প। ভিন্ন রঙের, ভিন্ন ঢঙের এই তিনটি উপাখ্যান নিয়ে এগিয়েছে মূল গল্প। এর পাশাপাশি আরো কিছু টুকরো টুকরো গল্প যুক্ত হয়ে উপন্যাসটিকে পাঠকের কাছে আরো গ্রহণযোগ্য করে তুলেছে। এবার চরিত্র বিশ্লেষণ সংক্রান্ত কথা বলবো। চরিত্রভিত্তিক বিশ্লেষণের আগেই জানিয়ে রাখছি— অন্যান্য অনেক উপন্যাসের মতো এখানে কোনো একক চরিত্র খুঁজে পাওয়া যাবে না। নানা বৈচিত্র্যময়তার ভরপুর এই উপন্যাসের গল্পের মতো চরিত্রেও নানা বৈচিত্র্য দেখা যায়। কোনো চরিত্র গঠনে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া না হলেও, কিংবা কোনো একক চরিত্র না থাকলেও চরিত্র গঠনের ক্ষেত্রে ঔপন্যাসিক আবদুল্লাহ আল ইমরান যে বিশেষ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন, তা বলতে গেলে বাহুল্য মনে হবে। যা হোক, এরকম একটা গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে রাখা হয়েছে আশ্বাব তালুকদারকে৷ চানপুরা গ্রামের প্রভাবশালী এক ব্যক্তিত্ব হিসেবে তাকে উপস্থাপন করা হয়েছে। পাশাপাশি তাকে একজন লোভী ও স্বার্থান্বেষী ব্যক্তি হিসেবে এই উপন্যাসে তুলে ধরা হয়েছে। ক্ষমতাশালী ও ধুরন্ধর ব্যক্তি আজমত চেয়ারম্যানকে ফাঁকি দিয়ে জমি কেনা নিয়ে চেয়ারম্যানের সাথে তার এক স্নায়ুযুদ্ধ শুরু হয়। এর পাশাপাশি আশ্বাব তালুকদারকে একজন সন্তানবৎসল পিতা হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। ব্যক্তি হিসেবে তিনি যেমনই হোন না কেন, সন্তানের মঙ্গলের জন্য বিন্দুমাত্র ছাড় দিতে রাজি নন। এমনকি সন্তানের সুস্থতার জন্য তিনি নিজের এতদিনকার বিশ্বাস ও আত্মগরিমা এক নিমিষেই ত্যাগ করতে দ্বিতীয়বার-ও ভাবেননি। ঔপন্যাসিকের ভাষায়, "যুক্তিবাদী চেতনা সন্তানের বাঁচা-মরার প্রশ্নে উঠে গেছে সকল ধর্মমতের ঊর্ধ্বে।" এই অন্তর্দ্বন্দ্বে কে হাসবে শেষ হাসি? তালুকদার কি পারবেন মা মনসার রোষানল থেকে নিজের সন্তানদেরকে রক্ষা করতে? আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে রাখা হয়েছে রাবেয়া নামক এক সংগ্রামী নারীকে। এই চরিত্রের মাধ্যমে জীবন যুদ্ধে অবতীর্ণ এক লড়াকু নারীর প্রকৃত প্রতিচ্ছবি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। তার সংসার বিমুখ স্বামী মতলেব খাঁ নিষ্ক্রিয়তার কারণে সংসারের হাল ধরতে হয় রাবেয়াকে। সমাজের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে তার জীবনযুদ্ধ অবিরাম চলতেই থাকে। অন্তহীন এই সংগ্রাম যেন কখনোই শেষ হবার নয়। রাবেয়া যেন চিরায়ত গ্রাম বাংলার এক হার-না-মানা নারীর নাম। প্রসঙ্গত, আমাদের আশেপাশেই এমন অনেক সাহসী নারী লুকিয়ে থাকে, যাদের নাম না জানলেও তাদের নিয়ত সংগ্রাম কোনোভাবেই থেমে থাকে না। চানপুরার রাবেয়া তাদেরই একজন। এর পাশাপাশি তার নিজের সন্তানের প্রতি মাতৃস্নেহের বিষয়টি অত্যন্ত দক্ষতার সাথে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। একজন দৃঢ়চেতা, সাহসী মানবীর মনেও যে স্নেহের মতো এমন কোমল অনুভূতি লুকিয়ে থাকতে পারে, সে ব্যাপারটি উপন্যাসের পাতায় ফুটিয়ে তোলার ক্ষেত্রে ঔপন্যাসিকের লেখনী সত্যিকার অর্থেই প্রশংসনীয়৷ এই উপন্যাসে বর্ণিত নানা চরিত্রের মধ্যে সবচেয়ে আশ্চর্যজনক চরিত্রে রাখা হয়েছে আজগরকে৷ গল্পের শুরুর দিকে তার উপস্থিতি সেভাবে চোখে না পড়লেও হঠাৎ করেই তার উত্থান হয়। উত্থানের দীর্ঘদিন আগে ধর্ষণের অপবাদ মাথায় নিয়ে চানপুরা গ্রাম ছাড়ে আজগর৷ গ্রাম ছেড়ে সে কোথায় চলে গিয়েছিল, তা কেউ জানে না। এই ব্যাপারে অনেকে অনেক কথা বললেও তার সত্যতা নিয়ে সন্দেহ রয়েই যায়। ঘটনাক্রমে সে অনেক ধন-সম্পদের মালিক হয়ে গ্রামে ফেরত চলে এলে লোকে তাকে সমীহ করে চলতে শুরু করে। এই ব্যাপারটাকে কাজে লাগাতে চায় চেয়ারম্যান। তাকে দাবার গুঁটি হিসেবে ব্যবহার করে ঘোষভিটা নিজের দখলে আনবার জন্য চেয়ারম্যান উঠেপড়ে লাগে। কিন্তু আজগর এ নিয়ে নতুন খেলায় মেতে ওঠে। শুরু হয় আরেক নতুন গল্প। আজগর চরিত্রটির মধ্য দিয়ে ঔপন্যাসিক একজন রহস্যময় মানুষের প্রতিচ্ছবি তুলে ধরেছেন। তার প্রতিটি কর্মের প্রতিটি পদক্ষেপ রহস্যময়তার চাদরে আবৃত থাকে। জীবন যেন তার কাছে বিজ্ঞান গবেষণাগারের কোনো তুচ্ছ এক্সপারিমেন্ট! এমনি নানা খামখেয়ালিপনায় অভ্যস্ত আজগরের প্রকৃত পরিচয় একসময় বেরিয়ে আসে শুরু করে। কিন্তু কী সেই পরিচয়? চানপুরা গ্রামের লোকে কি আদৌ পারবে তার অতীত ইতিহাস জানতে? এ তিনটি চরিত্র ছাড়াও গল্পের প্রয়োজনে ঔপন্যাসিককে আরো বেশ কিছু চরিত্রের সহায়তা নিতে হয়েছে। মানব জনমের এক উপাখ্যান হিসেবে এই উপন্যাসেও বহু ধরনের বহু চরিত্রের সমাহার দেখা যায়। আলোচ্য চরিত্রগুলো বাদেও আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রের সার্থক চিত্রায়ণ আমার দৃষ্টি এড়ায়নি। এসব চরিত্রের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোঃ আজমত চেয়ারম্যান, মায়মুনা, সোহেল, আনোয়ার প্রমুখ। প্রসঙ্গ অনুযায়ী এসব চরিত্রের সার্থক সৃষ্টি এই উপন্যাসটিকে এক আলাদা মর্যাদার আসনে বসিয়েছে। সাহিত্য মানের বিচারে তাকে নিয়ে গিয়েছে আলাদা এক উচ্চতায়। এককথায় বলতে গেলে, উপন্যাসের গল্পের প্রয়োজনে সৃষ্ট এসব চরিত্র গল্পের ধারার ক্ষেত্রে বা জীবনপ্রবাহের গল্প বলবার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেনি। এ উপন্যাসটিতে মূলত চলিত রীতি অনুসরণ করা হয়েছে। ভাষার অত্যন্ত সহজ ও সাবলীল প্রয়োগ উপন্যাসটিকে এক আলাদা বিশিষ্টতা দান করেছে। প্রসঙ্গক্রমে মানুষের কথোপকথনের ক্ষেত্রে আঞ্চলিক ভাষার প্রয়োগ এই উপন্যাসটিকে এক ভিন্ন উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছে। আঞ্চলিক ভাষার এমন সার্থক প্রয়োগে মূল গল্পের বিষয়বস্তুর ভাবগাম্ভীর্য কোনোভাবে বিনষ্ট হয়নি; বরং তাতে উপন্যাসের গল্প আরো আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। এর পাশাপাশি প্রসঙ্গক্রমে ঘনিষ্ঠ জীবন বোধের আলোচনা ও মারফতি গান এক্ষেত্রে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। বরাবরের মতো এই উপন্যাসেও আবদুল্লাহ আল ইমরান শব্দচয়নের ক্ষেত্রে তার নিজস্ব স্বকীয়তা বজায় রাখতে পেরেছেন। উল্লেখ্য যে, সাম্প্রতিক কালের বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিকেরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হুমায়ুন বলয় থেকে বের হতে পারেননি বলে হরহামেশাই শোনা যায়। এই ঔপন্যাসিকের সমসাময়িক অনেকের বিরুদ্ধে তেমন অভিযোগ কানে এলেও আবদুল্লাহ আল ইমরান তার নিজস্ব লেখনভঙ্গি দিয়ে প্রমাণ করে দিয়েছেন— অন্য কারো আলোতে নয়, নিজের মেধার আলোতে পাঠক সমাজকে আলোকিত করতে বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে পা রেখেছেন প্রবল সম্ভাবনাময়ী এই তরুণ লেখক। সাম্প্রতিক সময়ে সাংবাদিক হিসেবে জনপ্রিয়তা অর্জনের পাশাপাশি একজন তরুণ ঔপন্যাসিক হিসেবেও সাহিত্য বোদ্ধাদের প্রশংসা কুড়িয়েছেন। এই বিষয়গুলো নানা দিক দিয়ে উপন্যাসের সাহিত্যগুণ বৃদ্ধি করেছে। এর পাশাপাশি জীবনবোধের সার্থক চিত্রায়ণ উপন্যাসটিকে অনেক বেশি পাঠক সমাদৃত করে তুলেছে। তবে কিছু কিছু ব্যাপারে ঔপন্যাসিক চাইলে আরো সতর্ক হতে পারতেন বলে আমি মনে করি। উদাহরণস্বরূপ মারফতি গান উল্লেখ করার কথা বলা যায়। মারফতি গান নিঃসন্দেহে উপন্যাসটির ভাষারীতিতে এক নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে৷ তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে গানের উল্লেখ কিছুটা অস্পষ্ট মনে হয়েছে। উপন্যাসটি পড়তে গিয়ে মনে হয়েছে, ঔপন্যাসিক চাইলে আরো বেশি জায়গায় এই কাজটি করতে পারতেন৷ এছাড়া কোনো কোনো চরিত্রের ক্ষণিক উপস্থিতির কারণে উক্ত চরিত্রকেও বেশ অস্পষ্ট লেগেছে এসব ব্যাপারে ঔপন্যাসিক আরো সতর্ক হলে তাতে লেখার মান নিঃসন্দেহে বাড়তো! সর্বোপরি বলা যায়, গ্রামীণ জীবনের গল্প গাঁথা নিয়ে এক দারুণ উপন্যাসের নাম "দিবানিশি"। গ্রামের সমাজ-সংস্কৃতি-রাজনীতির সাথে এখানে যুক্ত হয়েছে মারফতি সহজিয়া জীবন-দর্শন। পুরো উপন্যাসেই আবদুল্লাহ আল ইমরান অত্যন্ত চমকপ্রদ শব্দ চয়নের মাধ্যমে বাস্তবিক অর্থেই জীবনের নিখুঁত জয়গানই গেয়েছেন। কী গভীর মমতাবোধ জড়িয়ে আছে সে লেখায়! কখনো তিনি গভীর মায়ায় জীবনের সাথে অন্তর্লীন গভীর দুঃখবোধকে শব্দে রূপ দিয়েছেনঃ "জগতে নিঃশব্দ কান্নার চেয়ে তীব্র কষ্টের আর কি কিছু আছে?" কখনোবা মমতা-ভালোবাসাহীন স্বার্থের দুনিয়ার প্রকৃত স্বরূপ তুলে ধরেছেন পরম যত্নেঃ "খুনি, ধর্ষক, ডাকাতের মতো অপরাধীকেও আমরা ক্ষমা করে দেই, ফেরাই স্বাভাবিক জীবনে। কিন্তু ভালোবেসে অপরাদী মানুষগুলোকে আমরা ক্ষমা করতে পারি না সারা জীবনে। মমতা-ভালোবাসাহীন তুমুল একাকীত্বের জীবন নিয়ে তারা ধুঁকতে ধুঁকতে তলিয়ে যায়, মরেও যায় একসময়। আমরা সে বেদনার খোঁজ রাখি না। ভালোবাসার মতো কঠিন পাপ বুঝি এই দুনিয়াতে আর একটাও নেই।" কিংবা পরম মমতায় লিখে গেলেন মানুষ নামক চৌপদী জন্তুর নির্লিপ্ত স্বার্থপরতার উপাখ্যানঃ "আমাদের আশেপাশে মুগ্ধ হবার মতো এমন কত-শত গল্প আছে, কত যে ক্ষমতার গল্প আছে— মানুষ তার খোঁজ রাখে না। বিপুল কৌতূহলে আমরা খোঁজ রাখি, চারিধারের ভালোবাসাহীন, মমতাহীন কুৎসিত সব গল্পের। প্রবল আগ্রহে জীবন সমুদ্র থেকে আমরা বেছে বেছে তুলে আনি অসীম বেদনা আর কষ্টমাখা হাহাকার। অথচ যত্নেগাঁথা ভালোবাসার রুমাল থেকে যায় আমাদের চোখের আড়ালে, হায়রে মানবজীবন!" উপরোক্ত বিষয়গুলো ছাড়াও ঔপন্যাসিক বেশ সতর্কতার সঙ্গে তুলে ধরেছেন মারফতি সহজিয়া গান। এখনো যেন কর্ণ কুহরের মরমে বাজে ঔপন্যাসিকের কলম নিঃসৃত সেসব গানের কথাঃ "ক্ষ্যানেক মুর্শিদ বইলা ডাকি ক্ষ্যানেক আমার মনে লয় না, নিদয়া হইয়ো না মুর্শিদ, নিদয়া হইয়ো না।" কিংবা কাছেম মাঝির দরদি গলায় গাওয়া মারফতি সহজিয়া গানের কথা যেন জীবন্ত শব্দ হয়ে কানে বাজেঃ "এ ভবের বাজারে মন ভুলে রইলি মায়াজালে বন্দী হইয়া সব খুয়ালি, পীর ধরিলে থির হইতি, সাফায়াতের নবী চিনতি, খোদাকে না ভুলে যাইতি, অগতির হয় গতি।....." বইয়ের কথা ছড়িয়ে পড়ুক জগৎময়। বইয়ের নামঃ দিবানিশি লেখকঃ আবদুল্লাহ আল ইমরান বইয়ের ধরণঃ সামাজিক উপন্যাস প্রকাশনাঃ অন্বেষা প্রকাশন প্রথম প্রকাশঃ অমর একুশে বইমেলা, ২০১৭ প্রচ্ছদঃ সানজিদা পারভীন তিন্নি নামলিপিঃ সব্যসাচী হাজরা আইএসবিএন নম্বরঃ ৯৭৮-৯৮৪-৯২৭৭৫-৭-৬ পৃষ্ঠা সংখ্যাঃ ২০৬ মুদ্রিত মূল্যঃ ২৭০ টাকা

      By Salman Mahadi

      08 Dec 2019 05:37 PM

      Was this review helpful to you?

      or

      বইয়ের নাম : দিবানিশি লেখকের নাম : আবদুল্লাহ আল ইমরান ধরন : উপন্যাস প্রচ্ছদ : সানজিদা পারভীন তিন্নি নামলিপি : সব্যসাচী হাজরা প্রকাশনীর নাম : অন্বেষা প্রথম প্রকাশ : ২০১৭ (অমর একুশে গ্রন্থমেলা) সুগন্ধা নদী তীরবর্তী চানপুরা গ্রামের মানুষের দিন রাত্রির গল্প দিবানিশি। মারফতি নূরে উদ্ভাসিত জনপদ যেমন এখানে উঠে এসছে, তেমনি উঠে এসেছে ভিলেজ পলিটিক্স। উপন্যাসটির আমার কাছে সবচেয়ে চমকপ্রদ লেগেছে ফকিরবাড়ি কথা। বংশপরম্পরা তারা গজল গেয়ে নিরাকারের আরাধনা করেন। তাদের মুরিদানরাও দুনিয়ার বিষয়ে উদাসীন থাকে। প্রায় দেড়শো বছর আগে মোরশেদ মাওলার যে তরিকা শুরু করেছিলমহেরউদ্দিন ফকির, চানপুরায় তা বিস্তৃত করেছিল তারই ভাবশিষ্য লালমুদ্দিন ফকির। কালের বিবর্তনে তার টুপি এখন খবিরউদ্দিনের মাথায়। তার ছোট মেয়ে মায়মুনা। উপনাসটির একটি বড় চরিত্র ই মায়মুনা। গ্রামের আর আট দশটি পরিবারের মতই ফকির পরিবারেরও পিতার নির্দেশেই চলে সব কিছু। তার ইচ্ছাতেই মায়মুনা সব কিছু মেনে নেয়। মায়মুনা তার বিয়ের বেশকিছু দিন জানতের পারেন স্বামীর প্রথম বিয়ে কথা। সেখানে ক্ষান্ত নেই ইদানীং নাকি মিলে কোন নারী শ্রমিকের সাথেও রয়েছে তার শরীরিক সম্পর্ক। তবে এই সব শুনেই দমে যাবার মত নারী নয় মায়মুনা। মা মারা যাবার পর বাবার বাড়ি আসেন। পীর বাড়ির খলিফা হওয়া নিয়ে বড় ভাই মজিদ আর বোন জামাই ইউসুফ এর দ্বন্দে পরিবারে মুল্য বাড়ে মায়মুনার। চানপুরা বাজরের মুদি ব্যবসায়ী আশ্বাব তালুদার। রাক্ষুসী নদী সুগন্ধার হাত থেকে বাচঁতে ঘোষ পরিবারের ভিটাটি কিনে রাখে আশ্বাস তালুকদার। ঘোষ পরিবারেরঅনুরোধ ছিল যে করেই হোক তালুকদার যেন মনসা মন্দিরটির ক্ষতি হয় এমন কিছু করতে দিবে না। কিন্তু কিছু দিন পর তালুকদারের এই ওয়াদর কথা বেমালুম ভুলে যায় মোহর ভরা কলসির লোভে। লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু। মোহর ভরা কলসিই কাল হল তালুকদারের। তার জোয়ান টাগরা বড় দুটি ছেলে কয়েকদিনের মাথায় চলে গেলেন না ফেরার দেশে। এই নিয়ে এলাকায় বিভিন্ন ধরনের কাহিনী শুনা যায়। এলাকার চেয়ারম্যান আফজাল। গ্রামের কূটকৌশলে চেয়ারম্যাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে। তেমনি আফজাল চেয়ারম্যান। তালুকদারের ঘোষ ভিটা নিয়ে তার যত পরিকল্পনা। রন্জু মেম্বার চেয়াম্যানের সংবাদদাতা। রন্জু মানেই নতুন খবর। চেয়ারম্যান তালুকদারকে ঘোষ ভিটা থেকে সরাতে ছক কষে। সেই কাজে সাহায্য নেয় আজগরের। সুযোগ বুঝে আজগর ও চেয়ারম্যানকে দিয়ে পছন্দের মেয়েকে বিয়ের সুযোগ করে নেয়। এবং দীর্ঘ দিনের জানু নেতা চেয়ারম্যানকে টেক্কা দিয়ে তালুকদারের নিকট থেকে ঘোষ ভিটা নেয়ার বন্দেবস্ত করে। মতলেব মিয়া। ভবঘুরে একজন মানুষ। ঘর বাড়ির খোজ খবর ঠিক মত নেন না। সকালে বের হয়ে বাজারের বিভিন্ন দোকানে বসে আড্ডা দিয়ে দিন কাটে তার। দুই ছেলে দুই মেয়ের সংসার তার। তার স্ত্রীর রাবেয়ার কারনেই টিকে আছে সংসার। সংসার চালাতে যখন হিমসীম খান তখন দুই ছেলেকে কাজে লাগান। হঠাৎ এক দিন নৌকা ডুবির কারনে নিখোঁজ হন দুই ভাই। রাবেয়া নিজের শত কষ্ট হলেও দুই মেয়ে পড়াশোনা করান। ছোট মেয়েকে স্কুলে যাবার পথে নসু পোলা আনোয়ার উত্ত্যক্ত করে প্রায়। তাতে দমে যাবার নারী নয় রাবেয়া। আজগর দশ বছর আগে খালাতো বোনের দর্শনের অভিযোগে গ্রাম ছাড়তে বাধ্য হয়। দীর্ঘ দশ বছর পরে গ্রামে এসে গ্রামে এসে ভাল মানুষের বেশ নিয়ে চলাফেরা করে। যে কোন প্রয়োজনে চেয়ারম্যান তাকে ডেকে পাঠায়। আজগরের বিয়ের আসরে পুলিশ এস হাজির হয়। যে নারী সারা জীবন যুদ্ধে যুদ্ধে কাটিয়ে দিয়েছে, লোকে কি বলবে তা কোন দিন মাথায় তুলে নি। সে আজও তার সেই সিদ্ধান্তে অটল। লোকে যা বলে বলুক। রাবেয়া আজগরকে লুকিয়ে রাখলেও পরে তাকে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। একাজে রাবেয়ার প্রশংসায় পঞ্চমুখ পুরো গ্রাম। নূরী থৈল উৎসবের শাহজালালের সাথে পরিচয়। নূরীর বাবা মুন্সীর এক গোয়েমীর কারনে পাগল হয় শাহজালাল। তার জায়গা বাড়ির সামনের গাছের সাথে। সৎ মা আম্বরী নূরীকে দেখে ফেলে শাহজালালকে দেখতে যাওয়া। বিচার জানায় মুন্সীর কাছে। মুন্সী সিদ্ধান্ত নেয় নূরীকে পাঠিয়ে দিবে তার শশুর বাড়ি। কিন্তু নূরী আর তার শাহজালালকে হারাতে চায়নি। তাই শাহজালালকে নিয়ে রওয়ানা হয় আজনার পথে। লেখক উপন্যাসটিতে গ্রামীন অবয়ব তুলে ধরেছেন। যেখানে নদী বিদৈত অঞ্চলের সংগ্রামী নারীদের জীবন কথা, ভিলেজ পলিটিক্স, প্রেম, পরকীয়, আশ্বাব তালুকদারের চরিত্রের মাধ্যমে অতি লোভী মানুষের পরিনতি, গ্রামের মেয়েরা যে প্রতিনিয়ত আক্রমনের স্বীকার হয় বখাটেদের হাতে আনোয়ারের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে সেই চিত্র, রাবেয়ার মাধ্যমে গ্রামীন হার না মানা নারী চরিত্র, রন্জু মেম্বার, আখতার, আজম, আফজাল মুন্সী, নিজাম, মতলেব, লালবানু, আঙুরি, সোহেল চরিত্রের মাধ্যমে গ্রামীন সমাজের একেকটি অবয়ব তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। ভাল লাগা কয়কটি লাইন- "জগতের সব মায়েরাই সন্তানের মন পড়তে পারার অদ্ভুত ক্ষমতা নিয়েই জন্মায়।'' "মন থেকে কিছু চাইলে এবং তা অর্জনে যদি চেষ্টার ত্রুটি না থাকে, তবে চারপাশের প্রকৃতি ও যেন সে ইচ্ছা পূরনে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে।'' ''জগতে যত কঠিন কাজ আছে তার মধ্যে আনন্দ চেপে রাখা একটা। চাইলেই আনন্দ চেপে রাখা যায় না। '' "খেটে খাওয়া মানুষের আর কিছু থাকুক বা না থাকুক আত্মসম্মান বোধটা থাকে, প্রখর মাত্রায় থাকে।

      By Sinthia shobnom

      02 Jul 2019 04:41 AM

      Was this review helpful to you?

      or

      গ্রামীণ পটভূমিতে লেখা খুবই অন্যরকম একটি গল্প । চমৎকার লেখনী। মুগ্ধ হয়ে পড়লাম।

      By Tanjina Tania

      17 Dec 2018 10:17 AM

      Was this review helpful to you?

      or

      #রকমারি_রিভিউ_প্রতিযোগ_ডিসেম্বর . বই আলোচনা ১ . বইয়ের নাম: দিবানিশি লেখক: আবদুল্লাহ আল ইমরান বইয়ের ধরণ: সমকালীন উপন্যাস প্রকাশনা: অন্বেষা প্রকাশন প্রথম প্রকাশ:অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৭ প্রচ্ছদ : সানজিদা পারভীন তিন্নি আইএসবিএন : 9789849277576 পৃষ্ঠা সংখ্যাঃ ২০৬ মুদ্রিত মূল্যঃ ৩০০ টাকা ব্যক্তিগত রেটিং : ৪.৮/৫ অনলাইন পরিবেশক :রকমারি.কম . "রাক্ষসী সুগন্ধার তীরে চানপুরাবাসী'র দিবানিশি জীবনকাব্য" . কাহিনী সংক্ষেপ:আশ্বাব তালুকদার, তার তিন ছেলে আখতার, নিজাম আর আজম। ঘোষভিটায় আছে মা মনসা দেবী'র মন্দির। এই মন্দির নিয়ে বহু বছর থেকেই জনশ্রুতি বেশ আকর্ষণীয়। তাই এই ভিটা কিনার পর আশ্বাব তালুকদার সবুর করতে পারলেও সবুর করতে পারেনি তার তিন ছেলে। তারা মন্দির প্রাঙ্গন খুঁড়ে দেখতে চেয়েছিল সত্যিই কি এখানে কোনো গুপ্তধন আছে কি না। মন্দির খুঁড়ার পর থেকেই আশ্বাব তালুকদারের উপর আসতে থাকে নানান বিপদ। তার ছেলেরা মারা যেতে থাকে একে একে। কী হয়েছিল তারপর? আশ্বাব তালুকদারের বংশ কী তবে মা মনসার অভিশাপে ধ্বংস হয়ে যাবে? উপন্যাসের আরেক চরিত্র আজমত চেয়ারম্যান, একজন সুবিধাবাদী মানুষ। ঘোষভিটার উপর তার লোভ অনেক। তার বিরোধ আশ্বাব তালুকদারের সাথে। বইয়ের প্রধান চরিত্রগুলোর একটি হচ্ছে মতলেব, একজন উদাসী মানুষ। সংসার, স্ত্রী-সন্তানের প্রতি কোনো দায়িত্ববোধ নেই যার। তার স্ত্রী রাবেয়া একা হাতে পুরো সংসারটা সামলে রেখেছে। এক সংগ্রামী নারীর নাম রাবেয়া। যে শত প্রতিকূল পরিস্থিতিতে শক্ত হাতে হাল ধরে রেখেছে দুই পুত্র, দুই কন্যা ও স্বামী সহ ছয়জনের সংসারের। রাবেয়ার দু'চালা একটা টিনের ঘরের বড় শখ। তার সারা জীবনের স্বপ্ন এই টিনের ঘর কি সে করতে পেরেছিল শেষে? রাবেয়ার শেষ পরিণতি কি হয়েছিল? তাদের দুই ছেলে সোহেল আর জুয়েল হঠাৎ হারিয়ে যায়। সত্যি কী ছেলেরা হারিয়ে গিয়েছিল নাকি ঘটনা অন্যকিছু? এবার বলি আরেক চরিত্র আজগরকে নিয়ে। লোকমুখে শুনা যায় আজগর তার খালাতো বোনকে ধর্ষণ করে এলাকা ছাড়ে। অনেকদিন পর ফিরে আসে অনেক টাকা পয়সা নিয়ে। কোথায় পেয়েছে সে এত টাকা? সেটা আরেক রহস্য। বইয়ে আমার প্রিয় চরিত্রগুলোর একটি হচ্ছে মায়মুনা চরিত্র। ফকির বাড়ি'র খবিরউদ্দিন ফকিরের মেয়ে। খবিরউদ্দিন ফকির বাড়ির মারফতি লাইনের বর্তমান খলিফা। মারফতি নূরে উদ্ভাসিত একজন মানুষ। খবিরউদ্দিন ফকিরের স্ত্রী জায়নামাযে বসে কার সাথে যেন বিরবির করে কথা বলতো! ছেলের বউ শ্বাশুড়িকে রান্নাঘরে দেখে এসে আবার ঘরে এসে দেখতো জায়নামাযে বসে আছে। অবাক হয় বউ। তার শ্বাশুড়ি আসলে কোন জন? যিনি রান্নাঘরে বসে আছেন তিনি, নাকি যিনি জায়নামাজে বসে আছেন তিনি? ফকিরবাড়ি'র লালবানু'র ছেলে শাহজালালের সাথে ভাব বিনিময় হয় পাশের বাড়ির মেয়ে নূরীর। নূরী'র বাবা মেয়েকে জোর করে বিয়ে দিয়ে দেয় অন্যত্র। সৎ মা'র দেওয়া মানসিক নির্যাতন আর শাহজালালের ভালোবাসা হারানো মেয়েটা ভিতরে ভিতরে ক্ষয়ে যেতে থাকে। . লেখক পরিচিতি : লেখক আবদুল্লাহ আল ইমরানের জন্ম খুলনাতে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশুনা শেষ করে সাংবাদিকতা পেশায় প্রবেশ করেন। বর্তমানে তিনি অনুসন্ধানী সাংবাদিক হিসেবে কাজ করছেন চ্যানেল টোয়েন্টি ফোরে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইটি সোসাইটি'র প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আবদুল্লাহ আল ইমরান জিতেছেন ২১তম জাতীয় টেলিভিশন বিতর্ক প্রতিযোগিতা'র চূড়ান্ত পর্বের শ্রেষ্ট বক্তার পুরস্কার। এছাড়াও পেয়েছেন যমুনা টেলিভিশন দুরন্ত বাংলাদেশ সম্মাননা। আমার জানামতে লেখকের অন্যান্য বইগুলো হচ্ছে কালচক্র, উড়ে যায় নীল টিপ, এইসব ভালোবাসা মিছে নয়, হোম পলিটিক্স। এগুলো বাদে লেখকের আরও বই আছে কি না আমার জানা নেই। থাকতেও পারে আবার নাও থাকতে পারে . নামকরণ : ফ্ল্যাপের ভাষায় মারফতি নূরে উদ্ভাসিত অলক্ষে বহমান এক জনপদের কাহিনী এই উপন্যাসে বিবৃত হয়েছে। চানপুরা গ্রামের মানুষের দিন-রাত গত হওয়ার বিভিন্ন গল্প মিলে একটি গল্প হয়েছে। মানবজনমের নানান দিক, নানান মানুষের জীবনকথা, হরেক রকম মানুষের বৈশিষ্ট্য ফুঁটে উঠেছে বইতে। এই ধরণের বইয়ের নাম দিবানিশি স্বার্থক হয়নি এই কথা বলা যাবে না । কিন্তু বইয়ের লেখাটা যে পরিমাণে আকর্ষণীয় এবং উন্নতমানের সেই তুলনায় খুবই সাধারণ আর অনাকর্ষণীয় নাম মনে হয়েছে আমার কাছে । একটি বইয়ের নাম আর প্রচ্ছদ দেখেই পাঠক বইটির প্রতি আকর্ষিত হয়। এক্ষেত্রে সবার আগে প্রয়োজন একটি চমৎকার নাম। যে নামটি শুনেই পাঠকমন বইটি পড়তে আগ্রহী হয়ে উঠবে। . প্রচ্ছদ : ২০১৭ সালে প্রকাশিত এই বইটি'র কথা আমি শুনেছিও এবং বইয়ের ছবিও দেখেছি পূর্বে। কিন্তু বইয়ের নাম বা প্রচ্ছদ কোনোটিই আমাকে বইয়ের প্রতি আকর্ষিত করতে পারেনি। কিন্তু কে জানতো এই অপেক্ষাকৃত কম আকর্ষণীয় প্রচ্ছদের এই বইয়ের ভিতর এমন উদ্দীপ্ত মহজের নিঃসরণ সম্বলিত একটি লেখা দণ্ডায়মান? সাদা, সবুজ, নেভেব্লু, হলুদ রংয়ের সংমিম্রণে তৈরী প্রচ্ছদের ভাবার্থ পরিষ্কার নয়। তবে আমার কাল্পনিক মন ধরে নিয়েছে সবুজটা স্বাভাবিক দিনাতিপাতের প্রতিচ্ছবি। তার ভিতর নেভেব্লু নিশি তথা রাতের চিত্র বহন করে আর তার ভিতর আলোকমাঝে গাছের অবয়ব দিনের প্রতিচ্ছবি। যদি এমনও হয়, তবুও প্রচ্ছদ বইয়ের নামের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হলেও আহামরি আকর্ষণীয় নয়। এমন চমৎকার লেখনীর উপরের মলাট আরও চমৎকার হতে পারতো। . ফন্ট, বাঁধাই, পৃষ্ঠা : সাম্প্রতিক সময়ে যেসব বই পড়েছি, এই বইয়ের ফন্টসাইজ সেগুলোর থেকেও সামান্য বড় মনে হলো। ফন্ট সাইজ বড় হলে চোখের জন্য আরাম। রিলেক্সে পড়া যায়। সেইজন্য আমি বইটি বেশ আরাম করে পড়তে পেরেছি। বইয়ের পৃষ্ঠা কোয়ালিটি খুবই উন্নতমানের এবং বাঁধাই নিয়েও কোনো অভিযোগ করা যাবে না। সব মিলিয়ে বইয়ের লেখাটার মতোই চমৎকার এই দিকগুলো। . পাঠ প্রতিক্রিয়া : বই নিয়ে সৈয়দ মুজতবা আলী'র বিখ্যাত দু'টি লাইন আছে। রুটি মদ ফুরিয়ে যাবে, প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে আসবে, কিন্তু বইখানা অনন্ত যৌবনা- যদি তেমন বই হয়। বইটি পড়ার সময় আমার এই লাইনগুলো বারবার মনে পড়ছিলো। আমি বহুদিন ধরে এমন রকমারি স্বাদের বই পড়ি না । বইটা আমার মধ্যে এক ঘোরলাগা সৃষ্টি করে দিয়েছিল। এই বই তো ২০৬ পৃষ্ঠা না হয়ে ২০০৬ পৃষ্ঠা হলেও পড়ে ক্লান্ত হতাম না। লেখকের বর্ণনাভঙ্গি, শব্দচয়ন এত দারুণ যে অভিভূত হয়ে গেছি। কোনো উদীয়মান নবীন লেখকের বই পড়ে আজ অব্দি এতটা তৃপ্তি পাইনি যতটা দিবানিশি পড়ে পেয়েছি। একজন ইসলাম ধর্মের লোক হয়েও হিন্দুধর্মের মনসা দেবী'র মন্দির আর দেবীর আশীর্বাদ অভিশাপ সহ সংশ্লিষ্ট সকল কিছু এত নিখুঁতভাবে বর্ণনা করেছেন লেখক যা অতুলনীয়৷ ফকির বাড়ির বিভিন্ন রীতিনীতিও কি কম ফুটিয়ে তোলেছেন? একটা বইতেই মারফতি লাইন আর মনসা দেবীকে লিখে ফেলেছেন নিখুঁতভাবে। মায়মুনা'র মায়ের গল্প, মায়মুনার গল্প, মহেরউদ্দিন ফকিরের এই এলাকায় আসার গল্প, তার নামকরণের গল্প, লালমুদ্দিন ফকিরের জামাই ইস্কান্দারের লোভে পড়ে ধ্বংস হওয়ার গল্প সবকিছুই আকর্ষণীয়। চানপুরা গ্রাম আর সুগন্ধা নদীর ভাঙন কবলিত এলাকার মানুষের দিন-রাতের গল্প যে কোনো পাঠককে টেনে ধরে রাখার মতো গল্প। রাক্ষুসী সুগন্ধা হঠাৎ করেই কেড়ে নেয় মানুষের ঘর-বাড়ি আর জীবন। নদী তীরবর্তী মানুষের দীর্ঘদিনের সুখ, স্বপ্ন, প্রিয়জন কেমন করে এক পলকে কেড়ে নেয় সুগন্ধার উত্তাল ঢেউ। ধর্ম নিয়ে ভেদাভেদ না করার এক সুস্পষ্ট বার্তা রয়েছে বইতে। এক কথায় আমি অভিভূত। . উপন্যাস হিসেবে দিবিনিশি'র স্বার্থকতা : গদ্যাকারে লেখা দীর্ঘ কাহিনীসম্বলিত বর্ণনামূলক কথাসাহিত্যের নাম উপন্যাস। উপন্যাসে পরিবেশ বর্ণনা, রূপরেখা, চরিত্র প্রভৃতি যখন মানুষের জীবনের কাহিনীকে পরিপূর্নরূপে ফুঁটিয়ে তোলা হয় তখন সেটিই উপন্যাস। এদিক থেকে "দিবানিশি" পুরোপুরি স্বার্থক উপন্যাস। চানপুরা গ্রামের রূপরেখা আর পরিবেশ লেখক যেভাবে ফুঁটিয়ে তোলেছেন তা সত্যিই প্রশংসার যোগ্য। পড়ার সময় ওই গ্রামের চিত্রাবয়ব চোখের সামনে ভাসবে। এছাড়াও লেখক চরিত্র বর্ণনা এমনভাবে করেছেন যেন প্রত্যেকটি চরিত্র পাঠকের সামনে ভেসে উঠে। একটি চরিত্র নিয়ে কিন্তু লেখক খুব বেশি বর্ণনা দেয়নি, তবুও চরিত্রগুলো পাঠকের চোখে জীবন্ত হয়ে ধরা দিবে পড়ার সময়। এক চরিত্রের সাথে আরেক চরিত্রের কোনো মিল নেই। একটা বইয়ে এতগুলো চরিত্র তবুও কোনো চরিত্র ফুঁটাতে ব্যর্থ হননি লেখক। এদিক থেকে উপন্যাসের সংজ্ঞার সাথে দিবানিশি সামঞ্জস্যপূর্ণ। উপন্যাসের সংজ্ঞা অন্যভাবে দিতে গেলে বলা যায় যে, মানব-মানবীর জীবন যাপনের বাস্তবতা অবলম্বনে যে কল্পিত ঘটনা পাঠকের কাছে আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য বিশেষভাবে বিন্যাস করে উপস্থাপন করা হয় সেটিই উপন্যাস। বইয়ের বিশেষ বিশেষ চরিত্র মতলেব, আশ্বাব তালুকদার, খবিরউদ্দিন ফকির, আজগর, মায়মুনা ,আজমত চেয়ারম্যান, এদের জীবন যাপনের দিকে নজর দিলে আমরা আমাদের চারপাশেই এমন চরিত্র দেখতে পাই। তাই এই কথা কোনো দ্বিধা ছাড়াই বলা যায় যে, কাল্পনিক এই চরিত্রগুলোকে লেখক আমাদের চারপাশের মানুষগুলোর রূপক চরিত্র হিসেবে অত্যন্ত নিখুঁতভাবে উপস্থাপন করেছেন। এ যেন বাস্তব জীবনের প্রতিফলন। সুগন্ধা নদী'র ভাঙনে প্রিয়জন আর ঘর-বাড়ি হারা মানুষের দুঃখবোধ আর সদা সুগন্ধা তীরের মানুষের সুগন্ধা'র ছোবল খাওয়ার ভয় যেন নদীভাঙন কবলিত মানুষের বাস্তব প্রতিচ্ছবি। রাবেয়া কোনো কাল্পনিক চরিত্র নয়, যেন বাস্তবিক জীবন্ত এক চরিত্রের নাম রাবেয়া। আকন বাড়ির মতো এমন অনেক বাড়িই নদীভাঙনের শিকার হচ্ছে প্রতিনিয়ত। কল্পনার আশ্রয় নিয়ে লেখক নিগূঢ় বাস্তবতা তোলে ধরেছেন বইতে । . প্রিয় উক্তি : ১.নিজের অপরাধবোধ কাটাতে অন্যকে কষ্ট দেওয়ার মানে হয়? ২.খুব বেশি নিকটে থেকেও কেউ কেউ এক জনমের দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে না। ৩.জগতে যত কঠিন কাজ আছে তার মধ্যে আনন্দ চেপে রাখা একটা। ৪.জগতের সকল নারীই যেন পুরুষের চোখের ভাষা বোঝার অপূর্ব ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছে। ৫.খুনি, ধর্ষক, ডাকাতের মতো অপরাধীকেও আমরা ক্ষমা করে দেই, ফেরাই স্বাভাবিক জীবনে। কিন্তু ভালোবেসে অপরাধী মানুষগুলোকে আমরা সারাজীবন ক্ষমা করতে পারি না। ৬.ভালোবাসার মতো কঠিন পাপ বুঝি এই পৃথিবীতে আর একটাও নেই। ৭. অতি আপনজনের কাছে নিজেকে সঠিক প্রমাণের চেষ্টার চেয়ে কষ্টের আর কিছু নেই। ৮.প্রকাশ্য ভালোবাসার জন্য তুমুল কাতরতা থাকলেও হৃদয়ের অপ্রকাশ্য গভীরতা মাপার ক্ষমতা কি সবার থাকে? ৯.ভেতরে মমতা লুকিয়ে রাখা অন্তর্মুখী মানুষের বেদনা অপার। ১০.জগতের সব মায়েরাই সন্তানের মন পড়তে পাড়ার অদ্ভুত ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়। ১১.কষ্ট চেপে চলার মতো যন্ত্রণা জগতে আর কিছু নেই। ১২.সত্যের চাইতে মানুষ মিথ্যা বিশ্বাস করে বেশি। ১৩.জগতে আর সব অনুভূতি চেপে রাখা গেলেও কান্না চেপে রাখা যায় না। ১৪.জগতের ভালো মানুষগুলোরই কেন যেন কষ্টের শেষ নেই। ১৫.কারো না থাকায় সময় থেমে থাকে না। কারণ প্রকৃতি নিজেই শূণ্যতা পছন্দ করে না। . ব্যক্তিগত মতামত : চাঁদেরও কলঙ্ক থাকে। আর এটা তো মনুষ্যসৃষ্ট একটি বই মাত্র। ঘোরলাগা এই বইয়ের প্রতিটি শব্দ, বাক্য খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়েছি আমি। ২০৬ পৃষ্ঠার বই , বানান ভুলসহ নানান ধরণের ত্রুটি থাকবে এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। বইয়ের রিভিউয়ে বানান ভুল বা টাইপিং মিস্টেক ধরিয়ে দেওয়া কতটা যৌক্তিক আমার জানা নেই। তবুও উল্লেখ করলাম। ১৬ পৃষ্ঠায় ঘোড়া দৌড়ের অনুষ্ঠানে শাহজালালের সাথে নূরী'র ঢাল গড়িয়ে ক্ষেতে পড়ার দৃশ্যটা এবং আঙুরিকে আজগরের আনোয়ারে'র হাত থেকে বাঁচানোর ব্যাপারটা কেমন যেন সিনেমাটিক মনে হলো। গ্রামীণ জীবন ফুটিয়ে তুলতে গিয়ে লেখক গ্রামের অশুদ্ধ ও আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার করেছেন। কিন্তু বেশ কিছু জায়গায় একই বাক্যে ও একই চরিত্রের সংলাপে শুদ্ধ আর অশুদ্ধ ভাষার সংমিশ্রণ ঘটে গেছে। রাতে আশ্বাব তালুকদার আর তার ছেলেদের ঘোষভিটায় যাওয়ার পথে লেখকের বর্ণনা একটু বেশি হয়ে গেছে বলে মনে হলো। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বর্ণনার চেয়ে ঘটনার প্রাধান্য পাঠককে টানে। আবার একই রকমভাবে উত্তেজনাকর মুহুর্তে অতিরিক্ত উপমা আর বাড়তি বর্ণনা পাঠকের বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যদিও বইতে বেশ কিছু জায়গায় বর্ণনার আধিক্য রয়েছে তথাপি অন্য কোনো ঘটনার বর্ণনায় বিরক্ত হইনি কেবল এই এক জায়গা ছাড়া। কারণ তখনও বইয়ের সব চরিত্রকে আমি বুঝে উঠতে পারিনি। আর এটা তো বইয়ের প্রথম অংশ। আমি মনে করি যতক্ষণ একজন পাঠক সবগুলো চরিত্রের সাথে পরিচিত হতে না পারে, ততক্ষণ সে বইটির উত্তম পাঠক হয়ে উঠতে পারে না। আর সবগুলো চরিত্র বুঝে উঠার আগে বইয়ের গভীরে ডুবও দেওয়া যায় না। তাই সব চরিত্র সামনে আসার আগে বর্ণনার আধিক্য একটু তো দৃষ্টিকটু বটেই। লেখক কিছু আঞ্চলিক শব্দ ব্যবহার করেছেন বইতে। যেমন, মাইট, পোঁতা, থৌল। এই আঞ্চলিক শব্দগুলো কিছু পাঠক হয়তো বুঝতে পারবে না। তাই সার্বজনীন শব্দ বা সহজভাবে বিষয়টি উপস্থাপনই উত্তম। ১৭২ পৃষ্ঠায় পোলা মাইয়াকে পোল মাইয়া লেখা হয়েছে। যে ভুলগুলোর কথা বললাম, ২০৬ পৃষ্ঠার বইয়ে এরকম ভুল বা অসামঞ্জস্য থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে দিবানিশি পড়ার সময় মনে হচ্ছিলো বিখ্যাত কোনো লেখকের বই পড়ছি বুঝি। গ্রামীণ পটভূমিতে লেখা বেশিরভাগ বইতেই জহির রায়হান কিংবা মানিক বন্দোপাধ্যায়ের লেখার ছাপ পাওয়া যায়। কিন্তু লেখক আবদুল্লাহ আল ইমরান সম্পূর্ণ অন্য লেখকদের প্রভাবমুক্ত। উনি নিজের মতো করে গল্প বলে গেছেন পুরো বইতে। এই বইটির ব্যক্তিগত রেটিং আমি দিলাম ৪.৮/৫ । এর কম দিলে দিবানিশি'র সাথে অন্যায় করা হবে। . রিভিউ লেখক :তানজিনা তানিয়া

      By Jabir Ahmed Jubel

      14 Oct 2019 12:27 AM

      Was this review helpful to you?

      or

      “দিবানিশিঃ সহজিয়া মানুষ এবং নারীর জয়েরই আখ্যান” দিবানিশি, উপন্যাসটা কোনো একজন ব্যক্তির গল্প নিয়ে নয় বরং এটি আমাদের আবহমান গ্রাম বাংলার প্রাকৃতজনের, যারা আমাদের চারপাশেই থাকেন অথচ তাঁদের জীবনকে অামরা সেভাবে দেখি না। কখনো কখনো হয়তোবা আমরা দেখি কিন্তু তাঁদের সহজ সরল আর বিশ্বাসে ভরপুর জীবনের অর্থটা আমরা বুঝে উঠতে পারি না। সেইসব মানুষের জীবনের নিত্যদিনের গল্প নিয়েই সাজানো “দিবানিশি”। ঔপন্যাসিকের ভাষায় এটি “লোকচক্ষুর অন্তরালে বহমান জনপদের দিন রাতের গল্প।” লেখক এমনি এক জনপদের মানুষের গল্প আমাদের সামনে বলেছেন যে জনপদে একদিন এক শিশু, যিনি পরবর্তীতে মহেরউদ্দিন ফকির হন, তাঁকে মানুষ কাদামাটিতে পাওয়া যায়। তাঁর অলৌকিকতায় মানুষ বিশ্বাস এনে মাত্র ১৪ বছর বয়স থেকেই মুরিদ হতে থাকে, তারই খলিফা লালমুউদ্দিন ফকিরের হাত ধরে গোটা এলাকায় বিস্তৃত হয় ফকিরিতত্ত্ব। এই অঞ্চলের মানুষগুলা এই ফকিরিধারা থেকে বুঝতে শিখে জীবনের মানে, জানতে শিখে জীবনের গভীরতা কোথায়। এতদ্বঞ্চলের মানুষগুলো লালমুউদ্দিন ফকিরের থৈলে গভীর আবেগে গেয়ে উঠত, “প্রেমেতে হইলে মত্ত পাওয়া যায় নিগূঢ় তত্ত্ব আত্মতত্ত্ব জানতে গেলে গুরুর চরণ ভুইলো না, প্রেম তরঙ্গে ভাসলো তরী, সে তরী উজান মানে না।” গেয়ে গেয়ে, গভীর ভালোবাসা নিয়ে এই মানুষগুলো নিজেদের আত্মার ভেতরেই খুঁজত সৃষ্টিকর্তাকে। লেখক শুধু এমনি এক জনপদের গল্প আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন যেখানে হিন্দু মানুষগুলো প্রচণ্ড ভালোবাসা আর ভক্তি নিয়ে মা মনসার পুজো দিত। তবুও এতো ভালো মানুষের ভিতরেও আমরা দেখতে পাই এই অঞ্চলে তালুকদার, চেয়ারম্যান কিংবা আসগরের মতো মানুষেরও অভাব নেই, যারা জীবন আর ভোগকেই সবকিছু মনে করে। এই উপন্যাসে আমরা যখন প্রবেশ করবো তখন আমরা সেইরকম একজন মানুষকে নিয়েই ঢুকব। আমরা গল্পে প্রবেশ করবো অমাবস্যার রাতে সুগন্ধা নদী থেকে বয়ে আসা হিমেল হাওয়াকে সাথে নিয়ে। উপন্যাসের প্রথমেই ঔপন্যাসিক তাঁর সুন্দর হাতে একটা গ্রামীণ পরিবেশ তৈরি করেন, সেই পরিবেশের ভেতর থেকেই আমরা একজন আশ্বাব তালুকদারকে আবিষ্কার করবো। আশ্বাব তালুকদার এমন এক মানুষ যাকে লোকায়েত বিশ্বাস কখনই প্রাভাবিত করতে পারেনি, অলৌকিকতায় তিনি কখনও তিনি বিশ্বাস করেননি চরম বিপদেও। কিন্তু একটু পরেই আমরা দেখতে পাবো লোভের কাছে এসব কিছু একদম ঠুনকো। লোভে পরেই তখন তালুকদার বিশ্বাস করেন কৃষ্ণদের কাছ থেকে কেনা ভিটায় দেবী মনসার মন্দির খুঁড়ে পাওয়া যাবে রত্নভরা কলস। কৃষ্ণ জায়গা জমি সব বেচলেও মা মনসার মন্দিরের জায়গা বেচে যায়নি। বাড়ি ছেড়ে, দেশ ছেড়ে চলে যাবার সময়, জল ভরা চোখ নিয়ে যে কৃষ্ণ মন্দিরের কোনো ক্ষতি না করতে অনুরোধ করে যায়, সেই অনুরোধ তিনি ভুলে যান। জাগতিক লোভের কাছে হেরে যান তালুকদার। যার পরিনিতিতে মা মনসার অভিশাপে তালুকদারের পরিবারের কি হয় তা আমরা উপন্যাসেই দেখবো। এই জায়গায় আমরা গ্রাম্য রাজনীতির নানা দিক দেখবো, এখানে গ্রাম্য রাজনীতির কুটিল খেলা খেলতে কখনো আমাদের সামনে হাজির হবে চেয়ারম্যান, কখনবা রহস্যে আবৃত আসগর। ঔপন্যাসিক এখনে অত্যন্ত সুন্দরভাবে তাঁর নান্দনিক লেখনীতে বর্তমান সময়কে সাথে নিয়ে তুলে ধরেছেন মা মনসার অভিশপের মিথ। সেই সাথে এখানে তিনি সাম্প্রদায়ীক সম্প্রীতিকে খুব দারুণভাবে তুলে ধরেছেন, আমরা দেখবো একজন মানুষ একই সাথে পূজা দিচ্ছে আবার নিরাকার আল্লাহর প্রেমে জিকির পড়ছে! লেখকের মায়াবী লেখায় এই জায়গায় আমরা মুগ্ধ হয়ে যাবও, আমরা এখানে পরিচিত হবো একজন দক্ষ কথাসাহিত্যিকের সাথে, যিনি হলেন আমাদের সবার কাছে একজন অনুসন্ধানী সাংবাদিক হিসেবে পরিচিত আব্দুল্লাহ আল ইমারান। দিবানিশি উপন্যাসে ঔপন্যাসিক আব্দুল্লাহ আল ইমরান খুব সুন্দর এবং সহজ ভাষায় ফুটিয়ে তুলেতে চেয়েছেন ফকিরি জীবন, মারিফতকে আক্ড়ে ধরে বেঁচে থাকা একটা গোঁটা অঞ্চলের জীবন। লালমুদ্দিন ফকিরের হাত ধরে চানপুরায় বিস্তৃত হওয়া ফকিরি তত্ত্ব এতটাই মানুষকে প্রভাবিত করে যে এখানকার সব সাধারণ মানুষ এই ফকিরি লাইনের মুরিদ। মহেরউদ্দিন ফকিরের চালু করা এই তরিকায় তাঁরা জীবনের অর্থ খুঁজে বেড়ায়। আমরা এই উপন্যাসে খবিরউদ্দিন ফকিরকে পাবো, লালমুদ্দিন ফকিরের বর্তমান উত্তরাধিকার। ফকিরহিসেবে তিনি মহৎ জীবনেরই সন্ধান করে চলছেন। নিজের ভেতর নিজের আত্মাকে জানার মাধ্যমে সৃষ্টিকর্তা সান্নিধ্য লাভের আশায় সাধনায় থাকা কবিরউদ্দিন ফকির আলোকিত করে যাচ্ছেন। ঔপন্যাসিক এই উপন্যাসে ফকিরি জীবন তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন, তবে আমার মনে হয়না তিনি এ ক্ষেত্রে তেমন সফল হয়েছেন। এই উপন্যাসের এই জায়গায় তিনি আরও ভালো কিছু কাজ করতে পারতেন, কিন্তু তিনি সেখানে একদম ভাসা ভাসাভাবে ফকিরি জীবন উন্মোচন করেছেন। ফকির দরবেশ আউল বাউলদের মহান, সরল এবং জীবনের গুঢ় রহস্য খুঁজতে থাকা মানুষের জীবনের জীবনের মধ্যে সামান্য খলিফা মনোনীত হওয়ার জন্য মজিদ এবং তাঁর বোনের জামাইয়ের মধ্যে যে রেষারেষি, এমনকি ভক্তদের ভেতরে দুই ভাগ করে ফেলা যখন আমরা দেখি তখন আমর মনে হয় একটা মহৎ জীবনকে ঔপন্যাসিক ঠিকভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারেন নাই। আবার আমরা যখন দেখি খবিরউদ্দিনের ছেলে নুরুল তাঁর পাগল হয়ে যাওয়া ফুফাতো ভাই শাহজালালের বকবকানি শুনে বলে উঠে, “চুপ থাক পাগলের জাত পাগল” কিংবা শাহজালালের পায়ের গুড়ালির কাছে কেটে গিয়ে গলগল করে রক্ত ঝরলে মাইমুনা যখন ছুটে যায় তখন আমরা দেখতে পাই, ফকিরবাড়ির ভাবি খলিফা “মজিদের চেহারায় অজস্র বিরক্তি”, যেই ফকিরেরা মানুষের ভেতরেই সৃষ্টিকর্তাকে খুঁজে বেড়ায় সেই ফকিরেরা কিভাবে এভাবে শাহজালালের সাথে আচরণ করতে পারে আমি বুঝতে পারি না। ঔপন্যাসিক আর একটু নজর দিলে, হয়তো এখানে ফকিরদের জীবনকে আরো সুন্দরভাবে উন্মোচন করতে পারতেন। একটা গল্প কিংবা উপন্যাসে ভাষা নির্বাচন কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা আমরা সবাই জানি। আঞ্চলিক ভাষার জয়গায় যখন প্রমিত ভাষা ব্যবহার করে তখন ব্যাপারটা প্রচণ্ড খারাপ দেখায়। তাই প্রত্যেক লেখকের এই জায়গায় বিশেষ গুরুত্ব দিতে হয়, কিন্তু দিবানিশির ঔপন্যাসিক আব্দুল্লাহ আল ইমরান এখানে উদাসীন ছিলেন। তিনি লিখেছেন দক্ষিনাঞ্চলের গ্রামের সাধারণ মানুষের গল্প, তাঁর গল্পের চরিত্র হিসেবে কখনো উঠে এসেছে মাঝি, কখনবা এসেছে গ্রামের দিনমজুরের বউ। এদের মুখের ভাষা প্রমিত নয়, কিংবা দুই একটা শব্দ এদিক সেদিক করা ভাষাও না। উপন্যাসের ভাষার একটা নমুনা দেখাইঃ নৌকার মাঝি কথাটা মাইমুনাকে উদ্দেশ্য করে বলে, “ সে যাই হোক। এত দূরের পথ আপনেরে একা ছাড়া ঠিক হয় নাই। তাও আবার মায়ের মৃতু সংবাদ জানার পর।” কিংবা আমরা দেখতে পারি গ্রামের দরিদ্র মহিলা রাবেয়ার মুখে শুনি “এত মাথা গরম কইরেন না। এইখানে একটু বসেন। আমার ভুল হইছে। ওই কথাটা বলা আমার ঠিক হয় নাই। আমিও তো মানুষ। আমারও রাগ ওঠে। আপনে সেইটা বুঝবেন না?” কিংবা আমরা শুনতে পারি পীর খবিরউদ্দিনের মুখের ভাষা, “তোমার এখন যে বয়স তাতে নারীসঙ্গ পাইতে মন চাইবো। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই লাইনে সেইটা করতা পারবা না আলমগীর। যত্রতত্র, যার তাঁর সাথে নারী সহবাস একদম নিষিদ্ধ।” অল্প কিছু জায়গা বাদ দিলে প্রায় সব জায়গায়ই লেখক কিছু কিছু শব্দের ভেতরে একটা ‘ই’ নিয়ে এসে ঔপন্যাসিক প্রমিত ভাষাকে আঞ্চলিক করার ব্যর্থ চেষ্টা করেছেন। কিন্তু এগুলো কি গ্রামের এক মাঝি কিংবা সাধারণ মহিলার মুখের ভাষা? ঔপন্যাসিক দক্ষিনাঞ্চলের জেলাগুলোর এতো মিষ্টি মিষ্টি ভাষা রেখে এভাবে এভাবে ভাষার ব্যবহার করে উপন্যাসের ভেতরের সৌন্দর্য্যকেই নষ্ট করে দিয়েছেন। এই ভাষা দিয়ে কৃত্রিম করে দিয়েছেন একটা সহজ-সাধারণ এবং প্রাণোজ্জ্বল জীবনধারাকে। আশা রাখি ভবিষ্যতে ভাষার ব্যবহারে সচেতন থাকবেন। এই উপন্যাসের অন্যতম সুন্দর একটা চরিত্র রাবেয়া। খুব সুন্দরভাবে লেখক ফুটিয়ে তুলেছেন এই চরিত্রটি। এই চরিত্রের মাধ্যমে গ্রামের সাধারণ একজন নারীর অসাধারণত্বের গল্প বলেছেন লেখক আব্দুল্লাহ আল ইমারান। ভবঘুরে, অকর্মণ্য, বেকার স্বামী মতলেবের অত্যাচারের পরেও সংসার চালান। মতলেবের ভাই তাঁদেকে বাড়ি থেকে বের করে দিলে, স্বামী স্ত্রী রাতে চাম্বল গাছের নিচে একজন আরেকজনকে জরিয়ে ধরে শুয়ে এক কাপড়ের আশ্রয়হীন যে নতুন এক জীবনের সূচনা করেছিলেন সেই জীবনেও আমাদের রাবেয়া ছিলেন প্রচণ্ড স্বপ্নবাজ। সেও স্বপ্ন দেখতো একটা নিজস্ব আশ্রয়ের, মাথা গোঁজার ঠাইয়ের, স্বপ্ন দেখতো দুচালা টিনের ঘরের স্বপ্ন। একদিন আমরা দেখি তাঁর স্বপ্ন বাস্তিব হয়, মানুষ দেখে সুগন্ধার তীরে একটি নতুন দুচালা তিনের ঘর উঠতে, আর আমাদের রাবেয়া তাঁর চোখের সামনে দেখে একটা স্বপ্ন দাঁড়িয়ে আছে। অভাবের মধ্যে জীবন কাটলেও প্রচণ্ড পরিশ্রমী রাবেয়া জীবনে ন্যায় নীতির কাছে কখনো আপস করেনি। গ্রামের সাধারন একজন মহিলা রাবেয়া হাজারো লৌকিক বিশ্বাসের, আর সামাজিকতার মধ্যে বেড়ে উঠেছে এবং সেও জানে বিয়ের মঞ্চ থেকে বরকে পুলিশে ধরে নিয়ে যাওয়া মেয়ের জন্য কতটা ক্ষতিকর। তবুও আমরা দেখি নিজ হাতে নিজের মেয়ের হবু স্বামীকে সে ই পুলিশের হাতে ধরে দেয়! লেখক প্রচণ্ড ভালবাসা দিয়ে তুলে ধরেছেন রাবেয়া চরিত্রটি। রাবেয়া আমাদের গ্রামের সেই সব সংগ্রামী মহিলাদের প্রতিনিধি। যারা এক সময় আমাদের ছেড়ে চলে যান, বুকে সীমাহীন ব্যাথা সৃষ্টি করে। আমদের রাবেয়াও হারায় মৃত্যুতে, হারিয়ে যায় আমাদের রাবেয়ার স্বপ্নস্বরূপ টিনের ঘরটি, হারিয়ে যায় সুগন্ধা নদীর গহ্বরে। এই উপন্যাসের বড় একটা অংশ জুড়ে ফকিরবাড়িই আছে, আর ফকিরবাড়ির সব আলো যেন একাই সে বাড়ির মেয়ে মাইমুনা ধারণ করে আছে। পারিবারিক জীবনের সীমাহীন দুঃখকে নিজের ভেতরে ধারণ করেও এই মেয়েটিই যেন ফকিরবাড়ির সবগুলো গুণ এক সাথে নিজের মধ্যে ধারণ করেছে। পরম ভালবাসায় সে পাগল শাহজালালের সেবা করে। শাহজালালের মা লালবানুকে যে তরিকার কেও দেখতে পারে না সেই লালবানুকেই ভালোবেসে জড়িয়ে ধরে মাইমুনা। সত্যি জীবনটা তো ভালোবাসার মাঝেই আছে, আর ফকিরেরা তো সেই ভালোবাসার দেয়া নেয়াই সৃষ্টিকর্তার সাথে করে। তাঁর গুণ এতই ছিলো যে তাঁর স্বপ্নে এসে ধরা দেন পীর লালমুউদ্দিন, যা এই লাইনের যে কারোর পরম পাওয়া! পৃথিবীর নিয়মে সব সময় খলিফা হয়ে আসছেন একজন পুরুষই, পীর খবিরউদ্দিন তাঁর মৃত্যুর পরের খলিফা করেন মজিদকে কিন্তু এই সবকিছু পেছন থেকে চালাবার দায়িত্ব দেন মেয়ে মাইমুনাকে! মেয়ে বলে সারা জীবন চোখ বুজে যেমন মাইমুনার মা সবকিছু সহ্য করেছেন তেমনি মাইমুনাও করেছে। তাঁর জন্য এমন একটা দায়িত্ব যান এক মহান পাওয়া। লেখক এখানে একটা নারীর জয়কেই তুলে ধরেছেন, যেমন নারীর জয়কে লেখক এই উপন্যাসে রাবেয়র মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। ঠিক একইভাবে এই উপন্যাসে আমরা আরেকজন নারীকে দেখি, সে হলো নূরী। নুরী আর শাহজালালের আখ্যানটা হলো ভালোবাসার। নুরীকে হারিয়ে পাগল হয়ে যাওয়া শাহজালালকে আমরা এই উপন্যাসে দেখবো পুড়ে পুড়ে মরতে। বিয়ে হয়ে গেলেই কি ভালোবাসা চলে যায়? না। আমরা দেখবো ভোর রাতে, উঠানে ঘুমিয়ে থাকা পাগল শাহজালালকে কাঁদতে কাঁদতে আঁকড়ে ধরে বুকের কাছে রাখে নূরী। বোধ শক্তিহীন শাহজালাল হয়তো, এই ভালবাসাটা এখন বুঝে না। কিন্তু একসময় ঠিকই বুঝে, তখন আমরা দেখতে পাবো নিজের ভালোবাসাকে বাঁচাতে শাহজালাল্কে নিয়ে পাড়ি দিচ্ছিলো ভিন্ন কোনো জায়গায় তখন নূরীর হাতের চোঁয়ায় বোধশক্তিহীন শাহজালালের মাঝেই নূরী খুঁজে পেল ভালোবাসার পরশ, খুঁজে পেলো নির্ভরতার জায়গা। বুকের ভেতর তীব্র ভালো লাগা তৈরি করে একসময় উপন্যাসটা শেষ হয়ে যায়। তখন মনে হয় যেনো আরেকটু পড়ি, মাইমুনা, রাবেয়া কিংবা নূরী শাহজালালদের পাশে আরেকটু সময় কাটাই। বইয়ের তথ্যঃ নামঃ দিবানিশি লেখকঃ আব্দুল্লাহ আল ইমরান প্রকাশনীঃ অন্বেষা প্রকাশন প্রথম প্রকাশঃ অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৭ খ্রী. মূল্যঃ ৩০০ টাকা অনলাইনে বইটি কিনুনঃ https://www.rokomari.com/book/129088/dibanishi

    • Was this review helpful to you?

      or

      ‘দিবানিশি’, দিবা ও নিশির গল্প ‘দিবানিশি’ মূলত আবহমান গ্রাম বাংলার দিবা ও নিশির গল্প। লেখকের তৃতীয় বই হলেও পড়ার দিক থেকে আমার প্রথম, তবে শেষ বই নয়। লেখকের গল্পবিন্যাস আমাকে একরকম বাধ্য করছে তার বাকি বইগুলো পড়তে। শীঘ্রই কালচক্র পড়া শুরু করতে পারব বলে আশা রাখি। ভূমিকা রেখে এবার আলোচনায় যাওয়া যাক। ‘দিবানিশি গ্রাম বাংলার দৈনন্দীন জীবনের গল্প’ এই একটি বাক্য দিয়ে আসলে এই উপন্যাসের ব্যাপ্তি বোঝানো সম্ভব নয়, এর ব্যাপ্তি বিশাল। মারেফতের নূরে উদ্ভাসিত জনপদ যেমন এই উপন্যাসে স্থান পেয়েছে তেমনি স্থান পেয়েছে গ্রাম্য কুটিল রাজনীতি। একদিকে যেমন আছে নদীর গর্ভে বিলীন হওয়া সর্বস্ব হারানো নারীর টিকে থাকার লড়াই, আবার অপরদিকে আছে মনসা দেবীর অভিশাপে নির্বংশ হতে যাওয়া এক পরিবারের আখ্যান। আমাদের জীবনে মুগ্ধ হবার এমন কত-শত গল্প আছে, কত যে মমতার গল্প আছে, ইতিবাচক জীবনের গল্প আছে, মানুষ তার খোঁজ রাখেনা। মানুষের ব্যস্ততা যতসব কুটিল, কুৎসিত আর মমতাহীন গল্পের খোঁজে। এই ব্যাপারটা লেখক এখানে সুচারুভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। আপনি যখন বইটি পড়বেন, শহুরে বা গ্রাম্য যে জনপদেরই আপনি হোন না কেন, আপনার জীবনের সাথে অনেক কিছুর মিল পাবেন। মূলত গ্রামীন পটভূমিতে লেখা হলেও যান্ত্রীক শহরের মধ্যে থেকেও আপনি খুব গভীরভাবে অনুভব করতে পারবেন এই উপন্যাসের বিষয়বস্তু। মানুষের মুগ্ধ হবার ক্ষমতা কিংবা কুটিলতা অথবা মানবিক গুণাবলীর শহুরে বা গ্রাম্য সংস্করণ হয়না। সুগন্ধা নদীর তীরবর্তী চানপুরা গ্রামের গুটিকতক পরিবারকে নিয়েই এগিয়েছে এই আখ্যানের ঘটনাপ্রবাহ। এই পরিবারগুলোর ভাগ্য অনেকাংশেই নির্ভর করে এই নদীটির উপর। এই পরিবারগুলোর মধ্যে একটি হলো আশ্বাব তালুকদারের পরিবার। বিপত্নীক আশ্বাব তালুকদারের তিন ছেলে, চানপুরা বাজারে বড় দুটি মুদির দোকানই তার। আর্থিকভাবে স্বচ্ছল বলা যায়। আশ্বাব তালুকদার সহজ সরল এবং নির্লোভ একজন মানুষ। কিন্তু জীবনের মায়ায় পড়ে লোভ ঢুকে যায় তার মনেও। উপন্যাসের শুরুতেই দেখা যায় একজন হিন্দু লোকের কাছ থেকে জলের দরে বাড়ি কিনে নেন আশ্বাব তালুকদার। যেভাবে প্রতিদিন সুগন্ধার পাড় ভাঙছে, যেকোনো দিন নিজের ভিটে হারাতে হতে পারে বলেই এই বন্দোবস্ত। যদিও ঐ হিন্দু লোকটাকে কথা দিয়েছিলেন মনসা মন্দিরের কোনো অমর্যাদা উনি হতে দিবেন না, কথা আর রাখতে পারলেন কই। ঐ যে বললাম, লোভ। চানপুরার আকাশে বাতাসে প্রতিনিয়ত যে গল্পটা ভেসে বেড়াচ্ছে তাকে এড়িয়ে যাওয়াও যে কঠিন। মনসা মন্দিরের মাটির নিচে নাকি গুপ্তধন ভর্তি কলস আছে! প্রথমে পাত্তা না দিলেও পাত্তা দেয়ার মতন কিছু একটা ঘটে যায় আশ্বাব তালুকদারের সামনেই। জয় হয় লোভের, পরাজিত হয়ে যায় মনুষ্যত্ব। মতলেব মিয়া ভবঘুরে মানুষ। সংসারে তার মন নেই। সংসারকে এড়িয়ে যাবার জন্যই সারাদিন ভবঘুরের মতন ঘুরতে থাকেন এখানে সেখানে। বাজারের হোটেলে বসে বাকিতে নাস্তা খান আর রেডিও শুনেন। দুপুর বিকেল কেটে যায় কখনো একটা সিংগাড়া খেয়ে কখনো কিছু না খেয়েই। রাতে বাড়ি ফিরে দুটা ভাত খেয়েই শুয়ে পড়েন। তার স্ত্রী রাবেয়া বেগমই বলতে গেলে এখনো সংসারটা টিকিয়ে রেখেছেন। জোয়ান দুটি ছেলে নৌকাডুবিতে হারিয়ে যাওয়ার পর মেয়ে দুটিকে নিয়ে একরকম ঘোর বিপদেই পড়েছেন রাবেয়া বেগম। আগে তো তাও ছেলেরা কিছু খরচ পাঠাতো, এখন তো ওরাও নিখোঁজ। ছেলেদের নিখোঁজ হওয়ার ব্যাপারে মতলেব মিয়াও কেমন যেন উদাস। খোঁজাখুঁজির কোনো চেষ্টাই যেন নেই তার ভিতরে। আমাদের সমাজে যেমন এরকম হাজারটা মতলেব মিয়া আছে রাবেয়া বেগম বরঞ্চ তার থেকে বেশিই আছে। পড়তে গিয়ে আমি যেমন আমার মায়ের ছায়া পেয়েছি, তেমনি আপনিও হয়তো পেয়ে যাবেন আপনার মায়ের ছায়া। একজন স্ত্রী আলাদা হতে পারেন, একজন বোন আলাদা হতে পারেন কিংবা একজন দাদি/নানি আলাদা হতে পারেন, কিন্তু মায়ের চিত্রটা সব জায়গাতেই প্রায় একই রকম। এই আখ্যানের একটা বড় অংশ জুড়েই আছে ফকিরবাড়ির কথা। বংশ পরম্পরায় তারা মারেফতি গজল গেয়ে নিরাকার নিরঞ্জনের আরাধনা করেন। এই বাড়ির লোকজন এবং তাদের মুরিদানরা দুনিয়া সম্পর্কে উদাসিন। জাগতিক কোনো কিছুই তাদের আগ্রহ জাগাতে পারেনা। তারা ব্যস্ত খোদার দিদার লাভের আশায় ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে। তাদের বাড়ির সামনে দিয়ে হেটে যেতে যেতে হয়তো শুনতে পাবেন; ক্ষ্যাণেক মুর্শিদ বইলা ডাকি ক্ষ্যাণেক আমার মনে লয় না নিদয়া হইয়ো না মুর্শিদ নিদয়া হইয়ো না। কিসে তোমার হইবে গো দয়া সেই কথাটি কওনা, অনুরাগে রাগ করিয়া, অনুরাগে রাগ করিয়া রোগ দিয়া পুড়াইয়া মাইরো না। এই ফকিরবাড়িরই ছোট মেয়ে মায়মুনা এই উপন্যাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। এই চরিত্রটি আমাদের গ্রামাঞ্চলের অধিকাংশ মেয়েদের প্রতিনিধীত্ব করে। পরিবারে ইচ্ছার উপরই এদের জীবন নির্ভর করে। মায়মুনা বাবার মতামতের উপর নিজের মতামতকে প্রাধান্য দিতে পারেনা। নিজের ভাগ্যকেও তাই সপে দিতে হয় বাবার ইচ্ছার উপরেই। তার পরিণতিটাও হয় ভয়াবহ। তবে মায়মুনা ভাগ্যের পরিণতি নিয়ে বসে থাকার মেয়ে নয়। নিয়তির সাথে লড়াই করে ফিরতে চেয়েছে শেকড়ের সন্ধানে। বেশিরভাগ গল্প উপন্যাস বা সিনেমা নাটকে আমরা গ্রাম্য চেয়ারম্যানকে দেখি কুটিল এবং ষড়যন্ত্রকারি হিসেবে। দিবানিশিও এই ধারণা থেকে বের হতে পারেনি। এখানেও চেয়ারম্যানকে দেখানো হয়েছে খল চরিত্রে। আমার মনে হয়েছে এই ধারণা থেকে আমাদের বের হওয়া উচিৎ। এই আখ্যানের একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং সবথেকে রহস্যময় চরিত্র বলা যায় আজগরকে। এই চরিত্রটা আপনাকে নিয়ে খেলবে। কখনো আপনার মনে হবে আজগর বিত্তবান একজন ভালোমানুষ, যে কিনা মানুষের বিপদে আপদে এগিয়ে আসে। আবার কখনো মনে হতে পারে ওর মত খারাপ মানুষ বুঝি আর নেই। এই যে খেলাটা, এই খেলাটা আপনি উপভোগ করতে বাধ্য। এর আগে নান্দনিক কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের বিভিন্ন বইয়ে আমরা এইরকম অসংখ্য চরিত্র দেখেছি। আখতার, আজম, নিজাম, মঞ্জু, লালবানু, আঙুরী-কমলা সহ এমন আরো অনেক চরিত্র আছে এই উপন্যাসে। সবাই বাস্তব জীবনের বিভিন্ন চরিত্রের প্রতিনিধিত্ব করছেন। সবাইকে নিয়ে আলোচনা করতে গেলে রিভিউ বড় হবে, আপনাদের বিরক্তির উদ্রেক হবে। এবার আসি আমার কাছে এই উপন্যাস কেমন লেগেছে সেই আলোচনায়। লেখক আব্দুল্লাহ আল ইমরানের লেখার সাথে পূর্বে আমার কোনো পরিচয় ছিল না। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে বিভিন্ন সময়ে তার বিভিন্ন লেখা পড়েছি। কিন্তু সেইসব লেখা দিয়ে তার লেখার ধরণ বিচার করতে পারিনি। একজন লেখকের লেখা বিচার করতে হলে তার কোনো পূর্ণাঙ্গ বই পড়া উচিৎ বলে আমি মনে করি। বইয়ের শুরুতে যে ভূমিকা দেয়া আছে, মূলত সেটা পড়েই বইটি পড়ার উৎসাহ পেয়েছি। এই উপন্যাসের গল্পটা মোটামুটি সবার পরিচিত। এর আগে বিভিন্ন লেখকের কলমের ছোঁয়ার গ্রাম বাংলার এই চিত্র ফুঁটে উঠেছে। তবে দিবানিশি ওগুলো থেকে কিছুটা ভিন্ন। এখানে লেখকের বর্ণনাগুলো ছিল চমৎকার এবং বাস্তব। খুবই চমৎকারভাবে বিশ্লেষন করে চরিত্রগুলো সাজিয়েছেন তিনি। তবে প্রথমদিকে পড়তে গিয়ে কিছুটা বিরক্তি লেগেছে। আমার কাছে লেখকের লেখার ধরণ প্রাঞ্জল মনে হয়নি। মনে হয়েছে লেখক ইচ্ছে করেই হয়তো এমনটা করেছেন। ফেসবুকে উনার যেসব লেখা পড়েছি সেগুলো কিন্তু এরকম ছিল না। ওগুলো পড়তে গিয়ে একবারও বিরক্তি লাগেনি। এই উপন্যাসে গল্পের ধরণের কারণে এমনটা হতে পারে। তবে যখনই আপনি প্রথম অধ্যায়ের শেষদিকে চলে যাবেন তখন আপনি না চাইলেও বইটি আপনাকে দিয়ে পড়িয়ে নিবে। প্রায় প্রতিটি অধ্যায়ের শেষদিকে ছোট ছোট কিছু টুইস্ট বা রহস্য ছিল যা আপনাকে পরবর্তী অধ্যায়ের দিকে আগ্রহী করে তুলবে। পরিশেষে বলব ‘দিবানিশি’ এমন একটা বই, যা শেষ করার পর আপনার ভিতর একটা রেশ থেকে যাবে। বইয়ের প্রচ্ছদটা সুন্দর, বাইন্ডিং এবং কাগজের মান খুবই ভালো। সামান্য কিছু বানান ভুল এবং টাইপিং মিসট্যাক নজরে পড়েছে। আশা করব পরবর্তী সংস্করণে এগুলো ঠিক হয়ে যাবে। হ্যাপি রিডিং।

      By Tahmid

      21 Sep 2019 09:02 AM

      Was this review helpful to you?

      or

      "নদীবিধৌত আবহমান বাংলার অলক্ষ্যে বহমান মোহমুগ্ধ এক জীবনের গল্প, যা বাংলার গ্রামীণ লোকসংস্কৃতির দিকে ফিরে আসার প্রবল হাতছানি জাগায়।" উপন্যাস: দিবানিশি। লেখক : আবদুল্লাহ আল ইমরান। প্রকাশক: অন্বেষা প্রকাশন। প্রচ্ছদ: সানজিদা পারভীন তিন্নি। মুদ্রিত মূল্য: ২৭০ টাকা মাত্র। পৃষ্ঠা সংখ্যা: ২১৬ পৃষ্ঠা। বুক রিভিউ মানে সংক্ষেপে বইয়ের এমন এক বিশেষত্ব তুলে ধরা যা পাঠ করার মাধ্যমে একজন পাঠকের মনে বইটি পড়ার কৌতূহল জন্ম নেয়। দিবানিশি উপন্যাসটি ইতিহাস, লোকজ মিথ, দেবী মনসা,গান, গজল ও তত্ত্বকথা- সব কিছুর মিল বন্ধনে লেখক আবদুল্লাহ আল ইমরান যে এক অতুলনীয় উপন্যাস সৃষ্টি করেছে তা নিয়ে আর কোন বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই। তেমনি এমনি এক কৌতূহল নিয়ে পড়তে শুরু করেছিলাম উপন্যাসটি। একজন আদর্শ পাঠকের দায়িত্বানুসারে উপন্যাসটির বেশ কিছু চমৎকার এবং কিছু অশ্রেয় দিক চোখে পড়লো। প্রতিটি অক্ষর,বাক্য,পৃষ্ঠা নিখুঁতভাবে পড়ে উপন্যাসের আপাদমস্তক বুঝে উপন্যাসটির সম্পর্কে আমার কিছু উপলব্ধি তুলে ধরছি। বুক রিভিউ: লেখক আবদুল্যাহ আল ইমরান কলমের আঁচড়ে তুলে ধরেছেন চানপুরার মানুষের দিন ও রাতের গল্প। আশ্বাব তালুকদার ও তার তিন ছেলে আখতার, নিজাম আর আজম। কৃষ্ণদের বসতবাড়ি, পুকুর,মন্দিরসহ বিপুল জমি পানির দামে কিনেছে আশ্বব তালুকদার।ঘোষভিটায় আছে মা মনসা দেবী'র মন্দির। এই মন্দির নিয়ে বহু বছর থেকেই জনশ্রুতি বেশ আকর্ষণীয়। বহুকাল ধরে চানপুরার বসবাসরত মানুষরা জানে যে কৃষ্ণদের এই মা মনসা মন্দিরে রত্ন ভরা কলস আছে। কৃষ্ণ কলকাতা যাওয়ার সময় আশ্বব তালুকদার তাকে কথা দেয় যে মন্দিরের কোনো ক্ষতি হতে দিবে না। কিন্তু পরবর্তীতে এই মন্দির কে ঘিরেই গড়ে উঠে গ্রাম্য রাজনীতি। আর এই রাজনীতিবিদরা হলেন আশ্বব তালুকদার, আজমত চেয়ারম্যান ও অজগর।আবদুল্যাহ আল ইমরান তার রচিত দিবানিশি উপন্যাসে খুব সুন্দর ভাবে বর্ণনা করেছেন এই রাজনীতির কথা। আশ্বাব তালুকদার তার কথা রাখার জন্য মন্দিরের কোন ক্ষতি করতে পারলো না কিন্তু তার তিন ছেলে আখতার, নিজাম আর আজম তারা মন্দির প্রাঙ্গন খুঁড়ে দেখতে চেয়েছিল সত্যিই কি এখানে কোনো গুপ্তধন আছে?? একদিন তারা মন্দির খুঁড়ে। এর পর থেকেই আশ্বাব তালুকদারের উপর নানান ধরনের বিপদ আসতে থাকে। একে একে তার ছেলেরা মারা যেতে থাকে । তারপর কী হয়েছিল? আশ্বাব তালুকদারের বংশ কী মা মনসার অভিশাপে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল? উপন্যাসের আরেকটি চরিত্র ময়মুনা । বাবার চাপে বিয়ে করে মায়মুনা। তার স্বামীর আগের স্ত্রী,অভাব সব কষ্ট বুকে চেপে রেখেছে মায়মুনা।কখনো কাউকে বুঝতে দেয়নি।তার মনের কষ্ট বুঝার একজনই ছিলো তার মা, তিনিও মারা যায়। মায়মুনার বাবা খবিরউদ্দিন । তিনি একজন খলিফা। উপন্যাসের আরেক চরিত্র আজমত চেয়ারম্যান, তিনি একজন সুবিধাবাদী মানুষ। ঘোষভিটার উপর তার লোভ ছিল অনেক। শেষের দিকে এই বিরোধ আশ্বাব ঘটে তালুকদারের সাথে। আবদুল্যাহ আল ইমরান রাবেয়াকে তুলে ধরেছেন একজন সংগ্রামী সাহসী নারী হিসেবে। স্বামী মতলেব একজন উদাসী মানুষ। সংসার, স্ত্রী-সন্তানের প্রতি কোনো দায়িত্ববোধ নেই। সে কোনো কাজ কাম করে না।সারাদিন টো টো করে ঘুরে বেড়ায় । সংসারে তার মন নাই।সংসার এ কখন কি ঘটছে দেখার সময় নাই তার। রাবেয়া একজন নারী হয়ে পুরো সংসার কে আগলে রেখেছে। কঠোর পরিশ্রমী, ধৈর্যশীল ,ত্যাগী ,সৎনিষ্টা চরিত্র রাবেয়া। রাবেয়া এমন এক নারী যে শত প্রতিকূল পরিস্থিতিতে শক্ত হাতে হাল ধরে রেখেছে দুই পুত্র, দুই কন্যা ও স্বামী সহ সংসারের ছয়জন সদস্যের। এক রাতে মতলেবের ভাই রাবেয়া ও মতলেবকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। তারা সারারাত গাছ তলায় কাটায়।তখন থেকে রাবেয়া সংকল্প করে একটি ঘর তুলবে। একটি নারী একটি ঘর তুলতে কত ত্যাগ তিতিক্ষা সহ‍্য করতে হয়, কত পরিশ্রম করতে হয়, মানুষের কাছে পাগলী বদনাম নিতে হয়।রাবেয়ার স্বপ্ন এই টিনের ঘর কি সে শেষ পর্যন্ত করতে পেরেছিল ? তার দুই ছেলে সোহেল আর জুয়েল হঠাৎ হারিয়ে যায়। কেন এবং কীভাবে? সত্যিই কী ছেলেরা হারিয়ে গিয়েছিল নাকি ঘটনা অন্যকিছু? উপন্যাসের আরেকটি চরিত্র আজগর। লোকমুখে শুনা যায় আজগর তার খালাতো বোনকে ধর্ষণ করে এলাকা ছাড়ে। অনেক টাকা পয়সা নিয়ে একদিন সে আবার ফিরে আসে । কোথায় পেয়েছে সে এত টাকা? এছাড়াও লেখক ফকিরবাড়ি'র লালবানু'র ছেলে শাহজালাল ও নূরীর করুণ ও বেদনাদায়ক প্রেমের গল্প তুলে ধরেছেন। নূরী'র বাবা মেয়েকে জোর করে বিয়ে দিয়ে দেয় অন্যত্র। সৎ মা'র দেওয়া মানসিক নির্যাতন আর শাহজালালের ভালোবাসা হারানো মেয়েটা ভিতরে ভিতরে ক্ষয়ে যেতে থাকে। নূরীর দেয়া স্মৃতি রুমালে লেখা , ভুলোনা আমায়! কতোটাই না নিষ্পাপ ছিলো সে প্রেম! বইয়ের ভালো লাগা কিছু উক্তি: * "ভালোবাসার মতো কঠিন পাপ বুঝি এই পৃথিবীতে আর একটাও নেই।" * "জগতে নিঃশব্দে কান্নার চেয়ে তীব্র কষ্টের আর কি কিছু আছে?" * "জগতের সকল নারীই যেন পুরুষের চোখের ভাষা বোঝার অপূর্ব ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছে।" * "খুব বেশি নিকটে থেকেও কেউ কেউ এক জনমের দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে না।" * "জগতের সব মায়েরাই সন্তানের মন পড়তে পাড়ার অদ্ভুত ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়।" শেষ কথা: উপন্যাস হিসেবে আবদুল্লাহ আল ইমরান এর দিবানিশির স্বার্থকতা এই যে, গ্রামীন বাংলার প্রকৃতি, জীবনদর্শন আর নিত্য সংগ্রামের যে অভিন্ন নিবিড় গভীর সম্পর্ক তা পাঠকের কাছে খুব সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। তুলে ধরেছেন নদীতীরবর্তী বসবাসরত মানুষের সহজ, সরল জীবনযাপনের চিত্র। ছোট থেকে শুরু করে যেকোন বয়সের যে কাউকে এই উপন্যাসটি আকর্ষণ করবে। একবার পড়ার পর বারবার পড়তে ইচ্ছে করবে...

      By nasir uddin baki

      09 Feb 2018 03:37 PM

      Was this review helpful to you?

      or

      ১.দিবানিশি। দিবানিশি,লেখক আবদুল্লাহ আল ইমরানের তৃতীয় উপন্যাস।লেখকের ২য় উপন্যাস কালচক্র গত বইমেলায় বেশ সাড়া ফেলে।বোদ্ধামহলেও বেশ আলোচিত হয় তার লেখা কালচক্র উপন্যাসটি।জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন তার জন্মদিনে প্রথম আলোকে দেওয়া বিশেষ সাক্ষাতকারে তরুণদের লেখকদের লেখা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে কালচক্রের কথা বলেছেন। ২.২০১৭ বইমেলায় অন্বেষা থেকে প্রকাশিত হয় দিবানিশি উপন্যাসটি।যেখানে বিস্তৃত হয়েছে বাংলার প্রত্যন্ত এক জনপদের দিনরাতের গল্প।বিস্তৃত হয়েছে সহজিয়া জীবনদর্শনে মারফতি নূরে উদ্ভাসিত অলক্ষে বহমান জনপদের কাহিনি।আছে শিকড়ে ফিরতে চাওয়া ও জলের গর্ভে সব হারানো দুই নারীর অদম্য লড়াই।এ গল্প মনসা দেবীর অভিশাপের লোকজ মিথেরও। ৩.দিবানিশি উপন্যাসে অনেকগুলো চরিত্র।একটি চরিত্রকে কেন্দ্র করে নয় বরং যেখানে প্রায় সব চরিত্রই হয়ে উঠেছে মূখ্য।অনেকগুলো চরিত্রকে কেন্দ্র করে অনেকগুলো গল্প।কিন্তু সব গল্পই একই সুতায় গাঁথা। ৪.গল্পটা নদী তীরবর্তী এক গ্রামের। গ্রামের নাম চানপুরা।নদীর নাম সুগন্ধা। নদী ভাঙন,মনসা দেবীর লোকজ মিথ,মারফতি সহজিয়া জীবনদর্শন,ধর্মীয় অনুভূতি,ভিলেজ পলিটিক্স, গ্রাম্য যুবক যুবতির প্রেম।এক নারীর শিকড়ে ফিরা ও অদম্য এক নারীর গল্প।এরকম অসংখ্য বিষয় উপন্যাসের পাতায় পাতায়। আছে বেশকিছু রহস্য।সব মিলিয়ে এ এক জীবনঘনিষ্ঠ উপন্যাস। ৫.চরিত্র: আশ্বাব তালুকদার -লোভ লালসায় পড়ে বিপন্ন জীবনের গল্প তার পরিবারকে ঘিরে। রাবেয়া খাতুন:জলের গর্ভে সব হারানো এক অদম্য নারীর লড়াই।টিকে থাকার প্রাণান্ত চেষ্টায় সদা ব্যাকুল এক নারী। আজগর :ধুরন্ধর মুখোশপড়া এক মানুষ। খবিরউদ্দিন ফকির:মেহেরউদ্দিন ফকিরের দর্শনে ছড়িয়ে যাচ্ছেন ফকিরি ধ্যান-ধারণা,দর্শন চিন্তা।পুরো পরিবারই যেন একটি বিস্তৃত গল্পের ডালা। মায়মুনা:শিকড়ে ফেরার এক অসাধারণ গল্প।বঞ্চিত হয়েছেন জীবনের অনেকটা সময়।হেটেছেন অনেকটা পথ একলা অভিমানে। শাহজালাল,নূরী,আফজাল মুন্সী, অম্বরী বেগম,চেয়ারম্যান, মতলেব,সোহেল,আঙুরীসহ আরও অনেক চরিত্র। ৬.উপন্যাসে ইভটিজিংয়ের মতো একটা বিষয় উঠে এসেছে, যা খুব ভালো লেগেছে।আমি এমনটাই চাচ্ছিলাম কোনো একটা বইয়ে!কোনো একটা উপন্যাসে এই বিষয়টা উঠে আসুক।হয়তোবা উঠেও এসেছে যা আমার দৃষ্টিগোচড় হয় নি।এই উপন্যাসে এই বিষয়টা আছে দেখে ভালো লেগেছে। ৭.হিন্দুদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতসহ তাদের বেশকিছু বিষয়কে কেন্দ্র করে গ্রাম্য রাজনীতি। সমসাময়িক সময়ে আমরা পত্রিকার পাতায় প্রায়ই দেখি হিন্দুদের মন্দিরে ভাংচুর, হামলা।এই বিষয়টা বিস্তৃত হয়েছে দিবানিশি উপন্যাসে। ৮.লেখক আবদুল্লাহ আল ইমরান তার লেখায় এমন এক গল্প বলেন,যে গল্পে উঠে আসে এমন এক জনপদের গল্প, যাতে স্বাদ পাওয়া যায় শিকড়ের।গল্পে উপজীব্য হয় বেশকিছু অনুভূতির। ৯.লেখকের জন্য শুভকামনা বারবার যেন ফিরে আসেন মানুষের গল্প নিয়ে।জগতের গল্প নিয়ে,জনপদের গল্প নিয়ে,অনুভূতির গল্প নিয়ে।

    •  

    Recently Viewed


    Great offers, Direct to your inbox and stay one step ahead.
    • You can pay using


    JOIN US

    icon Download App

    Rokomari.com is now one of the leading e-commerce organizations in Bangladesh. It is indeed the biggest online bookshop or bookstore in Bangladesh that helps you save time and money. You can buy books online with a few clicks or a convenient phone call. With breathtaking discounts and offers you can buy anything from Bangla Upannash or English story books to academic, research or competitive exam books. Superfast cash on delivery service brings the products at your doorstep. Our customer support, return and replacement policies will surely add extra confidence in your online shopping experience. Happy Shopping with Rokomari.com!