User login
Sing In with your email
Send
Our Price:
Regular Price:
Shipping:Tk. 50
প্রিয় ,
সেদিন আপনার কার্টে কিছু বই রেখে কোথায় যেন চলে গিয়েছিলেন।
মিলিয়ে দেখুন তো বইগুলো ঠিক আছে কিনা?
Share your query and ideas with us!
Was this review helpful to you?
or
শামসুজ্জামান খান মোটা দাগে লোকগবেষক হিসেবে বৈশ্বিকভাবে স্বীকৃত হলেও তাঁর লেখার বিষয়বস্তুর পরিধি বিস্তৃত, বৈচিত্র্যময়তাও ব্যাপক। এ বছর তাঁর ‘বাঙালির বহুত্ববাদী লোকমনীষা’ শীর্ষক অতি উল্লেখযোগ্য একটি প্রবন্ধ-সংকলন প্রকাশিত হয়েছে। বইটিতে বেশ কিছু অমীমাংসিত প্রশ্ন নিয়ে নাড়াচাড়া করেছেন প্রাবন্ধিক। সূচনা গদ্যটির শিরোনাম ‘বাঙালির সমাজ, সংস্কৃতি ও রাষ্ট্রচিন্তা’ সাম্প্রতিক প্রেক্ষাপটে খুব মূল্যবান পাঠ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। এখানে বাঙালির—হিন্দু-মুসলিম উভয় পরিচয়ে—জাতিগত ও মানবিক বিকাশের উৎসমূল অনুসন্ধান করা হয়েছে। সংস্কৃতি বিমূর্ত বিষয় হওয়ায় এবং ভারতীয় উপমহাদেশে একটা ব্যাপক সময় ধরে সংস্কৃতিচর্চার ধারা যথার্থ বিজ্ঞানমুখী না হয়ে অনুমানভিত্তিক হওয়ার কারণে বাঙালির যে দীর্ঘ প্রাক-ইতিহাস, সেটি এখনো পুরোপুরি আবিষ্কৃত না। শামসুজ্জামান খান পুরোনো প্রতিষ্ঠিত সত্য তুলে ধরার জন্য এই গদ্যখানা লেখেননি। প্রতিষ্ঠিত সত্যের সঙ্গে সঙ্গে নতুন গ্রহণযোগ্য সত্য মিলিয়ে বাঙালির সামগ্রিক বিকাশের ইতিহাসের নতুন ‘ডিসকোর্স’ তৈরি করেছেন তিনি। ১৬৬৬ সালের আগে বাংলা ছোট ছোট জনপদে বিভক্ত ছিল—একচ্ছত্র শাসনব্যবস্থা বা সর্বভারতীয় বাঙালি বলে কিছু ছিল না। প্রাবন্ধিক সাম্প্রতিক দুজন গবেষক মার্কিন অধ্যাপক রিচার্ড এম ইটন রচিত The Rise of Islam and Bengal Frontier এবং ভারতীয় গবেষক জহর সরকারের The Construction of the Hindu Identity in Medieval Western Bengal: the Role of Popular Custom সন্দর্ভের বিশ্লেষণ উল্লেখ করে জানাচ্ছেন, এই জনপদে তুর্কি এবং আফগান বিজয়ের পর পূর্ববঙ্গের ইসলামায়ন এবং রাঢ়দেশের হিন্দুয়ায়ন সমান্তরাল ঘটনা হয়ে দেখা দেয়। এখানে তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘কৃষিভিত্তিক আর্থসামাজিক জীবনব্যবস্থাই পূর্ববাংলার এবং রাঢ়বঙ্গের মানুষের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় জীবনকে নির্ধারণ করেছে।’ উল্লিখিত দুই গবেষকের উপস্থাপিত এই সিদ্ধান্তের ফলে প্রতিষ্ঠিত হয় যে, ‘পূর্ববাংলার ইসলামায়ন এবং রাঢ়বঙ্গের, বিশেষ করে বর্ধমান অঞ্চলে মুসলমান ও হিন্দুপ্রাধান্যের কারণ ধর্মগুরুদের প্রভাবে নয়, মূলত জীবনযাপনকে সহজ করে দেওয়া উৎপাদনব্যবস্থার জন্যই।’ প্রবন্ধের দ্বিতীয় অংশে বাঙালির ইতিহাসের আদিপর্ব নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। বিখ্যাত ইতিহাসবিদ নীহাররঞ্জন রায় তাঁর বাঙালির ইতিহাস: আদিপর্ব বইতে বাঙালির ইতিহাসের আদিপর্ব হিসেবে যে সময়টাকে চিহ্নিত করেছেন, তখন এই পূর্বাঞ্চল অনেকগুলো স্বতন্ত্র জনপদে বিভক্ত ছিল। ফলে সাহিত্যচিন্তক শিবনারায়ণ রায় আপত্তি তুলে বলেছেন, বাঙালির ইতিহাসের আদিপর্ব আরও অনেক পরে। প্রাবন্ধিক এখানে বলছেন, ‘কোনো জাতিসত্তাই আকস্মিকভাবে গড়ে ওঠে না। দীর্ঘকাল ধরে একটি দেশের জনসমাজে ধীরে ধীরে, ধাপে ধাপে পর্যায়ক্রমে ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতায় সেই দেশের মানসিক মনস্তাত্ত্বিক এবং আর্থসামাজিক ধারার বিকাশের সঙ্গেই জাতিসত্তার গঠনপ্রক্রিয়ার প্রথমে ভ্রূণাকারে পরে প্রত্ন পর্যায়ে আরও পরে সৃষ্টি পর্যায়ে সময়ের পরিক্রমায় একটা সুস্পষ্ট রূপ লাভ করে। বাঙালির ক্ষেত্রেও এমনটি ঘটেছে।’ তবে শিবনারায়ণ পাল যে বলছেন, বাঙালি জনগোষ্ঠীর বিকাশ মুসলমান আমলেই ঘটেছে, তার সঙ্গে প্রাবন্ধিক একমত পোষণ করেছেন। প্রাবন্ধিক বাংলার ২০০ বছরের স্বাধীন সুলতানি আমলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অসামান্য বিকাশের কথা উল্লেখ করে এই সময়টাকে বাঙালির প্রাথমিক নবজাগরণের কাল হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। অনেকেই বঙ্কিমচন্দ্রকে মুসলিমবিদ্বেষী হিসেবে চিহ্নিত করতে চান। প্রাবন্ধিক প্রবন্ধের পঞ্চম অংশে স্পষ্ট করে বলছেন, ‘তিনি (বঙ্কিমচন্দ্র) মোগলদের কিছু বিরোধিতা করলেও বাংলার সুলতানদের বিরোধিতা করেননি। ধারণা করা হয়, সুলতানেরা বাংলার ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন এবং স্বাধীন সুলতানি রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সে জন্যই তিনি তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেছেন।’ তবে বঙ্কিমচন্দ্র যে জীবনের শেষ দিকে এসে সমন্বয়বাদী এবং ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি জাতিসত্তায় বিশ্বাস করতেন—এ কথা বলা যাবে না বলেও উল্লেখ আছে তাঁর লেখায়। এখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যে মুসলিমবিদ্বেষী ছিলেন না, এ কথা বেশ জোর দিয়ে উচ্চারণ করে শামসুজ্জামান খান বলছেন, বাঙালি মুসলমান ও বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে বহু ক্ষেত্রে সমঝোতা ও সমন্বয় ঘটলেও একটি শক্তিশালী সমন্বিত বাঙালি জাতীয়তাবাদী ধারা গড়ে ওঠেনি। তাঁর কথার যথার্থতা আমরা বর্তমান সময়ের দিকে তাকালে দেখতে পাই। আমরা নিরেট বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্বপ্ন দেখলেও বাস্তবতা আমাদের দাঁড় করিয়েছে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের মুখোমুখি এনে। ফোকলোর নিয়ে তিনটি দীর্ঘ এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ স্থান পেয়েছে আলোচ্য সংকলনে। বাংলাদেশের ফোকলোর চর্চার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও রূপান্তরের ধারা এবং বাংলার জাগরণে লোকায়ত দর্শন ও লোকজসংস্কৃতির ভূমিকা নিয়ে এখানে গভীরভাবে আলোচনা করা হয়েছে। বইয়ের দ্বিতীয় অংশে লালন, হাসন, শাহ আবদুল করিম, জসীমউদ্দীন, চন্দ্রকুমারসহ লোকজসংস্কৃতি-সংক্রান্ত ১৩ জন লোকমনীষার ভাবনার ধরন ও মৌলিকতা নিয়ে সুলিখিত তথ্যপুষ্ট ১৩টি প্রবন্ধ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। জঙ্গিবাদের উত্থান নিয়ে আজ আমরা চিন্তিত, উদ্বিগ্ন। জাতীয় জীবনে এই সংকটকালে স্মরণে রাখতে হবে, বাঙালির জাতীয়তাবাদ ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ নয়, এ জাতির রক্তে ও দেহকোষে মিশে আছে বহুত্ববাদী চেতনা। সময়ের প্রাসঙ্গিক পাঠ / মোজাফফর হোসেন দৈনিক প্রথম আলো : http://www.prothom-alo.com/amp/art-and-literature/article/957871/সময়ের-প্রাসঙ্গিক-পাঠ