User login
Sing In with your email
Send
Our Price:
Regular Price:
Shipping:Tk. 50
প্রিয় ,
সেদিন আপনার কার্টে কিছু বই রেখে কোথায় যেন চলে গিয়েছিলেন।
মিলিয়ে দেখুন তো বইগুলো ঠিক আছে কিনা?
Share your query and ideas with us!
Was this review helpful to you?
or
নগরের কর্পোরেট সকল অভিজ্ঞতার ভেতর বাস করেও প্রান্ত ও প্রান্তিকের জনপদ, জীবন কবিতার বিষয় হয়ে উঠতে পারেÑ কাচপোকা তারই সংবেদ। বলা যায়, নগরের সুউচ্চ স্কাইস্ক্যাপারে দাঁড়িয়ে প্রান্তিক জীবনের পাতায় পাতায় উৎকীর্ণ বর্ণমালা কবি পাঠ করেছেন। এই পাঠ-অভিজ্ঞতা যে সর্বত্র স্পষ্ট ও আলোময় হয়ে উঠেছে তা নয়, কোথাও কোথাও অস্পষ্টতা অথবা অনালোকিত রয়ে গেছে। অবশ্য জীবনের সামগ্রিক আলোছায়ার যুগল ছবি সম্পূর্ণতা দেওয়ার বিষয়টি অত্যন্ত আপেক্ষিক। প্রাপ্তিটি এই যে, সাঁকোর মতো জীবনের দুই প্রান্তের সমবায়ী তরঙ্গ কবিতাগুলোর শব্দ ও শব্দান্তরে সংক্রামিত হয়েছে। চারপাশের পরিবেষ্টিত জগৎ এবং ওই প্রতিবেশ আলো হাওয়ার মতো সহজেই নায়েম লিটুর কবিতার শব্দাবলি হৃদয়ে প্রবেশ করে। একজন তরুণের কবিতার এই সম্ভাবনা পাঠক হিসেবে আমাদের আশাম্বিত করে। প্রেম এবং জীবনের নস্টালজিক অনুষঙ্গসমূহ কাচপোকায় তিনটি পর্বে বিভাজিত। পর্ব তিনটি হলÑ জীবনের বোবালিপি, বাইদানী এবং সম্পর্ক-শরীর-প্রেম। তিনটি পর্বের শিরোনামই জানিয়ে দেয় জীবনের রক্তমাংস এবং নিঃশ্বাসের সঙ্গে কবির বোধ ও চৈতন্যের অভিপ্রায়টি। প্রতিটি পর্বে স্বতন্ত্র ভাবনার কবিতা সূচিবদ্ধ হলেও কবিতাগুলোর অন্তর্স্রোতে একটি ঐক্যসূত্র রয়েছে। সেটি হচ্ছে প্রেম। এই প্রেমকেই কবি পর্যায়ে পর্যায়ে ভেঙেচুরে নিংড়ে সন্ধান করেছেন জীবনের সংজ্ঞার্থ। কাচপোকা উৎসর্গ করা হয়েছে পিতাকে এবং এর প্রথম কবিতা ‘মা’। এটা চমৎকার একটি সাজুয্য। মা সম্পর্কে বা বলা যায় সন্তানের প্রতি মায়ের আত্মত্যাগের কথা নতুন কিছু নয়, তবু এই বার্তা এমনই যে যতবার এবং যেভাবেই উচ্চারিত হোক না কেন, তার স্বরমালা হৃদয়তন্ত্রীকে সহস্র সুরে আলোড়িত করে, বেদনার্ত করে, সুখে আনন্দাশ্র“ ঝরায়। সকল মা সন্তানের কাছে শ্রেষ্ঠ, স্বতন্ত্র স্নেহের আধার : ‘নদীতে জড়িয়ে থাকে জল ও মাছ, কে মুছতে পারে নদীর গর্ভজাত এই লিপি! লোকারণ্যে খুঁজে পাইনি একজোড়া চোখ আমার মায়ের ভাষায় কথা বলে... এত এত লোক সুগন্ধী তেলে পরিপাটি কেশ, চলে মমতার আস্তরণে। তবু কেউ আমার মা নয়...’ [মা] ‘নদীতে জড়িয়ে থাকে মাছ ও জল’Ñএই অবিচ্ছেদ্য প্রেমই কবির কাছে সত্য। জীবনের এই অবিচ্ছিন্ন প্রেম [প্রকৃত অর্থে মাছের চিত্রকল্প কবিতার পর কবিতায়] নানান উত্থান-পতন ও সুখ-দুঃখের যৌথ চিেহ্ন পরিদৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। এই যাত্রা কাচপোকার আদ্য-প্রান্ত, জীবনের বোবালিপি তাই সম্পর্ক-শরীর এবং প্রেমে এসে তার সমাপ্তি। মাছ এবং জলের সম্পর্ক যেমন নিবিড় এবং শারীরিক, কবির প্রেমচেতনা এবং জীবনানুধ্যানের ভাবনাও তেমনি নিগূঢ় অর্থে শরীরী। প্রেমের এই শরীরী বোধের সঙ্গে সমীকৃত হয়েছে বিচিত্র অনুষঙ্গ, চেনা-অচেনা জগতের প্রতিবেশ। কাচপোকায় মাছ একটি তাৎপর্যপূর্ণ চিত্রকল্প। কবিতার পর কবিতায় মাছ এবং মানবজীবনের যৌথতা সৃষ্টি করেছে ভিন্ন মাত্রার রসায়নÑবিশেষত ইলিশ মাছ [তাহাদের কথা, চিঠি, কোনো কোনো রাতে কবিতায়]। জেলে জীবনের কঠিন কঠোর নিষ্ঠুর নিয়তির মতো বাস্তবতা আমরা দেখেছি তিতাস একটি নদীর নাম এবং পদ্মানদীর মাঝি উপন্যাসে অথবা বুদ্ধদেব বসুর ‘ইলিশ’ কবিতায়। নায়েম লিটু তাঁর কবিতায় ওই জীবন-সংগ্রামের চিত্রকল্প উপস্থাপনে অবলম্বন করেছেন সাম্প্রতিকের যন্ত্রণা ও কাক্সিক্ষত প্রেমের জন্য প্রতীক্ষার করুণ আততি : ‘নাইলন সুতার ফাঁদে পোয়াতি ইলিশ/প্রসব যন্ত্রণায় কাতর,/মৃত্যু ভয়ে টলটলে চোখ/শাদা বরফের মতো হিম-নিথর/পরের জন্মে মানুষ হবে/নিষ্ঠুর জেলে আর বুড়ো ঈশ্বরকে/এই চিঠি কে দেবে?’ [চিঠি] জেলে জীবনের এই নিষ্ঠুর ও নির্মম বাস্তবতা আরো তীক্ষè ও তীব্র হয়ে উঠেছে ‘কোনো কোনো রাতে’ কবিতায়। এখানে জেলেজীবনের দৈনন্দিন ছক আরো স্পষ্ট, আরো উন্মুক্ত এবং স্বপ্নবহুলও বটে। সেখানে প্রতিদিনের ক্লান্তি, অবসাদ এবং বহির্জগতের বিচিত্র কুটিল হিংস্রতা জীবনের স্বপ্ন ও আকাক্সক্ষাকে চুরমার করে দিলেও প্রেম অপরাজেয় : ‘কোনো রাতে জাল ফেলা এবং তোলার মধ্যবর্তী অবসরে/নাওয়ের পাটাতনে শুয়ে থাকা তুমি ডুবে যাও স্বপ্নের রাজ্যে/কোনো বেণী দোলানো কিশোরী খুনসুটিতে খামচে দিচ্ছে তোমাকে/বাইরের হিংস্রতা কাদা কাদা করে শিশুর সারল্য/তারপর মাঝগাঙে হল্লা/নাওয়ের খোল ভরে ওঠে ইলিশে/তখনো স্বপ্নের রেশ কাটাতে না পারা তোমার দৃষ্টি/গেঁথে থাকে মৃত ইলিশের পুতুল শরীরে/পলকহীন অভিমানি চোখে তাকিয়ে আছে তোমার প্রাণভোমরা ? [কোনো কোনো রাতে] ‘বাইদানি’ পর্বে ছয়টি কবিতা। বেদেজীবনের প্রাত্যহিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে কষ্ট, গ্লানি ও প্রেমের রূপায়ণ কবিতাগুলোর প্রধান প্রতিপাদ্য। তবে অন্ত্যজ জীবনের টুকরো টুকরো ছবি ছয়টি কবিতায় বস্তুসংহতি পেতে পারত, কিন্তু কবি নায়েম লিটু ওই অপরূপ সম্ভাবনার চৌকাঠে নিজেকে দাঁড় করিয়েছেন, অন্দরমহলে প্রবেশ করেননি। কবিতাগুলোতে আরো নিরীক্ষার সুযোগ ছিল, অবশ্য এ মন্তব্যও অত্যন্ত আপেক্ষিক এবং তারল্যপ্রসূতÑএ কথা মেনে নিয়েও বলা যায়, অন্তর্বর্তী শূন্যতা পূরণের জন্য কবিতায় যে চিত্রকল্প, উপমা, রূপকের আশ্রয় নেয়া যায়, নায়েম লিটু তার যথোপযুক্ত প্রয়োগ ঘটালে অসাধারণ একটি সিরিজ আমরা পেতাম। তবু কবিতাগুলোর পঙ্ক্তিতে পঙ্ক্তিতে যে প্রেম, নারী ও বেদেজীবনের অনুষঙ্গ চিকচিক করে ওঠে তার মূল্য কম নয়। যেমন : থমকে যাই নদীর ঘাটে/নাওয়ের পাটাতনে পা রেখেই/মানুষের খোলশ বদলে সাপ হয়ে যায়/সেই মেয়ে... [১ সংখ্যক]; নৌকার খোলে জলের অবিরাম ঘাই/আর ঝুড়িবন্দি নাগিনীর খোঁজে আসা নাগের অজস্র দংশন/ক্ষত-বিক্ষত করে তার শরীর/ভোরে ডাঙায় যাকে দেখো নাচের মোহিনী ছন্দে/তার কতটাই বা দেখো/প্রতিদিন যে মরে... [৩ সংখ্যক] এবং আমি কারেই বা বলি/পাগলিনী বেহুলার নির্ঘুম পাথুরে চোখ/প্রতিরাতে আমাকেও যে ছোবল কাটে.../সাপের বিষদাঁতে নত যে-জীবন/তার উতল মন নিয়ে খেলে কোন ঈশ্বর? [৪ সংখ্যক] জীবনানন্দ দাশ প্রেমকে ইতিহাস, ঐতিহ্য ও পুরাণের অন্তর্যাত্রায় রূপময় করে তুলেছিলেন এবং হাজার বছর পথ পরিভ্রমণে অশেষ ক্লান্তির উৎসারণে সংক্রমিত হয়েছিল তাঁর সংবেদনশীল চৈতন্য। নায়েম লিটুর প্রেমচেতনা বাস্তবের জীবন অতিক্রম করে সহসা চকিতে ঐতিহ্য এবং প্রান্তিকের জীবনের সঙ্গে পরস্পরিত হয়ে সমীকৃত। ‘সম্পর্ক-শরীর-প্রেম’ পর্বের কবিতাগুলো এই চেতনার সমীকরণ তো বটেই, পূর্বে উল্লিখিত যে, তাঁর প্রেমের স্ফুরণ এই বইয়ের আদিঅন্ত জুড়ে। আর এই পর্বের শিরোনামে স্পষ্ট যে, লিটুর প্রেম যে পরিণামে চরমতম অবসাদ, অপ্রাপ্তি ও বেদনার সুরে মূর্ছনা সূচিত করে লিটুর এই পর্বের দশটি কবিতায় তার স্ফুরণ লক্ষণীয় : ‘রূপবতী সে রাজকন্যারা টানত কী এক কুহকী জাদুর অব্যর্থ মন্ত্রে। যেন আমরা উত্তাল সমুদ্রে ঝড়ে-পড়া ডাঙা সন্ধানী নাবিক। তারা তীরের সবুজ ঝাউ বৃক্ষ। তাদের সে চোখে খুঁজতে চাইতামÑ বিলুপ্ত রাজ্যের মানচিত্র। অথচ নিকটে পৌঁছাতে না পৌঁছাতে মিলিয়ে যেত কর্পূরের ধর্মে। আর আমরা একফোঁটা পানীয় চলের কিংবা তীর সংলগ্ন মাটি স্পর্শ করতে না পেরেও ফিরে আসতাম, আসতে হতÑ পূর্ববর্তী নরক জীবনে।’ [১ সংখ্যক] তীরের ঝাউ বৃক্ষ সবুজ দূর থেকে নিবিড় মনে হলেও নিকটে এলেই তার সমস্ত সবুজতা ও ঘনসন্নিবদ্ধ বস্তুসমগ্রতা হারিয়ে দৃশ্যময় হয়ে ওঠে অন্তর্নিহিত ধূসর বিচ্ছিন্নতা। এবং এই দৃশ্য অবলোকনের পর প্রত্যাবর্তন করতে হয় ‘পূর্ববর্তী নরক জীবনে’। আর তমসাময় খিল খিল হাসি, শাবল-ছেনির আঘাতে ঘর সাজাবার জন্য তুলে ফেলা রাজপ্রাসাদের দেওয়াল-গাত্রে উৎকীর্ণ লিপিমালাÑ এইসব চিত্রের দৃশ্যসমাহার কিসের ইঙ্গিত? অন্তরাকর্ষণশূন্য মিথ্যে অলঙ্কার সর্বস্ব হয়ে পড়া ব্যক্তিমানুষের প্রেমচৈতন্যের প্রতীক নয়? প্রেমের এই রূপান্তর একবিংশ শতাব্দীর বর্তমান পৃথিবীর তৃতীয় বিশ্বের একজন ব্যক্তিকবির জীবনের নিষ্ঠুর সত্যই উন্মোচিত। তাই রতির ভঙ্গিমা পাল্টে গেলেও, শরীরী কসরত আরো অনুভূতিময় ও স্পর্শকাতর হয়ে উঠলেও ‘সেগুলো যে কসাইয়ের ছিল কসাই তা ঠিক ঠিক জানত...’Ñ এই অভিজ্ঞতায় সত্য। কাচপোকার শেষ কবিতা [তিনটি পর্বের অনবতর্ভুক্ত নয়?] ‘একটা রাতের জীবনী’। নারী ও প্রেম যে কাচপোকার কবিতার পর কবিতায় তরঙ্গায়িত, এই কবিতাতেও তার উচ্ছ্বাস রয়েছে। এই সূত্রে প্রেমের সঙ্গে কবির নারীচিন্তাও বিষয়টিও উল্লিখিত হতে পারে। মা থেকে শুরু করে প্রেমিকা নারীর নানান ভঙ্গি দৃশ্যায়িত হয়েছে এখানে। শেষপর্যন্ত নারী সীমাহীন প্রপঞ্চের আধার। এক অচেনা প্রাচীন রাজপ্রাসাদের মতোই দুর্গম, দুর্ভেদ্য : ‘আমরা সেইসব নারীদের কাছে মেলে দিতে চেয়েছিলাম আমাদের হৃদৎপিণ্ড যারা ক্রমশ বিশ্বাস করতে ভালোবাসত সমস্ত তরঙ্গই তাদের ইশারা অধীন। পেত আত্মরতির সুখ। চলতে চলতে চিতার নখের ক্ষুধার্ত থাবায় খুবলে খুবলে নিচ্ছিল আমাদের মাংস। তবু আমরা উন্মত্ত পণ করেছিলামÑ যেভাবেই হোক পৌঁছতে হবে রাজপ্রাসাদের অন্দরমহলে।’ এই নারী কবিকে বানিয়েছে তার ক্রিতদাস, আর কবির দৃষ্টিতে নারী প্রেমিকা হলেও রহস্যময়ী, বিচিত্র ছলনায় পারঙ্গম। অর্থাৎ নিছক পিতৃতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নারীকে নির্মাণ করেছেন কবি। তাঁর কাছে নারী নিতান্তই রক্তমাংসের শরীরী উপস্থিতি, পুরুষের কামনা চরিতার্থ করবার এক জৈবযন্ত্র। যেমন : ‘নতুন নারীর বগলের ঘ্রাণ শুঁকতে শুঁকতেÑ পুরুষটি ব্যভিচারের কুৎসিত কালি লিপতে থাকে পূর্বতন নারীটির যাপিত জীবনে। আর পুরুষটির লোমশ বুকে মুখ ঘষতে ঘষতে নারীটি গালি দিতে থাকে আগের পুরুষটিকেÑ অক্ষম অশ্ব বলে...’ চারপাশের বাস্তবতার এই প্রতিরূপায়ণের মাধ্যমে প্রতৃতপক্ষে প্রতিদেিনর চেনা দৃশ্যকে চোখের সামনে তুলে ধরে কবি আমাদের তথাকথিত প্রগতিশীলতার মুখোশের অন্তরালে যে পিতৃতান্ত্রিক ব্যক্তিমানুষের বসবাস তাকে চপেটাঘাত করেছেন। কেবল ‘উপমাই কবিতা’র আধার করে তোলেননি নায়েম লিটু, বরং এইসব স্বচ্ছতা, স্পষ্টতা রূপায়ণের ফলেই আমরা পেয়ে যাই আমাদের তরুণ কবি বন্ধুটিকে, যিনি ধ্যানের সমস্ত আয়োজনকে করে তুলতে পারেন ‘কাচপোকা’র তুচ্ছতম জীবনের অনুষঙ্গ। অথবা ‘কাচপোকা’ কী কাচ নির্মিত পোকা? মূল্যবান কোনো দ্রব্য নয়? এই দ্বন্দ্ব আমাদের মুগ্ধচৈতন্যে প্রপঞ্চের গুঞ্জন তোলে।
Was this review helpful to you?
or
নায়েম লিটুর ‘কাচপোকা’ কাব্যগ্রন্থের ‘সম্পর্ক-শরীর-প্রেম’ অংশ দশটি কবিতা নিয়ে গ্রন্থিত। প্রকৃতি-নারী-প্রেম ও কাম অব্যর্থভাবে উঠে এসেছে সম্পর্ক আর শরীরকে কেন্দ্র করে। ...সূর্যোদয় বা সূর্যাস্তে পাখি কিংবা জোনাকির আলোর ঝিলিকে, হরিণের তুমুল চাঞ্চল্যে অবসিত হত আমাদের দেহ-মন। আর আমাদের স্বপ্নগুলো ছিঁড়ে-খুঁড়ে ঠাট্টা করতে থাকল শিকারির অদৃশ্য নিষ্ঠুর ফাঁদ। এ যেন তাদের চরম আনন্দ উপলক্ষ। সম্পর্ক-শরীর- প্রেম / ১ কবির কাছে রূপবতী নারী- যারা রাজকন্যা তুল্য। সে নারীদের কবির কাছে মনে হয় তীরের সবুজ ঝাউ বৃক্ষের মতো। নারীর স্পর্শ বঞ্চিত কবিকে ফিরে আসতে হয় ‘পূর্ববর্তী নরক জীবনে।’ পুরুষ উপলব্ধিতে নারীর চিরন্তন রহস্যময়তা এই কবিকেও রেহাই দেয়নি। নারীর মাঝে দেখেন কবি- পুরুষকে নিঃশেষ করায় নারীর নিষ্ঠুর আনন্দ। ফলে কবি পুরুষের স্বপ্ন আর দুরন্ত যৌবন মরে যায়। আর নারী হাসে তামাশার খিল খিল হাসি। নারীর এই আচরণে কবি সান্ত¦না খোঁজেন জীবনের কাছে, পেয়েও যান পুরুষের ‘উপযুক্ত প্রাপ্তি...’ ভেবে। ...ডুব দিয়েছিলাম ঠিকই কিন্তু সেখানে মানুষ আর মানুষ। হারিয়ে গেলাম সেই জনারণ্যে। কেউ আর তুলে আনল না আমাদের। একটা মুখ থেকে আরেকটা মুখের ভেদরেখা ততদিনে এক হয়ে গেছে তার কাছে... সম্পর্ক-শরীর- প্রেম / ২ এখানে সময়-প্রকৃতি-নারী এসেছে। কবি যেন অমরত্বের সন্ধান করেন রূপকথায় টিকে থাকা কিংবা পরিত্যক্ত না হওয়া সময়ের সন্ধানে। আধুনিকতার নিষ্ঠুরতাও উঠে আসে শাবল-ছেনির আঘাতে টেরাকোটার লিপিগুলো উপরে ফেলার চেষ্টায়। রাজপ্রাসাদের সে দেয়াল থেকে কবি চলে যান দিঘির জলে আর কামিনীর ঝাড়ে। কবিতাটির ২য় ধাপে কবির পুরুষোচিত কামবোধে প্রেমিকার নাভিমূলের পথ ধরে চলে যায় যোনির ভেতরে। ৩য় ধাপে কবি জানান সে পাতাল রহস্য উদ্ঘাটনে কবি ডুব দিয়েছিলেন সেখানে দেখেছেন মানুষেরই মুখ। সে নারীর কাছে পুরুষের মুখের ভেদরেখা এক হয়ে গেছে বলে কবির মনে হয়, তখন আমরা যারা নারী পাঠক তাদের মনে হয় কবি নারীকে করে তোলেন বহুগামী করে। আর সে বহুগামিতার অভ্যস্থতায় ভেদরেখা বিলুপ্ত হয়ে যায় নারীর কাছে। ...তবু আমাদের নারীগণ চিনে নিল নতুন লোমশ পুরুষালী বুক, সুদৃঢ় পেশল বাহু। পাল্টে গেল রতির ভঙ্গিমা, আবিষ্কার করল শীৎকারের নিঃশব্দ স্বরÑ আরো বেশি অনুভূতিময় শরীরী কসরত। আমাদের ঘুমন্ত শরীর রক্তে ভিজতে ভিজতে ছড়িয়ে পড়ছিল গোলাপের ঘ্রাণ। সম্পর্ক-শরীর- প্রেম / ৩ নারী ও কাম কবির উপলব্ধিতে উঠে আসে এ কবিতায়। যে পুরুষ সাহস খুঁজত নারীর গভীর আলিঙ্গনে, সে নারীরা খুঁজে নেয় পুরুষের পুরুষোচিত রূপ। রতি-শীৎকার-অনুভূতিময় শরীরী কসরত আর গোলাপ, রক্তের ঘ্রাণ কাম আর প্রবৃত্তির নেশাকে ব্যক্ত করে। আরও ব্যক্ত করে পুরুষ কবির নারীর কোমলতার সন্ধান- পাখির পালকের নরমতার আকাক্সক্ষায়। কিন্তু নারীর কঠোর আচরণ কসাইয়ের মতো মনে হয়। আমাদের স্বপ্নগুলো যদিও হয়ে উঠলো অনন্ত নৈরাশ্যেভরা ধাঁধা। অথচ কী চেষ্টাই না ছিল বুক ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে উঠে যেতে পাহাড়ের সে শিখরে। যেদিন পেরেছি মনে হল দেখিÑ এ কোন মৃত্যুকূপ।... সম্পর্ক-শরীর- প্রেম / ৪ এখানে কবির আরেক প্রবৃত্তির পরিচয় দেয়। অভিজ্ঞতা পূর্ব ও পরবর্তী কবিমানস উঠে আসে এতে। যে চূড়া কবিমনকে চুরমার করে দেয়, কবি বোঝে তা নিছক মৃত্যুকূপ। ‘বিশ্বাস হারানো পাপ’ বলে কবি যখন নিবৃত্ত হন না তখন বুঝি বহুদিনের সংস্কার কবির মগজে,অস্থি-মজ্জায় কিভাবে গেঁথে আছে। এবং তারই প্রকাশ ঘটেছে এ কবিতায়। এই ভাবা না ভাবার ঘোর কিংবা বাস্তবতা থেকে বের হতে পরিত্রাণ খুঁজতে আমরা ভয় পাই, যদিও জানি অন্ধকূপের বীভৎস ক্ষুধা ঠিকই গিলে ফেলবে আমাদেরÑ ফিরতে পারি বা না পারি... সম্পর্ক-শরীর- প্রেম / ৫ এবার কথা বলেন সম্পর্ক নিয়ে। সময় এবং সম্পর্কের নিষ্ঠুর আপেক্ষিকতা ধরা দেয় কবির চিন্তায় ও চেতনায়। আরও উঠে আসে ভীত মানুষের অসহায়ত্ব, জানা সত্ত্বেও অনিবার্যতার করালগ্রাস। তবে কি আমরাও রপ্ত করে ফেলেছিলাম নিঃসঙ্গ ভাঁড়ের দক্ষতা- যার আঙুলের এককটা ভঙ্গিমায় হুমহুম ভেঙে পড়ত সারি সারি দর্শক, ঘরে ফিরে যদিও ভুলে যায় তাকে যে যার মতো। অথচ সে লোক রাতে শুয়ে শুয়ে উত্তর খুঁজত নিজেরই কাছে- কবে তার নিজের হাসবার দিন... সম্পর্ক-শরীর- প্রেম / ৬ আধুনিক মানুষের যন্ত্রণা-ব্যথা আর আকস্মিকতায় জর্জরিত সময় কথা বলে এখানে-‘আমাদের চোখগুলো কি কোটরশূন্য হলো, না দৃষ্টি থেকেও দৃষ্টিহারা?’ নিঃসঙ্গ ভাঁড়ের ব্যথায় কবির অনুভূতির প্রাখর্য ঈর্ষণীয়ভাবে লক্ষণীয়-‘কবে তার নিজের হাসবার দিন...’ দেখা যায় একচিলতে আকাশ ছবির মতন। পচন লেগেছে ডানায় পালকে উড়তে না পারার ব্যথায়... একদিন ঠিক ঠিক পৌঁছে যাবে পাখিটির মড়া-শিকারির দুঃস্বপ্নের মাঝে। জেনে নিতে কতটা সুখ দিল শিকার... সম্পর্ক-শরীর- প্রেম / ৭ রূপক কবিতা। পাখি যেন নারীর প্রতীক হয়ে দেখা দেয়। মানুষ আর পাখিকে আলাদা করে কবির পৌরষ যেন মানুষ বলতে পুরুষকে বোঝান, যদিও পক্ষপাত পাখির মতন নারীর প্রতি। রবিন্সনের স্বপ্ন দর্শনে শোষিত ফ্রাইডের মতন নারী আসে মড়া পাখি হয়ে শিকারির দুঃস্বপ্নেÑ‘জেনে নিতে কতটা সুখ দিল শিকার...’ অথচ যে রপ্ত করেছে নিজের ভেতর অসংখ্য পৃথিবী লুকিয়ে রাখার ধূর্ততা-জেনেও আমরা পৌঁছতে চাই না সিদ্ধান্তে! এ সবই আমাদের আশৈশব প্রবণতা? যে প্রবণতায় আমরা খুঁজিÑ দীর্ঘ খরার পর প্রথম বৃষ্টির প্রশান্তি ছড়ানো একটা মুখ।... সম্পর্ক-শরীর- প্রেম / ৮ পুরুষের বোধে দেখেন নারীর ধূর্ততা। তবে এ নতুন নয়, ‘চর্যাপদ’এ দেখি সিদ্ধাচার্য দিনে কাকের ভয়ে ভীত নারীকে রাতে নির্বিঘেœ অভিসারে যেতে দেখেন। বড়ুচণ্ডীদাস দেখান ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে’র রাধা স্বামী আইহন আর শাশুড়ী-ননদের চোখ ফাঁকি দিয়ে অভিসারে যাচ্ছে। তাদেরই উত্তরসূরী কবি দেখেন নারীর ছলনা- যা নারীর বঞ্চনার দুঃখের চেয়ে বেশি প্রকট হয় কবির কাছে। অসংখ্য পৃথিবী লুকিয়ে রেখে যে নারী রক্তাক্ত হচ্ছে তা স্পর্শ করে না কবিকে। বরং স্বার্থপরেরই মতন কবি খোঁজেন নিজের প্রশান্তি, দেখতে চান শান্তি প্রদানকারী বনলতা সেনের মতো- ‘দীর্ঘ খরার পর প্রথম বৃষ্টির প্রশান্তি ছড়ানো একটা মুখ।’ ফিরে যান কবি নিয়তির কাছে, আস্থা-বিশ্বাসে নিয়তির উপর ভরসা করেনÑ‘একপেশে ধ্যানী মুহূর্তের সুখ’ এর জন্য। তবে কি প্রথম দিনই জানতে চূড়া ছুঁতে চাওয়া ক্লান্তিহীন এই অভিযান একদিন শেষ হবে পরস্পরের বুকে ছোরা চালনায়। একে অপরের প্রতি তীব্র ঘৃণায় ফিরিয়ে নিতে হবে মুখ আর মধ্যবর্তী সংলাপগুলো কোনো চিহ্নই রাখবে না কারো মনে। সম্পর্ক-শরীর- প্রেম / ৯ কবি প্রথমের জানতে চান দ্বিতীয় কারো কাছে, সে দ্বিতীয় অস্তিত্ব কোনো নারীর। কেন না তুমুল প্রেমের দিনগুলো তারা সাজাত, যা পরে সাজার মতন মনে হয়, মনে হয় সম্ভাব্য জোয়ারে মিশতে যাওয়া বালির প্রাসাদ- যা জীবনের প্রসাদ নয় বলেই ধারণা কবির। এ কবিতাতেও দেখি কবি নিয়তির কাছে সমর্পণ করেন নিজেকে,উপলব্ধি করেন সময়ের বাস্তবতাকে-হায়, আমাদের নাবিক নিয়তি? শুধু ঝড় আর ঝড়Ñ নোঙরের চোখ খুঁজেই পেল না সমুদ্রের তলÑ যে মাটি স্থিরতা দিতে পারতো জীবনের...’ নতুন নারীর বগলের ঘ্রাণ শুঁকতে শুঁকতেÑ পুরুষটি ব্যভিচারের কুৎসিত কালি লিপতে থাকে পূর্বতন নারীটির যাপিত জীবনে। আর পুরুষটির লোমশ বুকে মুখ ঘষতে ঘষতে নারীটি গালি দিতে থাকে আগের পুরুষটিকেÑ অক্ষম অশ্ব বলে... সম্পর্ক-শরীর- প্রেম / ১০ কামজ সম্পর্কের মাঝে অন্বেষণ করেন কবি সার্বজনীন সম্পর্ককেÑ‘এই দিনই ফিরে আসবে ভিন্ন নারী ভিন্ন পুরুষের সাথে...’। সম্পর্ক-শরীর-প্রেম অংশের ভাষা সহজ-সাবলীল। তবে কোথাও ইচ্ছাকৃত অসংলগ্নতা আছে বলে মনে হয়, যেমনÑ‘তবে কি প্রথম দিনই জানতে চূড়া ছুঁতে চাওয়া ক্লান্তিহীন এই অভিযান একদিন শেষ হবে পরস্পরের বুকে ছোরা চালায়।’ নাকি ইচ্ছাকৃতভাবে কবির বিরাম চিহ্নে বিরাম দেয়াÑতাও বিবেচনার বিষয়। সম্পর্ক-শরীর-প্রেম বিষয়ে কবির নিয়তিতাড়িত মন বারবার ধরা দেয়। এই আত্মসমর্পণ এবং আত্মপীড়ন এই অংশের কবিতাগুলোকে বিশিষ্ট করেছে। রোমান্টিক প্রবণতায় নায়েম লিটুর এ্যান্টি-রোমান্টিক আবহ কবিতাগুলোতে ভিন্ন-মাত্রা এনেছে নিঃসন্দেহে। কবিতাগুলোয় যে বর্তমান সময়ের বাস্তবতা দৃশ্যমান তা অস্বীকার করার উপায় নেই।