1 verified Rokomari customers added this product in their favourite lists
এই যে পাঠক হিসেবে বইটি আপনি হাতে তুলে নিলেন; ধরে নেই সুদীপ্ত সালাম আপনার অচেনা। কেবল নামটি নয়, মানুষটিও। আপনার জানা নেই যে, সুদীপ্ত সালাম একজন আলোকচিত্রশিল্পী, সাহিত্যিক এবং গণমাধ্..
TK. 290TK. 218 You Save TK. 72 (25%)
Product Specification & Summary
এই যে পাঠক হিসেবে বইটি আপনি হাতে তুলে নিলেন; ধরে নেই সুদীপ্ত সালাম আপনার অচেনা। কেবল নামটি নয়, মানুষটিও। আপনার জানা নেই যে, সুদীপ্ত সালাম একজন আলোকচিত্রশিল্পী, সাহিত্যিক এবং গণমাধ্যমকর্মী। তাহলে কায়েসের অজ্ঞাত লাশ ছোটোগল্পের বইটি আপনার বা আপনার মতো অনেকের কাছে তার নামের মতোই রূপকধর্মী। প্রচ্ছদে বইয়ের নামটি দেখে যেমন আমাদের প্রশ্ন জাগে লাশটি যদি কায়েসেরই হয়, তবে সেটা অজ্ঞাত হয় কী করে? আর যদি অজ্ঞাতই হবে, তাহলে গল্পকার একটি সুনির্দিষ্ট নাম কেন নির্বাচন করলেন?
আমাদের শনাক্তকরণের চিরায়ত ব্যাকরণ আচমকা ধাক্কা খেলে নামগল্পটির কাছে হাঁটুমুড়ে বসতে পারি। যে সত্যকে আমরা এড়িয়ে চলতে ভালোবাসি, খানিকটা ইচ্ছে করেই; যে স্মৃতিগুলো আমরা বাক্সন্দী করে রেখেছি, কতগুলো নির্দিষ্ট ছুটির দিন ছাড়া যাদের সঙ্গে আমাদের দেখা হয় না; ক্যালেন্ডারের যে তারিখগুলো আমাদের কাছে শুধুই উদযাপন কিংবা অতীত দিনের কথকতা কায়েস সে সময়ের মানুষ। এমনকি তার লাশটিও। কিন্তু কায়েসের লাশ শনাক্তকরণের যে অপারগতা কী আশ্চর্য! তা আজও সমানভাবে সক্রিয়। সাহস তাহলে ঐতিহাসিক, কেবল ভীরুতাই প্রাত্যহিক! আজও কত কায়েস, কত কায়েসের লাশ রয়ে গেছে অজ্ঞাতে। আমাদের উদযাপনকেন্দ্রীক রাষ্ট্র কিংবা অধ্যাপনানির্ভর ইতিহাস তা খুঁজতে আগ্রহী নয়। লেখক সুদীপ্ত সালামের বুকপকেটে আমরা কায়েসের যে পরিচয়পত্রটি পাই, আদতে তা একটি রাষ্ট্রের জন্মসনদ। রূপান্তরের এ গানটি গল্পকারের নিজস্ব।
আখ্যানের সরলতার মধ্যে বক্তব্যের রূপান্তরধর্মীতা সুদীপ্ত সালামের গল্পের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। আপাতদৃষ্টে মনে হয়, গল্পের আখ্যানগুলো ততটাই সরল যতটা সরল হলে পাঠক বিরতিহীন পড়ে যেতে পারেন। কিন্তু সরল আখ্যানের খানিকটা পাঠের পর, প্রায় প্রতিটি গল্পের ক্ষেত্রেই, ভাবনাগুলোর কতগুলো স্তর-উপস্তর নির্মিত হতে থাকে। যেমন: বীজ গল্পটির কথাই ধরা যাক। বর্তমানে আমরা যে সমাজব্যবস্থার অংশ তাতে অধিকাংশ পাঠকই এ গল্পের সঙ্গে নিজেদের মেলাতে পারবেন। গল্পটি পড়ে অনেকে হয়ত আবিষ্কার করবেন, তার নিজের ভাবনাগুলোও শফিকের শাশুড়ির মতো। কেউ কেউ হয়ত মনেও করেন, এ ধরনের ভাবনায় কোনো দোষ নেই। না, গল্পকারও কোনো সিদ্ধান্ত দেননি। গল্পটি শেষ করতে করতে আমার অন্তত মনে হয়েছে, শফিকের বিষণ তার চেয়েও কথা শেষ করার পর তার শাশুড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে না-পারাটুকুই এ গল্পের মূল। প্রায় একইধরনের প্রতিক্রিয়া দেয়া যেতে পারে দেয়ালের দিকে মুখ ও হিউম্যানয়েড মানুষ গল্প দুটোর ক্ষেত্রে। বিন্যাস যেখানে বক্তব্যে পাল্টে যাচ্ছে। এ রূপান্তর স্বতঃস্ফ‚র্ত এবং পাঠকের দিক থেকেই তৈরি হয়। তার মনোজগতের কম্পাসটি ঘুরে যায় গল্পে অনুপস্থিত তৃতীয় কোনো বক্তব্যে। কিংবা ধরা যাক রায়ান গল্পটি যেখানে রূপান্তরের চেয়েও গল্পকারের রূপক ব্যবহারের শক্তিটুকু টের পাওয়া যায়। গল্পের রায়ান কি বোকা, নিঃসঙ্গ? টুকিনাদের পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে রায়ানকে বুঝতে পারি না আমরা। কিংবা পারি, কিন্তু স্বীকার করতে ভয় পাই।
ইতিহাসকে প্রেক্ষণে রেখে যে কোনো মাধ্যমে শিল্প সৃষ্টি করা কেবল কঠিনই নয়, ঝুঁকিপূর্ণও বটে। একদিকে থাকতে হয় ঐতিহাসিক তথ্যের কৌমার্য রক্ষার শ্রম, অন্যদিকে কষ্টিপাথরে যাচাই করতে হয় ন্যারেটিভের বিশুদ্ধতা। মুশকিল হলো, শেষপর্যন্ত এ শ্রমের কোনোটাই পাঠকের হাতে তুলে দেয়া যায় না। তাহলে পাঠক বলবেন, প্রবন্ধ লিখলেই হতো, গল্প লেখার কী প্রয়োজন? বোধ করি এ কারণেই বিশ^সাহিত্যেই অধিকাংশ ইতিহাসকেন্দ্রীক শিল্প হয় তথ্য-ভারাক্লান্ত, নাহয় সত্য-তথ্য-বিচ্যুত। এ গল্পগ্রন্থে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটকেন্দ্রীক কয়েকটি গল্প আছে। ‘কয়েকটি’ শব্দটি আমি সচেতনভাবেই ব্যবহার করেছি। কারণ, ইতিহাসের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে গল্পকার সুদীপ্ত সালামের আখ্যান নির্বাচন আর ভাষার আগুন তাতিয়ে তাতে সাহিত্যের সৌধ নির্মাণ দুটো সম্পূর্ণ আলাদা মনে হয়েছে আমার কাছে। যখন ভাঙে ভয়ের দেয়াল গল্পে আমরা সোবহানের যে জন্মান্তর দেখি ইতিহাস সেখানে ফুটনোট; কিন্তু দেশভাগের আগের ভাগ কিংবা কৃষ্ণচ‚ড়া রঙের শার্ট গল্প দুটোতে ইতিহাসই আখ্যানের সঞ্চারপথ তৈরি করেছে। বোধ করি এজন্যই যখন ভাঙে ভয়ের দেয়াল গল্পে আমরা সোবহানের মাধ্যমে পরিপাশর্কে চিনতে পারি; অথচ বাকি দুটো গল্পেই বিনয় বাবু কিংবা জুননু কেউ আমাদের কাতর করে না বরং তারা যে বার্তা আমাদের জন্য বয়ে আনেন, তাতে আমরা তীব্রভাবে সংক্রমিত হই। সুদীপ্ত সালাম একজন আলোকচিত্রশিল্পী বলেই জানেন, কীভাবে ফ্রেমে রাখা একটি দৃশ্যকেও কেবল বার্তাবাহকের ভ‚মিকায় সীমাবদ্ধ রাখা যায়; আবার ফ্রেমে না-থাকা দৃশ্যকে কী করে গড়ে তোলা যায় মূল বক্তব্য হিসেবে।