User login
Sing In with your email
Send
Our Price:
Regular Price:
Shipping:Tk. 50
প্রিয় ,
সেদিন আপনার কার্টে কিছু বই রেখে কোথায় যেন চলে গিয়েছিলেন।
মিলিয়ে দেখুন তো বইগুলো ঠিক আছে কিনা?
Share your query and ideas with us!
Was this review helpful to you?
or
#রকমারি_রিভিউ_প্রতিযোগ_ডিসেম্বর ১. এই পৃথিবীর দু'টো মানুষ কখনও এক নয়। তাদের মাঝে বাহ্যিক পার্থক্য যেমন আছে, তেমন তারা মানসিক ভাবেও আলাদা। এমনকি দু'টো মানুষের মাঝে বাহ্যিক মিল থাকলেও মননে, রুচিতে, চিন্তায় পার্থক্য থাকবেই। শরীর, মনের মতো পার্থক্য থাকে মানুষের যৌনতায়। ২. সময়টা গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি। সে সময়ে টেলিভিশন কেবল জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। কিন্তু প্রান্তিক মানুষের কাছে পৌঁছতে তখনও অনেক বাকি। মানুষের বিনোদন কেবল নয়, ভরসার নামও রেডিও। আকাশবাণীতে কাজ করে অনিকেত। অনুষ্ঠান বরাবরে তার কাছে বিভিন্ন চিঠি আসে। সেসবের মাঝ থেকে কৌতূহল উদ্দীপক অনেক চিঠি অনিকেত জমিয়ে রাখে। সেসব চিঠিতে কেউ পাঠায় অদ্ভুত সব কবিতা, আবার অনেক কিশোর লিখে পাঠায় তাদের বয়ঃসন্ধি সময়ের অজ্ঞানতা, জটিলতা। যখনকার কথা বলা হচ্ছে, তখন রেডিও, সাহিত্যকে খুব পূত পবিত্র মনে করা হতো। তাই অনিকেত চাইলেও এমন একটা রেডিও অনুষ্ঠান করা সহজ ছিল না যেখানে অনিকেত এইসব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে। কিন্তু পরিবর্তনের হাওয়া হয়ত বইতে শুরু করেছিল তখনই। একটা অনুষ্ঠান করতে সমর্থ হয়েছিল অনিকেত। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, সাহিত্যিক, সমাজ বিশেষজ্ঞ নিয়ে গঠিত 'টীম' উত্তর দিয়েছিল অনেক প্রশ্নের। আর এই অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়েই অনিকেতের সামনে একটি নতুন বিষয় আসে, ঠিক নতুন না, তবে কাজের জন্য নতুন। সমকামিতা। ৩. অনিকেতের বাড়ির কাজের লোক 'দুলালের মা'। সেই দুলাল প্রথমে সব্জি এবং পরে মনোহরি পণ্য নিয়ে সাইকেলে ঘুরে বিক্রি করতো। দুলালের কথাবার্তা, চলন ছিল মেয়েলী। দুলাল একদিন হারিয়ে গেলো। অনেক বছর পর দুলালকে আহত অবস্থায় যখন পথের ধারে পাওয়া যায়, তখন তার ঊরুসন্ধিতে তার পুরুষত্বের চিহ্নটি ছিল না। প্রশ্ন হলো, 'লিঙ্গ-চিহ্ন'ই কি একজন মানুষকে 'পুরুষ' কিংবা 'নারী' হিসেবে বাঁচতে বলে? সামাজিকভাবে কিংবা শারীরবিদ্যার ভাষায় হয়ত তা-ই। যার লিঙ্গ আছে, সে পুরুষ, নারীর থাকবে যোনি। কিন্তু, প্রকৃতির খেয়ালে এমন কিছু মানুষ এই মাটিতে বসবাস করে, তাদের বাহ্যিক শরীর থেকে তাদের মন আলাদা। পুরুষের চিহ্নধারী একজন হতে পারেন মনে মনে নারী। কিংবা কোন শরীরে নারীত্বের চিহ্ন নিয়ে মনে মনে কেউ হতে পারে পুরুষ। অর্থাৎ কেবল শরীরের গঠন নয়, মনই বলে সে নারী, না পুরুষ। দুলালের ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছিল। তার মন তাকে বলেছিল সে নারী। দুলাল তাই বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিল। কেন? আমাদের সমাজে মানুষকে বিচার করা হয় বাহ্যিকতা দিয়ে। সেখানে মনের কোন দাম নেই। অন্তর্দহন কেউ দেখে না। সমাজ ঠিক করে দিয়েছে পুরুষ হবে মারদাঙ্গা, নারী হবে ব্রীড়াবতী। তাই কোন পুরুষের মাঝে কমনীয়তা থাকলে তাকে 'লেডিস', 'মাইগ্যা' বলে পরিচিতি দেওয়া হয়। আর যদি মন থেকে সে হয় পুরুষের প্রতি আকর্ষিত, কিংবা তার মাঝে পৌরুষের চিহ্ন কম থাকে তবে তাকে 'হিজড়া' উপাধি দেওয়া হবে। ৪. হিজড়া শব্দে আজকাল অনেকের আপত্তি আছে। 'তৃতীয় লিঙ্গ' বলে তাদের পরিচয় করাতে চান। কিন্তু 'হিজড়া', 'বেশ্যা' আসলে কোন খারাপ শব্দ নয়, এগুলো গালিও নয়। এসব শব্দকে গালি হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু কারা হিজড়া? মানুষের এই সমাজ বড় অদ্ভুত। এখানে বহু ধরনের মানুষ বাস করে। যাদের অনেকের সম্পর্কে আমরা তেমন কিছুই জানি না। হিজড়া সম্প্রদায় এমনই। আমরা তাদের সম্পর্কে জানি না, না জেনে ভয় পাই। সমাজ থেকে আপাত বিচ্ছিন্ন এই মানুষেরাও এই ভয়কে পুঁজি করেই নিজেদের গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থাটা করে নেন। কেউ হিজড়া কেন হয়? অনেক রকম মত প্রচলিত আছে। কোথাও বলা হয় ঋতুমতী নারীর সঙ্গে সহবাসে যদি সে গর্ভবতী হয় তাহলে 'হিজড়া' সন্তান হয়। কিন্তু আসলে তারা কেমন হয়? তাদের লিঙ্গ চিহ্ন কি? সমকামিরাও কি হিজড়া? ৫. এই সব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন স্বপ্নময় চক্রবর্তী। অনিকেতকে দিয়ে গল্প শুরু করে তিনি আমাদের নিয়ে গেছেন হিজড়াদের বাসস্থান 'খোল'-এ। সেখানে তারা কীভাবে বাস করে, তাদের সমাজের নিয়মের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। অনিকেতের পরিচয় হয়েছিল কিছু সমকামীর সাথে, যারা একটি পত্রিকা প্রকাশ করে। সেখান থেকেই অনিকেত জেনেছিল, সমকামী হলেই সে 'লেডিস' হয় না। একজন সমকামী হতে পারে একজন সমর্থ পুরুষের মত। সমকামের বিষয়টা শরীরে থাকে না, থাকে মনে। তারাও সাধারণ মানুষের মতো চার হাত পায়ের মানুষ। পার্থক্য কেবল তাদের যৌন রুচিতে। এখানেই কেউ তাকে বলেছিল, "গোলাপ কেবল গোলাপি হবে এমন তো নয়। গোলাপ তো হলুদও হয়"। অর্থাৎ মানুষ সবাই এক হবে না, কিছু মানুষ আলাদা হয়। মানুষের মনে রয়েছে অনেক গলি ঘুঁজি। সেসবে ভ্রমণ করার মতো জটিল কাজটাই লেখক করেছেন এই উপন্যাসে। একজন পুরুষ কেন একজন পুরুষের প্রতি আকর্ষিত হবে? এটা কি কেবল মানসিক? ৬. না, কিছু শারীরিক বিষয়ও। ক্রোমোজোমের স্বাভাবিক বিন্যাসের ব্যত্যয়ের জন্য একজন পুরুষের মাঝে পৌরুষ কম হয়ে তার ভেতরে নারীত্ব জেগে উঠতে পারে। নারীর ক্ষেত্রে হতে পারে একই ঘটনা। এই পৃথিবী তার বুকে অনেক রহস্য নিয়ে বসে আছে। সেখানে রহস্য মানুষের শরীরেও। তাই কোন পুরুষের জন্ম হয় অপরিণত লিঙ্গ নিয়ে। হরমোনের স্বাভাবিক প্রবাহের ব্যত্যয়ের কারনে সে নিজেকে নারী হিসেবে ভাবতে থাকে। আকর্ষিত হয় পুরুষের প্রতি। সমাজ যখন তাকে মেনে নেয় না, সে চলে যায় সমাজ থেকে দূরে। আমরা এই উপন্যাসে দেখতে পাই শরীর ও মনের বৈচিত্র্য। যে বৈচিত্র্য, প্রকৃতির খেয়ালে সৃষ্টি, অথচ সে কারনেই মানুষগুলো সমাজচ্যুত। নিজেরা দোষ না করেও তারা দোষী। কখনও শরীর তাদের ধাওয়া করে, কখনও মন। ছেলেবেলার বন্ধু মঞ্জুকে স্নান ঘরে ভোগ করতে চেয়েছিল অনিকেত। সেই মঞ্জুর তিরস্কার বয়ে বেড়িয়েছিল অনিকেত, বহুদিন। অনিকেতের স্ত্রী শুক্লা কোনদিন মা হতে পারেনি, কেননা ডিম্বাশয় বাদ দিতে হয়েছিল তার। পরবর্তীতে বিছানায় পুতুল হয়ে পড়ে থাকতো শুক্লা। বহুদিন পর মঞ্জুর সাথে দেখা হয়ে অনিকেত জেনেছিল, মঞ্জুও বিছানায় কাঠ হয়ে পড়ে থাকতো। ছেলেবেলায় বহুবার যৌন হয়রানির শিকার হয়ে মঞ্জু এমন হয়ে গিয়েছিল। তবু সন্তান ধরতে পেরেছে সে। কিন্তু, তার ছেলে পরিমল সমকামী। ৭. পরিমল নিজেকে নারী ভাবে। নারী হিসেবেই নিজেকে সে একটু একটু করে গড়ে তুলেছে। নিজের নাম রেখেছে সে পরি। মঞ্জুর ছেলে পরিকে দিয়ে নতুন সময়ের শুরু। '৯৫ থেকে অনেকটা সময় পেরিয়ে এসেছি আমরা অনিকেতের সাথে। পৃথিবী বদলে যাচ্ছিলো খুব দ্রুত। সেই সঙ্গে বিজ্ঞান, সামাজিক বিজ্ঞান আর মূল্যবোধের পরিবর্তে আমরা বুঝতে শুরু করেছি যে সমকামীতা প্রকৃতির বৈচিত্র্যের একটা অংশ। ইন্ডিয়ান পেনাল কোড যাকে 'ক্রিমিনাল অফেন্স' বলেছিল, পশুমেহনের সঙ্গে তুলনা করেছিল, আসলে তা ভুল। এমনকি সমকামী মানুষেরা মানসিক ভারসাম্যহীন কিংবা বিকৃত যৌনতার অধিকারী, সে ধারনাও ভুল। লেখক আমাদের একটি ভ্রমনে নিয়ে বেড়িয়েছিলেন, যে ভ্রমণের গাইড অনিকেত। আকাশবাণীতে বহুদিন চাকরি করা স্বপ্নময় চক্রবর্তী আমাদের অনিকেতের মাধ্যমে নিয়ে গেছেন একটা সময়ে যেখানে মানুষ কিছু সংস্কার, কিছু অন্ধকার মনের মধ্যে নিয়ে বেঁচে ছিল। যেখানে আপাত স্বাভাবিক মানুষদের ভিড়ে অন্যরা লাঞ্ছনার স্বীকার হতো। অনেক রকমের মানুষই আছে। লেখক তাদের মাঝ থেকে এক ধরনের মানুষকে বেছে নিয়েছেন। অথচ এই উপন্যাস কেবল সমকামী কিংবা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের নিয়ে নয়। তাদের সঙ্গে সঙ্গে আছে ইতিহাস, উপকথা, পুরাণ, রূপকথা, বিজ্ঞান। এই উপন্যাস যেমন দুলাল কিংবা পরির কথা বলে, তেমনি এই উপন্যাস অনিকেত, শুক্লা, মঞ্জুর কথাও বলে। নব্বইয়ের দশক থেকে ২০১০/১১-র বদলে যাওয়া কলকাতার কথাও বলে। কিন্তু এরই মাঝে, স্বপ্নময় চক্রবর্তী মূল স্রোতে রেখেছেন দুলাল, পরি, অলোকদেড় মতো সমকামী, রুপান্তরকামী মানুষদের। স্রেফ গপ্পো নয়, লেখক বারবার তাদের মনের কথা তুলে আনতে চেয়েছেন। আমাদের বার বার মনে করিয়ে দিতে চেয়েছেন এরা আসলে আমাদেরই মতো মানুষ। সুখ দুঃখ, প্রেম ভালোবাসা, আশা আকাঙ্ক্ষা, ক্ষুধা তৃষ্ণা নিয়ে বেঁচে থাকা জীবন। ছয়শত পৃষ্ঠার এই বিশাল বইকে কয়েকটা কথায় ব্যখ্যা করে বোঝানো সম্ভব না। তবে এটুকু বলতে পারি, অনেক ভুল ধারনা ভেঙে দিতে সক্ষম এই বই। 'হলদে গোলাপ' পড়তে পড়তে কখনও শিউরে উঠতে হবে, কখনও অবাক হতে হবে, কখনও মমরে গিয়ে বিঁধবে কিছু কথা। এমন অসাধারণ একটা বইয়ের জন্য লেখককে শ্রদ্ধা জানাতেই হয়।