Category:রচনা সংকলন ও সমগ্র
এবং আরো কিছু রশীদ করীম কবিতার সঙ্গে রশীদ করীম-এর প্রেমটা আগে থেকেই ছিল। যদিও তিনি প্রথম জীবনে অন্যান্য বাঙালী সংবেদনশীল মানুষের মতো কবিতা লিখেছেন বলে শোনা যায়নি, ছোটগল্প লেখার ম..
বর্তমানে প্রকাশনীতে এই বইটির মুদ্রিত কপি নেই। বইটি প্রকাশনীতে এভেইলেবল হলে এসএমএস/ইমেইলের মাধ্যমে নোটিফিকেশন পেতে রিকুয়েস্ট ফর রিপ্রিন্ট এ ক্লিক করুন।
এবং আরো কিছু রশীদ করীম কবিতার সঙ্গে রশীদ করীম-এর প্রেমটা আগে থেকেই ছিল। যদিও তিনি প্রথম জীবনে অন্যান্য বাঙালী সংবেদনশীল মানুষের মতো কবিতা লিখেছেন বলে শোনা যায়নি, ছোটগল্প লেখার মাধ্যমেই শুরু হয়েছিল তার সাহিত্যিক-জীবন, পরে ক্রমশ: উপন্যাস লেখায় সিদ্ধহস্ত হন এবং ক্ষেত্রেই দেখালেন চূড়ান্ত সফলতা, কিন্তু যখন তিনি উপন্যাস লেখার ফাঁকে ফাঁকে মননশীল প্রবন্ধ রচনা করতে থাকলেন একের পর এক, তখনই প্রকাশ পেল কবিতার প্রতি তার প্রেম কতোটা গভীর, একনিষ্ঠ এবং পরিব্যপ্ত। কবি আবুল হোসেন, বন্ধু শামসুর রাহমান, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বুদ্ধদেব বসু এবং রবীন্দ্রনাথের কবিতা নিয়ে তিনি একাধিক প্রবন্ধ লিখেছেন, রবার্ট ফ্রস্ট এবং স্টিফেন স্পেন্ডার-এর দু’চারটে কবিতা অনুবাদও করেছেন স্বচ্ছন্দ এবং সাবলীলতায়। তা সত্ত্বেও তিনি সারাজীবন কবিতা লিখেননি বা লেখবার চেষ্টা পর্যন্ত করেননি, কিন্তু শেষ জীবনে এই কবিতাই হয়ে উঠেছিল তার পরম আশ্রয়। বলা যায় কবিতাকে অবলম্বন করেই তিনি স্বপ্ন-আশার খড়কুটো আঁকড়ে ধরতে চেয়েছেন, নিজের সৃষ্টিশীলতার ঘটিয়েছেন প্রকাশ। আমি এখানে তার শেষ জীবন বলতে সুনির্দিষ্টভাবে বোঝাতে চেয়েছি, ১৯৯২ সালের ২০ নভেম্বর থেকে ২০১১ সালের ২৬ নভেম্বরের সময়কালকে। কড়ে গুণলে যা আসে সেই ১৯ বছর তিনি একটানা বিছানায় শয্যাশায়ী ছিলেন। ১৯৯২ সালের ২০ নভেম্বর অকস্মাৎ মাইল্ড স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে হারিয়ে ফেলেছিলেন লেখালেখির ক্ষমতা, চলবার শক্তি এবং মস্তিষ্কের কার্য-সক্ষমতা। এই চরম বিপর্যস্ত জীবনেও ডিকটেশনের মাধ্যমে আত্মজীবনী গ্রন্থ জীবন মরণ লিখেছেন। এরপর ক্রমশ ডিকটেশন দিয়ে লেখার ক্ষমতাও হারিয়ে যায়, তখন কবিতা এবং একমাত্র কবিতাই হয়ে উঠে সৃজনশীলতার মাধ্যম। হাতের কাছে পত্রপত্রিকা পেলে সেখানেই লিখে রাখতেন দু’তিনটি মনে আসা কবিতার চরণ। পরে খাতায় পূর্ণাঙ্গভাবে লিখে ফেলতেন ছন্দের পয়ারে নিজের সেই অনুভূতি। শেষজীবনে লেখা এসব কবিতার মধ্যে মৃত্যু ভাবনা, জীবনকে ফিরে দেখা এবং সামনে যা দেখছেন সেসব বিষয় নিয়ে তার মনের ক্রিয়া প্রকাশ পেয়েছে। মূলত দৈনিক জনকন্ঠ এবং দৈনিক প্রথম আলোতেই প্রকাশিত হতো তার কবিতাসমূহ। এসব কবিতা পাঠে বোঝা যায় তার শেষ জীবনের মানসিক অবস্থাকে। যে মানুষটি একদিন ছিলেন বড় এক তেল কোম্পানির উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, কর্মচাঞ্চল্যে মেতে থাকতেন সহকর্মীদের সঙ্গে, আড্ডায় সরব হতেন কখনো পত্রিকার সম্পাদকের কক্ষে, কখনো আবার বাসায় সাহিত্যের আসর জমিয়ে রাখতেন উচ্চ কন্ঠে, কখনো বা জাতীয় কোনো আয়োজনে বইতেন পৌরহিত্যের ভারÑ তার কি ভালো লাগার কথা সারা দিনমান ঘরের ভেতর শুয়েবসে কাটাতে? তাই এলেবেলে চিন্তা কবিতায় লিখেন, ‘কপাট খোলা থাকে,/ ভাবি যদি কেউ আসে।/ কতকাল একা চুপচাপ বসে/ থাকা যায়।/ দ্বিপ্রহর কেমন শূন্য/ খাঁ খাঁ করে,/ এত বড় নিদাঘ/ তাও করে হাহা/ কোনো কোনো পথিক/ সামনের পথ দিয়ে/ হেঁটে যায়।/ তখন নিস্তব্ধ গৃহ/ কিছুটা মুখর মনে হয়।/’ নিঃসঙ্গ মানুষটার প্রত্যাশামতো কেউ যখন আসে না, তখন সামনের পথ দিয়ে কারো হেঁটে যাওয়ার আভাস শুনলেই তার নিস্তব্ধ গৃহ মুখর হয়ে উঠে, এই চরণের মধ্য দিয়ে একদিকে যেমন তার হৃদয়ের আশানিয়া স্বপ্নময়তার পরিচয় মেলে তেমনি কবিতাও আর সাধারণ থাকে না, খুঁজে পায় ভিন্ন ব্যঞ্জনা। বন্ধুবৎসল আড্ডাপ্রিয় মানুষটি বন্ধুদের অভাবও বোধ করতেন প্রচণ্ডভাবে। বন্ধুত্ব কবিতায় আক্ষেপ, ‘সে সব সোনালি দিন/ বিলীন হয়ে গেছে।/ দিনকাল সময় সব বদলে গেছে,/ বন্ধুদের একটু একটু করে/ অচেনা মনে হয়।/ নতুন বৃত্তে নতুন বলয়ে/ নতুন অবয়বে ঘুরে বেড়ায়।’ গৃহবন্দীত্বের দিনগুলোতে তার মায়ের কথা মনে পড়ে, বাবার কথা মনে পড়ে, ফেলে আসা কলকাতা জীবনের টুকরো টুকরো শৈশব এসে ধরা দেয়, মনে পড়ে সাদাত বলে একটা ভাই ছিলÑ পুকুরে ডুবে মরে গেছে, গৃহসেবিকা হেলেনার আড়াই বছরের ছেলেটার মধ্যে খুঁজে পান সেই অকালে হারিয়ে যাওয়া ভাইকে, ‘আড়াই বছরের ছেলেটি’ কবিতায় লিখেন, ‘ফুটফুটে দেখতে, নাম তার আরমান,/ আমার কামরায় এসে/ হাত ধরে টানাটানি করছে/ ভাইয়া ও ভাইয়া সকাল হয়ে গেছে/ আমি খানিক চুপ থাকি/ মনে ভাবি এত দিন পরে/ সাদাত কি এলো ফিরে!’ রশীদ করীম-এর এসব কবিতাগুলি গ্রন্থভুক্ত হয়নি, হয়তো কবিতার বইয়ের স্বপ্ন তার মনেও ছিল, তিনি চাইতেন এসব কবিতা গ্রন্থভুক্ত হোক, পড়ুক পাঠক, এর প্রমাণ হলো রশীদ করীমকে নিয়ে যখন আমি কথক নামের একটি পত্রিকা প্রকাশ ও সম্পাদনা করি, তখন তিনি সেখানে কবিতাগুলো সংবদ্ধ করতে বলেছিলেন এবং তা আমি করেওছিলাম। রশীদ করীম-এর গদ্যের অনুরক্ত পাঠকরা শুনলে নিশ্চয়ই খুশি হবেন যে, কবিতার মতোই তার বেশ কিছু প্রবন্ধ এখনো গ্রন্থভুক্ত হয়নি। উপন্যাস লেখার পাশাপাশি রশীদ করীম একটা পর্যায়ে এসে দু’হাতে বেশ গদ্যও লিখতে শুরু করেছিলেন। স্বাধীনতার আগে ইংরেজিতে আলী বাবা ছদ্মনামে কলাম লিখেছেন মর্ণিং সান পত্রিকায়। স্বাধীনতার পর কলাম লিখতে শুরু করেন সাপ্তাহিক বিচিত্রার মাধ্যমে। বিচিত্রাতে তার লেখা মানুন আর নাই মানুন শিরোনামের কলামটি এক সময় প্রচুর জনপ্রিয়তাও লাভ করেছিল। বিচিত্রার পর সাপ্তাহিক সচিত্র সন্ধানীতে মানুন আর নাই মানুন-এর বেশ কয়েকটি পর্ব প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়াও তিনি কলাম লিখেছিলেন দৈনিক বাংলায় লেখা লেখা খেলা, দৈনিক বাংলার বাণী, দৈনিক বাংলাবাজার পত্রিকা এবং প্রতিশ্রুতি নামের সাপ্তাহিকে। এসব কলাম ছাড়াও দেশবিদেশের সাহিত্য-শিল্প-সংস্কৃতি নিয়ে বিভিন্ন দৈনিক ও সাপ্তাহিকে নিয়মিত প্রবন্ধ, নিবন্ধ রচনা করেছেন। বিচিত্র বিষয়ে লিখেছেন তিনি। শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি তো আছেই সিনেমা, খেলা, রাজনীতি কোনকিছুই বাদ পড়েনি। অতি সাধারণ বিষয়ও অসাধারণ হয়ে উঠেছে তার লেখনীতে। লেখালেখি জীবনের শেষদিকে রাজনীতি এবং সামাজিক সমস্যামূলক বিষয় নিয়ে লেখার প্রতি ঝোঁক বেশ লক্ষ্য করা গেছে। বিশেষ করে সাপ্তাহিক প্রতিশ্রুতির লেখাগুলো ছিল বেশ তীক্ষè, শানিত এবং সাহসী। উল্লেখ্য সে সময়ে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র বিরোধী সরকার ছিল ক্ষমতায় এবং মুক্তিযুদ্ধ এবং বাঙালি চেতনাবোধের ওপর একের পর এক আঘাত আসছিল। তিনি স্বৈরাচার এবং স্বাধীনতা বিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে সব সময়ই সোচ্চার ছিলেন। এ সময়ে দৈনিক বাংলার বাণীতেও নিয়মিত কলাম লিখেছেন। যার অধিকাংশর বিষয়ই ছিল সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যা ও সংকট নিয়ে। তিনি সে সমস্ত প্রবন্ধ নিবন্ধে সমালোচনার পাশাপাশি সংকট উত্তরণেরও পথ দেখাতে চেয়েছেন। এই যে এতোসব প্রবন্ধ নিবন্ধ লিখছেন রশীদ করীম, গ্রন্থভুক্ত করার সময় কিন্তু বেশ সতর্কতা অবলম্বন করেছেন। প্রবন্ধগুলো মান উত্তীর্ণ হয়েছে কিনা, বিষয়াবলীর মধ্যে সমন্বয় আছে কিনা ইত্যাদি ইত্যাদি। বেশ ঝাড়াই বাছাই করে ১৯৮৯ সালের এপ্রিলে প্রকাশিত হয় তার প্রথম প্রবন্ধের বই আরেক দৃষ্টিকোণ, ১৯৯২ সালে প্রকাশিত হয় দ্বিতীয় প্রবন্ধের বই অতীত হয় নূতন পুনরায়, ১৯৯৭ সালের মে মাসে প্রকাশিত হয় তৃতীয় প্রবন্ধের বই মনের গহনে তোমার মুরতিখানি। লক্ষণীয় যে, রশীদ করীম পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগে আক্রান্ত হন ১৯৯২ সালে, আর তার শেষ প্রবন্ধ গ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৯৯৭ সালে। পরে অবশ্য ২০০৩ সালে প্রবন্ধের ৩টি বই এবং তার সঙ্গে আরো ৫টি অগ্রন্থিত লেখা যোগ করে প্রকাশিত হয় প্রবন্ধ সংগ্রহ। এখানে বলার লোভ সামলাতে পারছি না যে, এই ৫টি প্রবন্ধের মধ্যে একটি প্রবন্ধ ছিল আমার প্রথম প্রকাশিত ছোটগল্প গ্রন্থ কলকব্জার মানুষ নিয়ে- যেটি রশীদ করীম-এর সর্বশেষ লেখা। যা হোক, রশীদ করীম-এর অনুরক্ত গদ্য পাঠকদের জন্য সুসংবাদটি হলোÑ তার মৃত্যুর পর পুরনো পত্রপত্রিকা ঘেটে আবিষ্কার হয়েছে, বিচিত্রা, সন্ধানী, প্রতিশ্রুতি, দৈনিক বাংলা, দৈনিক সংবাদ, বাংলাবাজার পত্রিকা, বাংলার বাণীতে প্রকাশিত তার বেশ কিছু প্রবন্ধ গ্রন্থভুক্ত হয়নি। একটি অপ্রকাশিত গল্পও পাওয়া গিয়েছে, যেটি প্রকাশিত হয়েছিল রেডিওর ম্যাগাজিনে, গল্পটি রেডিওতেই পরিবেশিত হয়েছিল। অগ্রন্থিত এসব প্রবন্ধ নিবন্ধগুলো বিষয়বৈচিত্র্যে অনন্য। এখনো যেমন প্রাসঙ্গিক, ভবিষ্যতের জন্যও মূল্যবান হয়ে থাকবে। আমি কিছুটা পরিচয় তোলে না ধরে পারছি না। একটা সময় ছিল পশ্চিমবঙ্গ থেকে এদেশে কোনো বই আসতো না। কিছু কবিতার বই লুকিয়ে চুরিয়ে আসতো। আর যদি কেউ যেত, তার মাধ্যমে পাওয়া যেত গল্প, উপন্যাস বা অন্য কোনো বিষয়ের বই। ‘পশ্চিমবঙ্গের কয়েকটি গল্প-উপন্যাস প্রসঙ্গে’ শিরোনামভুক্ত প্রবন্ধটিতে শুধু যে কয়েকটি বই সম্পর্কেই জানা যাবে তা নয়, তখনকার পরিস্থিতিকেও বোঝা যাবে। ‘কবি-সাহিত্যিকের পুরস্কার’ প্রবন্ধটি যেন এই সময়কার নৈরাজ্যময় সময়েরই বর্ণনা। রয়েছে আবু সাইয়িদ আইয়ুব নিয়ে আরো কিছু কথা, হুমায়ুন কবিরের বাংলার কাব্য নিয়ে অসাধারণ এক মূল্যায়ণ। রশীদ করীম-এর পঠন পাঠনের ছিল বিস্তৃত অভিজ্ঞতা। বাংলা সাহিত্যের যেমন অভিনিবিষ্ট পাঠক ছিলেন, বিশ্ব সাহিত্যের কোথায় কী হচ্ছে তার প্রতিও ছিল গভীর নজরদারি। অগ্রন্থিত রচনাগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটি রচনায় নিজের সময়ে বিশ্বের আলোড়ন তোলা সাহিত্যিক বা তাদের যে সাহিত্যকর্মটি আলোচনার যোগ্য হয়ে উঠেছিলÑ রশীদ করীম বাংলা সাহিত্যের পাঠককে তা জানানোর দায় যেন নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। সমারসেট মম লেখকদের নোটবই সম্পর্কে কত গভীরভাবে কী আলোচনা করলেন, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে প্যারিস ভ্রমণ করতে গিয়ে কী অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হলো, দুনিয়া কাঁপানো ডি এইচ লরেন্সের লেডি চ্যাটার্লিজ লাভার কতটুকু অশ্লীলতাপূর্ণ কিংবা শিল্পমূল্য উত্তীর্ণ কিনা, নিজের বোধ ও চৈতন্য দিয়ে বিশ্লেষণ করেছেন। রশীদ করীম-এর প্রতিটি প্রবন্ধ গ্রন্থে যেমন বৈচিত্র্যপূর্ণ বিষয়ের সমাহার ঘটে, এই অগ্রন্থিত রশীদ করীমও তা থেকে ব্যতিক্রমী হবে না। বিশ্বসাহিত্যের মতো বৈশ্বিক রাজনীতি এবং কৌতূহল-উদ্দীপক ঘটনা নিয়ে তিনি এক একটি সরস রচনা উস্থাপন করেছেন। প্রায় ত্রিশটির মতো প্রবন্ধের প্রতিটিই আলাদা মেজাজ এবং মর্জি নিয়ে উপস্থিত। ক্রিকেটে নিশ্চিত হেরে যাওয়া একটা দল জিতে গেলে যেমন আনন্দ লাগে তার সমর্থকদের মনে, রশীদ করীম-এর অগ্রন্থিত রচনাও তেমনই এক হঠাৎ প্রাপ্তির আনন্দ বইয়ে দেবে তার অনুরক্ত পাঠককে- যে, এখনো কিছু অবশিষ্ট রয়েছে প্রিয় লেখকের যা এতদিন অনাবিষ্কৃত ছিল।
Report incorrect information